ভাই দর্পনারায়ণ ওরফে মুকুন্দরামের সঙ্গে কলহবিবাদ ও মনোমালিন্যের জেরে পাথুরিয়াঘাটার বাড়ি ছেড়েছিলেন নীলমণি ঠাকুর। সন ১৭৮৪ নাগাদ। কেউ বলেন, গলায় পৈতৃক লক্ষ্মীজনার্দন ঠাকুর ঝুলিয়ে, স্ত্রী-পরিবার (স্ত্রী ললিতা, পুত্র রামলোচন, রামমণি, রামবল্লভ) নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন নীলমণি ঠাকুর। কপর্দকশূন্য হয়ে, শুধু আত্মাভিমান আর গৃহদেবতা, এই দুই সম্পদ সঙ্গে নিয়ে। কেউ নাকি তাঁকে ফটক পর্যন্তও এগিয়ে দিতে আসেনি। তিনি নাকি চিৎপুরের পাথুরিয়াঘাটার বাড়ি থেকে এগিয়ে চলেছিলেন মেছুয়ার দিকে। এক বিরাট পুকুর, মস্ত তেঁতুল গাছ সাক্ষী ছিল সেই অনিশ্চিত যাত্রার।
বেরিয়ে তো পড়লেন, যাবেন কোথায়? কার ভদ্রাসনে উঠবেন, ঠিক করতে পারছেন না। তখনই তাঁর মনে পড়ল, মেছুয়ার বৈষ্ণবচরণ শেঠদের বাড়ি এই সময় কবিগানের আসর বসে। পারিবারিক ট্র্যাডিশন অনুসারে তাঁর কবির লড়াইয়ে ভালোই ব্যুৎপত্তি ছিল। বাবা জয়রামও নদিয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছ থেকে কবির দল ধনসায়রে নিয়ে এসেছিলেন একবার। নিজেও নেমেছিলেন কবির লড়াইয়ে। নির্মাণকার্য করার সময়ে যে কষ্টিপাথরের মূর্তি তিনি পেয়েছিলেন, তার বদলে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি গড়ে দিয়েছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। কে না জানে কবির লড়াইয়ের একটি প্রধান অংশ রাধাকৃষ্ণের গীত।
নীলমণির কবির লড়াইয়ে সন্তুষ্ট হয়ে বৈষ্ণবচরণ শেঠ নীলমণিকে বিপুলপরিমাণ অর্থ দিয়ে সাহায্য করতে চাইলেন। নীলমণি রাজি হলেন না, ব্রাহ্মণ সন্তান তিনি, কী করে নেন এই দান! তখন বৈষ্ণবচরণ তাঁর গৃহদেবতা লক্ষ্মীজনার্দনকে দান করলেন মেছুয়াবাজারের জমি। তখন অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে সেই জমির উপর আটচালা বানিয়ে থাকতে শুরু করলেন নীলমণি ঠাকুর। যেন রাজ্য হারানো, বিতাড়িত এক রাজা। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন সেরেস্তাদার-কবিয়াল নীলমণি ঠাকুর।
ঠাকুরবাড়ির প্রায় প্রতি সদস্যের নিয়তি ছিল মানসিক দ্বন্দ্ব। সমাজের সঙ্গে, চিরাচরিত প্রথার সঙ্গে লড়াই করতে করতে একটা নীতিই হয়তো জপমন্ত্র হয়ে গিয়েছিল তাঁদের, যোগত্যমের উদ্বর্তন! যে সময়কার কথা বলছি, তখনো জোব চার্নক কলকাতা নগরীর পত্তন করেননি। খুলনার পিঠাভোগ থেকে নৌপথে গোবিন্দপুরের কৈবর্ত্যপাড়ায় এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন রবিঠাকুরের পূর্বপুরুষ পঞ্চানন কুশারী। সমাজের রক্তচক্ষু তাঁদের পিরালি করেছে। তবু দূরে এসে বসতি তৈরি করে নিজেদের মজ্জাগত কবিগানের দৌলতে তাঁরা হলেন জেলেদের ‘ঠাকুর মশাই’ আর প্রায় সদ্য আসা ইংরেজদের ‘ট্যাগোর’। জীবনযুদ্ধের তাড়নায় পদবির উচ্চারণ পরিবর্তনের দিকেও ঝোঁক ছিল না তাঁদের। অস্তিত্বের লড়াই করতে করতে সমাজে নিজেদের বেশ প্রতিষ্ঠিত করে ফেললেন কুশারীদের উত্তরপুরুষরাও।
