অলোক গোস্বামী আমার কালের সেই শিল্পী যিনি তীব্র কালজ্ঞান, সময়কে সঠিক মাত্রায় ব্যবচ্ছেদ ও মধ্যবিত্তের ঘুণধরা মূল্যবোধকে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনেন। বৃত্তকে ঘিরে উপবৃত্ত নয়, তত্ত্বকে সামনে রেখে আখ্যান গড়া নয় বরং আখ্যানের ভিতর থেকেই তিনি একটি তত্ত্ব পাঠককে উপহার দিতে চান। আখ্যানের সমস্ত কাঠামোটাই দাঁড়িয়ে থাকে লেখকের সচেতন ভাষা বয়নের কৌশলে। জোরালো শব্দ বিন্যাস, ব্যঙ্গ ও হালকা রসিকতা দ্বারা কথনের চলনকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হন। তাঁর তৃতীয় উপন্যাস ‘আদিম হাওয়ার সংলাপ’ এক যুবকের সাংবাদিক হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টার আড়ালে অস্তিত্বের সংকটের প্রগাঢ় বিশ্লেষণসহ নিঃসঙ্গ মানুষের অব্যর্থ মূল্যায়ন চিত্রিত হয়েছে।
অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের মানসিক জগৎই এই আখ্যানের কেন্দ্রবিন্দু। চেতনার আড়াল-অবডাল, অন্ধকার, দীনতা নিয়েই এর মানস পরিক্রমা। দিনেশচন্দ্র-বিমল সরকার-বরুণচন্দ্র সকলেই অস্তিত্বের সংকটে ভুগেছে। নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবার অহমিকায় নিজেই মানসিক দ্বিধায় সংকটগ্রস্ত। তবে প্রবল প্যাশন, জীবন সম্পর্কে অধীর আগ্রহ, বাঁচা নামক প্রক্রিয়াকে তীব্রভাবে জানা, উপলব্ধির ক্রমাগত চেষ্টার মধ্য দিয়ে লেখক শুনিয়ে যেতে চান চরাচরের সমাজ বাস্তবের বহুমুখী গল্প। প্রান্তিক মধ্যবিত্ত পরিবার পিছু যখন একটি সাইকেল কিনতে সমর্থ হয়েছে এই আখ্যান সেই সময় সরণির। আখ্যানের ভূগোল শিলিগুড়ি পার্শ্ববর্তী আশাপুর। শব্দের আকর্ষণে লেখক প্রথম থেকেই একটা ঘোর সৃষ্টি করেন। যা অনুসন্ধানমূলক।
জীবন প্যাশনে ভরা, শখ-ইচ্ছা-স্বপ্নে ভরপুর। কিশোর বরুণচন্দ্র বসুর নিজের স্বপ্ন, কখনও পিতার স্থিতধী পথে এগিয়ে যাবার স্বপ্ন। পিতার আদর্শ, ক্রিয়াকর্ম সন্তানের মনে প্রবল আকাঙ্ক্ষার জন্ম দিয়েছে। তা কিন্তু অনৈতিক নয়। প্রবল প্যাশন নিয়ে সাংবাদিক হবার ইচ্ছা ছোটবেলা থেকেই মনের মধ্যে লালিত হচ্ছে। একটি শিশু বড় হচ্ছে তীব্র আকর্ষণ, জীবন সম্পর্কে গভীর রহস্য, সমাজ ব্যবস্থার ভালোমন্দ, ফাঁকফোকরগুলি দেখতে দেখতে। লেখক খুব সচেতনভাবেই শিশুটির মানস পরিক্রমা সম্পূর্ণের জন্য পিছনের কাহিনি বুনে চলেন। যেখানে আছে গত শতকের সাত-আটের দশকের মফস্সল বাংলার সাংবাদিক-প্রশাসনের লুকোচুরি খেলা। সেই খেলার অন্তরাল হিসেবে শিশুর উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ। সেও সব দেখছে। মাঝে মাঝে ভয়ানক বয়ানে (যা অলোক গোস্বামীর লেখনবিশ্বের স্বভাবধর্মও বটে) বেরিয়ে আসে সত্য।
