ছোট বড় মাঝারি ভালো মন্দ মাঝারি জীবনে কত গল্পই না লিখলাম। তবু অলিখিত গল্পের সংখ্যা যেন আরো বেশি। যে সব গল্প লিখব বলে ভেবে রেখেছি অথচ শেষ পর্যন্ত লেখা আর হয়ে ওঠেনি, যে সব গল্পের ইসারা সামান্য একটু সাড়া দিয়েই চঞ্চল পায়ে অদৃশ্য হয়ে উঠেছে, যারা কেবল চকিতের জন্যে দেখা দিযেছে অথচ ধরা ছোঁওয়া দেয়নি, তাদের সংখ্যা কম নয়।
না-লেখা গল্পগুলির কথা যাক। লেখা গল্পগুলির কথাই বলি।
পিছনে ফেলে আসা দিনগুলির আর দিন ভরে রাত ভরে লেখা গল্পগুলির দিকে তাকিয়ে কেমন যেন একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। বাস্তব আর কল্পিত, অরচিত আর স্বরচিত সব মিলিয়ে এই গল্পগুলি যেন আমারই জীবনবৃত্ত।
অনেকদিন আগে নারকেলডাঙ্গায একটি ভাড়াটে বাড়িতে আমি সপরিবারে ভাড়া করে ছিলাম। দোতলায় বাডিওয়ালা থাকতেন আর একতলায় থাকতাম আমরা তিন ঘর ভাডাটে।
সেই বাসা ছেড়ে দেবার প্রায় বিশ বছর বাদে কোন একটা উপলক্ষে আবার আমাকে ওই অঞ্চলে একদিন যেতে হয়েছিল। কি কৌতুহল হল, ঘুরতে ঘুরতে গিযে দাঁড়ালাম সেই বাসাবাডিটার সামনে। দেখি আমাদের সেই ঘরখানি জুডে আর একটি নবীন দম্পতি বসবাস করছে।
আমার সেই পুরোন ঘরের নতুন বাসিন্দারা আমাকে খুবই আপ্যায়ন করল। চা এল, মিষ্টি এল। এল সানুরাগ অনুরোধ, আবার আসবেন। কবে আসবেন বলুন।’
বিদায় নেওয়ার সময় আর একবার আমি সেই ঘর দুখানির দিকে তাকালাম। কেমন যেন একটা উদাস বৈরাগ্যে মন ভরে উঠল। এই ঘর একদিন আমার ছিল আজ আর আমার নয়। পুরো তিন বছর আমি এই ঘরে কাটিয়ে গেছি। তিনশ পয়ষট্কেটিকে তিনগুণ করলে কত হয়? বৃহৎ পারিবারিক বন্ধনের মধ্যে ছোট ছোট সুখ দুঃখে আন্দোলিত হতে হতে এখানে সহস্র দিন-রজনী আমি বাস করেছি। এই বাস। যেমন এখন আর আর আমার নয়, সেই দিনরাত্রিগুলিও তেমনি আর পুরোপুরি আমার নয়। প্রত্যক্ষতা হারিয়ে তার অতীতের ছায়ার মধ্যে মুখ লুকিয়েছে।
নিজের পুরোন গল্পগুলির দিকে তাকালেও আমার প্রায় ওই ধরনের একটা অনুভূতি হয়। এগুলি যেন আমার অতীতের লীলাক্ষেত্ৰ। বহু গল্পের কথাই আমার আর মনে নেই। পাত্রপাত্রীর নাম মনে রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু বহু গল্পের ঘটনা-সংস্থানের কথা, তাদের শুরু আর শেষের কথাও আমি বিস্মৃত হয়েছি।
একবার এক কাণ্ড ঘটেছিল। এক ভদ্রলোক আমার একটি গল্প পড়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। গল্পটি আমার আগের লেখা কিন্তু তিনি পড়ে এসেছে সদ্যসদ্য। তিনি পাত্রপাত্রীর নাম উল্লেখ করে ঘটনা-বিন্যাসের কথা বলে জায়গায় জায়গায় লাইন পর্যন্ত মুখস্ত বলে পরম উল্লাসে উৎসাহে আমার সঙ্গে আলোচনা শুরু করলেন। একজন লেখকের কাছে এসেছেন একজন সাহিত্যরসিক পাঠক। আমি মস্ত বড় অরসিক বনে গেলাম। গল্পটির কথা আমি একেবারেই ভুলে গেছি। আমি তার সঙ্গে তাল রেখে একবার বলি, হুঁ’, আর একবার বলি,হ্যাঁ। আর একবার বলি, না।
