গঙ্গাতীরে, দক্ষিণেশ্বর কালিবাড়িতে মাস্টার এসেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গে দেখা করতে। ১৮৮২ সালে বসন্ত কালের কথা। মন্দিরের কাছে শ্রীরামকৃষ্ণের ঘর। সেখানে কাজ করেন বৃন্দা নামের এক পরিচারিকা। তাঁকে মাস্টার জিজ্ঞেস করছেন, আচ্ছা এই সাধু কি খুব বইটই পড়েন। বৃন্দা বলছেন, আর বাবা বই-টই! সব ওঁর মুখে! পরে মাস্টার কথা বলছেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গে। মাস্টার বলছেন, যাঁরা মাটির প্রতিমা পূজো করেন, তাঁদের তো বুঝিয়ে দেওয়া উচিত যে মাটির প্রতিমা ঈশ্বর নয়, আর প্রতিমার সামনে ঈশ্বরকে উদ্দেশ করে পূজা করেন, মাটিকে পূজা করা উচিত নয়। এ কথা শোনামাত্র বিরক্ত শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, তোমাদের কলকাতার লোকের ওই এক। কেবল লেকচার আর লেকচার। লেকচার দেওয়া আর বুঝিয়ে দেওয়া। আপনাকে কে বোঝায় তার ঠিক নেই। তুমি বোঝাবার কে? যাঁর জগৎ তিনি বোঝাবেন। যিনি জগৎ করেছেন, চন্দ্র, সূর্য, ঋতু, মানুষ, জীব-জন্তু করেছেন, সকলের খাবার উপায় করেছেন তিনিই বোঝাবেন। ‘তিনি এতো উপায় করেছেন, আর এ উপায় করতে পারেন না’। হতভম্ব মাস্টার ভাবছেন ইনি যা বলছেন তা তো ঠিক। আমি কি ঈশ্বরকে জানি যে তাঁর কথা লোককে বোঝাবো। এর পর থেকে নিয়মিত দক্ষিণেশ্বর আসা যাওয়া। কিন্তু কে এই মাস্টার?
মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত সারা পৃথিবী জোড়া পরিচিতি পেয়েছেন ওই মাস্টার বা শ্রীম নামে। তাঁর লেখা শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের মুখের কথা লোকের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেল। মহেন্দ্রনাথ নিজেকে বলতেন শ্রীরামকৃষ্ণের স্টেনোগ্রাফার।
মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের জন্ম ১৮৫৪ সালের ১৪ জুলাই। তাঁর বাবা মধুসুদন গুপ্ত এবং মা শ্যামাময়ী দেবী। মহেন্দ্রনাথের পড়াশোনা কলকাতার হেয়ার স্কুল এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে। একসময় ব্রাহ্ম সমাজে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। খুব অল্পবয়সে মাকে হারান মহেন্দ্রনাথ। সংসারে হাজারো জটিলতা পারিবারিক অশান্তিতে একসময় আত্মহত্যার কথাও ভেবেছেন। পরবর্তীকালে বলতেন, তাঁর জীবন সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হলো শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখার পর।
একদিকে স্বামী বিবেকানন্দ সারা পৃথিবী জুড়ে প্রচার করেছেন শিব জ্ঞানে জীব সেবার আদর্শ। আর মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের লেখায় একে একে পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত।
ভারতবর্ষে আঠারোটা পুরাণকাহিনির মধ্যে ভাগবত পুরাণ অত্যন্ত জনপ্রিয়। বলা হয় ১৮ পুরাণ রচয়িতা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস সব পুরাণ লিখেও শান্তি পাননি। ভাগবৎ পুরাণ রচনা করার পর তাঁর অন্তরে শান্তি আসে। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষও এই পুরাণকথা পড়ে বা শুনে তপ্ত জীবনে শান্তির বারি পেয়ে থাকেন। এই পুরাণকাহিনি শুনলেও মঙ্গল হয়। মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত শ্রীমদ্ভাগবত-এর এই শ্লোকটি রামকৃষ্ণ কথামৃতের সূচনায় উদ্ধৃত করেছেন। সকলেই জানেন ‘তব কথামৃতম তপ্তজীবনম্…’ এই শ্লোকটি। পৃথক পৃথক সময় হলেও পাঁচ খণ্ডে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত প্রকাশিত হয়েছে। শ্রীম উত্তর কলকাতার ঠনঠনিয়া কালিবাড়ির কাছে থাকতেন। তাঁর বাড়ির নাম কথামৃত ভবন। এখান থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত। পরে রামকৃষ্ণ মিশন-সহ বহু প্রকাশক এই বই প্রকাশ করেছেন। বাংলা ভাষায় সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় সম্ভবত এই বইটি। হিন্দু-মুসলমান, শিখ-খ্রিস্টান সব ধর্মের মানুষ এই বই পড়ে আনন্দ পান। এই বইয়ের ছত্রে ছত্রে রয়েছে জীবনকে ঘিরে গভীর সব প্রশ্ন আর সর্বধর্মসমন্বয়ের চিরায়ত বাণী। এ কথা কে না জানে যে শ্রীরামকৃষ্ণ আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘যত মত, তত পথ’। বহু গুরুত্বপূর্ণ কবি-লেখকরাও শ্রীম বা মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের আশ্চর্য লিখনশৈলী উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। যাঁরা বিশ্বাসী ভক্ত কিংবা আধ্যাত্ম জিজ্ঞাসু তাঁরা তো শিয়রের কাছে রেখে দেন এই পাঁচ খণ্ড। শ্রীসারদা মা বলেছিলেন মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত সম্পর্কে, উনি সারা জগতের উপকার করলেন।