প্রশাসন-সাংবাদিকের সম্পর্ক খতরনাক। অনেকটা সাপ-বেজির মতো। প্রশাসন সামঝে চলে সাংবাদিককে। কিন্তু যখন বোঝে সাংবাদিক, সাংবাদপত্রের ক্যালমা শেষ তখন কেশ দিয়েও পাত্তা দেয় না। প্রবীণ সাংবাদিক দিনেশচন্দ্র বসু সম্পর্কে প্রশাসনের উদাস দৃষ্টি মফস্সলের সংস্কৃতি বিবর্তনের গূঢ় রসভাস জানান দিয়ে যায়। আখ্যান আত্মকেন্দ্রিক। আখ্যানে রয়েছে শিশুটির আত্মপ্রতিকৃতি নির্মাণের বিবিধ পরম্পরা। সমাজবদ্ধ মানুষ হিসেবে ব্যক্তির নির্মাণে সমাজেরও যে একটা ভূমিকা থাকে বা চারপাশ আবর্তিত হয় সেই ঢঙে আখ্যান এগিয়ে চলে। বলা ভালো সেই পরিসর সংবাদ-সাংবাদিককেন্দ্রিক।
অলোক গোস্বামীর গদ্যের বৈশিষ্ট্য অনিবার্য গতি। গতির সমান্তরাল স্রোতে আমাদের বাঁচা নামক প্রকোষ্ঠের নানা ছলচাতুরি, বিবেক, ধর্ম, বোধ, মেকিপনা—সব মিলিয়ে আমরা যেভাবে বাঁচি তার ভালোমন্দ দিক খুঁটিয়ে তুলে ধরা। এমনকি প্রতি পদক্ষেপে ভুল ধারণাকে আঘাত করা। গদ্যের অনিবার্য স্মার্টনেস অলোক গোস্বামীকে করে তোলে স্বতন্ত্র। বরুণচন্দ্র চরিত্রের অনিবার্যতা, নিরপেক্ষতা, জেদ, অনমনীয়তার পিছনে ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে ছিল পিতা-মাতার অধ্যবসায়, পরিশ্রমী মনন, বিবেক ও মূল্যবোধ। পারিবারিক সূত্রে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতাই যেন চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছে।
সাংবাদিকের চোখে খবর, সংবাদ, সংবাদের নন্দন, মূল্যবোধ, এথিক্স আর সাধারণ মানুষ সাংবাদিকদের কোন চোখে দেখে এই দুইই আখ্যানের চালিকাশক্তি। দুই পরম্পরাকে সামনে রেখে লেখক সময় উপনিবেশের ঘোরতর অন্ধকারে প্রবেশ করেন। সন্দেহ, অবিশ্বাস, মানুষকে বোকা বানানো, সাংবাদিকের অভিমান, অহংকার, আদর্শ, সাধারণ দৃষ্টিতে ভিত্তিহীন সব মিলিয়ে লেখক পৌঁছে যেতে চান অন্তঃসার শূন্য সময় সত্যের কাছে যার রোমন্থনে উঠে আসে মূল্যবোধ পরীক্ষার একাধিক প্রশ্নপত্র। আখ্যান শেষ হয়েছে জীবনানন্দ দাশের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে। তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়ে যান অন্ধকারের ভাষাই তাঁর আখ্যানের কেন্দ্রবিন্দু। যা সাদা চোখে দেখা যায় না, যা মানুষ গ্রাহ্যের মধ্যে আনে না সেই বিচ্যুত-পরিত্যক্ত সত্যকেই তিনি আপনমনে সাজিয়ে তোলেন।
