আহাহা মরে যাই কথা শুনে, রান্নায় নাকি রসের নদী বইবে! ঝাঁঝিয়ে ওঠে আরতি, — বলি, চাদ্দিকের এই আকাল কালোয় অত রসের রান্না আসে কোত্থেকে শুনি?
হারাণবুড়ো আরতিকে বোঝাতে থাকে, — ওগো মেঘবদনী বায়সকন্ঠী নির্ঝরিণী; রান্নায় মিষ্টিরসের নদী না বইলে যে পরাণটা খাঁচাছাড়া হয় যে। তখন তোমাকে বাকী জীবনটা ঘাসপাতা খেয়েই কাটাতে হবে, এ যে আমার সহ্য হবে না গো প্রিয়তমা।
— তা বলি,— অ ভালোমাইনসের পো, ওই বদনীটদনী বলে আমার কি ব্যাখ্যানটা করলে শুনি?
— আহাহা, বুঝলে কিনা তুমি হলে গিয়ে আমার খেজুর গাছে বেঁধে রাখা বেলা বারোটার হাঁড়ির জাঁকের রস গো।
— ঠিক আছে, থামো দিকিনি, যাই দেকি রসবতীর ভাঁড়ারে কিচু পাওয়া যায় কিনা।
— আবার হাঁড়িচাচার মতো এর ওর ভাঁড়ারে উঁকি দাও কেন?
— নদের চাঁদের জন্য রসের নদীতে বাণ ডাকতে রসবতীর ভিয়েনই ভরসা যে। যাই দেকি কি পাওয়া যায়।
রসবতীর রান্নাঘরের দরজায় উঁকি মারে আরতি।
ভেতর থেকে ময়রা হাঁক দেয়,— “ও মাঠান, ওকেনে খাড়ায়ে আছ কেনে? ইদিকপানে এস দিকিনি। এই দ্যাখো মাঠান, আজ কত্তো কিচু তৈরী করেচি।
নিমক্ষীরের গজা, কালমেঘের শোনপাপড়ি, শিউলিপাতার রসবড়া। এই রসে সবকিচু ভেসে যায় গো মাঠান।”
— তা কিরকম শুনি, আরতি বলে।
— এই দ্যাখো না মাঠান,— এই মিষ্টি তুমি যেকানে খুশি সেকানে রাখতে পারো, পিঁপড়ে ছুঁয়েও দেখবে না,— এত মিষ্টি তাদের আবার সয় না কিনা।
— আচ্ছা, দাও দেকি আমায় কয়খান, আরতি বলে, আমার চিনিরুগী সোহাগবদনের সামনে রাখলেই বুঝবো তোমার ভিয়েনের রসে কতটা মিষ্টি আছে।
— ওপরে রাংতার তকমা দেওয়া রসবতীর মিষ্টিগুলো আরতি ফ্রিজে সাজিয়ে রাখে। ও ভালো করেই জানে নিঝুম দুপুরে মিষ্টি সাঁটানোর জন্য ওর ভালোমাইনসের পো হারাণ ফ্রিজ খুলবেই। এই সময়টার জন্য হারাণ তক্কে তক্কে থাকে।
— ঠিক তাই। দুপুরবেলা সবাই যে যার ঘরে সেঁধিয়ে গেলে হারাণবুড়োর ফ্রিজ খুলেই মিষ্টিগুলো দেখে মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে যায়।
একটা রসবড়া বের করে কামড় বসিয়েই মুখ আর বন্ধ করতে পারে না হারাণবুড়ো, উরেব্বাস, এটা কি মিষ্টি! তেতোয় মুখটা বিস্বাদ হয়ে যায়, ভাবে মিষ্টিটা বোধহয় পচে গেছে। তা যাক্ গে অন্য মিষ্টিগুলো দেখে হারাণের মনটা উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। এবার হাত দেয় কালমেঘের শোনপাপড়িতে। একটা শোনপাপড়ি বের করে তাতে কামড় বসাতেই তো মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার জোগাড়।
পেছন ফিরে দেখে আরতি দাঁড়িয়ে। ধরা পড়ে যাওয়া হারাণবুড়ো ফ্যালফেলিয়ে তাকায় বউয়ের দিকে। আরতি ওর অবস্থা দেখে হেসে ফেলে। বলে, মরণ! মুখ বেঁকিয়ে হেসে চলে যায় আরতি। হারাণবুড়ো বুঝতে পারে ওকে জব্দ করার চাল চেলেছে আরতি।
সন্ধ্যেবেলা আরতি সবার জন্য কফি তৈরী করতে রান্নাঘরে যায়। আরতির স্বভাব কোনো জিনিস ব্যবহার করার আগে শুঁকে দেখে নেয়। এইজন্য গন্ধশোঁকা প্রভুভক্তর অপবাদও তার কপালে জোটে।
যাইহোক, দুধ গরম করে কফির কৌটো খুলে শুঁকতে গিয়েই বিপত্তি ঘটে। হাঁচতে শুরু করে আরতি, দমকে দমকে হাঁচি। মেয়ে মিঠু ছুটে আসে। আরতি কোনওরকমে ইশারায় মেয়েকে কফির কৌটোটা দেখায়। মিঠু কিছু বুঝতে না পেরে কৌটোটা খুলে শোঁকে। ব্যাস্ আর যায় কোথায়! ওরও হাঁচতে হাঁচতে দমবন্ধ হওয়ার জোগাড়।
ওদিকে হারাণবুড়ো খাটে বসে নিশ্চিন্তে ঠ্যাং দোলাতে থাকে। আর পেছনের বাগানে বুড়োর নস্যির ডিবেটা গড়াগড়ি খায়।