প্রধানমন্ত্রী ত্রাণ তহবিলের এক বিরাট অনুষ্ঠান চলছে কলকাতায়। সেখানে ধনঞ্জয়ের সঙ্গে বাংলার সব নামিদামি শিল্পীরাই থাকবেন। ‘প্রধানমন্ত্রীর চিঠি না পেলে আমি গাইতে যাব না’ — সটান বলে দিলে উদ্যোক্তাদের।
তখন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর পপুলারিটি মধ্যগগণে। তিনি শর্ত দিয়ে বসলেন, অনুষ্ঠান যখন প্রধানমন্ত্রীর নামে তাকে অনুরোধ করে চিঠি পাঠাতে হবে। উদ্যোক্তাদের মাথায় হাত। প্রধানমন্ত্রীর জহরলাল নেহেরুর চিঠি কোথায় পাওয়া যাবে?
খবর গেল মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের কাছে। তিনিও ধনঞ্জয়ের গানের ভক্ত। দেখা হলেই বলতেন, “তোমার গয়া গঙ্গা প্রভাসাদী কাশী কাঞ্চি কে বা চায়, কালী কালী কালী বলে” গানটা গাওতো। শেষ জীবনে বিধানচন্দ্র ধনঞ্জয়ের গান শুনতে চেয়েছিলেন, তাই ডেকে পাঠিয়েছিলেন তার বাড়িতে। ছেলের টাইফয়েডের জন্য, অসুস্থ ছেলেকে ফেলে তিনি যেতে পারিনি। অদ্ভুত ব্যাপার তারপরেই বিধানচন্দ্র রায় মারা যান ‘৬১ সালে। সেই শোক সারা জীবন তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছিলো।
যাইহোক, ধনঞ্জয় প্রধানমন্ত্রী চিঠি চেয়েছেন শুনে বিধান রায় বলেছিলেন, ‘এই ছেলের গার্ডস আছে। বাঙালির এই চরিত্রটির বড়ই অভাব। ওকে বলো গান গাইতে, আমি জহরলালের চিঠি পাঠিয়ে দেবো।’ হয়েছিলও তাই, কথা রেখেছিলেন বিধান চন্দ্র রায়। সেই অনুষ্ঠানে গানও গিয়েছিলেন ধনঞ্জয়।
জেদ, শক্তপোক্ত শিরদাঁড়া আর সম্মানবোধ জীবন জুড়ে ছিল ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের। আজীবন তার গানের মতোই সযত্নে বয়ে বেরিয়েছেন।
ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের জন্ম বৃটিশ ভারতের অধুনা পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার বালির বারেন্দ্র পাড়ায় ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১০ সেপ্টেম্বর। এনারা হলেন বারেন্দ্র ভাদুড়ি বংশের লোক, ধর্মে শাক্ত কিন্তু মন্ত্রে বৈষ্ণব। প্রায় ৫০০ বছর আগে বংশধরেরা রাজশাহী থেকে নবদ্বীপ হয়ে পায়রাটুঙ্গি গ্রামে আসেন। ধনঞ্জয়রা ছিলেন আদপে ভাদুড়ী, পৌরহিত্য করার জন্য উপাধি হয় ভট্টাচার্য। ঠাকুরদা যোগাচার্য নগেন্দ্রনাথ ভাদুড়ি নিজে গান লিখতেন, সুর দিতেন। তাঁর লেখা গানের বই ও আছে। তিনি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করেন। তার গান শুনে পরমহংস তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন।
পিতা সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, মাতা অন্নপূর্ণা দেবীর অষ্টম গর্ভের সন্তান ধনঞ্জয়। অন্নপূর্ণা দেবী অসাধারন গান গাইতেন। তাঁর এই শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রভাব ধনঞ্জয়ের জীবনে গভীরভাবে ছাপ ফেলেছিল। পরিবারটির ধ্যান জ্ঞান ছিল শাস্ত্র, সংগীত আর লেখালেখি। ধনঞ্জয় পড়াশোনা করেছেন বালির রিভার্স টম্পসন স্কুলে। সঙ্গীতের তালিম নেন গোকুল নাগ, পণ্ডিত সত্যেন ঘোষাল প্রমুখের কাছে। তার ছোট ভাই পান্নালাল ভট্টাচার্য ছিলেন শ্যামাসঙ্গীতের এক প্রবাদপ্রতিম কণ্ঠশিল্পী।
