নাভি গয়া ক্ষেত্র : নৈমিষারণ্যের আরেক নাম নাভি গয়া ক্ষেত্র। কথিত আছে, মহাবিষ্ণু গয়াসুর রাক্ষসকে বধ করেছিলেন এবং তার দেহ তিন ভাগ ভাগ করে। মাথার অংশটি বদ্রীনাথে পড়েছিল যাকে কাপালি গয়াও বলা হয়, পায়ের অংশটি গয়াতে অনুভূত হয় তাই একে পাদ গয়াও বলা হয় এবং মধ্যবর্তী অংশটি নৈমিষারণ্যে পড়েছিল তাই একে বলা হয় নাভি গয়া।
পাণ্ডব কিলা ও হনুমানগড় বা গদ্দি : এই অঞ্চলের সবচেয়ে উঁচু জায়গায় অবস্থিত হনুমানগড় হল একটি হনুমান মন্দির। বিশ্বাস করা হয় এখানে হনুমান স্বয়ম্ভু ।লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, হনুমানের কাঁধে বসে রয়েছে ছোট ছোট মূর্তি রাম এবং লক্ষ্মণের। বিশ্বাস করা হয় যে, রাম-রাবণ এর যুদ্ধের সময় যখন রাম ও লক্ষ্মণকে বন্দী করে পাতাল লোকে নিয়ে যাওয়া হয় , তখন হনুমানই তাদের ফিরিয়ে আনেন। তিনি যে জায়গা থেকে বেরিয়েছিলেন সেখানেই এই মন্দির স্থাপিত বলে ধারণা করা হয়। আবার কারো মতে, মহিরাবনকে বধ করে রাম-লক্ষণ কে কাঁধে নিয়ে হনুমান এখানেই প্রথম বিশ্রাম নেন।
মন্দিরে যে হনুমান ১৮ ফুটের যে বিশাল মূর্তিটি আছে তা বহু প্রাচীন এবং দীর্ঘকাল ধরে পূজা করা হচ্ছে । মন্দিরের বাকি অংশটি সাম্প্রতিক নির্মাণ। মন্দিরের চাতালে দাঁড়ালে বনময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও গোমতী নদীর সরু জলরেখা চোখে পড়ে।
হনুমানগড়ের কাছে পাণ্ডব ও কৃষ্ণের বিশালাকায় ছবি-সহ একটি ছোট মন্দির আছে। একে পাণ্ডব কিলা বা দুর্গ বলা হয়।
এর থেকে খুব বেশি দূরে নয় দক্ষিণ ভারতীয় শৈলীতে নির্মিত একটি মন্দির আছে, যেখানে একটি সোনার স্তম্ভ রয়েছে। স্তম্ভটিতে বিষ্ণুর বাহন গরুড় খোদাই করা হয়েছে এবং তার সঙ্গে শঙ্খ শেল এবং চক্রও রয়েছে।
চক্রতীর্থ থেকে কিছুটা এগিয়ে সতীপীঠ ললিতা দেবীর মন্দির। একই ভবনের মধ্যে দুটি মন্দির রয়েছে যা ‘ললিতামাইয়া’র নিকট উৎসর্গিত। প্রচুর ভক্তের সমাগম ঘটে এই মন্দিরে।
অপেক্ষাকৃত একটি নতুন মন্দির আছে যেখানে মায়ের নতুন মূর্তি একটি উঁচু চত্বরে বসানো আছে। বাইরে ত্রিভুজাকার যজ্ঞকুন্ড দেখতে পাবেন। এবং এরপরে আপনি যখন ছোট মন্দিরের সামনে আসেন দেখবেন এই প্রাচীন মন্দিরে শ্রী ললিতার পুরনো মূর্তি রয়েছে। এখানেই তার রূপ ললিতা সহস্রনামে দেবীর বর্ণনার সাথে মিলে যায়।
শ্রী ললিতা দেবীর মন্দির একটি শক্তিপীঠ। বিশ্বাস করা হয় যে দক্ষ যজ্ঞের পর শিব তান্ডবে দেবী সতীর হৃদয় এখানে পড়েছিল। এখানে তাকে লিঙ্গ-ধারিণী শক্তিও বলা হয়। শ্রী ললিতা দেবী নৈমিষারণ্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী এবং স্থানীয়দের কাছে তিনি মায়ের মতন। তাই তাঁকে শ্রদ্ধা জানানো ছাড়া আপনার যাত্রা সম্পূর্ণ হবে না। ললিতামাইয়ার মন্দিরে অখন্ড জ্যোতি জ্বলছে।
আরেকটি কিংবদন্তী বলে যে ঋষিরা যখন বিষ্ণুর চক্র নিয়ে আসেন, তখন চক্র পৃথিবীর ভিতরে চলে যায় এবং খুব বেশি জল বেরিয়ে আসে। শ্রী ললিতাই জল নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন যাতে ঋষিরা শান্তিতে ধ্যান করতে পারেন।
