‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’ তার বিখ্যাত দেশাত্মকবোধ গান আজও দেশপ্রমিকের কণ্ঠে গীত হয় পরম শ্রদ্ধায়। এই দেশাত্মকবোধ গানটির গীতিকার কে তা কম লোকই জানে। এই গানটির গীতিকার মোহিনী চৌধুরী।
মোহিনী চৌধুরীর লেখা ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’, ‘আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়’, ‘দিনদুনিয়ার মালিক তোমার’, ‘ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে’-সহ অনেক গান এখনো মুখে মুখে ফেরে৷ কিন্তু কালজয়ী গীতিকার মোহিনী চৌধুরী অনেকটাই উপেক্ষিত৷
সংগীতের চর্চায় বরাবরই গীত রচয়িতাদের একটু লঘু চোখে দেখা হয়৷ গান হয়ে যায় কণ্ঠশিল্পীর৷ কখনো-সখনো জনপ্রিয় গানের সুরকার কিছুটা কৃতিত্ব পেলেও আড়ালে থেকে যান গীতিকার৷ এই আড়ালে থাকার বেদনা সারা জীবন বয়ে বেড়িয়েছেন মোহিনী চৌধুরী৷ স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের বাংলা আধুনিক গানের জগতে বহু জনপ্রিয় গানের রচয়িতার ২০২০ সালে জন্মশতবর্ষ পালিত হয়নি বললেই চলে।
তার জন্ম অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার কোটালিপাড়ায় ৫ সেপ্টেম্বর ১৯২০। তার পিতা মতিলাল চৌধুরী ইংরেজ আমলে সরকারি ডাক বিভাগে কাজ নিয়ে দীর্ঘদিন মেসোপটেমিয়ায় ছিলেন; মাতা গোলাপকামিনীদেবী। কলকাতার রিপন স্কুল (সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) থেকে বিশেষ কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পাশ করেন ও ওখান থেকেই আই. এস. সি পাশ করে বি. এস. সি তে ভর্তি হন। গানের প্রতি নেশায় বি.এস. সি পরীক্ষা অসমাপ্ত রেখে গান লেখার সাথে যুক্ত হন। ১৯৪০ সালে কলকাতা জিপিও তে চাকরিতে যোগদান করেন। তিনি আট বছর মাত্র এই চাকরিতে ছিলেন।
চল্লিশের দশকের গোড়া থেকে তাঁর গীতিকার জীবনের শুরু৷ এক দশক না ঘুরতেই বিপুল জনপ্রিয় হয়েছিল গীতিকবির লেখা অনেক গান৷ ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’ থেকে ‘আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়’ আজো বাঙালির শ্রুতির সঙ্গী হয়ে আছে৷ তিনি বেঁচে আছেন ‘দিনদুনিয়ার মালিক তোমার দীনকে দয়া হয় না’, ‘ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে, তোমারে করেছে রানি’, ‘শুনি তাকদুম তাকদুম বাজে বাজে ভাঙা ঢোল’, ‘পৃথিবী আমারে চায়’-এর মতো কালজয়ী, জনপ্রিয় গানের মধ্যে৷ সিনেমার গানেও তিনি প্রতিভার ছাপ রেখেছেন৷ ‘নায়িকা সংবাদ’ ছবিতে ‘কী মিষ্টি দেখো মিষ্টি’ বা ‘কেন এ হৃদয় চঞ্চল হলো’ আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে৷
১৯৪৩ খৃষ্টাব্দ থেকে গ্রামোফোন রেডিও সিনেমার গীতিকার হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু হয়। ‘রাজকুমারী ওলো, নয়নপাতা খোলো, সোনার টিয়া ডাকছে গাছে ওই বুঝি ভোর হল’ মোহিনী চৌধুরীর প্রথম গানের রেকর্ড। গানটি গাইলেন কুসুম গোস্বামী কমল দাশগুপ্তর সুরে। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘অভিনয় নয়’ ছায়াছবিতে প্রথম গান লেখার সুযোগ পেলে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। জিপিও’র চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে সর্বক্ষণের জন্যে গানের জগতে মনোনিবেশ করেন। রংবেরঙ, সন্ধ্যাবেলার রূপকথা, একই গ্রামের ছেলে, ব্লাইন্ড লেন ইত্যাদি ছবিতে সহকারী চিত্রপরিচালনার কাজ করেন এবং গান লেখেন। তার পরিচালিত ও প্রযোজিত ছবি সাধনা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হলে তিনি বিজ্ঞানী ও সাংসদ মেঘনাদ সাহার অধীনে সংসদীয় সচিবের চাকরি করেন কিছুকাল। ১৯৫৪ সালে শিল্পপতি ডি. এন ভট্টাচার্যের একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করতে থাকেন। পরে প্রাইভেটে বি.