তাঁর গান শুনে এতদিন আনন্দ পেয়েছি। কিন্তু তিনি যে এত সুন্দর, সাবলীল ভাবে বলেন, শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখেন তা প্রথম জানার সুযোগ হল শুক্রবার সন্ধ্যায়। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ২৫ তম প্রয়াণ দিবসে প্রথম কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় স্মারক বক্তৃতা দিলেন তিনি বাংলা আকাদেমি সভাঘরে। রেজওয়ানার অন্তরঙ্গ স্মৃতিচারণা শোনার অভিজ্ঞতা অবিস্মরণীয় হয়ে মনের গভীরে রয়ে যাবে।
রেজওয়ানা বলছিলেন, কণিকার গান তিনি প্রথম শোনেন ছোটবেলায় বিগত শতকের ষাটের দশকে। তখন তো পূর্ব পাকিস্তান। তাঁর বাবা কলকাতা থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে যেতেন রবীন্দ্র সঙ্গীতের সব রেকর্ড। বাড়িতে গ্রামোফোনে কণিকা, সুচিত্রা, হেমন্ত, কে এল সায়গলের গান শোনার রেওয়াজ ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পরের বছরেই কণিকা যখন ঢাকায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে গেলেন, তখন সামনে থেকে তাঁর গান শোনার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন রেজওয়ানা। তার কয়েক বছর বাদেই তাঁর জীবনে এল এক বিরাট সুযোগ। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব কালচারাল রিলেশনসের (আই সি সি আর) স্কলারশিপ নিয়ে ১৯৭৫ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে পড়তে এলেন বি মিউজ। তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন আর এক ছাত্রী শামীমা পারভিন। কণিকা তখন সঙ্গীতভবনে বিভাগীয় প্রধান। রেজওয়ানা আর শামীমা কণিকার অফিস ঘরের সামনে বসে আছেন। দেখেন, কণিকা আসছেন। পরনে হালকা গোলাপী ফুল ছাপ শাড়ি, হাতে একটা বটুয়া, মুখে পান। বাইরে জুতো খুলে খালি পায়ে ঘরে ঢুকলেন। অফিসের কোন কর্মীর কাছে যখন শুনলেন বাংলাদেশের দুটি ছাত্রী সঙ্গীতভবনে ভর্তি হয়ে দেখা করতে এসেছে, তখনই তাদের ডেকে পাঠালেন। রেজওয়ানা বলছিলেন, বাংলাদেশের দুই ছাত্রীকে দেখে কণিকা খুব খুশি। বলে দিলেন, কোন অসুবিধে হলেই বলবে আমার কাছে এসে। ছাত্রীদের পরম নিষ্ঠা ও স্নেহের সঙ্গে গান শেখাতেন। একটা গান নিজে অনেকবার গাইতেন। তারপর ছাত্রীদের বলতেন, এবারে তোমরা গাও। সুর না লাগলে বা গায়কী ঠিক না হলেও কখনও কোন ছাত্রীকে বলতেন না, তোমার গাওয়া ঠিক হয়নি। বরং আবার নিজে গেয়ে ছাত্রীদের গাইতে বলতেন। এভাবেই ছাত্রীরা নিজেদের ভুল শুধরে নেওয়ার সুযোগ পেত।
রেজওয়ানা শান্তিনিকেতনে পড়তে আসার বছর দুই-তিনেকের মধ্যেই ঘটল এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা। বাংলাদেশের আর এক ছাত্রী নাসরিন ছিলেন রেজওয়ানার কিছু সিনিয়র। বিশ্বভারতীর এক ছাত্রের সঙ্গে হঠাৎ একদিন নাসরিন চম্পট দিলেন। চারিদিকে হৈ চৈ পড়ে গেল। কণিকার তো তখন প্রচন্ড উদ্বেগ। তিনি তখন সঙ্গীতভবনের অধ্যক্ষা। সব দায়িত্ব তাঁর ওপরেই। তিনি তো হস্টেলে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। কিন্তু অন্য ছাত্র-ছাত্রীরা এই ঘটনা সম্পর্কে আগে থেকে কিছুই জানত না। পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছিল সঙ্গে সঙ্গে। কণিকার মতো শান্ত মানুষও এই ঘটনায় প্রচন্ড ক্ষুব্ধ। অবশেষে পুলিশ সেই যুগলকে উদ্ধার করে আনল সিউড়ি থেকে। তারা সেখানে বিয়ে করেছে। তাদের নিয়ে আসা হয়েছে সঙ্গীতভবনে অধ্যক্ষার অফিসের সামনে। খবর গেছে কণিকার কাছে। তিনি তো আগে প্রচন্ড রেগে ছিলেন ছেলেমেয়ে দুটির ওপরে। কিন্তু রিকশা করে আসার সময় সঙ্গে নিয়ে এসেছেন এক হাঁড়ি রসগোল্লা। বিয়ে যখন হয়েছে তখন তাদের মিষ্টি মুখ না করালে চলে! শুধু এক সঙ্গীতশিল্পী বা শিক্ষাগুরু নন, কণিকার মানবিক বৈশিষ্ট্যও এই বিবরণের মাধ্যমে তুলে ধরলেন রেজওয়ানা।
