সাহিত্যের রথীমহারথীদের মধ্যে অনেকেরই কবিতা দিয়ে তাদের লেখালেখির সূত্রপাত করেন।আধুনিক মার্কিন সাহিত্য তথা বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম কথাসাহিত্যিক উইলিয়াম ফকনার (সেপ্টেম্বর ২৫, ১৮৯৭-জুলাই ৬, ১৯৬২) তার ব্যতিক্রম নন।কবি হিসাবে ফকনার সফল হতে পারেনি। তিনি এ বিষয়ে বলেছেন, ‘আমি একজন ব্যর্থ কবি। হয়তো প্রত্যেক ঔপন্যাসিকই প্রথমে কবিতা লিখতে চেষ্টা করেন, যখন দেখেন যে পারছেন না, ছোটগল্পে হাত দেন। ছোটগল্প কবিতার পরেই সবচেয়ে কঠিন শিল্প-মাধ্যম। তাতে ব্যর্থ হলে উপন্যাস লেখায় হাত দেন।’
উইলিয়াম ফকনারের নিজের জীবনেও এমনটাই ঘটেছিল।তাঁর সাহিত্যিক জীবনের শুরু কবিতা দিয়ে । বয়:সন্ধিক্ষণ থেকেই তিনি কবিতা পড়তে ও লিখতে শুরু করেন। প্রকৃতপক্ষে, তিনি মাত্র ১২ বছর বয়সে স্কটিশ ও ইংরেজি রোমান্টিক কবিতা বিশেষ করে রবাট্র্ বার্ণস, এ. ই. হাউসম্যান, এ.সি.সুইমবাণ কবিতার প্রতি অনুরক্ত হন। তাঁরপ ্রথম কবিতার বই ‘ভিশন ইন স্প্রিং’ ১৯২১ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯২৬ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস‘ সোলজারস পে’ প্রকাশিত হয়। ১৯২৭ সালে বের হয় দ্বিতীয় উপন্যাস ‘মসকুইটোস’ এবং ১৯২৯ সালে ‘সার্টোরিজ’ নামের তৃতীয় উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে তিনি তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস অ্যাবসালোম, অ্যাবসালোম! (১৯৩৬), এবং দি আনভ্যাংকুইশ্ড (১৯৩৮) রচনা করেন।
ফকনারের পূর্বপুরুষেরা ১৮শ শতকে স্কটল্যান্ড থেকে আমেরিকায় এসেছিলেন। প্রপিতামহ উইলিয়াম ক্লার্ক ফকনার ছিলেন তরুণ লেখক ফকনারের প্রেরণার উৎস। উইলিয়াম ক্লার্ক মার্কিন গৃহযুদ্ধের সময় একজন কর্নেল ছিলেন। তিনি রেলপথ নির্মাণ করেন এবং ১৮৮১ সালে একটি জনপ্রিয় রোমান্টিক উপন্যাস লেখেন যার নাম ছিল দ্য হোয়াইট রোজ অফ মেমফিস। এক ব্যবসায়ী অংশীদার তাঁকে রাস্তায় হত্যা করে। এই ঘটনাটি ফকনার তাঁর সাহিত্যে বিভিন্নভাবে পুনরাবৃত্ত করেছেন। ফকনার তাঁর ১৯২৯ সালে উপন্যাস সার্টোরিস-এর চরিত্র কর্নেল জন স্যান্টোরিসের মডেল হিসেবেও তাঁর প্রপিতামহকে ব্যবহার করেছেন।
উইলিয়াম ফকনার আধুনিকতা ধারার নিবেদিত আমেরিকান লেখক, ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানী হিসাবে বিশেষভাবে খ্যাত । তিনি আমেরিকার দক্ষিণের গ্রামাঞ্চলের তমস আধারের মাঝ থেকে অকৃত্রিম সৌন্দর্যকে তুলে ধরেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। ফকনার বলেন, ‘সোলজারস পে’র সময় মনে হয়েছিল লেখা মজার কাজ। পর বুঝলাম, শুধু গ্রন্থ বিশেষেরই নয় লেখকের গোটা সাহিত্যর্কীতিরই একটা রূপরেখা থাকা দরকার।