প্রত্যেকেই জেদি। প্রত্যেকেই নিজস্ব বিশ্বাসে অটল। প্রত্যেকে এথিক্সকেই জীবনের মূলধন, জীবনধর্ম ভাবে। এই ভাঙন বেলায় লেখক কোন আখ্যান শোনাতে চান? মূল্যবোধহীন, বিশ্বাসঘাতক সময়ে, মুনাফা লুটের দলদাসত্ব সময়ে তিনি দেখিয়ে দিতে চান এখনও সত্য বলে কিছু আছে। হোক না তা উপন্যাস। তবুও তো আয়নার ভিতর দিয়ে জীবনকে দেখা। আখ্যানটি উৎসর্গ করেছেন জেমস অগাস্টাস হিকিকে। ‘বেঙ্গল গেজেট’কে বাদ দিয়েও ‘দিগদর্শন’ থেকে শুরু করলে দেখা যাবে ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে সাময়িক পত্র, সংবাদপত্রের দুইশ বছর হয়ে গেল। বহু লেখক কর্মজীবনে সংবাদিক বা সংবাদ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত থেকেও এমন আখ্যান লিখলেন না কেন? কেনই বা অলোক গোস্বামীকে এই কালবেলায় এমন আখ্যান লিখতে হয়? সাংবাদিকতায় পচন ধরেছে বলেই। সাংবাদিক আজ মূল্যহীন, সমাজ ধ্বংসের অন্যতম দোসর বলেই। মোক্ষম আঘাতটা জরুরি ছিল সাহিত্য ও সমাজের ক্ষেত্রে। আক্ষেপ একটাই অখ্যান কতটা মানুষের কাছে পৌঁছবে। সেখানেও যে পাবলিসিটির রমরমা। সেখানেও যে সাংবাদিকের দফারফা।
দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সংবাদপত্র-সাংবাদিকদের হালহকিকত চরম বাস্তবে দ্ব্যার্থবোধক অর্থে প্রকাশ পেয়ে যায়। সংবাদ-সংবাদপত্র যে পার্টিনির্ভর, ঘটনার সত্য অপেক্ষা পক্ষ-বিপক্ষ নির্ভর, সরকারের পাশে থাকা, সরকারকে চাপে ফেলার নানা গোপন ফাঁদ যা অবশ্যই স্বার্থকেন্দ্রিক তার সমস্ত পথ স্পষ্ট হয়ে যায়। হাউসের সঙ্গে রিপোর্টারদের যেন দেনাপাওনার সম্পর্ক। রয়েছে ব্যবহৃত হওয়ার নানা কায়দা কৌশল। হাউস সাংবাদিককে ব্যবহার করে। একটু এদিক ওদিক হলেই ছুঁড়ে ফেলে। তার চাই মুনাফা। দিনেশচন্দ্রের তো সেই পরিণতিই ঘটেছিল। আখ্যানের উপরিভাগে সাংবাদিক জগতের সত্য ভেসে এলেও নিচে রয়েছে ব্যক্তির চূড়ান্ত ব্যর্থতার অলিগলি যা পুরোটাই ভ্রান্তিমূলক। সেই ভ্রান্তি, ভুল উপনিবেশ নিয়েও প্রবল প্যাশনে, জেদে যে বাঁচার চেষ্টা করা যায়, বাস্তবকে উপেক্ষা করে প্রান্তিক মানুষ ভুল সত্যকে আঁকড়ে ধরেও এক জগৎ রচনা করতে পারে সেই বিন্দুবিসর্গ আখ্যানের চাবিকাঠি।