প্রেমে তো কণিকাও পড়েছিলেন। তবে কিশোরী বয়সের সেই প্রেম পূর্ণতা পায়নি। সেই অব্যক্ত কাহিনীও শোনালেন রেজওয়ানা। পাকিস্তানি ছাত্র আব্দুল আহাদ পড়তে এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে। সঙ্গীতভবনেই কণিকার সঙ্গে আলাপ ও প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কালোবাড়ির সামনে তাঁরা গল্প করতেন। শান্তিনিকেতনের আনাচে কানাচে দুজনের দেখা হত। সেই খবর পৌঁছুল রথীন্দ্রনাথের কানে। তিনি আহাদকে শান্তিনিকেতন থেকে রাস্টিকেট করা বা বিতাড়নের সিদ্ধান্ত নিলেন। আহাদ জানালেন কণিকাকে, তাঁকে পরদিনই চলে যেতে হচ্ছে। তিনি কণিকাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলেন। কণিকা অত্যন্ত ব্যথিত হলেন শুনে। চোখের জল ফেললেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গেলেন না। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, এমন ঘটনা ঘটলে তাঁর বাবা-মা চরম অসম্মানের সম্মুখীন হবেন। ভবিষ্যতে বোনেদের বিয়ে দেওয়া দুষ্কর হবে। ওই অল্প বয়সে তিনি পরিবারের কথা চিন্তা করে স্বার্থত্যাগ করেছিলেন। রেজওয়ানা বলছিলেন, তখন আহাদ ভাইয়ের সঙ্গে পাকিস্তানে গেলে কণিকা আর কণিকা হয়ে উঠতে পারতেন না। তিনি বলছিলেন, অনেক বছর বাদে কলকাতায় আকাশবাণীতে কণিকার গানের রেকর্ডিং ছিল। তিনি তখন ছিলেন শুভ গুহঠাকুরতাদের বাড়িতে। আহাদ সেই সময়ে ইতালি থেকে কলকাতা হয়ে দেশে ফিরছিলেন। কণিকা কলকাতায় আছেন জানতে পেরে দেখা করতে চেয়েছিলেন। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল চত্বরে দুজনের দেখা হয়। দু’জনেরই জীবন আলাদা ছন্দে এগিয়ে চলেছে। আহাদ তখন ঢাকা রেডিওতে কর্মরত। এত বছরের জমে থাকা অনেক কথা হয় দু’জনের মধ্যে। আহাদ ইতালি থেকে কণিকার জন্যে নিয়ে এসেছিলেন চুলের কাঁটা। কণিকা সেই উপহার পেয়েই খোঁপায় গোঁজেন। কিন্তু বাসে বাড়ি ফেরার সময় নেমে দেখেন সেই কাঁটা কখন অজান্তে খসে পড়ে গেছে।
রেজওয়ানা তাঁর ভাষণে মানুষ হিসেবে কণিকার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে তুলে ধরেন। বিশ্বভারতীর পাঠ সাফল্যের সঙ্গে শেষ করে রেজওয়ানা ঢাকায় ফিরে যান। তারপরে লন্ডনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে কণিকার সঙ্গে তাঁর আবার দেখা হয়। দুজনেরই গান ছিল এক মঞ্চে। কণিকার সঙ্গে গিয়েছিলেন গোরা সর্বাধিকারি। তিনি কণিকাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারছেন না। কিন্তু তাঁর একটু লন্ডন ঘোরার ইচ্ছে। তিনি রেজওয়ানাদের বললেন, তোরা একটু দিদির সঙ্গে থাকিস। সেই সময়েই ব্যক্তিগত ভাবে কণিকার অন্তরঙ্গ সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পান রেজওয়ানা। বিগত শতকের নব্বইয়ের দশকে তিনি আবার শান্তিনিকেতনে আসেন কণিকার কাছে নিবিড় অনুশীলনের জন্যে। তখনই মানুষ হিসেবে কণিকাকে কাছে থেকে দেখার, জানার সুযোগ পান রেজওয়ানা। বারে বারেই নানা ঘটনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলছিলেন, কণিকার শিক্ষা ছিল, ভালো গায়িকা হলেই শুধু হবে না, প্রথমে একজন ভালো মানুষ হতে হবে। রেজওয়ানা বলেন, সেই শিক্ষাই পাথেয় করে এগিয়ে চলেছি।
কলকাতায় শৈলজারঞ্জনের সঙ্গে কণিকার শেষ সাক্ষাৎকারের সাক্ষী ছিলেন রেজওয়ানা। সেই গল্পও আমরা শুনতে পেলাম। শিক্ষক ও ছাত্রীর দীর্ঘ মান-অভিমানের পালা চলার পর ও অনেক কথাবার্তার শেষে কণিকা যখন উঠে আসছেন তখন শৈলজারঞ্জন তাঁকে বলেন, ‘এতদিন তোমাকে বলিনি, তুমি সত্যিই ভালো গাইতে পার। তোমার গলা পাখির মতো।’ এই কথা শোনার পরে কণিকা অত্যন্ত আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। দু’চোখ বেয়ে নেমে আসে অশ্রুধারা। বলেন, সারা জীবন এই কথাটুকু শোনার জন্যে অপেক্ষায় থেকেছি। রেজওয়ানা বলছিলেন, অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলতেন, ‘মোহরের গলার সাথে এস্রাজের সুর বাঁধা যায়।’ এমনই মিষ্টি, কোকিল কন্ঠী ছিলেন কণিকা। ছাত্রীরা তাঁর কণ্ঠের অনুকরণ করার চেষ্টা করলে তিনি বলতেন, উচ্চারণ আর সুর নির্ভুল কর। কিন্তু তোমার নিজের কণ্ঠের স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে আর কাউকে অনুকরণ করো না। কণিকার নির্দেশ ও প্রেরণাতেই রেজওয়ানা বাংলাদেশে গড়ে তুলেছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষা কেন্দ্র ‘সুরের ধারা’।
অনুষ্ঠানে সভামুখ্য ছিলেন বিশিষ্ট চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ যিনি কণিকার ওপর নির্মাণ করেছেন একটি তথ্যচিত্র ‘মোহর’। রবীন্দ্রনাথের ‘সভ্যতার সংকট’ নিবন্ধের উল্লেখ করে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক হিংসা ও অসহিষ্ণুতার পরিবেশে আজ যদি কবি জীবিত থাকতেন তাহলে হয়ত তিনি লিখতেন, ‘সভ্যতার আত্মসংহার’। তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথের আদর্শ আমরা গ্রহণ করতে পারিনি। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা রবীন্দ্র-চেতনার প্রসার ঘটাতে পারেনি সমাজের সর্বস্তরে। তাঁর আশা, প্রজন্মান্তরেও রবীন্দ্রনাথের গানের আকর্ষণ স্থায়ী হবে।
অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিল কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় মেমোরিয়াল ট্রাস্ট। সংগঠনের তরফে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা, শান্তিনিকেতনের ‘আনন্দধারা’ বাড়িতে কণিকা আর্কাইভ গড়ে তোলার কথা জানালেন কণিকার বোনের ছেলে প্রিয়ম মুখোপাধ্যায়। ঋতপা ভট্টাচার্যের কণ্ঠে উদ্বোধনী সঙ্গীতে ছিল অনবদ্য উপস্থাপনা — ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ’। সৌমিত্র মিত্রের কণ্ঠে ছিল রবীন্দ্র কবিতার মননশীল আবৃত্তি। অনুষ্ঠান শেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন সংগঠনের সেক্রেটারি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের বিশিষ্ট অধ্যাপক সৈকত সিংহ রায়।
অনুলিখন : দীপঙ্কর দাশগুপ্ত, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ২৫তম মৃত্যু বার্ষিকী স্মরণে বাংলা অ্যাকাদেমি সভাঘরে। ৫ এপ্রিল ২০২৪
পেজ ফোর নিউস কে অনেক ধন্যবাদ জানাই 🥰💐🙏