‘ সোলজারস পে’ এবং ‘মসকুইটোস’ লেখা শুধু লেখার জন্যেই, কারণ ওদুটো বই লিখে মজা পেয়েছিলাম। ‘সাটোরিজ’এর শুরু টের পেলাম যে আমার নিজস্ব অঞ্চলের ডাকটিকেটও সাহিত্যের উপজীব্য হওয়ার যোগ্য এবং তার সবদিক নিয়ে শেষ পযন্ত লেখার দীর্ঘায়ু আমার হবে না এবং বাস্তবতাকে কল্পনায় উন্নীত করে নিজের প্রতিভাকে চূড়ান্তভাবে কাজে লাগানোর স্বাধীনতা পাবো। এতে আমার সামনে অন্য লোকদের স্বর্ণখনির দ্বার উন্মোচিত হলো। তাই নিজের বিশ্ব সৃষ্টি করে নিলাম। এই সব মানুষকে দেবতাদের মতো গতিবান করতে পারি , শুধু মহাশূন্যে নয়, সময়ের জগতে গতিবান করতে পেরেছি তার কারণ আমার নিজস্ব তত্ত্ব যে, সময় হলো তরল অবস্থা এবং ক্ষণিক ব্যক্তিগত অবতার ছাড়া তার অস্তিত্ব নেই। ‘ছিলো বলে, কিছু নেই — যা আছে তা হলো ‘ আছে’। ‘ছিল’ যদি থাকতো তাহলে কোন দু:বেদনা থাকতো না। আমার তৈরি বিশ্বকে আমি পৃথিবী শিরোবিন্দু বলে বিবেচনা করি। ছোটো সে শিরোবিন্দু, কিন্তু একে সরিয়ে নিলে গোটা বিশ্ব ধ্বসে যাবে। আমার শেষ গ্রন্থ ইয়কনাপাটাওফা অঞ্চলের সোনালী গ্রন্থ ‘ডুম্স ডে বুক’। তারপর কলম ভেঙে ফেলবো এবং আমাকে ক্ষান্ত হতে হবে।
তরুণ বয়সে ফকনার এস্টেল ওল্ডহ্যাম নামে এক তরুণীর সাথে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুললেও কিছু দিনের জন্যে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে। কারণ ফকনারের সঙ্গে তাঁদের মধ্যে মন দেওয় নেওয়া আগে কর্ণেল ফ্রাঙ্কলিন নামের একজন সামরিক অফিসারের পারিবারিক ভাবে সঙ্গে এস্টেল ওল্ডহ্যামের গাটছড়া বাঁধার কথা চলছিল। কর্ণেল ফ্রাঙ্কলিন হাইওয়ান টেরিটোরিজে মেজর পদে উন্নীত হওয়ায় এস্টেল আশা করলেন বাঁচা গেল, কিন্তু তার কয়েক মাস পরেই মেজর ফ্রাঙ্কলিন এস্টেলকে ইনগেজমেন্ট রিং পাঠিয়ে দিলেন। এস্টেলের পিতামাতা একে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখলেন এটা ভেবে যে ফ্রাঙ্কলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী ও মর্যাদাপূর্ণ পদের অধিকার, তাদের মেয়ে এস্টেল ওল্ডহ্যামের বিয়ে হয়ে গেল।
এস্টেলের ইনগেজমেন্ট হওয়ার পর ফকনার তাঁর পুরনোর বন্ধু কবিতার অনুরাগী ফিল স্টোন নামে স্থানীয় একজন এ্যাটোর্নীর সাথে সম্পৃক্ত হন। স্টোন তাঁর সঙ্গে কবি জন কিটস, শেরউড এ্যান্ডারসনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাঁকে তাদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ করে দিলেন। এস্টেল ওল্ডহ্যাম তার প্রথম স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে ১৯২৯ সালের কয়েক মাস পরে ফকনার কে বিয়ে করেন।
