ধুপধাপ্ পা ফেলে বছর তেরোর তিস্তা রান্নাঘরের সামনে এসে চৌকাঠের বাইরে মুখ গোঁজ করে দাঁড়িয়ে ফ্রকের কোণাটা হাতে নিয়ে পাকাচ্ছে।
মাটিতে পাতা উনুনে মাছ ভাজতে ভাজতে মেয়ের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মন দেয় অনুপমা।
মায়ের মনোযোগ আকর্ষণ করতে না পেরে ডান পা টা আরও একবার সজোরে মাটিতে ঠুকে গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইল তিস্তা।
রান্নাঘরের একপাশে বসে বঁটিতে সব্জি কুটছিলেন অনুপমার বড় জা তাপসী। মা-মেয়ের কাণ্ড দেখে বলে উঠলেন, “এমন উড়নচণ্ডী হয়ে কোত্থেকে আসা হচ্ছে শুনি? আর এত তেজই বা দেখাচ্ছিস কেন রে তিসু?”
জ্যেঠিমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল ও।
“কি রে, ডাক্তারবাবুকে দেখিয়েছিস? কি বললেন ঊনি” মেয়ের দিকে না তাকিয়েই অনুপমা জিজ্ঞেস করল।
ওদের বাড়ির পাশেই ডাক্তার পানের বাড়ি। একটুআধটু শরীর খারাপ হলে তিস্তা এখন একাই যায় ডাক্তার জ্যেঠুকে দেখাতে। মায়ের কথায় তিস্তা ঝাঁঝিয়ে ওঠে, “না দেখাইনি। আর কোনওদিন আমি ডাক্তারখানায় যাব না। তোমাদের এই বাড়ি বিচ্ছিরি।”
ওর কথায় হকচকিয়ে যায় অনুপমা, তাপসী। বঁটি ছেড়ে উঠে তাপসী জড়িয়ে ধরেন তিস্তাকে।
“কি হয়েছে তিসু মা?”
এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তিস্তা বলে, “জান জেম্মা, আজ শর্মিলা দিদিমণি সবার সামনে আমাকে প্রণাম করতে গিয়েছিলেন। আমার খুব খারাপ লেগেছে।”
“মানে?” মাছের কড়াইটা উনুন থেকে ঠক্ করে পাশে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ায় অনুপমা।
“হ্যাঁ তাই-ই” তিস্তা বলে, আমি ডাক্তার জ্যেঠুর ওখানে গিয়ে দেখি অনেক ভীড়। সবাই বসে আছে। শর্মিলা দিদিমণিকেও দেখলাম। কম্পাউণ্ডার কাকুর কাছে আমার নামটা লিখিয়ে আসার সময় দিদিমণির পায়ে আমার পা ঠেকে গেল। আমি নীচু হয়ে ওনাকে প্রণাম করতে যেতেই ঊনি আমার হাতদুটো ধরে ফেলেন। সবার সামনে বলে ওঠেন, “আরে কর কি, কর কি! তুমি হইল্যা গ্যিয়া আমার গুরু কইন্যা। সম্পর্কে আমার গুরু বহিন; তায় বামুন। তুমিই আমার প্রণম্য। কিন্তু আমার বয়স তো অনেক বেশী। তাই জোড় হাতেই তোমারে প্রণাম করি।”
এসব বলে দিদিমণি দুইহাত জোড় করলেন। সবাই দেখি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। লজ্জায় আমি একছুটে পালিয়ে এসেছি। আর কখনও যাব না।”
তিস্তার কথা শেষ হতেই তাপসী হেসে ফেলেন। বলেন, “এ আর বেশি কথা কি! আমরা হলাম গিয়ে ভটচায্ বামুন, উচ্চশ্রেণী। আর তিসু, তুই-ই বা কোন্ আক্কেলে ওই কায়েত দিদিমণির পা ছুঁতে গিয়েছিলি?”
