একবার ভগবান কৃষ্ণ ভুলবশত সুদর্শন চক্রে তাঁর আঙুল কেটে ফেলেছিলেন। এটা দেখে রাজকন্যা দ্রৌপদী তার শাড়ি থেকে এক টুকরো কাপড় ছিঁড়ে রক্তপাত বন্ধ করার জন্য কৃষ্ণের আঙুলে বেঁধে দেন। সেই মহাভারতের যুগ থেকে ক্ষত স্থানে কাপড় কেটে জড়ানোর পদ্ধতি চালু আছে। সময়ের পরিবর্তনে ছেঁড়া কাপড়ের স্থানে আসে জীবাণুমুক্ত ছোট্ট-স্মার্ট একটি বৈপ্লবিক উদ্ভাবন। নাম তার ‘ব্যান্ড-এইড’। যদিও কলিযুগে ‘ব্যান্ড-এইড’ এর জন্ম হয়েছিল আর্ল ডিকসনের স্ত্রীর ক্ষত নিরাময়ের জন্য। কিভাবে? তবে বলি সেই কাহিনী।
বিশ শতকের গোড়ার কথা। আমেরিকার নিউজার্সিতে জোসেফিন নাইট (Josephine Frances Knight) আর আর্ল ডিকসনের (Earle Dickson) আনকোরা দাম্পত্য সংসারে হঠাৎ করেই ঘটে যায় অভূতপূর্ব এক আবিষ্কারের ঘটনা। বড়লোকের আদুরে কন্যা জোসেফিনকে কোনদিনই কুটোটা নেড়ে দেখতে হয়নি কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারে বিয়ে করে সংসার করায় এক প্রকার বাধ্য হয়েই কাজকর্মে হাত দিতে হয় জোসেফিনকে। ফলে ঘরকন্নার অভিজ্ঞতা না থাকার জন্য রান্নাবান্না করার সময় ছ্যাকা খাওয়া, কুটনো কাটতে গিয়ে হাত কেটে যাওয়ার ঘটনা হামেশাই ঘটতে থাকে। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এসে জোসেফিনের এহেন দশা দেখে আর্লকে পড়তে হতো মহা ফ্যাসাদে। আহত হাতকে ওষুধ-ন্যাকড়া-তুলো দিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে স্ত্রীর শুশ্রশা করতো স্বামী। কিন্তু তাতেই বা সমাধান হলো কই! তাড়াহুড়ো করে কাজ করতে গিয়ে ওষুধ গজের পট্টি খুলে ক্ষত স্থানে তেলমশলা লেগে ইনফেকশন হতে শুরু করল।
সেই সময়ে ডিকসন নিউ ব্রান্সউইক, নিউ জার্সির একজন তুলাক্রেতা হিসেবে জনসন অ্যান্ড জনসনের হয়ে কাজ করছিলেন। আদুরে বউকে কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে জনসন অ্যান্ড জনসন কোম্পানির গজ ও টেপ ব্যবহার করে ব্যান্ডেজ তৈরি করে স্ত্রীর ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিলেন ডিকশন। সেই আমলে এমন চটজলদি ব্যান্ডেজ করার উপকরণ পাওয়া যেত না। কিন্তু তাতেও খুব একটা সুরাহা হলোনা।আঙ্গুলের মত ছোট অঙ্গ প্রত্যহিক কাজে বহুল ব্যবহৃত হয়ে ব্যান্ডেজ দীর্ঘস্থায়ী হতো না। আর এগুলো বেঁধে রাখা হয়ে গেছিল কষ্টসাধ্য, ফলে জোসেফিনের আঙ্গুল প্রায়ই তাকে যন্ত্রণায় ভোগাতো।
এই অবস্থায় স্ত্রী সমস্যার সমাধানের জন্য বুদ্ধি খাটিয়ে এক অভিনব পন্থা বের করলেন ডিকশন। কোম্পানির কারখানায় সহজে পাওয়া যায় অ্যান্টিসেপ্টিক তুলো দিয়ে তৈরী গজ আর টেপ। সেই টেপের ১৮ ইঞ্চি পট্টি কেটে নিয়ে তার ঠিক মাঝখানে আড়াই ইঞ্চি চওড়া গজ কোমলভাবে আটকে দিলেন স্ত্রীর আঙ্গুলে। তার উপর দিলেন ক্রিনোলিনের প্রলেপ। এতে অনেকটাই নিরাময় হল জোসেফিনের ক্ষত। এই প্রয়োজনই জন্ম দিলো BAND-AID এর।