প্রবল যুক্তি, যুক্তি ভেঙে পালটা যুক্তি, নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করার অনমনীয় মানসিকতা ও ব্যক্তিত্বকে প্রবলভাবে আত্মপ্রতিষ্ঠা করার ঝোঁক আখ্যানকে ভিন্ন সুর দান করেছে। দিনেশচন্দ্র বসুর ব্যর্থ হওয়ার দিনলিপি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে চিত্রিত করে যায় বরুণচন্দ্র বসু। আশ্চর্যজনকভাবে অলোক গোস্বামীর তিনটি উপন্যাসেরই কেন্দ্রবিন্দু প্রান্তিক পরাজিত মানুষ। তথাকথিত সমাজ যাদের বাতিল ঘোষণা করে দেয়, প্রচলিত সমাজের চোখে যারা মূল্যহীন তাদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার মধ্য দিয়েই তিনি জীবন উপনিবেশের রসদ খোঁজেন। কথার ভিতর কথা কীভাবে লুকিয়ে থাকে, কথার চাপেই পরবর্তী কথা কীভাবে বেরিয়ে আসে সেই বিন্যাস আখ্যানকে তীব্র গতিদান করেছে। যুক্তির রেল গাড়ি, আত্মপক্ষ নির্মাণ ও প্রতিপক্ষের যুক্তিকে উড়িয়ে দেবার দৃ্ঢ় বয়ান আখ্যানে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করে যা ভিত্তিহীন হলেও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বাস্তবকে সামনে রেখে আরেক বাস্তব নির্মাণই আখ্যানকে করে তুলেছে ভিন্ন গোত্রের।
জার্নালিজম-সংবাদপত্রের নথিনক্ষত্র নিয়ে এই আখ্যান উপনিবেশ। সংবাদ-সাংবাদিকের দায়িত্ব-মূল্যবোধ-ইয়েলো জার্নালিজম সমস্ত নিয়ে মফস্সল মিডিয়ার একাধিক হলফনামার বয়ান। সমস্ত রকম চোরাবালিকে উপেক্ষা করে নিজের আত্মসত্তা প্রতিষ্ঠা করার জেদই বরুণচন্দ্রের জীবনসম্পদ। আত্মপ্রতিষ্ঠার রহস্যলিপি, প্রতি পদে বাধা ও পথের আনাচে কানাচের ষড়যন্ত্র ও মানুষের ভূমিকা নিয়ে এই আখ্যান। একই বক্তব্য বারবার ঘুরিয়ে এনে লেখক দেখাতে চান এক যুবকের আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই। শুধু লড়াই নয় জেদ, অনমনীয় মানসিকতা ও অসম যুদ্ধে জয়ী হবার অদম্য দক্ষতা। চেতনার চোরাস্রোতে যে ভেলকি বিরাজ করে যা ব্যক্তিকে প্রবল অহমিকা, প্যাশন, জেদ ও নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার মোক্ষম আয়ুধে নিয়ে যায় তার সোপান এই আখ্যান। প্রবল যুক্তি, অন্যের সামনে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার সাহস-শ্রম, মস্তিষ্কে সঞ্চালিত বোধ, যুক্তির পর প্রতিযুক্তি সাজিয়ে নিজের অস্তিত্বকে বড় পরিসরে তুলে ধরার নিজস্ব প্রয়াস বরুণচন্দ্র বসুকে করে তোলে স্বতন্ত্র। বাস্তববোধের অভাবে ভুলবিন্দুকেই জীবনের প্রকৃত সত্য ভেবে বারবার ভ্রমের মধ্য দিয়ে লেখক এমন এক জগৎ রচনা করেন যা বাস্তবের ঊর্ধ্বে অথচ ঘোর বাস্তবই যার চালিকাশক্তি।
