রবিবার | ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৪:৪২
Logo
এই মুহূর্তে ::
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলের দুর্গোৎসব : রিঙ্কি সামন্ত মর্ত্যে দুর্গাপূজার সেকাল ও একাল : অসিত দাস বই-বাই : নবনীতা দেব সেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছোটগল্প ‘প্রবাসী’ ম্যান মেড নয় ডিভিসি-র পরিকল্পনা আর রূপায়নে গলদ : তপন মল্লিক চৌধুরী রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে রাখাইনে সেইফ জোন তৈরি করা আবশ্যক : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন ফলের নামটি পাকা কলা : রিঙ্কি সামন্ত বই-বাই : নবনীতা দেব সেন হেমচন্দ্র বাগচীর ১২০তম জন্মবর্ষ : দীপাঞ্জন দে নিম্ন চাপের অতিবৃষ্টি ও ডিভিসির ছাড়া জলে প্লাবিত আরামবাগ : দেবাশিস শেঠ আরামবাগে ভয়াবহ বন্যা, দুর্যোগের পদধ্বনি, ক্ষোভ জনমানসে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন মেয়েদের ক্ষমতায়নের পক্ষেও আওয়াজ তুলেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী কবি দেবদাস আচার্য-র কবিতাজগৎ — বহমান পৃথিবীর জীবনপ্রবাহ, চেতনাপ্রবাহ : অমৃতাভ দে মনসার নাম কেন ঢেলাফেলা : অসিত দাস ভোও.. ও ..ও.. কাট্টা…! ভো… কাট্টা…! : বিজয় চৌধুরী দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা : সন্দীপন বিশ্বাস নারীবেশী পুরুষ অভিনেতা শঙ্করকে সামাজিক ট্যাবুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয় না : বিশ্বেন্দু নন্দ সাসারামের রোহতাসগড়, বৃহতের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ : নন্দিনী অধিকারী জমিদার রবীন্দ্রনাথ : আহমাদ ইশতিয়াক আন্দোলনরত জুনিয়র চিকিৎসকদের আবেদন মুখ্যমন্ত্রীর, এবারও অধরা রইলো আলোচনা : সুমিত ভট্টাচার্য জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (ষষ্ঠ পর্ব) : বিজয়া দেব চাষির দুঃখের ঘরে সাপের বাসা, আজও রেহাই নেই ছোবলের হাত থেকে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় সল্টলেক তথা লবণহ্রদই কি কুচিনান : অসিত দাস পদ্মা বা পার্শ্বপরিবর্তনী একাদশী ব্রতকথা : রিঙ্কি সামন্ত জয়া মিত্র-র ছোটগল্প ‘ছক ভাঙার ছক’ কত দিন বিনা চিকিৎসায় চলে যাবে অসুস্থ মানুষের প্রাণ? প্রশ্ন দেশ বাঁচাও গণমঞ্চের : সুমিত ভট্টাচার্য দেবী করন্দেশ্বরীর পূজো ঘিরে উৎসবের আমেজ মন্তেশ্বরের করন্দা : প্রবীর কুমার সামন্ত প্রেতবৈঠকে (প্ল্যানচেট) আত্মার আগমন : দিলীপ মজুমদার সংগীত সাধক ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য : রিঙ্কি সামন্ত শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্যের অন্দরে বাহিরে বিরাজমান সিণ্ডিকেট : তপন মল্লিক চৌধুরী
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ কৌশিকী অমাবস্যার-র আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

মর্ত্যে দুর্গাপূজার সেকাল ও একাল : অসিত দাস

অসিত দাস / ৯ জন পড়েছেন
আপডেট শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

ছাত্রাবস্থায় কলকাতা মেডিকেল কলেজের এক কুইজ কম্পিটিশনে এক জামাইঠকানো প্রশ্নে ঠকে গিয়েছিলাম। মর্ত্যে দুর্গাপূজা প্রথম কে করেছিল, এই প্রশ্নের উত্তরে কেউ রামচন্দ্র, কেউ রাজা নবকৃষ্ণের নাম বলছিল। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে কুইজমাস্টার বলে দিলেন উত্তরটা। রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য।

