‘ঠেকুয়া খাওগে?’ প্রতিবেশিনীর এই প্রশ্নের উত্তরে ঠিক কি বলব বা বলা উচিত বুঝতে পারছিলাম না। ঠাকুরের প্রসাদ। আমি সংশয়ী। নাস্তিক নই একেবারেই। ‘ঠাকুরের’ কথা মানতে গেলে, হয় পুরো বিশ্বাসী হও, নয় নাস্তিক হওয়া মঙ্গল। কারণ মাঝামাঝি কিছু হয় না। সমস্ত ব্যাপারেই দৃঢ় হওয়া ঠাকুর পছন্দ করতেন। তাই নরম মিনমিনে হলে মুখের উপর বলতেন ‘ম্যাদামারা’। তাই বেছে নেওয়া নরেন্দ্রনাথ দত্তকে। দৃঢ়চেতা, সবল একজন মানুষ। তা আমি মিনমিনে একেবারেই নই, বরং বেশ জোরের সঙ্গেই কথা বলতে পারি। কিন্তু ঐ… সংশয় পিছু ছাড়ে না। আসলে ঠেকুয়ার পূর্ব স্মৃতি আমার খুব একটা মনোরম নয়। পুরোটা বলি। তখন আশেপাশে এত অবাঙালির নামগন্ধ ছিল না। পাড়ার মধ্যে সবাই বাঙালি। অবাঙালির পাড়া একটা ছিল বটে আধ কিলোমিটার দূরে। স্কুল যেতে আসতে তাদের বাজার করতে দেখা মিলত। ডানদিকে আঁচল, এক হাত কাঁচের চুড়ি আর একটু মেটে বা কমলা সিঁদুর। ব্যস। ঐটুকুই। এর বেশি ওদের সম্পর্কে জানতে আগ্রহী ছিলাম না সেই বয়সে। জানার দরকারও ছিল না। কারণ গায়ে গায়ে বাস তো ছিল না। ওরা তখন আমাদের প্রতিবেশী হয়ে ওঠেনি। তাই ওদের মহল্লা আলাদা, একেবারেই আলাদা।
সেই স্কুলের দিনে এক বন্ধুর হাত ধরে টিফিন বাক্স থেকে বের হল নতুন একটি জিনিস ‘ঠেকুয়া’। তার পাশের বাড়ির অবাঙালি কাকীমা পুজোর প্রসাদ দিয়েছেন। সেই প্রথম একটু স্বাদ নেওয়া নতুন প্রসাদ ঠেকুয়ার। মিথ্যে বলবো না, খুব ভাল না লাগলেও খারাপ লাগেনি। তারপর সেই বন্ধুকে সবাই মিলে জিজ্ঞেস করলাম “কিসের পুজো রে? আর কি প্রসাদ দেয়?” সে উত্তর দিল, “ছট পুজো”। প্রথম শোনা একটা নাম। আবার ভুলেও গেলাম। কারণ তখনও ছটপূজার এত বড় প্রশেসন যেত না রাস্তা দিয়ে। এত বাজনার আওয়াজ ছিল না। এত বাজি ফুটত না। সে ছিল একপাশে, একটেরে, খানিক নিঃশব্দে। তাই তাকে নিয়ে আলাদা করে মনে রাখার প্রয়োজন পড়েনি তখন। তবে এই ঠেকুয়া ভক্ষণের দু এক বছর পরেই ঐ ঠেকুয়া প্রসাদ হিসাবে হাতে পেলাম আমার স্কুলে নিয়ে যাওয়া রিক্সাওয়ালা রামস্বরূপ দাদার কাছ থেকে। দাদা বলছি বটে, কিন্তু সে ছিল আমার জেঠুর বয়সী। একটু ভাঙা, কিন্তু পরিষ্কার বাংলা বলত। বাংলা পড়তেও পারত। রামস্বরূপ দাদার স্ত্রীর আমার প্রতি সন্তান স্নেহ ছিল বেশ। তবে প্রথমদিকে আমায় কোনদিন প্রসাদ অফার করেননি। বেশ ছোট ছিলাম বলে হয়ত তখন খাবার জিনিস দেওয়া ঠিক মনে হয়নি তাঁর। যাইহোক আমি ওই ঠেকুয়া নিয়েছিলাম এবং খাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু এত শক্ত ছিল যে বলার নয়। তাই ঠেকুয়া সম্বন্ধে আমি সংশয়ী।
আজ এত বছর পর যখন চারপাশে তাকিয়ে দেখি, বাঙালির তুলনায় অবাঙালি প্রতিবেশী কম তো নয়ই বরং বেশি হলেও হতে পারে। আর তাদের মধ্যে বেশিরভাগই বিহার থেকে এসেছেন। এখন আর ‘ছট’ শুনে কেউ হাঁ করে তাকিয়ে থাকে না। ছট পুজো কি, কবে হয়, রাস্তা জ্যাম হয়, সকলে নাচতে নাচতে, বাজি ফাটিয়ে, ভয়াবহ মিউজিক বাজিয়ে গঙ্গায় যান, এ আমরা ফি বছর দেখে থাকি। রবীন্দ্র সরোবর নিয়ে ছট পুজোর টানাপোড়েন কাগজে পড়ে থাকি। কিন্তু ছটের অন্তর্নিহিত অর্থ খুঁজে দেখি না। চেষ্টাও করি না হয়ত।