নিজেকে তুলে ধরার আত্মপ্রচেষ্টা আখ্যানের বয়ানকে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করে তুলেছে। নিজেকে দক্ষ প্রমাণ করার নানা কৌশল জানান দেওয়া। দক্ষ সাংবাদিকের সন্তান হিসেবে সেও যে পারদর্শী সেই সূত্র ধরিয়ে দেওয়া। আছে নিবিড় ডিটেলিং। ঘটনার পরতে পরতে ডুব দিয়ে সত্য জানার আগ্রহ। তা সঠিক না ভুল সেই রহস্য নয় বরং সত্য উন্মোচনের প্রবল উদ্দীপনা। যার মধ্য দিয়ে উঠে আসে জনপদজীবনের ভূত-ভবিষ্যৎ। সংবাদ অপেক্ষা সংবাদের সূত্র আবিষ্কার বড় হয়ে ওঠে। সেই আবিষ্কারে নানা ছিদ্রপথে জীবনের অলিগলি দেখা। দেখছে বরুণচন্দ্র। প্রবল আরধ্য শক্তি নিয়ে নিজেকে জাহির করা, নিজের মেধাকে প্রকাশ্যে দেখানোর যৌবনোচিত একরোখা জেহাদ চরিত্রটির মূল রহস্য। বাস্তবের একাধিক আঘাতও যে কাউকে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত করতে পারেনা, আঘাত যতই ভয়ংকর হোক ব্যক্তি নিজের অস্তিত্বকে প্রবলভাবে নিজেই ধারণ করে থাকে, অসম্ভব জেদ দ্বারা নিজের ভুল অস্তিত্বকেই প্রমাণ করতে চায়, সেই বিপরীত জীবনধর্মের খনন এই আখ্যানের ভিত্তিভূমি।
অলোক গোস্বামীর গদ্য পড়া পাঠকমাত্রই জানেন তিনি পরিসরকে মাঝে মাঝেই হালকা করে দেন। পাঠক যেন অধৈর্য, ক্লান্তি, একঘেয়ামি বোধ না করে সেজন্য হালকা তথ্য, ব্যঙ্গ, হেঁয়ালি, চুটকি এনে গদ্যে একটা সরস আমেজ আনেন। যা পাঠকের মস্তিষ্কে ঘা দিয়ে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। যথারীতি এখানেও তা বিদ্যমান। উচ্চাকাঙ্ক্ষা, নিজেকে বড় ভাবার মোহ, ‘আমি জানি’, ‘আমি পারি’ মানসিকতা বরুণচন্দ্রকে বারবার ধাক্কা দিয়েছে। সেই মোহ, অন্যের সামনে নিজেকে তুলে ধরার আত্মঘাতী প্রবণতা ও তা থেকে বিচ্যুত হবার যন্ত্রণা আখ্যানের মূল সুর। তেমনি আছে সাংবাদিক লাইনের সত্য উন্মোচনের প্রয়াস—
“সাংবাদিক হিসেবে বাবাকে তুই গুরুত্ব না দিতেই পারিস কিন্তু এক্সপিরিয়েন্সটাকে তো মানবি? বাবা বললো, এই লাইনটা এখন অনেক বদলে গিয়েছে। চারিদিকে নিম্নমেধার ছড়াছড়ি। এক লাইন শুদ্ধ বাংলা লেখার মুরোদ নেই অথচ সাংবাদিক হয়ে যাচ্ছে। এমন কী তাদের সবার বগলেই একটা করে সার্টিফিকেটও রয়েছে। জার্নালিজমের ডিগ্রির সার্টিফিকেট। খবরের কাগজগুলোও প্রতিভা যাচাই না করে শুধু সার্টিফিকেট দেখেই নিয়ে নিচ্ছে।” (পৃ. ১২৪)
বরুণের আত্মসংকট নিজের প্রতিষ্ঠার পথে নানা বাধায়। তাঁর নিজের ধারণা যে ভুল তা সে মানতে চায় না। চায় না বলেই অন্যকে ভুল ভাবে। ভাবে সকলেই প্রতিষ্ঠার পথে বাধা সৃষ্টি করছে। সেই প্রক্রিয়া থেকে ক্ষোভ উগড়ে দেয়। প্রতিবেশীরা যে তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী তা মানতেই চায় না। বরং বিরূপ মন্তব্য করে। আত্মগ্লানিতে ভোগে। কাহিনি হয়ে ওঠে অন্তর্মুখী। ব্যক্তির