হ্যাঁ, রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য মর্ত্যে দুর্গাপূজার প্রচলন করেন। তবে মেধস মুনি তাঁদের দু-জনকে মা দুর্গার আরাধনা করতে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন। বঙ্গাধিপতি রাজা সুরথকে চৈত্রবংশীয় রাজা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে মার্কণ্ডেয় পুরাণে। তিনি একদা সর্বস্বান্ত হয়ে রাজধানী বলিপুর (বর্তমান বোলপুর) ত্যাগ করেন। রাস্তায় সমাধি বৈশ্যর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। এই বণিকও দেউলিয়া ছিলেন তখন। এই দুজনের সঙ্গে দৈবক্রমে মেধস মুনির দেখা হয়ে যায়। তাঁর পরামর্শে দুজনে বসন্তকালেই দেবী দুর্গার আরাধনা করেন। বোলপুরের কাছে গড় জঙ্গল-এ মেধসমুনির আশ্রমে তাঁরা দুর্গাপূজা করেন।

প্রথম পুজোটুকু না হয় ওঁরাই করলেন, তার পরের দুর্গাপূজার চিহ্নগুলি কোথায়? পুঁথিপত্রে মিললেই তো হবে না, পাথুরে প্রমাণও তো চাই। তারজন্যে দরকার প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য।

পান্ডুরাজার ঢিবিতে ৪০০০ বছর আগেকার মাতৃকামূর্তি পাওয়া গেছে। এই পক্ষীরূপিনী মাতৃকা দেবী ছিলেন শস্যদায়িনী ও প্রজাপালিকা। আজকের আদ্যাশক্তি মায়ের আদিরূপ বলে অনেক গবেষক ভেবে থাকেন এই পক্ষীরূপিনী দেবীকে।

গঙ্গারিডি যুগের চন্দ্রকেতুগড়ে অনেক প্রাকদুর্গা দেবীমূর্তি পাওয়া গেছে। উত্তর চব্বিশ পরগনার বেড়াচাঁপা গ্রামের কাছেই এই চন্দ্রকেতুগড়। পুরাতাত্ত্বিক খননকালে প্রাপ্ত মাতৃমূর্তিগুলি বৈদিক ঊষা বা ইষা রূপে পূজিতা হতেন। আড়াই হাজার বছর আগেও দেবী দুর্গার অস্তিত্বের জানান পাওয়া যায় সেখানে।

মৌর্য ও কুষান যুগের টেরাকোটায় পক্ষী নয়, পূর্ণাবয়ব নারীমূর্তি এসে গেল। গুপ্তযুগে আজকের দিনের দশভুজা মায়ের খোদাইকরা সিল পাওয়া যায়। বর্তমানকালের মা দুর্গার যে অসুরমর্দিনী সিংহবাহিনী দশভুজা রূপ দেখি, তা আসে পালযুগে। হাজার বছর ধরে চলে আসা কয়েকটি দুর্গাপূজার সূচনা হয়েছিল পালযুগেই। পালযুগে গৌড়ীয় সেনা দুর্গাপূজায় অংশ নিত, বীরাষ্টমীতে মঙ্গলঘটের পবিত্র জল দিয়ে পূজা করা অস্ত্র নিয়ে মায়ের আশীর্বাদ নেওয়ার পর দশমীর দিন দিগ্বিজয়ে বেরোতেন।

সেন রাজাদের আমলে তামা ও ব্রোঞ্জের মাতৃকামূর্তি তৈরি হত। সেন রাজাদের মদতে বিরাট বিরাট দুর্গাপুজোর চল হয় সেনযুগে। মূলত শাক্ত হলেও সেনরাজারা দুর্গাপূজার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

বাংলায় প্রথম দুর্গাপুজো করেন বারোভুঁইয়াদের অন্যতম রাজশাহীর রাজা কংসনারায়ণ রায় ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দে (৮৮৭বঙ্গাব্দ)। তিনি তাহেরপুরের তাহের আলিকে যুদ্ধে পরাজিত করেন। সেই যুদ্ধজয়ের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে তিনি শরৎকালের আশ্বিনমাসে দেবী দুর্গার পুজো করেন। সেই যুগে মোট নয় লাখ টাকা খরচ হয়েছিল। দেবী দুর্গার মূর্তিটি ছিল স্বর্ণনির্মিত।