এই পূজার কবে উৎপত্তি হয়েছিল সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু পৌরাণিক যুগে সূর্য্য বন্দনার সঙ্গে এই পূজার মিল পাওয়া যায়। ঋকবেদে সূর্য্য বন্দনার শ্লোকে আমরা তা জানতে পারি। সৃষ্টির আদি পর্বে মানুষের কাছে সূর্য্যই ছিলেন প্রত্যক্ষ দেবতা। ভারত ছাড়াও গ্রীস, মিশর, রোমেও সূর্য্য ছিলেন প্রধান দেবতা। তেমনি ঊষা ছিলেন বৈদিক দেবী। রাত্রি যার ভগিনী। ঊষা পূর্বের দেবী। আর সূর্য্য পূর্বদিকেই ঊষালগ্নে প্রথম প্রকাশ পান। তাই হিন্দু ধর্মে পূর্বদিক, ঊষাকাল, সূর্য্যদেব ও সায়ংকাল সবসময়ই প্রাধান্য পেয়ে আসছেন সেই আদিকাল থেকে। রামায়ণে এবং মহাভারতে আছে যে রামের কুলদেবতা সূর্য্যকে রাম সীতা একত্রে এই পূজা করেছিলেন। আবার মহাভারতে দ্রৌপদী ধম্যমুনির উপদেশে সূর্য্যের আরাধনা করে অক্ষয় পাত্র লাভ করেন। মহাবীর দাতা কর্ণও নাকি এক কোমর জলে দাঁড়িয়ে সূর্য্য বন্দনা করতেন। অবশ্য তিনি তো সূর্য্যের সন্তান এবং কবচকুন্ডল লাভ করেছিলেন স্বয়ং সূর্য্যের কাছ থেকেই। আফটার অল পিতৃত্বের একটা দায় তো থাকে নাকি! একটি সন্তান পৃথিবীতে এনে দিলাম অথচ তাকে না দিলাম পিতৃপরিচয়, না দিলাম জননীর কোল। না, সূর্য্যদেব অবশ্য তাঁর পিতৃত্ব অস্বীকার করেননি। কিন্তু সমাজ কি ওসব যুক্তি মানবে? তাই কবচকুন্ডল দিয়ে ছেলেকে একটু বেঁচে থাকার সুযোগ করে দেওয়া আর কি। আজও তাই মানুষ গঙ্গার জলে কোমর পর্যন্ত ডুবে সূর্য্য প্রণাম করে বাঙালি অবাঙালি নির্বিশেষে।
সঙ্গমরত দুই হরিণ হরিণীর দিকে তীর ছুঁড়ে রাজা পান্ডু তো তাদের মেরে ফেললেন। কিন্তু মারা যাবার আগে হরিণ হরিণী মনুষ্যরূপে ফিরে পান্ডুকে অভিশাপ দিলেন যে এভাবেই একদিন পান্ডুর মৃত্যু ঘটবে। হরিণ হরিণী ছিলেন এক ঋষি ও ঋষিপত্নী। মহাভারতে সবই কেমন রূপকের মাধ্যমে এসেছে বারে বারে। আসলে সঙ্গমরত কোন প্রাণীকে আঘাত করতে নেই, আর সেটাই পান্ডু করে অনুশোচনায় ভুগছিলেন। এই হত্যার প্রায়শ্চিত্তের কারণে এবং পুত্র কামনায় পান্ডু ও কুন্তী একযোগে সরস্বতী নদীর ধারে সূর্য্য উপাসনা করেছিলেন। আর কুন্তীর সঙ্গে তো সূর্য্যের পূর্বেই যোগ ছিল। সূর্য্য আলোর উৎস। সূর্য্য না থাকলে প্রাণীকুল বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। সূর্য্য অর্থ প্রাণের আগমন, প্রাণের প্রকাশ। সুতরাং নতুন প্রাণের জন্য, নতুন শস্যের জন্য সূর্য্যের তপস্যা করতেই হবে। সূর্য্য না থাকলে জগৎ চরাচর অন্ধকারে মুখ ঢাকবে। আসবে শৈত্য। রিক্ত হবে শস্যশামলা বসুন্ধরা। তাই পান্ডু ও কুন্তী সূর্য্যের উপাসনা করেছিলেন। তবে প্রাণশক্তিতে ভরপুর সূর্য্য নতুন প্রাণ সৃষ্টির জন্য একটু বেশিই উদগ্রীব নন কি? তা না হলে কুন্তী অল্পবয়সী কৌতুহলে দুর্বাসা মুনির বর পরীক্ষা করতে গিয়ে সূর্য্যকে আহ্বান করে কম বিপদে পড়েছিলেন? নটখট স্বভাব শুধু কৃষ্ণের নয়, সূর্য্যেরও ছিল। শুধু তাইই বা বলি কি করে? ইন্দ্র, চন্দ্র, স্বয়ং ব্রহ্মা, এমন কি শিব, তিনিও কি বাদ পড়েছেন?