দ্রোহ, জেদ, প্রতিষ্ঠা, খ্যাতি, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, মোহ নিয়ে ব্যক্তির আত্মপ্রতিষ্ঠাসহ খননভূমির খতিয়ান। প্রবল বিদ্রোহ, স্বতন্ত্রতা, জেদ নিয়েও বাঁচা সম্ভব নয়। হারতে হারতেও হয়ে ওঠে সিস্টেমের অংশ। সিস্টেমকে মানতে শেখে। সে ক্রমেই জটিলতায় আটকে পড়ে। যা থেকে মুক্তির পথ নেই। বলা ভালো সে যত এগিয়ে যায় জীবন ততই জটিল হয়ে পড়ে। ক্রমেই পরাজিত হতে থাকে। যন্ত্রণাময় জটিল সময়ের ভাষ্য এই আখ্যান। যে সময় ব্যক্তিকে কোন সুযোগ দেবে না, যে সময় ব্যক্তিকে নিঙড়ে নিয়ে চুসে ছিবড়ে করে দেবে সেই ঘাতক সময়ের চিত্র।
আছে শিলিগুড়ি নগরায়ণের পূর্বাভাস। মফস্সল শহর থেকে কীভাবে মেগাসিটিতে পরিণত হল। উন্নয়নের নামে প্রকৃতি কীভাবে ধ্বংস হল, ছোট ব্যবসা, দোকান মাঠে মারা গেল। ক্ষমতার নজরানায় দাপুটে সাংবাদিক দিনেশচন্দ্র বসু কীভাবে ব্যাকফুটে চলে গেল যার আড়ালে রয়েছে হাউস-মালিক পক্ষের হাত মেলানো, যেখানে পরাজিত হয়ে যায় মূল্যবোধ, এথিক্স। বরুণচন্দ্র নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসী নয় আবার প্রতি পদক্ষেপে অন্যকে অবিশ্বাস করে, হেয় মনে করে। এক প্রকার ঔদ্ধত্য, সবজান্তা মানসিকতা ও আলগা চালাকি যা নিজেকেই দংশন করে বারবার সেই জটিল মানসিকতার সংকটে ভুগেছে। অবক্ষয়িত সময়ে, যখন চারপাশ দ্রুত বদলে যাচ্ছে সেই চক্রধাঁধায় সে বড় হয়ে ওঠে। সর্বত্রই চালাকি। সেই চালাকি থেকে নিজেকে স্বতন্ত্র করতে, এমনকি নিজের প্রতিভাকে প্রমাণ করতে আবার আলগা চালাকিকেই পথ হিসেবে বেছে নিতে হয়।
বরুণের অপ্রতিরোধ্য যুক্তি, অন্যকে আক্রমণ করার অমোঘ বাক্য আসলে তাকেই যে পক্ষান্তরে ঘায়েল করে তা সে বোঝে না। সংবাদপত্র, সাংবাদিক, এথিক্স, মূল্যবোধের পতনকে আঘাত করতে গিয়ে পক্ষান্তরে সেই আহত হয়। তবুও জয়ের প্রগাঢ় নেশায় উত্তেজিত হয়ে কথার বল্লম ছোঁড়ে। আবার আঘাতপ্রাপ্ত হয়। ব্যক্তির অস্থিরতা, মানসিক ঘাত-প্রত্যাঘাত, ঔদ্ধত্য, অপরকে ঘায়েল করে আত্মতৃপ্তির আনন্দ, আবার ব্যর্থতার গ্লানি বহন নিয়ে এই আখ্যান।
ব্যক্তির অপ্রতিরোধ্য আত্মনির্মাণের প্রতিকৃতি এই আখ্যান। আত্মসত্তায় নানা দোলাচলতা, যুক্তি দিয়ে চেতন মনের সাম্রাজ্য গড়ে তোলাই লেখকের অভিপ্রায়। সেই অভিপ্রায়িক বচনে রয়েছে নিজের মেধা-যোগ্যতা প্রমাণের অনিবার্য ঝোঁক। কিন্তু নিজের ভাবনা বলয়ের সীমাবদ্ধতা, বাস্তবের অভাব সে জানে না। জানে বলেই ধাক্কা খায়। ধাক্কা খেয়ে পালটা যুক্তি সাজায়। এই