তার আগ থেকেই ফকনার তাঁর নিজের দেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ছয় মাসের জন্য ইউরোপ ভ্রমণ করেন। সেটা ছিল ১৯২৫ সালের দিকের কথা। ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্টে ফিরে তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন।
১৯৩০ ও ১৯৪০ এর দশকের শুরুর দিকে ফকনার চিত্রনাট্যলেখক হিসেবে হলিউড যান। বহুমুখী প্রতিভরি অধিকারী উইলিয়াম ফকনার চিত্রনাট্যের সফল লেখক হিসেবে হলিউডের শ্রেষ্ট পরিচালক হামফ্রে বোগাট্রের সাথে কাজে করেন। ফকনার একদা বলেছিলেন ,‘ তিনি এবং আমি‘ট্রু হ্যাভ এ্যান্ড হ্যাভ নট এবং দ্য বিগ স্লীপের সঙ্গে কাজ করেছিলাম।
জীবনের বাকী সময় তিনি অক্সফোর্ডেই গল্প ও উপন্যাস লিখে কাটিয়ে দেন। উইলিয়াম ফকনার তাঁর সাহিত্য কর্মের জন্যে ১৯৪৯ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর লেখা ‘দি সাউন্ড অ্যান্ড দি ফিউরি’ (১৯২৯), ‘অ্যাজ আই লে ডাইং’ (১৯৩০) এবং ‘লাইট ইন অগাস্ট’ (১৯৩২) এ তিনটি ক্লসিকধর্মী আমেরিকান উপন্যাসের জন্য মূলত তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।এ উপন্যাস তিনটি বিংশ শতাব্দীর মর্ডান লাইব্রেরীর তালিকার একশত ইংরেজি ভাষার সর্বোত্তম উপন্যাসের অন্তভুক্ত হয়।
‘দি সাউন্ড অ্যান্ড দি ফিউরি’ (১৯২৯) উপন্যাস শ্রষ্টা ফকনার বলেন — ‘উপন্যাসটি পাঁচ পাঁচবার লিখি। এ না হলে স্বপ্ন আমার বেদনা দিতো। এটা হলো দুই দু:স্থ রমণীর ট্রেজেডি: ক্যাডি ও তার মেয়ের কাহিনী। ডিলসে হলো আমার প্রিয় চরিত্র কারণ সে সাহসী, দয়ালু অমায়িক এবং সৎ। সে আমার চেয়ে অনেক বেশি সাহসী, সৎ ও দয়লু। উইলিয়াম ফকনার নিজেই তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘দি সাউন্ড অ্যান্ড দি ফিউরি ‘ লিখেন সে বিষয়ে বলেন, ‘লিখতে শুরু করি একটি মানসিক চিত্রের মাঝ দিয়ে, তখন বুঝিনি যে এটা প্রতীকী। ’
ফকনার ‘দি সাউন্ড অ্যান্ড দি ফিউরি ‘উপন্যাসটি লিখবার কাহিনী শুনিয়েছেন তাঁর নিজের কথায়। তিনি বলেন, ‘একটা আপেল গাছের নিচে একটি মেয়ে কর্দমাক্ত আসনে বসে জানালা দিয়ে তার দাদিমার অন্তেষ্টিক্রিয়ার দৃশ্য দেখে নিচের মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা ভাইয়ের কাছে তার বর্ণনা দিতে থাকে। ওরা কারা, কি করছে ওরা, মেয়েটির আসন কর্দমাক্ত হলো কি করে, এর বর্ণনা দেয়ার পর বুঝতে পারলাম যে ছোটগল্পে সব কিছুকে তুলে ধরা সম্ভব নয়। জন্য দরকার বইয়ের