চক্রতীর্থ থেকে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কিছুটা এগোলেই পরে ব্যাসগদ্দি। এখানেই ব্যাসদেব বসবাসকালে বেদ বিভাজন করেন।
একটি দৈত্যাকার বটবৃক্ষের নীচে বেদব্যাস বসে সেই ধর্মগ্রন্থগুলি বর্ণনা করেছিলেন যা আমরা এখন বেদ, পুরাণ, শাস্ত্র ইত্যাদি নামে জানি। পুরানো গাছগুলির মধ্যে একটি ৫০০০ বছরেরও বেশি পুরানো বলে মনে করা হয় এটি মহাভারত যুগের বা বেদ ব্যাসের বসবাসের সময়। এই গাছটিই আসলে ব্যাস গদ্দি। গাছটি আধুনিক মন্দির দ্বারা বেষ্টিত যার মধ্যে একবার গদ্দির মতো আসন রয়েছে।
বেদ ব্যাসকে নিবেদিত একটি ছোট মন্দির রয়েছে। ব্যাস দেবের পিতা পরাশর এবং তাঁর পুত্র শুকদেবের সঙ্গে ছাড়াও তাঁর আলাদাভাবে পুজো হচ্ছে ধুতি চাদর দিয়ে। এখানে লাগানো একাধিক বোর্ড আপনাকে এই স্থানের লেখা ধর্মগ্রন্থর কথা বলবে।
সত্যনারায়ণ স্বামীকে উৎসর্গ করা একটি মন্দির আছে যা ব্যাসগদ্দির কাছেই অবস্থিত।
কাছেই আছে মনুর মন্দির। এখানেই শতরূপা সহ মনু পুত্র কামনায় যজ্ঞ করেছিলেন। ধারণা করা হয়, এখানেই মনু সংহিতা রচিত হয়েছিলো।
চক্র নারায়ণ মন্দির : চক্রতীর্থ বা নৈমিষারণ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্দির। ভগবান বিষ্ণু এখানে চক্র রূপে বিরাজমান। পদ্মফুলের উপর বসে থাকা বিষ্ণু তার চক্র বা চাকার মধ্যে আবদ্ধ। দেয়ালে খোদাই করা একটি কালো পাথরের একটি সুন্দর মূর্তি, যার চারপাশে তুলনামূলকভাবে নতুন কিছু মুর্তি দিয়ে সুন্দরভাবে সজ্জিত করা আছে।
মন্দিরটি বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন শাসকদের অবদানের সাথে উল্লেখযোগ্য প্রাচীনত্বের নিদর্শন বলে মনে করা হয়। এটিকে বিষ্ণুর আটটি মন্দিরের মধ্যে একটি হিসাবে গণনা করা হয় যা স্বয়ং উদ্ভাসিত এবং স্বয়ংব্যক্ত ক্ষেত্র হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত মন্দির খোলা থাকে।
আদি গঙ্গা বা গোমতী নদী : গোমতী নদী যা আদি গঙ্গা নামেও পরিচিত, নৈমিষারণ্যের কাছাকাছি প্রবাহিত হয়। অনুমান করা হয়, যে নদীর গতিপথ সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। নদীর ধারে আরও একটি পুরানো বটগাছ আছে এবং কথিত আছে ঋষিরা এখানে বসে ধর্মগ্রন্থ বলতেন।
নদীর মাঝখানে একটি ছোট দ্বীপ দাঁড়িয়ে আছে এবং স্থানীয়রা মনে করেন সেই দ্বীপে একটি মন্দির ছিল। বন্যার সময় এই মন্দিরের অবলুপ্তি ঘটে।
এখানে আছে আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম ও অতিথিশালা। আনন্দময়ী মা কে নৈমিষারণ্যের জননী বলা হয়। স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধীও তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন। তিনি পুরোনো মন্দিরগুলোর সংস্কার সাধন ও প্রচারের দ্বারা নৈমিষারণ্যেকে পুনরুজ্জীবিত করেন। চন্দনকাঠের আলমারিতে রাখা আছে বেদ, অষ্টাদশ পুরাণ, উপ-পুরাণ ইত্যাদি খুব প্রাচীন ও পরে সংগৃহিত সিল্কের কাপড়ে মোড়া পুঁথি।