যুক্তির পরম্পরা আখ্যানকে জীবনের জটিলতার স্বাদে নিমজ্জিত করে। ধর্ষিত নারীর রহস্য উদ্ধার করতে সে পৌঁছে যায় নিয়েনডার্থালে। ভুলকেই সত্য ভেবে নিয়ে ভাবনার অতল রহস্যে ডুবে যায়। নিয়েনডার্থালের রহস্য খোঁজার মধ্য দিয়ে সংবাদপত্রের নীতি-চরিত্র সম্পর্কে কিছু ধারণা তো স্পষ্ট হয়ই। সংবাদপত্র কীভাবে সংবাদ পরিবেশন করে, কোন সংবাদ পাবলিক খাবে, অতীতকে খুঁচিয়ে কীভাবে সংবাদের ক্লু বের করে আনতে হবে, কীভাবে নিজেদের পত্রিকাকে হাইলাইট করতে হবে। নিয়েনডার্থালের যে গল্প তা বরুণচন্দ্রের মেধাকে জাহির করার জন্যই তেমনি আখ্যানে ঘোর সৃষ্টিসহ বহুমুখী জীবনজিজ্ঞাসার জ্বালামুখ খুলে দিতেই। তেমনি সেই রহস্যকে সামনে রেখে সাংবাদিক হিসেবে বরুণচন্দ্রের আত্মজিজ্ঞাসা, রিপোর্টিংয়ের কায়দা কৌশল, নিজের জ্ঞাত জ্ঞান ও নিজেকে প্রমাণ করার পথ অস্পষ্ট নয়।
বরুণচন্দ্র বারবার অস্তিত্বের সংকটে ভুগেছে। অবিশ্বাস সন্দেহের বীজ বড় হয়ে উঠেছে। মাতা থেকে তুলি কাউকেই বিশ্বাস করেনি। চরিত্রটি বড় প্যাঁচালো। নিজেই নিজের জড়িয়ে যাবার জাল রচনা করে, সংকট তৈরি করে সকলকে অবিশ্বাস করে নিজেকে মুক্ত করতে চেয়েছে। সংকট যত ঘিরে ধরেছে জেদ তত বৃদ্ধি পেয়েছে। ততই কথাপরিমণ্ডল নির্মিত হয়েছে। যা থেকে সময়-সমাজ মানুষকে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার রসদ লেখক জাগিয়ে যান। নিজেই নিজের চক্র রচনা করে অন্যকে ঘায়েল যেমন করতে চেয়েছে তেমনি নিজেই আহত হয়েছে। কিন্তু সেখানেই শেষ নয় আহত হয়েই ফনা তুলেছে অন্যকে আঘাত করতে।
ব্যর্থ হতে হতে বাস্তব থেকে বহুদূরে বিচরণ করতে করতে একসময় সে বুঝতে পারে ব্যর্থ হবার কারণ। পরাজিত মানুষ আজ আর দোষারোপ নয় বরং নিজের দিকে তাকায়। আত্মসমীক্ষায় নিজেকে বুঝতে চায়। সে তুলিকে ভালোবাসতেও পারে না আবার তুলি অন্যের হয়ে যাক তাও মেনে নিতে পারে না। চূড়ান্ত বিভ্রান্তিতে ভোগে। সে একবিংশ শতাব্দীর বিমূঢ় বিভ্রান্ত যুগের নায়ক। বাংলা উপন্যাসের নিঃসঙ্গ নায়কের সারিতে বরুণচন্দ্র বসুকে স্থান দিতেই হবে। বাস্তবকে উপেক্ষা করে যে রোমান্টিক বাস্তব-অবাস্তব-নির্মিত বাস্তব তা নিয়েই সে বাস্তবের স্বপ্ন দেখেছে। সেই দেখা যে ভুল তা পাঠক হিসেবে আমরা বুঝলেও সে বোঝে না। বোঝে না বলেই যুক্তি সাজায়। এমনকি বাস্তব থেকে পৃথক হয়ে যায়। নিঃসঙ্গভাবে ঘুরে চলে। একাকিত্বে ভোগে। বাস্তবকে পাশে রেখে বরুণচন্দ্রের নির্মিত বাস্তবের ক্যানভাস লেখক এমন বয়ানে উপস্থাপন করেছেন যা প্রবাহিত বাংলা উপন্যাসের ছককে সচেতনভাবে উপেক্ষা করে স্বতন্ত্রভূমি নির্মাণ করে।