গোঁজামিলটা তার চোখে ধরা পড়ে গেল। তিনি হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, “কিছু মনে করবেন না। গল্পটা কি সত্যি আপনিই লিখেছিলেন? বললাম, ‘একদা লিখেছিলাম। কিন্তু আজ যে আমি অন্য গল্প লিখছি। লিখতে লিখতে উঠে এসেছি আপনার কাছে।’
লেখকের গল্পগুলির উৎস নিয়ে হয়তো আপনাদের কারো কারো মনে কৌতুহল আছে। আমার নিজের তেমন খুব একটা কৌতুহল নেই। গল্পের নেপথ্যে যে গল্প তা না শোনাটাই ভালো। আমার মনে হয় তাতে আসল গল্পের রস হানি ঘটে। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকেই লিখি। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতার আনাগোনা কখনো রাজপথে কখনো সুড়ঙ্গপথে। কখনো সেই পথরেখা চোখে দেখা যায়, কখনো বা তা দৃষ্টিগোচর হয় না। এই অগোচর তাই লেখকের নিজের পক্ষে বিস্ময়কর। এতেই তার সৃষ্টির আনন্দ।
দুটি একটি গল্পের কথা বলি। ধরা যাক ‘রস’ গল্প।
এ গল্পের যে পটভূমি তা আমার খুবই পরিচিত। পূর্ববঙ্গে আমাদের গ্রামের বাড়িতে পূব দিকে ছিল একটি পুকুর। আর সেই পুকুরের চারধারে ছিল অজস্র খেজুর গাছ। ছেলেবেলা থেকে দেখতাম আমাদের প্রতিবেশী কিষাণকে সেই সব খেজুর গাছের মাথা চেছে মাটির হাড়ি বেঁধে রাখত। বাঁশের নল বেয়ে সেই হাড়িতে সারারাত ধরে ঝির ঝির করে রস পড়ত। সেই রস কড়াইতে করে, বড় বড় মাটির হাঁড়িতে করে জালিয়ে গুড় তৈরি করতেন আমাদের মা-জেঠমারা। শীতের দিনে রস থেকে গুড় তৈরির এই প্রক্রিয়া মায়ের পিঠের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে রোজ দেখতাম। আমার চিরচেনা এই পরিবেশ থেকে রস গল্পটি বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু রসের যে কাহিনী অংশ মোতালেফ, মাজু খাতুন আর ফুলবাবুকে নিয়ে যে হৃদয় দ্বন্দ্ব , খেজুর রসকে ঘিরে রূপাসক্তির সঙ্গে যে জীৰিকার সংঘাত তা কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে আসে নি। সেই কাহিনী আমি দেখিওনি, শুনিওনি। ও মনের মধ্যে যেন আপন থেকেই বানিয়ে উঠেছে।
আর একটি গল্পের কথা মনে পড়ে। ‘সেতার’। এই গল্পে যক্ষ্মা রোগগ্ৰস্থ স্বামীকে সুস্থ করার জন্যে স্ত্রী সেতারের টুইশন করত। সামান্য যা কিছু আয় হত তা যেত স্বামীর সেবায়। প্রয়োজনের যে সঙ্গীত চর্চা বউটি শুরু করেছিল ধীরে ধীরে সেই চর্চায় সে আনন্দ পেতে লাগল। ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে তার পরিচিতি বাড়ল, খ্যাতিও হল। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে স্বামী যেদিন বাড়িতে এল স্ত্রীর সেইদিনই ডাক পডল একটি বড় অনুষ্ঠানে বাজাবার জন্যে। এমন সম্মান সে এর আগে কোনদিন আর পায় নি। কিন্তু স্বামী তাকে ছেড়ে দিতে চায় না। এতদিন পরে স্ত্রীকে সে কাছে পেয়েছে। কত রোগ যন্ত্রণা মৃত্যুভয় পার হয়ে সে এসে পৌঁছেছে তার দয়িতার কাছে। এত দীর্ঘদিনের বিরহের পর স্ত্রীর সঙ্গে তিলমাত্র বিচ্ছেদ যেন তার সহনাতীত। সঙ্গীতের আসরে স্ত্রীর আর যাওয়া হল না। কিন্তু তার এই থাকাটাই কি পুরোপুরি থাকা?