যদিও বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব, ইতিহাস ঘাঁটলে প্রমাণ মেলে যে, দুর্গাপুজো ও কলকাতার সম্পর্ক কিন্তু বিশেষ প্রাচীন নয়। ১৬১০ সালে বড়িশার সাবর্ণরায়চৌধুরী পরিবারের লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার বড়িশা রাজবাড়িতে দুর্গাপূজার সূচনা করেন। মাটির আটচালায় গোলপাতার ছাউনি তখন। পরে সেই আটচালা পাকা হল। একটি পুজো ১১টি পুজোয় দাঁড়াল। এখন তারমধ্যে ছয়টি পুজো টিকে আছে। আটচালাবাড়ি, বড়বাড়ি, মেজবাড়ি, মাঝের বাড়ি, বেনাকি বাড়ি, কালীকিঙ্করভবন। এছাড়া নিমতা ও বিরাটিতে সাবর্ণরায়চৌধুরীদের বংশধরদের বাড়িতেও দুর্গাপূজা হয়।

১৭৫৭ সালে ইংরেজবাহিনীর হাতে সিরাজদৌল্লার পরাজয়ের পর ইংরেজশাসকের বিজয় উদ্‌যাপন উপলক্ষ্যে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এবং শোভাবাজার রাজবাড়ির রাজা নবকৃষ্ণ দেবের হাত ধরেই দুর্গাপুজোর রমরমা বাড়ে কৃষ্ণনগরে এবং কলকাতায়।

১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে নবাব সিরাজদৌল্লা পরাজিত হলেন। এই হারের মাশুল ভারতবাসীকে দিতে হয়েছিল তাদের স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে। কিন্তু এই পরাজয়ে বিশেষ খুশি হয়েছিলেন নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়ির আদিপুরুষ নবকৃষ্ণ দেব। কলকাতায় তথা বঙ্গে দুর্গাপুজোর রমরমা শুরু এঁদের হাত ধরেই। এঁরা দুর্গাপুজোকে হাতিয়ার করে সাহেবদের খুশি করার দিকে মন দেন। কারণ এঁদের বিশ্বাস ছিল যে, এদেশের মঙ্গলের জন্য সাহেবদেরই প্রয়োজন। লর্ড রবার্ট ক্লাইভ নিজের বাকচাতুর্যের মাধ্যমে একথা তাঁদের বুঝিয়েছিলেন যে, এই জয় আসলে হিন্দুদের জয়। এমনকি, ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি লাভের পর, হিন্দু রাজাদের সন্তুষ্টিবিধানের জন্যে লর্ড ক্লাইভ নিজেও একবার দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন। লর্ড ক্লাইভ যে চতুরশিরোমণি ছিলেন, তা বলাই বাহুল্য।

শোনা যায়, শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোয় নাকি ক্লাইভ, ড্রেক, ওয়াটসন-সহ তাঁর পারিষদবর্গকে নিয়ে এসেছিলেন এবং একশো টাকা দক্ষিণা দিয়ে পুজোয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। এর আগে মহিষাসুরমর্দিনীর আরাধনা শরৎকালে হতই না, তা হত বসন্তকালে। কিন্তু সাহেবদের খুশি করার জন্য বসন্তকালের পুজো ও শরৎকালের নবপত্রিকা, এই দুইকে এক করে নতুনরূপে দুর্গাপুজো চালু করা হল রাজা নবকৃষ্ণদেবের ইচ্ছায়। এভাবেই ধনী পরিবারগুলিতে এ পুজোর শুরুয়াত। সেকালে দুর্গাপুজোর পরিধি কেবলমাত্র অভিজাত ধনী পরিবারগুলিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণ মানুষের জন্য এ-পুজোর দ্বার উন্মুক্ত ছিল না, আনন্দোৎসবে তাদের কোনও অংশগ্রহণ ছিল না। যে বাড়িতে পুজো হত, তাঁদের আমন্ত্রণে যারা আসতেন, কেবল তাঁরাই দুর্গাপুজোর আনন্দে মেতে উঠতেন, অন্যরা ছিলেন রবাহুত।