জেম্মার কথায় মনের মধ্যে যত রাগই জমা হোক না কেন তিস্তা মুখে কিছু বলে না। মায়ের দিকে তাকায়।
অনুপমা তাপসীকে বলে, “না দিদি, এটা মোটেই ঠিক কথা নয়। তাছাড়া আমিই তোমার তিসুকে শিখিয়েছি যে শিক্ষকের কোনও জাত, ধর্ম হয় না। যাঁরা ওকে ওর ভবিষ্যৎ গড়তে সাহায্য করছেন তাঁরা সকলেই ওর প্রণম্য।”
তারপর মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলে, “দিদিমণির তো বয়স হয়েছে, তাছাড়া ঊনি ধর্মভীরু মানুষ তাই হয়তো অমনভাবে বলেছেন। ওঁর ওপর অভিমান করিস না।”
এসব কথা তাপসীর সহ্য হয় না। বলেন, “এভাবে মেয়েকে আস্কারা দিস না ছোটো। দেখবি এই মেয়েই একদিন বংশের নাম ডোবাবে। আমার খোকনকে দেখ্। পৈতে হতে না হতেই নিজের সম্পর্কে কত সচেতন হয়ে উঠেছে। শিষ্য-যজমানরা বাড়িতে এলেই ও গিয়ে ঠিক তোর ভাশুরঠাকুরের পাশটিতে বসে পড়ে।
সবাই এখন আমার খোকনকেও গুরু বলে মানতে শুরু করেছে।”
অনুপমা জা’য়ের সাথে আর কথা বাড়ায় না। কঠিন স্বরে মেয়েকে বলে, “ঘরে যাও।”
***
রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হয়েও অনুপমা ছোট থেকেই স্বাধীন উদার ভাবনার মানুষ। এই ভাবনা আরও ঘন হয় পিতৃসম মার্ক্সিস্ট মাসতুতো দাদার সান্নিধ্যে। প্রি-ইউনিভার্সিটি পাশ করার পর এই দাদার চেষ্টায় বীরভূমের একটা আবাসিক স্কুলে শিক্ষকতার কাজ জুটে যায় অনুপমার।
মেয়ে চাকরি করবে তায় বাড়ির বাইরে থেকে; এটা অনুপমার বাবা শিবনারায়ণের ভাবনার অতীত হলেও পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সেই মুহূর্তে তিনি বাধা দেন নি।
অনুপমা চাকরিসূত্রে বাড়ি ছাড়ে। ফেরে পূজোর ছুটিতে। কিন্তু ছুটি কাটলেও অনুপমার চাকরিস্থলে আর ফেরা হয় না। শিবনারায়ণমশাই বনেদী রক্ষণশীল পালটি ঘরে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন।
অনুপমার স্বামী মহীনাথ একেবারে বনেদীয়ানার আদর্শ ফুলবাবু। দায়-দায়িত্বহীন; নিজেকে নিয়ে সদা ব্যস্ত। আরামবিলাসে দিনযাপন করতে করতে দিনে দিনে তার মধ্যে সবরকম বদগুণই প্রকট হয়ে ওঠে। ফলে বাড়ির তুলনায় বাইরে কাটানো রাতের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
এরই মধ্যে অনুপমার কোলে আসে তিস্তা। মেয়ের নামকরণ নিয়েও বিস্তর জলঘোলা হয় সংসারে। মহীনাথের দাদা শিবনাথ বলেন, “নদীর নামে নাম রাখলে মেয়ের দুখের জীবন হয়। ঠাকুর দেবতার নামে নাম রাখাই শ্রেয়।”
কিন্তু অনুপমা গোঁ ধরে থাকে। ও চায় পাহাড়ী নদীর মতোই কঠিন পথ অবলীলায় অতিক্রম করুক মেয়ে, থাকুক মালিন্যহীন।
স্কুলের নিয়মিত পাঠ্যের বাইরে অনুপমা মেয়েকে পড়ে শোনায় বিভূতিভূষণ, জীবনানন্দ। শোনায় কার্লমার্ক্স, ফ্রেডরিক এ্যাঙ্গলস্।
আশা, সব সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে থাকবে মেয়ের চিন্তাধারা।
***
তিস্তা স্কুলের গণ্ডী পেরোতে না পেরোতেই সবরকমের বদ নেশা মহীনাথের আয়ুকে দ্রুত শেষ করে দিয়েছিল।
জ্যেঠু শিবনাথ একমাত্র ভাইঝিকে পাত্রস্থ করে দায়মুক্ত হতে চাইলেও বেঁকে বসেছিল অনুপমা। জোরের সঙ্গে বলেছিল, “ও নিজের পায়ে না দাঁড়ানো পর্যন্ত ওর বিয়ের কথা চিন্তাতেও আনছি না।”
ভ্রাতৃবধূর কথায় শিবনাথ রেগে গিয়ে বলেছিলেন, “ঠিক আছে। তাহলে আজ থেকে তোমার মেয়ের ভাবনা শুধুমাত্র তোমার। তোমরা সংসারে যেভাবে আছ সেভাবেই থাকবে, কিন্তু তিসুর পড়াশোনাবাবদ কোনওরকম সাহায্য আমার কাছে পাবে না।”
***
তিস্তা টিউশনি করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে আজ ও সফল জার্নালিস্ট। কাজের সূত্রেই পরিচয় হয় নাবীলের সাথে। সময় ওদের একসূত্রে বাঁধে। সারাজীবন একসাথে পথ চলতে চেয়ে ওরা বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে দুই বাড়িতেই জানায়। নাবীলের পরিবারের তরফে কোনো বাধা না এলেও ঝড় ওঠে ভটচায্ বাড়িতে।
অনুপমার কোনো আপত্তি না থাকলেও বাড়িতে অশান্তি চরমে পৌঁছায়। কারণ নাবীল বিধর্মী। শিবনাথ পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন যে অন্য ধর্মের কাউকে ভটচায্ বাড়ির জামাই হিসেবে মেনে নেবেন না। তিস্তা যদি নিজের সিদ্ধান্ত না বদলায় তাহলে ধর্মকে বিসর্জন দিয়ে তাঁর পক্ষে এক সংসারে থাকা সম্ভব নয়। তিস্তা নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। ফলে পাঁচিল ওঠে বাড়িতে।
এখন অনুপমা একাই থাকে নিজের সীমানার মধ্যে। মাঝেমধ্যে দুই বাড়ির ছাদ থেকে দুই জায়ের কথাবার্তা হয়। নাবীল আর তিস্তা প্রায় রোজই আসে ওর কাছে।
ওদের দেখে আনন্দে ভরে ওঠে অনুপমার বুক।
বাবার পথ অনুসরণ করে খোকন আজ প্রতিষ্ঠিত পুরোহিত। জ্যোতিষচর্চা করে আয়ের নতুন একটা ধারা খুলেছে ও। শিবনাথ ঠিকুজি-কুষ্ঠী মিলিয়ে বড় সাধ করে ঘটাপটা করে ছেলের বিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু তাপসীর সংসারে কোথাও যেন তাল কেটে গেছে। নিত্যনৈমিত্তিক ঝামেলা লেগেই থাকে। তাপসীর বয়স হয়েছে। আজকাল কাজকর্ম সেভাবে করতে পারে না। অথচ পুত্রবধূ মালবিকা শ্বশুরবাড়ির সাংসারিক নিয়মকানুন মানতে নারাজ। পাঁচিলের ওপাশ থেকে শিবনাথের পারিবারিক অশান্তির তাপ অনুপমার কানেও পৌঁছায়।
আজ কোজাগরী লক্ষ্মীপূজো। সকাল থেকেই তাপসী আর মালবিকার গলার আওয়াজ পাচ্ছিল অনুপমা। টুকরো টুকরো কথা ভেসে আসছিল। আর তাতেই বুঝতে পারল তাপসীর শরীর খারাপ। আর মালবিকা পূজোর ভার নিতে নারাজ।
অনুপমা বুঝতে পারে, ওবাড়িতে এতদিনের পূজো আজ বন্ধ হয়ে গেল।
বিকেলের দিকে ও বাড়িতে যায়। ওকে দেখেই হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে তাপসী। বলে, “ঘরে যাকে লক্ষ্মী করে আনলাম, সে-ই গৃহলক্ষ্মীকে পূজো করতে চাইছে না।”
অনুপমা চুপ করে সব শোনে। তারপর বলে, “দিদি ওঠো। চলো আজ আমরা এমন এক জায়গায় যাই যেখানে মন ভালো হতে পারে।”
— “কোথায় রে?”
— “ওঠো তৈরী হও।”
***
তিস্তার বাড়িতে আজ লক্ষ্মীপূজো। নাবীলের মা, বোন মিলে ঠাকুরের ভোগ রান্না করেছে। জানলা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া চাঁদের আলোয় তিস্তার উলুধ্বনির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে নাবীলের শঙ্খধ্বনি। মুছে গেছে ধর্মের বিভেদ।
অনুপমা সারা বাড়িতে তাপসী খুঁজে না পেয়ে ছাদে আসে। দেখে, নারকেলগাছের ফাঁক দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে তাপসী। দু-চোখ বেয়ে জলের ধারা গাল ভিজিয়ে দিয়েছে।
পেছন থেকে এসে ওর কাঁধে হাত রাখে অনুপমা।
একটু যেন চমকে উঠে তাপসী বলে, “দেখ্ ছোটো, চাঁদের গায়ে ওই অল্প কালো দাগগুলো আছে বলেই যেন চাঁদকে আরও বেশি উজ্জ্বল মনে হয়; তাই না?”
ওর মনের ভেতরের কথাগুলো বুঝতে পারে অনুপমা। তাই কোনো উত্তর দেয় না। মৃদু হাসে।
দুই নারীর কানে কানে চাঁদ বলে যায়, কে জাগ রে….।।
এমন গল্প পড়লে মনে ভালো হয়ে যায়। লক্ষ্মী প্রশান্তি আনুক ঘরে বাইরে।
অসংখ্য ধন্যবাদ আর অনেক ভালোবাসা জানাই❤️❤️
ভাল লাগল! আর ও অনেক এরকম সুন্দর ছোট গল্প চাই।
অবশ্যই চেষ্টা করব। অশেষ ধন্যবাদ❤️❤️
খুব সহজ ও সুন্দর ভাষায় লেখা গল্প পড়ে ভালো লাগলো। এ রকম আরো অনেক সৃষ্টি তোমার লেখনী জাত হোক, শুভেচ্ছা রইল।
প্রাপ্তি আমার। অশেষ ধন্যবাদ❤️❤️