এই গল্প এলো কোথেকে? হাসপাতালে কি হাসপাতালের বাইরে আত্মীয় অনাত্নীয় বহু যক্ষা রোগীকেই তো দেখেছি? গীতানুরাগিণী একটি গৃহবধূর সঙ্গেও আমার পরিচয় নিবিড়। কিন্তু এই আখ্যানটি দুটি প্রধান চরিত্র তার কাহিনী অংশ, আর কাহিনীসঞ্জাত যে হৃদয়বেদন আগে আমি দেখিওনি– শুনিওনি। মনের কোন আক্ষেপ কোন ভাবাবেগ থেকে এই গল্পের সৃষ্টি হয়েছিল আজ আমার পক্ষে তা বলা কঠিন। এই অক্ষমতাটুকু শিল্পীর অগৌরবের নয়। বরং এই অনির্বচনীয়তায় তার আনন্দ। লেখার মধ্যে সে সবই ব্যক্ত করতে চায় না, বোধ হয় পারেও না। সবই যদি ভাঙিয়ে বলে দেব তবে আভাষ আর ইসারা আছে কিসের জন্যে?
সব লেখকই নিজের চেনাজানা গণ্ডির ভিতর থেকে গল্পের উপাদান পেয়ে যান। আমিও তাদের ব্যতিক্রম নই। তবে কেউ কেউ বলেন আমার লেখায় সামান্য ছদ্মনামের আড়াল যদি বা থাকে, ছদ্মবেশের আড়ালটুকু থাকে না। যাদের নিয়ে লেখা তারা নিজেদের চিনে ফেলে। পাঠকদের মধ্যে যদি তাদের আত্নীয় বন্ধু কেউ থাকে তারাও জেনে যায়। এই দুর্বুদ্ধির জন্য শাস্তি পেতে হয়েছে। আইন আদালতের শান্তি নয়, সামাজিক শাস্তি। এই নিয়ে একজন বান্ধীর সাথে চিরবিচ্ছেদ হয়ে গেছে। সেই দুঃখের কথা আজ মনে পড়ে। অথচ আমি আমার সেই গল্পটির মধ্যে তাকে ছোট করিনি, অপমানও করিনি।
হৃদয়ের পরিপূর্ণ সমবেদনা আর সহানুভূতি দিয়েই আমি সেই প্রেমের গল্পটি লিখেছিলাম। পরিণাম হল অপ্রেম।
কেউ কেউ আবার অন।রকম অনুরোধও করেছে, লিখুন আমাকে নিয়ে। আমি যেন আপনার লেখার মধ্যে থাকি।”
লিখতে বসেছি সেই অনুরোধ কাহিনীকে নিয়ে। কিন্তু লিখতে লিখতে সেই একজনের সঙ্গে আরো কতজন যে মিশে গেছে। সেই বাস্তবিকার সঙ্গে লেখকের একটি মানসবাসিনী কেমন করে যে অঙ্গাঙ্গী হয়ে রয়েছে তার রাসায়নিক বিশ্লেষণ কে করবে?