তবু মানুষ যুগে যুগে আরাধ্য দেবতার আরাধনা করে চলেছে সম্পদ ও পুত্রলাভের আশায়। কন্যা লাভের আশায় কাউকে আরাধনা করতে দেখা গেছে কি? বোধহয় না। পারিবারিক সুখ সমৃদ্ধি লাভের আশায় এই ছট পূজো অনুষ্ঠিত হয়। একটা জিনিস লক্ষনীয় এই যে, কার্তিক মাসেই মা কালীকে মহালক্ষ্মী রূপে আরাধনা করা হয়। এই মাসেই ধনতেরাস আবার কিছুদিনের মধ্যেই সূর্য্য পুজো বা ছট পরবের মাধ্যমে সেই সমৃদ্ধির আরাধনা। আসলে আমরা কিসের আরাধনা করি এটাই মাঝেমাঝে ঘুলিয়ে যায় আমার মত সংশয়ী মানুষের। সূর্য্য? কালিকা? লক্ষ্মী? না শুধুই ধন মান সমৃদ্ধির? তবে যাই হোক না কেন, ছট পুজোয় মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয় বলে বিশ্বাস। নারী পুরুষ সমান ভাবে এই উপাসনায় অংশ গ্রহণ করেন। ছট পূজোয় কোনও মূর্তি নেই। কিন্তু তবু এখন সব ঘাটে সূর্য্য ও ঊষাদেবীর মূর্তি দেখা যায়।
উদিত সূর্য্যকে পূজা করে ফল লাভ হয়। পূজার দুদিন আগে লাউ ভাত এবং একদিন আগে ক্ষীর ভাত খেতে হয়। টানা ছত্রিশ ঘন্টা কঠোর সংযমের মধ্য দিয়ে ব্রত পালন করতে হয়। বিভিন্ন ফলমূলের মধ্যে কলা অন্যতম ফল, যা সূর্য্য দেবকে নিবেদন করা হয়। এই সময় নুন ও মশলা ছাড়া খাদ্য গ্রহণ করা নিয়ম। নির্জলা উপবাসে থেকে ব্রত সম্পন্ন করে তবেই এই খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। অর্ঘ্য স্বরূপ সূর্য্য দেবকে দুধ অর্পণ করা হয়। এছাড়া নানা মিষ্টি ও ঠেকুয়া তো থাকবেই।
পুরাণ মতে প্রথম মনুর কোনো সন্তান ছিল না। তাই তাঁর পিতা কাশ্যপ মুনি পুত্রেষ্ঠী যজ্ঞের পরামর্শ দেন। এই যজ্ঞের ফলস্বরূপ মনুপত্নী মৃত পুত্রের জন্ম দেন। মৃত শিশুকে দেখে মায়ের বিলাপ শুনে আকাশ থেকে এক দেবী প্রকট হন। তিনিই ঊষাদেবী। ঊষাদেবী মৃত শিশুকে স্পর্শ করামাত্র পুত্র জীবন ফিরে পায়। তাই সূর্য্য দেবের পাশাপাশি ঊষাদেবীও পূজা পেয়ে থাকেন এই ছট উৎসবে। ছট পূজা এখন আমাদের ঘরের পূজা। আশেপাশে বহু অবাঙালি প্রতিবেশী। সব কিছু নিয়েই আমাদের ভারতবর্ষ। শুধু যদি বাঙালির কালীপুজো আর অবাঙালির ছট পুজোয় বাজি ফাটানো এবং তারস্বরে মাইক বাজানো বন্ধ হয়, তাহলে পথে থাকা অবলা পশু আর বাড়িতে থাকা অসুস্থ এবং বৃদ্ধ মানুষ একটু স্বস্তি বোধ করেন। তারপর সারাবছর চলুক সমৃদ্ধির প্রার্থনা।
পরিশেষে বলি ছটপুজোর একটি সুন্দর দিকের কথা। এটি জেনেছি এক রিসার্চ স্কলার বিহারী বাবুর কাছে। ছটপুজোর জন্য কোনো পুরোহিতের প্রয়োজন হয় না। দেবতা এবং পূজকের মাঝখানে কোন মাধ্যম নেই। আর রাশি রাশি জিনিসের বদলে মাত্র পাঁচ ফলেই সূর্য্য দেবতা সন্তুষ্ট হন। কে বলে তিনি নটখট?