আশ্রমের মধ্যে অজস্র পাখি, বাঁদর, ময়ূর ঘুরে বেরাচ্ছে। ময়ূরের সংখ্যা এখন কমে গেছে তবে বর্ষার সময় এলে পেখম তুলে নৃত্য ও কেকা ধ্বনি শোনা যায়। মন্দিরের বিপরীতে মায়ের থাকার ঘর। এখানে রয়েছে একটি শিব মন্দির।
চক্রতীর্থ থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত তীর্থের অন্যতম আকর্ষণ দধীচি কুন্ড। ঋষি দধীচীর কাহিনী হল পরম ত্যাগের। দেবগণের রাজা ইন্দ্রকে একবার বৃত্র নামক অসুর দ্বারা দেবলোক থেকে বিতাড়িত হন। বৃত্র-র একটি বর আছে যে তাকে বিদ্যমান যে কোনো ধাতু বা কাঠের তৈরি কোনো অস্ত্র দ্বারা হত্যা করা যাবে না। তার ফলে তাকে হত্যা করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। নিরুপায় হয়ে তখন ইন্দ্র বিষ্ণুর কাছে গেলেন। ভগবান বিষ্ণু তখন তাকে দধীচি ঋষির হাড়গুলি নিয়ে তাদের থেকে একটি অস্ত্র তৈরি করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
ইন্দ্র নৈমিষারণ্যে দধীচি ঋষির কাছে গেলেন এবং দেবতাদের দুঃখের কথা শুনে তিনি তার অস্থি দান করতে রাজি হলেন। তবে, তিনি দেহ ত্যাগের পূর্বে সারা দেশের সমস্ত পবিত্র জলে স্নান করতে চেয়েছিলেন। ইন্দ্র তখন পবিত্র নদীগুলির সমস্ত জল নৈমিষারণ্যের কাছে একত্রিত করেন, যার ফলে ঋষি আরও সময় নষ্ট না করে তাঁর ইচ্ছা পূরণ করেন। দধীচি তখন যোগের শিল্প দ্বারা তাঁর জীবন ত্যাগ করেছিলেন বলে কথিত আছে যার পরে দেবতারা তার মেরুদণ্ড থেকে বজ্র তৈরি করেছিলেন। এই অস্ত্রটি তখন অসুরকে পরাজিত করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল, যার ফলে ইন্দ্র দেবলোকের রাজা হিসাবে তার স্থান পুনরুদ্ধার করতে পেরেছিলেন। কুন্ডটি বড় এবং সুন্দর এবং এর চারপাশে ঘাট বাঁধানো রয়েছে।
সাধারণত তীর্থযাত্রীগণ লখনউ বা সীতাপুর থেকে এক-দু দিনের ভ্রমণের জন্য এখানে আসে। এই মুহূর্তে নৈমিষারণ্যে থাকা/খাওয়ার জন্য প্রাচুর্যতা না থাকলেও, ব্যবস্থা রাখা আছে। নৈমিষারণ্যে একটি ট্রাভেলার্স বাংলো আছে। এখানে অবস্থিত কিছু ধর্মীয় ট্রাস্ট তীর্থযাত্রীদের আশ্রয় দিচ্ছে। শ্রী বালাজি মন্দিরে ডরমেটরি সুবিধা পাওয়া যায়। তারা পর্যটকদের অন্নদান ও করেন। নৈমিষারণ্য এখন তীর্থস্থানের একটি ব্যস্ত স্থান যা লক্ষাধিক তীর্থযাত্রীকে আকর্ষণ করে। কথিত আছে যে, নৈমিষারণ্যের দর্শন ছাড়া বদ্রীনাথ ও কেদারনাথের তীর্থযাত্রা অসম্পূর্ণ।
নৈমিষারণ্য ভারতীয় আধ্যাত্মিক তীর্থের প্রাণকেন্দ্র। তীর্থ মানুষের মনকে নির্মল, উদার, আনন্দময় করে তোলে। তীর্থে ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ দর্শন না পেলেও, তাঁকে স্মরণ করা যায়। ভিন্ন প্রদেশের মানুষের সঙ্গে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ মেলে। তীর্থযাত্রীদের উপর নির্ভরশীল স্থানগুলোর আর্থিক সহায়তা ঘটে।।
খুবই ভালো লাগার মত প্রতিবেদন। অপরুপ ছবিগুলো, অনেক অজানা কাহিনী জানতে পারলাম, সব মিলিয়ে দারুন!! 👌
ধন্যবাদ জানাই আপনাকে🌹
সুন্দর বর্ননা। আপ্লুত
ধন্যবাদ🌹
খুবই ভালো লাগলো। অপূর্ব সুন্দর সব ছবি। দারুন।
ধন্যবাদ জানাই🌹