ধনঞ্জয়ের স্কুলবেলার এক ঘটনা বলি। রিভার্স টম্পসন স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে গান গাইলেন ধনঞ্জয় — ‘পাগলা মনটারে তুই বাঁধ’, ‘ভাইয়ের দোরে ভাই কেঁদে যায়’। উত্তরপাড়ার রাজবাড়িতে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শরৎচন্দ্র। ধনঞ্জয় গান শুনে আপ্লুত শরৎচন্দ্র অনুষ্ঠানের শেষে ছুটে এলেন তার কাছে, আশীর্বাদ করে পুরস্কারস্বরূপ তুলে দিয়েছিলেন ৫ টাকার একটি নোট। এই নোটটি সারা জীবন সঙ্গে রেখেছিলেন ধনঞ্জয়, জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার হিসেবে।
আধুনিক বাংলা ও হিন্দি গান দিয়ে তিনি তার জীবন শুরু করেন। পায়োনিয়ার রেকর্ডে গাওয়া তাঁর প্রথম গান “যদি ভুলে যাও মোরে, জানাবো না অভিমান” অসম্ভব জনপ্রিয়তা পায়। ‘রাধে ভুল করে তুই চিনলে না তোর প্রেমিক শ্যাম রায়’ গানটি, ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ চলচ্চিত্রে তার দেওয়া সুর সংগীত জগতে পাদপ্রদীপের তলায় তাঁকে নিয়ে আসে। নজরুল গীতি, শ্যামা সংগীত, বাংলা গানের সঙ্গে উচ্চাঙ্গ সংগীতের সমান পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। ‘রাজা কৃষ্ণচন্দ্র’ ছবিতে ‘মন রে কৃষিকাজ জানো না’, ‘ঢুলি’ ছবির ‘ত্রিনয়নী দুর্গা’, ‘সাধক বামাখ্যাপা’ ছবিতে ২৪টি গানের মধ্যে ২৩টি গানই গেয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। সেকালে ‘ঝির ঝির ঝির ঝির বরষা’ তার গাওয়া গানটি ছিল তরুণ তরুণীর কাছে প্রেম নিবেদনের পুষ্পস্তবক।
বোম্বেতে গান গাইতে তিনি কোনদিনই যেতে চাননি। তবু একবার তাকে যেতে হয়েছিল মুম্বাই ‘৫২ সালে সুরকার রাইচাঁদ বড়ালের টেলিগ্রাম পেয়ে। রাইচাঁদকে পিতৃশ্রদ্ধা করতেন ধনঞ্জয়। কলেজ স্ট্রিটের সিসিল হোটেলের বাড়িতে ‘ধনু প্লিজ কাম’ টেলিগ্রাম পেয়েই, দুশ্চিন্তায় ছুটলেন মুম্বাইতে।
তখন প্রকাশ পিকচারস এর হিন্দি ছবি ‘মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্য’ এর সুরকার হিসেবে কাজ করছেন রাইচাঁদ। মুম্বাইতে পৌঁছে ধনঞ্জয় জানতে পারলেন, ছবিতে দুটি গান গাইতে হবে, একটি একা অন্যটি মহম্মদ রফি লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে। এদিকে তো তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে বসে আছেন ওখানে তিনি গাইবেন না। রাগে অভিমানে কষ্টে তিনি ফিরতে চাইলেন কলকাতায়। অনেক কষ্টে রাইচাঁদ বলেন ‘বেশ তাই হোক’। কিন্তু চোখমুখে যা অবস্থা হলো রাইচাঁদের তা বলে ব্যক্ত করা যাবে না, তাই দেখে মন গেলে গেল ধনঞ্জয়ের। তিনি বলেন, ‘ঠিক আছে গাইছি কিন্তু এই প্রথম এই শেষ বার’।
প্রায় দু-মাস ধরে গান তোলাতে হয়েছিল লতা, আশা, মুকেশ, রফি, তালাত মাহমুদ আর গীতা দত্তকে। তবে সেই প্রথম সেই শেষ। এক সময় বালির বাড়ি থেকে তার স্ত্রী লিখেছিলেন, ওরা যখন এত করে চাইছেন তখন তা ওখানেই থেকে যেতে পারো।
উত্তর এসেছিল হ্যাঁ থাকতেই পারি। অনেক টাকা পাবো। স্বাচ্ছন্দ, ভোগ বিলাস, গভীর রাতে বাড়ি ফেরা, উশৃংখল জীবনযাপন এমনকি তুমি চাও? হ্যাঁ কিনা জানিও। এরপর তাঁর স্ত্রী পুরো পাতা জুড়ে বড় বড় করে একটা শব্দই লিখে পাঠিয়েছিলেন “না”।