এ পাশ করেন। ১৯৭১ সালে ডি.এন ভট্টাচার্যের ব্যবসা বিপর্যয় ঘটলে তার ১৭ বছরের চাকরিটি চলে যায়। শেষ জীবনে আর্থিক দুর্গতির সম্মুখীন হন এই জনপ্রিয় গীতিকার। গ্রামোফোন রেকর্ড ও সবাক চলচ্চিত্রে তার অজস্র গান শ্রোতাদের ভেতর খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। যার কিছু আজো বাঙালির মুখে মুখে ফেরে। ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হলো বলিদান’ নামক দেশাত্মবোধক গানটির জন্যে তিনি খ্যাতি ও সুনামের অধিকারী হন। এই গানটির সুরকার ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে।
তার লেখা বিখ্যাত গানগুলো মধ্যে ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’, কাশ্মীর হতে কন্যাকুমারী, ভালবাসা মোরে ভিখারি করেছে, শতেক বরষ পরে জয় হবে হবে জয়, শুনি আগডুম বাগডুম বাজে, কেন এ হৃদয় চঞ্চল হলো কে যেন ডাকে, আজ চঞ্চল মন যদি ইত্যাদি।
প্রসঙ্গক্রমে গায়ক জগন্ময় মিত্র ও সুরকার কমল দাশগুপ্ত-র সঙ্গে মোহিনীবাবুর কথা বলতে হয় তার লেখা যে কয়েকটি গান জনপ্রিয় হয় তাহল—ভুলি নাই ভুলি নাই, আমি যে দুরন্ত বৈশাখী ঝড়, ভালবাসা মোরে ভিখারী করেছে
গীতিকার মোহিনী চৌধুরীর কিছু গানের কথা বলতে হয়। জানা যায়, প্রখ্যাত সুরকার কমল দাশগুপ্ত মোহিনীর লেখা ‘পৃথিবী আমারে চায়’ গানটি ফেরত দিয়ে বলেছিলেন তাঁর লেখা এই গান চলবে না। কিছুদিন পরে এইচএমভি কিছু গান চেয়েছিল মোহিনীর কাছে। মোহিনী তাঁর ‘পৃথিবী আমারে চায়’ গানটিও দেন। এই গান রেকর্ড করেন সত্য চৌধুরী। বিশাল হিট করে যায় গানটি। সত্য চৌধুরী আর উত্তমকুমার ভবানীপুরেই থাকতেন এবং পরস্পরের বন্ধুত্ব ছিল। এই গানটি উত্তমের এতটাই ভালো লেগে যায়, যে এই গানের প্রথম লাইন দিয়ে উত্তমকুমার-মালা সিনহার ছবির নামকরণ হয় পৃথিবী আমারে চায়। গানটি তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে কালজয়ী হিট হয়।
দেবেন ভট্টাচার্যর ছবি ‘নায়িকা সংবাদ’-এর গীতিকার হওয়ার সুযোগ পেলেন মোহিনী চৌধুরী, সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। কিন্তু তার লেখা দুটো গানই নায়িকা অঞ্জনার লিপে। উত্তমের লিপের গান মোহিনী পেলেন না। ছবি রিলিজ হতেই দেখা গেলো অঞ্জনার লিপের ‘কী মিষ্টি দেখো মিষ্টি’ এবং ‘কেন এ হৃদয়, চঞ্চল হল’— সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া দুটো গানই লোকের মুখে মুখে। এর পরে ‘শুকসারী’ ছবিতে উত্তমকুমারের লিপে মোহিনীর লেখা গান গাইলেন মান্না দে— ‘সখি চন্দ্রবদনী, সুন্দরী ধনি।’ এ সময়ে মোহিনী চৌধুরীর লেখা গান গাইলেন জগন্ময় মিত্র, ‘ভালবাসা মোরে ভিখারি করেছে, তোমারে করেছে রানি’।
মোহিনী চৌধুরী একজন লেজেন্ড, উপেক্ষা আর অবহেলা নিয়েই পেরিয়ে গেছে তাঁর জীবন। মোহিনীর স্ত্রী লীলা চৌধুরী ও বড় পুত্র ভবিষ্যত চৌধুরী দুজনেই সফল গীতিকার। মেজো পুত্র দিগ্বিজয় সরকারি চাকরির পাশাপাশি সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র প্রযোজক।
জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কাজ করে গেছেন মোহিনী চৌধুরী। ১৯৮৭ সালের ২১ মে সারাদিন স্টুডিওতে কাজ করলেন, রাতে ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাক। মোহিনী চৌধুরীর লেখা কালজয়ী গানগুলো নতুন নতুন প্রজন্মগুলি যখনই গাইবে আমাদের মনে পড়বে মোহিনী চৌধুরীকে শ্রদ্ধায় এবং ভালোবাসায়। মোহিনী চৌধুরির ১০১ তম জন্মশতবর্ষে তার পরিবারের সদস্যরা তার ১০১টি গানের সংকলন — মোহিনী চৌধুরী ১০১ গানে গানে প্রকাশ করেন।
গীতিকার মোহিনী চৌধুরী মারা যান ২১ মে, ১৯৮৭ সালে। তার লেখা –মুক্তির মন্দির সোপানতলে এই গান তাকে চির স্মরণীয় করে রাখবে।
মনোজিৎকুমার দাস, প্রাবন্ধিক, লাঙ্গলবাঁধ, মাগুরা, বাংলাদেশ।