স্ত্রীর মুশকিল আসান হতেই, এই কনসেপটির কথা কোম্পানী আরেক সহকর্মী বন্ধুর কাছে প্রকাশ করলেন আর্ল। সালটা ছিল ১৯২১। বন্ধুর পরামর্শের দুরুদুরু বক্ষে বড়কর্তা জেমস জনসনের কাছে তার এই অভূতপূর্ব আবিষ্কারের বিষয়টি বললেন তরুণ আবিষ্কারক। বুদ্ধিটি সঙ্গে সঙ্গে লুফে নিলেন বড়কর্তা। আর সিদ্ধান্ত নিলেন নতুন ধরনের এই পণ্যটিকে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করার। ছোটখাটো ক্ষতকে চটজলদি সুরক্ষা দিতে বাজারে এলো এক অভিনব ছোট ব্যান্ডেজ, নাম দেওয়া হলো ‘ব্যান্ড- এইড’।
১৯২০ সাল পর্যন্ত আমেরিকানরা ক্ষত পরিচর্যার ক্ষেত্রে ঘরের চারপাশে থাকা জিনিসপত্র বা গজ দিয়ে মুড়িয়ে কাজ চালাত। কিন্তু লুই পাস্তুরের জীবাণু তত্ত্বের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতার পর সকলের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেল। তারা বুঝতে পারলো অ-জীবাণুমুক্ত ক্ষত চিকিত্সা করতে না পারলে তা হবে সংক্রমণের কারণ।
সেই সময় জনসন অ্যান্ড জনসন অন্যান্য গাইডের পাশাপাশি পাঠকদের কীভাবে তাদের শরীরের যত্ন নিতে হয় তা শেখানোর জন্য একটি ম্যানুয়াল প্রকাশ করে। তারা ঘোষণা করে, “জরুরী অবস্থার জন্য ব্যান্ডেজ এবং কাপড়ের একটি স্টক প্রতিটি বাড়িতে সর্বদা হাতের কাছে রাখা উচিত,”। ব্যান্ডেডের আবিষ্কার এই পরিস্থিতিতে উপযুক্ত হয়ে ওঠে।
যদিও প্রথমের দিকে ব্যান্ডেডের মত কাজের সামগ্রীটিকে পরিচিত করে তুলতে বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল জনসন অ্যান্ড জনসনকে। তবে একটি মজার কৌশল বেছে নেন প্রতিষ্ঠানটি। অজস্র বিজ্ঞাপন, বাড়ি বাড়ি ঘুরে ব্যান্ডেডের বিনাপয়সায় প্রোডাক্ট ও ডেমো দেখান কোম্পানি এবং অবশেষে
১৯২৪ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বয় স্কাউটদের বিনামূল্যে ব্যান্ডেডের বিতরণ করে জনসন। এছাড়া শিশু-কিশোরদের স্বাস্থ্যসুরক্ষা এবং আগ্রহের জন্য মিকি মাউস, ডোনাল্ড ডাক, সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান, ব্যাটম্যান, বার্বি ইত্যাদি জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্রের থিম নিয়ে তৈরি করা হলো নানান ডিজাইনের ব্যান্ড-এইড।
আর এরই সঙ্গে বাড়তে থাকে ব্যান্ডেডের জনপ্রিয়তা। একই ধারাবাহিকতায় ১৯৩৯ সালে বাজারে আসে মেশিনে তৈরি জীবাণুমুক্ত ব্যান্ডেড। ১৯৫৮ সাল থেকে ব্যান্ডেড তৈরিতে ভিনাইল টেপের ব্যবহার শুরু হয়।
ব্যান্ডেডের আবিষ্কার চিকিৎসা সুরক্ষা সরঞ্জামের দুনিয়ায় পহেলা নম্বরে নিয়ে আসে জনসন এন্ড জনসনকে। আর্ল ডিকসনও এর যথাযথ পুরস্কার পেয়েছিলেন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। অবসর নেওয়ার সময় অব্দি তিনি ছিলেন কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ১৯৬১ তে প্রয়াণকাল পর্যন্ত পরিচালক বোর্ডের সম্মানিত সদস্য।
দামের তুলনায় তো বটেই আকার আকৃতিতে ছোট এই অতি প্রয়োজনীয় জিনিসটি জোসেফিনের বাড়ির চৌকাঠ ডিঙিয়ে সারা বিশ্বের মানুষের কাটাছেঁড়ার দাওয়াই হয়ে উঠলো। হয়ে উঠল বিশ্বের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক ব্রান্ডগুলির মধ্যে একটি।
অজানা বিষয় জানলাম
Dhonyobad 🌹
বাঃ ! বেশ ভালো লাগল।
ধন্যবাদ