আয়তন এবং এরপর কাদা লাগা প্যান্টের প্রতীক বুঝাতে পারলাম এবং এ ছবিটির বদলে পিতৃমাতৃহীনা সেই মেয়েটির ছবি তুলে ধরলাম যে মেয়েটি বৃষ্টির পানি নামার পাইপ বেয়ে পালিয়ে যাচ্ছে তার একমাত্র আশ্রয় থেকে যেখানে কোনদিন সে পায়নি ভালোবাসা অথবা স্নেহ। একটি নির্বোধ শিশুর চোখ দিয়ে কাহিনীটি আমি বলতে শুরু করেছিলাম। কেননা, আমার মনে হয়েছিল তার আবেদন বেশি হবে, কারণ গল্প বলছে এমন একজন যে ঘটনা দেখছে শুধু ,অথচ সে কারণ জানে না। দেখলাম, গল্পটি তখনো বলা হয়নি। আবার বলার চেষ্টা করলাম, একই গল্প, আরেক ভাইয়ের চোখ দিয়ে। তবু বলা হলো না। খন্ডগুলো জোড়া দিয়ে নিজেকে মুখপাত্র করে ফাঁকগুলো পূরণ করতে প্রয়াসী হলাম। তবুও তা পূর্ণতা পেল না। এটি প্রকাশের পনেরো বছর পর অন্য একটি বইয়ের সংযোজন হিসেবে আমি গল্পটি লেখার চূড়ান্ত প্রয়াস পেলাম। এবং মন থেকে তা ঝেড়ে ফেললাম যাতে করে কিছুটা শান্তি পেতে পারি। এ বইটটির ব্যাপারে আমার অনুভূতি কোমল। একে ছাড়তেও পারিনি, সঠিকভাবে লিখতেও পারিনি বারবার চেষ্টা সত্ত্বেও। আবার চেষ্টা করতে ইচ্ছা হয়, মনে ভয় হয় যদি আবার অসফল হই।’
উইলিয়াম ফকনার এমনই একজন কথাসাহিত্যিক যিনি এক একটা উপন্যাস লিখতে ঘটনা, শব্দ, বাক্যবিন্যাস করেছেন একের পর এক পরীক্ষানিরীক্ষা মাধ্যমে।
তিনি তাঁর ‘দি ওয়াইল্ড পাম্পস’ হলো শার্লোট রিটেসমেয়ার ও হ্যারি উেইলবোর্ণের কাহিনী। এরা প্রেমের কারণে সব বিসর্জন দিয়ে এক সময় সব হারিয়ে ফেলে। ফকনার তাঁর চিন্তা চেতনা, মেধা মননের মাধ্যমে দুটো কাহিনীকে ‘দি ওয়াইল্ড পাম্পস’ উপন্যাসে তুলে ধরেছেন ঋদ্ধতার সাথে।
প্রচুর পড়াশোনা সত্ত্বেও ফকনার হাইস্কুল শেষ করতে ব্যর্থ হন। ১৯১৮ সালে ফকনার শিক্ষানবিশ বৈমানিক হিসাবে রাজকীয় বিমান বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হন। এক বছর পরে তিনি রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় ‘ওল ফিস’ এ ভর্তি হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট অফিসে পোস্টমাস্টার হিসেবে কাজ করতে থাকেন। ছাত্রাবস্থায় চাকুরী করার কারণে তিনি এক সময় চাকুরী থেকে বরখাস্ত হন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সনদ না পেয়েও ফকনার কাজ করেছেন নানা জায়গায়। তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘যা কিছু কাজ পেতাম সব কাজেই কিছু করতে পারতাম। নৌকা চালানো, বাড়ি রং করা, উড়োজাহাজ চালানো। খুব বেশি টাকার দরকার ছিল না। নিউ অলির্ন্সে জীবন ধারণের খরচ খুব কম ছিল তখন। আর আমার প্রয়োজন ছিল ঘুমানোর জায়গা, সামান্য