মেয়েটি আমার সেই গল্প পড়ে মুখ ভার করে বলেছিল, “এ কার মূর্তি একেছেন। এ তো আমি নই।’
আমি তার মুখের সঙ্গে আমার নায়িকার মুখ মেলাতে মেলাতে জবাব দিয়েছি, ‘এক তুমি।’
আর একটি মেয়ের কথা বলি। সে আমাকে একেবারে হাতে-নাতে ধরে ফেলেছিল। অপূর্ব ভ্রুভঙ্গি করে বলেছিল, “আপনার সঙ্গে বেশি মিশব না। আপনি যে এত মেলামেশা করেন তার বিশেষ একটা উদ্দেশ্য আছে।”
মেয়েটির জীবনে কিছু প্রণয়-ঘটিত জটিলতা ছিল। আমি তা জানতাম।
তার কথার জবাবে আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, ‘উদ্দেশ্য? আমার তো ধারণা আমি নিষ্কাম।” •
সে বলেছিল, ‘নিষ্কাম ন৷ হাতি। আপনি আসেন গল্প লেখার তাগিদে।”
আমি তাকে বলেছিলাম, অমন কথা বোলো না। আমি আমার তাগিদেই আসি। তুমি তো জানো না, লেখকেরা যাদের ভালবাসে তাদের নিয়ে লিখতেও ভালবাসে। লেখাটা আবার ভালোবাসারই অঙ্গ।”
মেযেটি সঙ্গে সঙ্গে আমার কথা মেনে নেয় নি। তর্ক জুড়ে দিয়েছিল, “অমন বডাই করবেন না। আপনার বেশির ভাগ গল্পই প্রেমের গল্প তা জানি। তবু গল্পে উপন্যাসে আপনি যত মেয়ে পুরুষকে এনেছেন যত চরিত্রের সৃষ্টি করেছেন তার সবই কি আপনার ভালোবাসার জন”?
চট করে জবাব দিতে পারিনি। কিছুক্ষণ আমাকে নির্বাক থাকতে হয়েছিল। ভেবেছিলাম কথাটা হয়তো অসত্য নয়। সবাইকে সমান ভালোবাসতে পারিনি। আমার সৃষ্ট চরিত্রগুলির সকলের প্রতি সমান মনোযোগ দেওয়া হয়ে ওঠেনি। হয়তো ইচ্ছা ছিল না, হয়তো সে সাধ্যও ছিল না।
কিন্তু পিছন ফিরে তাকিয়ে বই না পড়ে নিজের গল্পগুলির কথা যতদূর মনে পড়ে আমি দেখতে পাই বিদ্বেষ,ব্যঙ্গ বিদ্রুপ, বৈরিতা আমাকে লেখায় প্রবৃত্ত করেনি। বরং বিপরীত দিকের প্রীতি, প্রেম, সৌহৃদ্য, স্নেহ, শ্রদ্ধা ভালোবাসা পারিবারিক গণ্ডীর ভিতরে ও বাইরে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিচিত্র সম্পর্ক একের সঙ্গে অন্যের মিলিত হবার দুর্বার আকাঙ্ক্ষা বারবার আমার গল্পের বিষয় হয়ে উঠেছে। তাতে পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। তা জেনেও আমি আমার সীমার বাইরে যেতে পারিনি।
অথচ জানি সংসারে অনাচার-অবিচার আর অত্যাচারের অভাব নেই। প্রেমের শক্তি যেমন শক্তি, প্রয়োজনবোধে ঘৃণা বিদ্বেষের শক্তিও তেমনি। বৃহত্তর প্রেম গভীরতর কল্যাণকে অবারিত করার জন্যে সেই শক্তিরও প্রয়োজন আছে। শুধু আলিঙ্গন নয়, দরকার হলে আঘাত করতেও জানা চাই, আঘাত করতেও পারা চাই। সেই পৌরুষ সেই বীর্যবত্ত মানুষের জীবনকে সমৃদ্ধ করে, লেখকের রচনার মধ্যে দীপ্তি এনে দেয়।
কিন্তু এই তত্ত্ব আমি জ্ঞান দিয়ে জানি বুদ্ধি দিয়ে জানি। একে হৃদয়রসে জারিত করে রসরূপ দিতে জানিনে।
নিজের স্বভাবকে দেখে নিয়ে, নিজের প্রবৃত্তি আর প্রবণতাকে স্বীকার করে আমি সারা জীবন শুধু ভালোবাসার গল্পই লিখেছি। যে ভালোবাস হয়তো সঙ্কীর্ণ অর্থে ভালোবাসা, সীমিত অর্থে ভালোবাসা, তবু ও ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু নয়।