স্বামী দিনেশচন্দ্র, পুত্র বরুণচন্দ্রের আত্মপ্রতিষ্ঠায় স্ত্রী/মাতা মাধবী বসুও অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন। কিন্তু পথ ভুল হওয়ায়, লাগাতার ব্যর্থ হওয়া ভুলকেই সঠিক ভেবে জীবনে এগিয়ে যাওয়ায় তিনিও হাল ছেড়ে দেন। এমনকি শেষপর্যন্ত বিরোধীতা করেন। প্রান্তিক মানুষের ভুল বয়ান যা ব্যক্তির কাছে সঠিক কিন্তু সর্বিকভাবে ভুল সেই রহস্যকে তলিয়ে দেখার দূরবিন এই আখ্যান। দিনের আলোয় ভেঙে যায় বরুণচন্দ্রের বোধ। আঘাতের বাস্তব ভেঙে দেয় নির্মিত বোধকে। বাস্তব আলাদা, সেই বাস্তবের আলো-আঁধারের কাছে সে দেখে সব ভিন্ন। শৈশব থেকে সে এমন একটা পরিবেশে বড় হয়েছিল যা নিঃসঙ্গ, একাকিত্বে ভুগিয়েছে। সেই নিঃসঙ্গতা থেকে সে একটা কল্পিত বাস্তব গড়ে তুলেছিল। সেই কল্পিত বাস্তবের ভাব-ভালোবাসা, উত্থান-পতন, নির্মাণ-বিনির্মাণ, প্রতিষ্ঠা-পিছিয়ে পড়া নিয়ে এই আখ্যান পরিক্রমা। শেষে এসে ভেঙে যায় সে বোধ। বুঝতে পারে বিকৃত বোধে সে নিমজ্জিত।
ক্রোধ, হিংসা, কামনা, লোভ, ধর্ষণসহ আদিম রিপু যা সভ্য মানুষ আজও বহন করে চলেছে, নিজেকে সভ্য, সিভিল সোসাইটির নাগরিক বলে পরিচয় দিলেও বোধ থেকে উৎপাটিত হয়নি সেই সমূহ অন্ধকার, যা ব্যক্তিসহ সমাজকে দূষণ করে, যা থেকে ব্যক্তির মুক্তি নেই সেই জৈবিক প্রবৃত্তিময় জীবনলিপি লেখকের কেন্দ্রবিন্দু। মানুষ শেষ পর্যন্ত ফিরে আসে ভালোবাসার কাছেই, তা চরম-পরম বলেই বিশুদ্ধভাবে পেতে চায়। পূর্বে বিস্তর ভুল করেও ফিরে আসে ভালোবাসা নামক হাতছানির কাছে। জেনে নেয় জীবনের সংহত সম্পূর্ণ রূপ। লেখকও সেই বোধে চরিত্রকে ফিরিয়ে আনেন।
বাংলা উপন্যাসের ধারাপাতে ‘আদিম হাওয়ার সংলাপ’ নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ আখ্যান। বিষয়, উপস্থাপন, রিয়ালিটি, সংবাদপত্রের নথিনামা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এবং তা সচেতনভাবেই মেধাবী কৌশলে প্রয়োগ করা হয়েছে। উত্তম পুরুষে ব্যক্তি মানুষের অস্তিত্ব খনন করে নিঃসঙ্গতা, একাকিত্বের বর্ণলিপি যেভাবে গড়ে উঠেছে এবং চরিত্র নিজেই ছিন্নভিন্ন করেছে তা বাংলা উপন্যাসের জটিল পথরেখায় তাৎপর্যপূর্ণ সমীক্ষা বলেই মনে হচ্ছে।
আদিম হাওয়ার সংলাপ। অলোক গোস্বামী। আত্মজা পাবলিশার্স। প্রথম প্রকাশ ২০২২। মূল্য ৪০০ টাকা।
লেখক : অধ্যাপক, রায়গঞ্জ সুরেন্দ্রনাথ মহাবিদ্যালয়।
গুরুত্বপূর্ণ একটা লেখার যথার্থ মূল্যায়ণ … ❤️