কিছু খাদ্য, তামাক আর হুইস্কি। দু’তিন দিন কাজ করে সারা মাসচালিয়ে নেওয়ার মতো অর্থ উপার্জন করার মতো অনেক কাজ ছিল। মনের দিক থেকে আমি ভবঘুরে। কাজ করে টাকা রোজগার করার মতো দুরবস্থা আমার ছিল না। আমার ধারণায় লজ্জার ব্যাপার হলো যে পৃথিবীতে এতো কাজ আছে। দু:খের বিষয় দিনের পর দিন আট ঘন্টা করে মানুষ যা করতে পারে তা হলো কাজ। দিনে আট ঘন্টা আপনি খেতে পারেন না, প্রেম করতে পারেন না। আট ঘন্টা ধরে যা করতে পারেন তা হলো কাজ। মানুষ যে নিজেকে এবং অন্যকে এতটা অসুখী করে, এটাই হলো তার কারণ। সেনাবাহিনীতে সৈনিক,বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে কেরানি, বাড়ি তৈরির কাজে লিপ্ত থেকেও উইলিয়াম ফকনার আমেরিকার ইংরেজি সাহিত্যে নতুন একট মাত্র দান করতে সক্ষম হন।
তারপর তিনি শেরউড এ্যান্ডারসন এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ‘সোলজার’স পে’ (১৯২৬) লেখেন।তিনি শেরউড এ্যান্ডারসনকে মূল্যায়ন করতে দ্বিধা করেননি। তিনি বলেন,‘শেরউড এ্যান্ডারসন আমার কালের মার্কিন লেখকদের এবং আমাদের উত্তসূরীদের মার্কিন সাহিত্য ধারার ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে বিবেচিত, তিনি মার্কিন সাহিত্যের জনক হলেও সত্যিকার ভাবে তাঁর মূল্যায়ন কখনো হয়নি, ড্রেইজার তাঁর বড় ভাই আর মার্ক টয়েন হলেন তাঁদের দু’জনের জনক।’ ফকনারের লেখক হয়ে উঠার পেছনে শেরউড এ্যান্ডারসনের অবদানের কথা কৃতজ্ঞ চিত্তে এভাবে স্বীকার করেন।
‘নিউ অর্লিন্সে তখন থাকি আর সামান্য কিছু অর্থ উপার্জনের জন্যে এখানে ওখানে টুকটাক কাজ করতাম।শেরউড এ্যান্ডারসনের সঙ্গে পরিচয় হলো। বিকেলে আমরা শহরময় ঘুরে বেড়াতাম আর লোকজনের সঙ্গে কথা বলতাম।সন্ধ্যার আবার দেখা হতো এবং আমরা এেক জায়গায় বসতাম। তিনি বলতেন, আমি শুনতাম। দুপুরে কখনো তাঁর সঙ্গে দেখা করতাম, তখন তিনি নিরিবিলিতে লিখতেন। পরের দিকে একই কাজ করতাম। ভাবলাম, এই যদি লেখকের জীবন হয় তাহলে লেখক হওয়াই আমার কাজ। আমার প্রথম বই লিখতে শুরু করলাম। সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম, লেখাটা মজার কাজ এমন কি ভুলে গেলাম যে তিন সপ্তাহ মি. এন্ডারসনের সঙ্গে আমার দেখাই হয়নি।অবশেষে একদিন তিনি আমার ঘরে এলেন, সেই তাঁর প্রথম আসা। বললেন, ‘ব্যাপার কি? তুমি কি আমার উপর ক্ষেপে আছ?’ বললাম, যে আমি বই লিখছি। তিনি ‘হাঁ ঈশ্বর’ বলে গেলেন। ‘সোলজারস পেবইটি লেখা শেষ হলে রাস্তায় মিসেস এন্ডারসনের সঙ্গে দেখা। ‘লেখা কেমন চলছে, কেমন চলছে,’ তিনি জিজ্ঞেস করলেন। বললাম লেখা শেষ । তিনি বললেন, ‘শেরউড বলেছে যে, সে তোমার সঙ্গে রফা করবে। তোমার পান্ডুলিপি না পড়েই সে তার প্রকাশককে বলবে তা গ্রহণ করতে। বললাম, ‘তথাস্তু ’। এভাবেই লেখক বনে গেলাম।