এ ছাড়া, দুর্গাপুজোর আনন্দোল্লাসের একটি বিশেষ দিক ছিল সাহেবদের নিমন্ত্রণ করা। সাহেবরা সদলবলে পুজো দেখতে আসত, এমনকি তাদের মনোরঞ্জনের জন্যও থাকত বিশেষ ব্যবস্থা। বাঈজি নাচের আসর বসত, সারারাত ধরে চলত জলসা। শোনা যায়, সাহেবদের খুশি করার জন্য নাকি সুদূর বার্মা থেকে বাঈজি আনিয়ে শোভাবাজার রাজবাড়িতে জলসার আয়োজন করা হত। অবিরাম সুর, সুরার জোগান, এই দুই মিলেমিশে তখন এক অন্য জগৎ। শোনা যায়, উইলসন হোটেল থেকে খাবারদাবার ও পানীয় যেত লর্ড ক্লাইভ, উইলিয়াম ড্রেক ও তাঁদের সঙ্গীসাথীদের জন্যে।

মা দুর্গা বাঙালিদের কাছে একরকম ঘরের মেয়েই। ঘরের মেয়ে পুজোর ক’দিন সন্তান-সন্ততি-সহ শ্বশুরঘর ছেড়ে বাপের বাড়ি আসে। দশমীতে সকলকে কাঁদিয়ে মেয়ে ফিরে যায় কৈলাসে তাঁর স্বামীর কাছে। দেবী দুর্গার চালচিত্রের যে বর্তমান রূপ, সেখানে দশভুজা দেবী তাঁর চার সন্তান, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশ-সহ বিরাজমান। এই যে এক পারিবারিক রূপের বহিঃপ্রকাশ, এই চালচিত্রর ব্যবহার প্রথম শুরু রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের হাত ধরেই। এর আগে কেবল দেবীর মহিষাসুরমর্দিনী রূপটাই জ্ঞাত ছিল। কিন্তু পরে দেবীর পারিবারিক কোমল রূপটাও মানুষের কাছে বেশি আপন হয়ে ওঠে।

পুরোনো কলকাতায় একটি প্রবাদ লোকের মুখে মুখে ফিরত যে, মা দুর্গা নাকি মর্ত্যে প্রথম পা রাখেন হুগলি নদীর তীরে। সেখান থেকে মা যান শিবচন্দ্র দাঁর বাড়িতে গয়না ও কাপড় পরতে। তারপর সুসজ্জিতা মা অভয়চরণ মিত্রের বাড়িতে যান মধ্যাহ্নভোজন সারতে এবং দিনের শেষে মা শোভাবাজার রাজবাড়িতে যান বাঈজি নাচ দেখতে। এই জনশ্রুতির কারণ, এই সব পরিবারগুলি তাদের বিত্তের জন্য সুখ্যাত ছিল সে যুগের কলকাতায়।

শোনা যায়, সেই সময় দাঁ-পরিবারের সদস্যরা নাকি প্রতি ঘণ্টায় কাপড় বদলে নতুন কাপড় পরতো। বিলেত থেকে সোনা ও রুপোর তৈরি প্রতিমার সাজ আনা হত। ডাকযোগে আসত সেসব সাজ। সেই থেকেই নাকি ‘ডাকের সাজ’ কথাটির শুরু। মিত্রবাড়িতে নাকি জিলিপি বানানো হত প্রায় রথের চাকার সাইজের এবং দুপুরে রাঁধা হত একশটি পদ। শোভাবাজার রাজবাড়ির বাঈজি নাচের জলসা ছিল সুবিদিত। ইংরেজ রাজপুরুষরা তো বটেই, মুসলমান, আর্মেনিয়ান ও জিউস সম্প্রদায়ের গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও আমন্ত্রিত হতেন সেখানে। যদিও এ সবই জনশ্রুতি, তবুও যা রটে তার কিছুটা তো বটে।

দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে কলকাতার বাবুদের শখ ও শৌখিনতার অজস্র গল্প চালু আছে। কলকাতার বিখ্যাত ধনী বাবু ছিলেন শ্রীযুক্ত প্রদ্যুম্ন মল্লিক। একসময় তাঁর মনে হল, এই যে সাধারণ মানুষ দুর্গাপুজোর আনন্দ থেকে বঞ্চিত, তার জন্যে কিছু করা দরকার। তাঁর নির্দেশে বিলেত থেকে অর্ডার দিয়ে বানিয়ে আনা হল ক্রিস্টালের তৈরি এক অপূর্ব দুর্গামূর্তি। সাধারণ মানুষকে দেখানোর জন্য প্রদ্যুম্ন মল্লিক সেই মূর্তি রোলস্ রয়েস গাড়িতে চাপিয়ে সারা কলকাতা ঘোরালেন। ১৮৪২-৪৩ সাল পর্যন্ত সাহেবরা কলকাতার গণ্যমান্য বাবুদের বাড়ির পুজোয় নিয়মিত নিমন্ত্রিত হতেন। পরে কোনও সরকারি নির্দেশে তা অনেক কমে যায়।

পাথুরিয়াঘাটার ঘোষবাড়ির দুর্গাপুজোও খুব প্রাচীন ঐতিহ্যের অধিকারী। নবপত্রিকা স্নান করানো হয় রুপোর কলসে করে গঙ্গাজল বয়ে নিয়ে গিয়ে। ভবানীপুরের মল্লিকবাড়ির পুজোর বনেদিয়ানাও বলার মতো বিষয়। এঁদের একটি অংশ এখন টালিগঞ্জে থাকেন।

বনেদিবাড়ির দুর্গাপুজোর বিসর্জন নিয়ে হুতোম প্যাঁচার নকশায় আছে এক ধ্রুপদী বর্ণনা —

‘‘কর্মকর্তারা প্রতিমা নিরঞ্জন করে, নীলকণ্ঠ শঙ্খচিল উড়িয়ে ‘দাদা গো’ ‘দিদি গো’ বাজনার সঙ্গে ঘট নিয়ে ঘরমুকো হলেন৷ বাড়ীতে পৌঁছে চণ্ডীমণ্ডপে পূর্ণ ঘটকে প্রণাম করে শান্তিজল নিলেন, পরে কাঁচা হলুদ ও ঘটজল খেয়ে পরস্পরকে কোলাকুলী কল্লেন৷  অবশেষে কলাপাতে দুর্গানাম লিখে সিদ্ধি খেয়ে বিজয়ার উপসংহার হলো’।

আগেকার পুজোর একমাস আগে খুঁটিপুজোর কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না। বছর কুড়ি হল, ময়দানের বারপুজোর মতো খুঁটিপুজোর চল দেখা যাচ্ছে। এই খুঁটিপুজো কাঠামোপুজোর বিবর্তিত রূপ কিনা বোঝা দুষ্কর। তবে পুরনো কলকাতার পুজোয় খুঁটিপুজোর কোনও উল্লেখ নেই। ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’-য় দুর্গোৎসব পর্বে একজায়গায় পাঁঠাবলির আগের যে বিবরণ পাচ্ছি, তাতে এক মোসাহেব বলছে ‘খুঁটি ছাড়! খুঁটি ছাড়!’ তারপরেই পাঁঠাকে হাড়িকাঠে চড়ানো হচ্ছে। একজন মুন্ডি আর একজন ধড় চেপে ধরছে, কামারমশাই কোপ মেরে পাঁঠাকে দ্বিখণ্ডিত করছে। এই ছাগলবাঁধার খুঁটির সঙ্গে আজকের দুর্গাপুজোর আগে অবশ্যপালনীয় খুঁটিপুজোর কোনও যোগ আছ কিনা জানি না। পাঁঠাবলি আগে তো দুর্গাপুজোর অন্যতম আবশ্যিক অনুষঙ্গ ছিল। তাহলে পাঁঠাবাঁধার খুঁটিটিকেও কি ভক্তিভরে পুজো করা হত? কচি ঘাসপাতা খাইয়ে মাসখানেক আগে থেকেই হয়তো নধর হৃষ্টপুষ্ট করা হত নবমীর পাঁঠাটিকে! তাকে বাঁধার খুঁটির মাহাত্ম্য থাকতেই পারে। খুঁটিটিকেও হয়ত দেবজ্ঞানে পুজো করা হতো। এখন পাঁঠাবলি উঠে গেছে। কিন্তু রয়ে গেছে সেই রীতি। একটি কাঠের দণ্ডকে কাপড়ে জড়িয়ে পুজো করা হচ্ছে!