এমনই একজন হলেন পঞ্চাননপুত্র জয়রাম। তাঁর চার ছেলে ও এক মেয়ে — আনন্দীরাম, নীলমণিরাম, মুকুন্দরাম, গোবিন্দরাম এবং সিদ্ধেশ্বরী। জয়রাম হঠাৎ করেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নেকনজরে পড়ে গেলেন। গোবিন্দপুরের মাটি খুঁড়ে একজোড়া কালো কষ্টিপাথর পেয়েছিলেন জয়রাম। স্বপ্নাদেশ পেলেন বিগ্রহ তৈরির। অথচ পিরালি ব্রাহ্মণ হওয়ায় দেবসেবায় প্রত্যক্ষ উদ্যোগ নিতে অপারগ ছিলেন। এগিয়ে এলেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র। তৈরি করানো হলো রাধা ও কৃষ্ণ মূর্তি। কৃষ্ণচন্দ্র দেবোত্তর করে দিলেন কিছু সম্পত্তি। জয়রামের জয়যাত্রা শুরু হল। কিন্তু বড়ো ছেলে আনন্দীরামের অকাল মৃত্যু, ইংরেজদের তহবিলে রাখা গচ্ছিত অস্থাবর সম্পত্তির নয়ছয় জয়রামকে দিশেহারা করে দিয়েছিল। ছেলেদের মধ্যে একমাত্র নীলমণির কাছে এই কথাগুলি বলেছিলেন জয়রাম। তারপরেই মৃত্যু হয় জয়রামের।
পলাশির যুদ্ধের পর নীলমণি নিজেদের পুরোনো সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করেন। শুরু হয় ঠাকুরবাড়ির নতুন অধ্যায়। নীলমণি ঠাকুর ছিলেন অত্যন্ত পরিশ্রমী এবং দায়িত্বশীল। গোবিন্দপুরে প্রতিষ্ঠিত শিববিগ্রহকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন উত্তর কলকাতার শিবতলায়। তারপর পাথুরিয়াঘাটায় বাড়ি তৈরি করে সকলকে নিরাপদে রেখে নিজে কাজের জন্য চলে গিয়েছিলেন অনেকদূরে, উড়িষ্যামুলুকে। নীলমণির ভাই মুকুন্দরাম নতুন নাম নিলেন,- দর্পনারায়ণ। শুরু করলেন তেজারতির ব্যবসা। অর্থ আসতে শুরু করলো দর্পনারায়ণেরও। নীলমণি স্নেহশীল ছিলেন ভাইদের প্রতি। নিজের কঠোর পরিশ্রমে উপার্জিত অর্থ তিনি দর্পনারায়ণকে দিতেন ব্যবসায় লগ্নি করে বৃদ্ধি করার অভিপ্রায়ে।কর্মক্ষেত্র উড়িষ্যা থেকে কলকাতা আসা যাওয়ার পর্বে অনেক কাজ করেছিলেন নীলমণি। যেমন বর্গভীমার মন্দির সংস্কার, ঘাট বাঁধানো, ভাইয়ের মেয়েদের সুপাত্রে দান,পারিবারিক দায় দায়িত্ব পালন ইত্যাদি। তাঁর ছোটো ভাই গোবিন্দরামকে তিনিই নিযুক্ত করেছিলেন ফোর্ট উইলিয়মের নির্মাণ কাজে। দায়িত্ব ও কর্তব্য বিষয়ে নীলমণি ছিলেন আপসহীন যোদ্ধা। সে দেবসেবা হোক বা পরিবার প্রতিপালন।
কিন্তু নিশ্চিন্ত জীবনে ঝড় আসাটাই ভবিতব্য। ঠাকুরবাড়িতেও এলো। গোবিন্দরাম হঠাৎ করে মারা গেলেন। তাঁর স্ত্রী রামপ্রিয়া এবং আনন্দীরামের ছেলে রামতনু একজোট হয়ে দর্পনারায়ণ আর নীলমণির বিরুদ্ধে মামলা করেন। সেই সমস্যার সমাধান করেছিলেন নীলমণি যথেষ্ট দায়িত্বসহকারে। কিন্তু এইবার আঘাত এল দর্পনারায়ণ তথা মুকুন্দরামের থেকে। নীলমণির বহুবছর ধরে লগ্নি করা অর্থের লভ্যাংশ ফিরত দিতে অস্বীকার করলেন দর্পনারায়ণ। যুক্তি হিসেবে বললেন প্রবাসী নীলমণির পরিবারকে নিজের তত্ত্বাবধানে রেখে প্রতিপালনের কথা। এই অপমান সহ্য করতে পারলেন না নীলমণি। দর্পনারায়ণ দেবতাকে সাক্ষী করে যখন অর্থের প্রসঙ্গ অস্বীকার করলেন দর্পনারায়ণ তখন সব অর্থ, বৈভব, স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে পথে নামলেন। সঙ্গে শুধু শালগ্রামশিলা। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পরে এই প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমার প্রপিতামহ নীলমণি ঠাকুর, তিনি তাঁর ভ্রাতা দর্পনারায়ণের সহিত কলহ করিয়া এই স্থানে (জোড়াসাঁকো) আমাদের ভদ্রাসন স্থাপিত করলেন। দেবেন্দ্রনাথ যে ঘটনাকে ‘কলহ’ বলেছিলেন তার আড়ালে চূড়ান্ত অভিমান খুঁজে পেয়েছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনীকার ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি লিখেছিলেন, ‘যৌথ পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ, অর্থোপার্জনের জন্যে পারিবারিক প্রতিবেশ থেকে অনেক দূরে প্রায় অজ্ঞাতবাসের কৃচ্ছ্রসাধনার পরে প্রৌঢ়ত্বে উপনীত হয়ে তিনি যখন একমাত্র জীবিত সহোদরের মুখে এই নিদারুণ কথা শুনলেন তখন বিষয়সম্পত্তির উপরে তাঁর সাময়িক বিতৃষ্ণা এসে গেল।’ নীলমণির মেয়ে কমলমণির স্মৃতিচারণায় জানা যায় নীলমণির মাটি খুঁড়ে পঞ্চাশহাজার সোনা পাওয়ার কথা। সেই সোনা নিজের মেয়ের জন্য রাখবেন বলেছিলেন বলে দর্পনারায়ণ নাকি নিদারুণ ক্ষিপ্ত হয়ে সমস্ত কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। যে কারণেই হোক দুইভাইয়ের মধ্যে অনর্থের মূলে ছিল অর্থ ও সম্পত্তি। কথায় আছে অর্থই অনর্থের মূল। এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। দর্পনারায়ণ হঠাৎ করেই যেন কলকাতা শহরের আট বাবুদের এক বাবু হয়ে ওঠেন। ভুঁইফোড়ের মতো। এটি এক সম্মানজনক উপাধি ছিল। অনেক বছরের পরিশ্রমেও নীলমণি তা অর্জন করতে পারেননি। তাই দেখে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি জয়রামের উত্তরাধিকারী হিসেবে সনদ দেওয়ার জন্য নীলমণিকে নয়, দর্পনারায়ণকেই বেছে নিল। তাঁর তালতলার বাজার এলাকাকে করশূন্য এলাকা বলে ঘোষণাও করে দেওয়া হয়। এর সঙ্গে ছিল দর্পনারায়ণের অহঙ্কার! দুইভাইয়ের মধ্যে অহংয়ের লড়াই শুরু হয়েছিল বলেই মনে হয়।
কিন্তু নীলমণির পারিবারিক কলহ দেখানো নয়, আমাদের বক্তব্যের মূল প্রতিপাদ্য অন্য! নীলমণি একটা জীবনের সমস্ত সঞ্চয় হেলায় ছেড়ে এসে মধ্যবয়সে একটা নতুন সূচনা করলেন জীবনের। হতাশা নয়, দৈন্য নয়! কবির লড়াইয়ে নেমে নতুন এক দৃষ্টান্ত তৈরি করে ফেললেন। এইখানেই নীলমণি স্বতন্ত্র! কবিগানের দৌলতে বৈষ্ণবচরণ শেঠের সাহায্য এল লক্ষ্মী জনার্দনের আশীর্বাদের মতো। মাথা গোঁজার মতো ঘর তুলে ফেললেন। বর্তমান জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির উত্তরপূর্ব কোণে চালাঘরটি থাকার জন্য নির্মাণ করেছিলেন নীলমণি। এই সেই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি, যা বাঙালির সাংস্কৃতিক পীঠস্থান হয়ে উঠল একটা সময়। এরপর অনেক নিন্দার ঝড় উপেক্ষা করে নীলমণি ফিরে যান কটকে, অর্থ উপার্জনের জন্যে। সে কাজে রীতিমতো সফলও হন। এর মধ্যে দর্পনারায়ণ বেশি সম্পত্তি অধিকার করে নীলমণিকে দিয়েছিলেন এক লক্ষ টাকা। নীলমণি পাথুরিয়াঘাটার গৃহদেবতা রাধাকান্ত জিউর সেবার জন্য উল্টে অর্থ দান করেন। ভাইয়ের সঙ্গে বিবাদ দূর করলেও আর একাত্ম হতে পারলেন না। মানসিক কষ্টটা রয়েই গিয়েছিল। বিপুল ধনসম্পদ ছেড়ে এসে খড়ের বাড়ি, গোলপাতার ছাউনি দেওয়া বাসভূমিকে কীভাবে ঠাকুরবাড়ি করে তুললেন, সেইটি দেখার মতো। কপর্দকহীন অবস্থা থেকে আবার শুরু করে ফের লক্ষ্যে পৌঁছনোর এ এক রূপকথার মতো ঘটনা। এক নিষ্ঠাবান সদাচারী ব্রাহ্মণের আত্মমর্যাদাবোধ, কোম্পানির নিশ্চিন্ত চাকরি সত্ত্বেও কবিগানকে নয়নের মণি করে রাখা, সুযোগ পেলেই কবির লড়াইয়ে নামা, তাঁর সারাজীবনের অর্জিত মর্যাদাবোধ ও সাঙ্গীতিক প্রতিভা ঠাকুরবাড়ির পরবর্তী প্রজন্মের অন্তরের শক্তি হয়ে, আশীর্বাদ হয়ে রয়ে গেল। নীলমণি ঠাকুর তাই আমাদের কাছে এক উজ্জ্বল আলোর দিশারী।
কভারের ছবি মেছুয়া ১৮২৬