লেখকের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রয়োজন আছে কিনা সে সম্পর্কে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন যে লেখকের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রয়োজন নেই। তাঁর যা দরকার, তা হলো কলম আর কিছু কাগজ। ফকনার বলেন যে অর্থ দান হিসেবে গ্রহণ করার পর ভালো কিছু লেখা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। ভালো লেখক কখনো কোন ফাউন্ডেশনের কাছে আর্জি পেশ করেন না।লেথা নিয়েই তিনি ব্যস্ত থাকেন।
ফকনারের এ বক্তব্য থেকে একজন ভাল লেখকের বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। এ সম্বন্ধে তাঁর আরো কথা এখানে তুলে ধরা অপ্রসঙ্গিক হবে না। তিনি বলেন, ভাল মানের লেখক না হওয়ার কারণেই এক শ্রেণীর লেখক সময় ও আর্থিক স্বাধীনতার অভাবের দোহাই দিয়ে সে নিজেকেই বোকা বানান।
তিনি আমেরিকান সাহিত্যে ঋদ্ধতার উজ্বল স্বাক্ষর রেখে সাহিত্যে সর্বোচ্চ পুরস্কার লাভ করেন। ফকনার মোট ১৯টি উপন্যাস ও বহু ছোট গল্প লেখেন। তাঁর বেশ কিছু কাব্যগ্রন্থও আছে। তাঁর লেখা উপন্যাসগুলো হল — মসকুইটোস (১৯২৭), স্টোরিজ/ফ্লাগস ই দি ডাস্ট (১৯২৭/১৯৭৩), দি সাউন্ড অ্যান্ড দি ফিউরি (১৯২৯), অ্যাজ আই লে ডাইং (১৯৩০), স্যাঙ্কচুরি (১৯৩১), লাইট ইন অগাস্ট (১৯৩২), পাইলন (১৯৩৫), অ্যাবসালোম, অ্যাবসালোম! (১৯৩৬), দি আনভ্যানকুইড (১৯৩৮), দি ওয়াইল্ড পাম্পস (১৯৩৯), দ্য হেমলেট (১৯৪০), গো ডাউন, মোসেস (১৯৪২), ইনট্রুডার ইন দি ডাস্ট (১৯৪৮), রিকুইয়েম ফর এ নান (১৯৫১),এ কেবল (১৯৫৪), দি টাউন (১৯৫৭), দ্য ম্যানসন (১৯৫৯), দ্য রেইভারস (১৯৬২)। এগুলোর মধ্যে বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালের উল্লেখযোগ্য রচনা হলো ‘ইনট্রু ইন দি ডাস্ট্’ (১৯৪৮) ,এ ফেবল (১৯৫৪), দি টাউন ( ১৯৫৭) ইত্যাদি
ফকনার অসংখ্য ছোট গল্প রচনা করেন। তাঁর লেখা গল্পগুলোর মাঝ থেকে বেশ কিছু গল্পের নাম এখানে করা যেতে পারে। ল্যন্ডিং ইন লাক, মিররস অফ চার্টস, ডাইমন্ড এন্ড পাইথিয়ানস আনলিমিটেড, আউট অফ নাজারেথ, দ্য কিংডম অফ গড, দ্য কিড লার্নাস, কান্ট্রি মাউস, জো হো এন্ড টুবটলস অফ রাম, এ রোজ ফর এমিটি, রেড লিভস, ড্রাই সেপ্টেম্বর, ইভিনিং সান, স্পটেড হর্স, ডিভোর্স ইন নাপেলস, ‘অল দি ডেড পাইলট, এ ডাস্টিস, ডক্টর মার্টিনো, মিস জিলফিয়া গ্রান্ট, ডেথ ড্রাগ, মাউন্টিন ভিক্টরি, দেয়ার ওয়াজ এ কুইন, আর্টিস্ট অ্যাট হোম, ইলি, পেনসিলিভেয়ান স্টেশন, এ বিয়ান হান্ট, গোল্ডেন ল্যান্ড, দ্যাট উইল বিল বি ফাইন, আঙ্কেল উইলি, দ্য ব্রোচ, টু ডলার ওয়াইফ, দ্য টল ম্যান, টু সোলজার ইত্যাদি। তাঁর লেখা কাব্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দ্য মার্বেল ফন, দ্য আর্থ, এ পোয়েম, মিসিপি পেয়েমস, হেলেন, এ কোর্টসিপ এন্ড পোয়েমস ইত্যাদি। লাজুক ও আরাম প্রিয় হলেও ফকনার ইউনাইটেড স্টেটস আনফরমেশন সার্ভিসের হয়ে পৃথিবীর নানা দেশ সফর করেন এবং নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বক্তৃতা দেন। ১৯৫৬ সালের দিকে তিনি নিউইয়ক নগরীতে এক আলোচনা চক্রে লেখালেখি প্রসঙ্গে নানা প্রশ্নের জবাব দেন।
লেখক হিসেবে আপনার নিজের সম্বন্ধে কী ধারণা? তাঁর জবাবে ফকনার বলেন, ‘আমি না জন্মালে অন্য কেউ আমার হয়ে লিখতেন, হেমিংওয়ে, ডস্টয়েভস্কি এবং আমাদের সকলের। প্রমাণ, শেকসপিয়ারের নাটকগুলোর লেখক হিসাবে তিনজন দাবিদার। কিন্তু যা মূল্যবান তা হলো ‘ হ্যামলেট’ এবং ‘মিড সামার নাইট’স ড্রিম’ কে লিখেছেন তা নয়, বরং কেউ একজন তো লিখেছেন। শিল্পীর কোন মূল্য নেই। তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তাই মূল্যবান, যেহেতু নতুন কিছু বলার নেই। শেকসপিয়ার, বালজাক, হোমার সবাই প্রায় একই জিনিস নিয়ে লিখেছেন এবং যদি এক হাজার কি দু’হাজার বছর বেশি বাঁতেন তাহলে আর কারো প্রকাশদের দরকার হতো না।
১৯৪৯ সালের সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী উইলিয়াম ফকনার ১৯৫০ সালের ১০ ডিসেম্বর স্টকহোমের সিটি হলে নোবেল প্রাইজ স্পিচে তিনি সাহিত্য কর্মের উপর গুরত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, ‘ আমি মনে করি এ পুরস্কার একজন মানুষ হিসেবে আমাকে দেওয়া হয়নি , দেওয়া হয়েছে আমার কাজকে। — আজকের দিনে তরুণ তরুণীরা তাদের লেখায় লিখতে ভুলে গেছে মানব মনের যন্ত্রণা। দু:খ যন্ত্রণার করুণ কাহিনী তারা তাদের লেখায় অবলীলাক্রমে তুলে ধরতে পারেন। তিনি উক্ত ভাষণে তাঁর সাহিত্যকর্মের দিকদর্শন তুলে ধরতে সচেষ্ট হন, যা বিশ্বসাহিত্যের যুগান্তকারী দলিল হিসাবে বিবেচিত।
ফকনারের স্বাস্থ্য দুর্বল হতে থাকে এবং বেশ কয়েকবার ঘোডা থেকে পড়ে গিয়ে অনেকগুলি আঘাত পান। এমনই এক আঘাতের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হবার পর হার্ট অ্যাটাকে ১৯৬২ সালের ৬ জুলাই তিনি মারা যান। তিনি লোকান্তরিত হলেও তাঁর অমর সৃষ্টি তাঁকে বিশ্ব সাহিত্যঙ্গনে চিরভাস্বর করে রাখবে।
মনোজিৎকুমার দাস, প্রাবন্ধিক, লাঙ্গলবাঁধ, মাগুরা।