অবশ্য কলকাতায় এসে তিনি কয়েকটা হিন্দি ছবিতে গান গেয়েছিলেন ‘ঝুটি কসমে’, ‘হুয়া নাদান রে’, ‘এক সুরত দো দিল’, ‘বিদ্যাপতি’, ‘কস্তুরী’ ইত্যাদি।
কোমল মনের মানুষ ছিলেন ধনঞ্জয়। কারো কষ্ট সহ্য করতে পারতেন না — সে বাড়িরই হোক বা বাইরের। একবার গ্রামাফোন কোম্পানি সতীনাথ মুখোপাধ্যায় সমেত বাংলার শিল্পীকে একবারে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছিলেন। রেকর্ড তো করবেনই না উপরন্ত তাদের এতদিনের যা মাস্টার কপি সব নষ্ট করে দেবে তারা। কিন্তু এভাবে শিল্পীদের জীবন নষ্ট করে দিতে পারা যায় না ধনঞ্জয় গেলে গ্রামাফোন কোম্পানির কর্তা পিকে সেনের কাছে। অনেক কিছু বোঝানোর চেষ্টা করলেন তাকে কিন্তু কিছুতেই তিনি রাজি হলেন না। শেষে ধনঞ্জয় বললেন, ‘ঠিক আছে তবে আজ থেকে আমার সঙ্গে গ্রামাফোনের সম্পর্ক শেষ’, তার এই কথাতেই বরফ গললো। অথচ কি আশ্চর্যের কথা জানেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায় ছাড়া একথা আর কেউই মনে রাখেনি।
পাঁড় মোহনবাগানি ছিলেন ধনঞ্জয়। মোহনবাগানের খেলা থাকলে তিনি মাঠে যাবেনই। উদ্যোক্তাদের প্রার্থনা থাকতো আজ যেন মোহনবাগান যেতে, না হলে যে কি করবেন ধনঞ্জয় বলা মুশকিল।
একবার ধনঞ্জয় সুন্দরবনে গেছিলেন শিকারি বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে। জ্যোৎস্না রাতে দরবারী কানাড়ায় গান ধরেছেন। নৌকার সামনে হরিণের দল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। হরিণগুলোও জানতো যে এটা শিকারির অহংকার, তবু দাঁড়িয়ে ছিল, তখন মনটা এমনই অভিভূত হয়েছিল যে, তিনি বন্ধুদের অনুরোধ করলেন অন্তত সেই রাতে যেন কোন পশু বধ করা না হয়।
১৯৯২ সালের ২৭ শে ডিসেম্বর রবিবার সন্ধ্যাবেলা ছটা পঞ্চান্ন মিনিটে ইহলোক ছেড়ে চলে গেলেন। সেদিন দূরদর্শনে সিনেমা চলছিল ‘ছোট্ট জিজ্ঞাসা’। তাতে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের গাওয়া একটি গান ছিল ‘ছেলে কাঁদে মা মা বলে, মা গো মা।’ আশ্চর্যের বিষয়, সেই গানটি শেষ হলো আর সময়ের সাথে কাঁটায় কাঁটায় ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য ইহলোক ছেরে তার মায়ের কোলে ফিরে গেলেন।
এত দরদ যার কন্ঠে, যাঁর গান শুনে থমকে গিয়েছিল বনের হরিণ, কাল ছিলো সেই ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের জন্মদিন। এই মৃত্যুঞ্জয় শিল্পীর ১০২ বছর জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধার্ঘ জানিয়ে আজকের প্রতিবেদন।
অসাধারণ প্রতিভাবান শিল্পী ছিলেন। আমার বাবার অন্যতম প্রিয় গায়ক ছিলেন,,বাড়িতে তখন অনেক ক্যাসেট ও ছিলো,,,, খুব সুন্দর প্রতিবেদন।
জেনে ভালো লাগলো। বাংলা গানের জগতে এক যুগের ধারক কণ্ঠ শিল্পী ছিলেন। ধন্যবাদ 🌹
প্রবাদ প্রতিম সব শিল্পীর কথা কেউ মনে রাখে না, এটা আমাদের প্রজন্মের কাছে লজ্জার ব্যাপার।
খুব ভালো লাগলো লেখাটা। অনেক ধন্যবাদ।
ঠিকই বলেছেন।তাঁর মতো শিল্পীর মৃত্যু নেই,তিনি মৃত্যুঞ্জয়।
মতামতের জন্য ধন্যবাদ 🌹