নাকি খুঁটিপুজোর আর কোনও বৈদিক বা পৌরাণিক ব্যাখ্যা আছে? তাহলে একটি শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যার চেষ্টা করা যাক।

বাংলা ভাষায় ‘কোটি’র অর্থ শীর্ষ বা অগ্র। কোটি মানে উৎকর্ষও হয়।

‘কোটিপূজা’ থেকেও অপভ্রংশে খুঁটিপুজো আসতে পারে৷ বৈদিক দেবতাদের উচ্চকোটির স্থান বা আসনটিকেই যেন পূজা করা হয় খুঁটিপুজোয়। যে লম্বা খুঁটিতে কাপড় জড়িয়ে সেলিব্রিটি নায়কনায়িকারা ধরে সেটিকে খাড়া করেন সবাই মিলে, তার উচ্চতম বিন্দুটিই কোটি। কোটিকেই পূজা করা হয় প্রতি বছর। সেখানেই যে দেবতা আসনগ্রহণ করবেন। দণ্ডটি উপলক্ষমাত্র।

হিসেবমতো হিন্দুদের তেত্রিশ কোটি দেবতা। কথাটি আসলে তেত্রিশ ‘কোটিদেবতা’।

তেত্রিশ ‘কোটিদেবতা’ —

দ্বাদশ আদিত্য :

ধাতা, অর্য্যমা, মিত্র, বরুণ, অংশ, ভগ, বিবস্বান, ইন্দ্র, পূষা, পর্জ্জন্য, ত্বষ্টা, বিষ্ণু।

একাদশ রুদ্র :

অজ, একপাৎ, অহিব্রধ্ন, বিরূপাক্ষ, রৈবত, হর, বহুরূপ, ত্র্যম্বক, সাবিত্র, জয়ন্ত, পিনাকী।

অষ্টবসু :

ধর, ধ্রুব, সোম, অহ, অনিল, অনল, প্রত্যূষ, প্রভাস।

ইন্দ্র ও প্রজাপতি বা, অশ্বিনীকুমারদ্বয=২

মোট= ১২+১১+৮+২=৩৩

এই তেত্রিশ বৈদিক দেবতা শাস্ত্রস্বীকৃত। তাঁদের স্মরণ করেই দেবী দুর্গার পূজা শুরু করার বিধি আছ শাস্ত্রে।

শাস্ত্রে আছে — ‘কোটিপূজা ফলম লভেৎ তৎভালোৎপন্ন কৈবল্যম্’৷

শিবপুরাণেও কোটিপূজার উল্লেখ পাওয়া যায়, —

“সামন্তানাং জয়ে চৈব কোটিপূজা প্রশস্যতে

রাজামযুতসংখ্যং চ বশীকরণকর্মণি।”

উড়িষ্যাবাসী কবি সারলা দাস লিখেছেন, —

‘কলিকাল ধ্বংসন ভোগেণ কোটিপূজা’।

প্রণমিতে খটই দেবাদিদেব কপিলেশ্বর মহারাজা।’ (দাণ্ডিবৃত্ত ছন্দে লেখা)

স্কন্দপুরাণেও আছে কোটিপূজার উল্লেখ।

কোটিপূজা তাই পৌরাণিক দেবী দুর্গার মর্ত্যে আগমনের আগে তাঁর ও তাঁর পুত্রকন্যাদের স্থাপনের নিমিত্ত বৈদিক দেবতাদের উচ্চকোটির আসনগুলিকে প্রতি বছর পূজা করে নেওয়ার অনুষ্ঠান।

অর্থাৎ পৌরাণিক দেবী দুর্গা, সরস্বতী, লক্ষ্মী ও পৌরাণিক দেবতা কার্তিক ও গণেশের আগমনকে নির্বিঘ্ন করতে কোটিপূজার মাধ্যমে বৈদিক দেবতাদের স্মরণ করা হয় এই অনুষ্ঠানটিতে।

কোটিপূজাই অপভ্রংশে খুঁটিপুজো হয়ে গেছে।

কোটিপূজা > কুটিপূজা > খুটিপূজা > খুঁটিপুজো।

এখনকার দুর্গাপুজোর উদ্যোক্তা খুঁটিপুজো দিয়ে মুখবন্ধ লেখেন, মহালয়ায় সূচিপত্র তৈরি করেন, পঞ্চমীর বোধনে প্রথম প্রবন্ধ বা কবিতা শুরু করেন।

সাবেক আর থিম, দুটি ভাগে ভাগ হয়ে গেছে কলকাতার দুর্গাপুজো।

সাবেকপুজোয় যদি মাদুর্গার পটলচেরা চোখ হয়, থিমের পুজোয় উর্বশী রাউতেলার চোখ দেখা যাবে।

মহম্মদ আলি পার্কের মতো অসুর কখনও ডাক্তারের বেশ ধারণ করে বিতর্কের সৃষ্টি করবে, কখনও কোভিডাসুর হবে।

বুর্জ খলিফার মতো উঁচু মণ্ডপ তৈরি করার প্রতিযোগিতা দেখা যায় থিমের পুজোয়। দুর্গাপুজোয় সনাতন দিন্দার কাজ দেখে একবার মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম। এবারও হাতিবাগান সার্বজনীনে তাঁর বিশ্বস্ত হাতদুটি নিয়ে তিনি সক্রিয়। গৌরাঙ্গ কুইল্যা, জয়ন্ত দাসরাও কম যান না। যে যার নিজের মতো করে থিম ভাবছেন।

১৯৮৫ সালে এশিয়ান পেন্টস নামক রঙকোম্পানি কলকাতার এক পুজোকে স্পনসর করে যে থিমসর্বস্বতা আমদানি করেছিল, এখন সেটা ‘এশিয়া’ ছাড়িয়ে কলকাতার পুজোর ক্ষেত্রে ইউনিভার্সাল হয়ে গেছে।

তবে দু-বছর আগে যদি কলকাতাকে মাতায় শ্রীভূমির বুর্জ খলিফার মতো আকাশছোঁয়া মণ্ডপ, এবার জ্বলজ্বল করবে চন্দ্রযান ৩-এর চন্দ্রবিজয়। ল্যান্ডার বিক্রম ও রোভার প্রজ্ঞানের কত কারিকুরি যে ফুটে উঠবে চন্দননগরের শ্রীধর দাসের আলোয়, তার ইয়ত্তা নেই। বাবু পালও আছেন তাঁর আলো নিয়ে। একসময়ের ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগর যে বহুবছর আগে থেকেই ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ তত্ত্বে বিশ্বাসী, শ্রীধর পাল তা হাতেকলমে দেখিয়ে দিয়েছেন। দেখতে হবে সূর্যযান আদিত্য এল ওয়ান বা জি ২০ সামিট নিয়ে কোনও থিমের চিন্তা কেউ করেন কিনা। চন্দননগরের ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ আলো কি পারবে ভারতবাসী তথা বাঙালির প্রাণের দুর্গাপূজাকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে? ইউনেসকোর স্বীকৃতি পাওয়ার পর বিসর্জনে রেড রোড ও বাবুঘাটে তো সাজ সাজ রব। থিমেরও কোনও থামা নেই। একটাই ভয়। জুনিয়ার পিসি সরকারের ওয়াটার অফ ইন্ডিয়ার মত বৃষ্টি এসে সব ভ্যানিশ করে দেবে না তো?

২০২৩ পেজফোরনিউজ পুজো সংখ্যায় প্রকাশিত


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন