“কোথায় আমার সবুজ সকাল, হলুদ বিকেল, জোনাক ঝিঁঝিঁ
কোথায় আমার মাটির বাড়ি, নদীর খেয়া,
করিম মাঝি
আমি চাইনা শহর, ইঁটের সারি নিয়ন রাতে
আমি অরণ্য চাই, অরণ্য দাও আমার হাতে”
আজও পরিবেশকে বাঁচাতে, পরিবেশ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তুলতে গান বাঁধেন গীতিকার, তাতে সুর সংযোজনা করেন সুরকার, শিল্পীর রং তুলিতে একটা সুন্দর পৃথিবীর ছবি ফুটে ওঠে, একজন ভাস্কর গাছের শরীরে স্থাপন করেন মানুষের মুখ। প্রতিদিন কত স্লোগান তৈরি হচ্ছে, প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে কত কবিতা। আজও শানু জল দেয় রোজ জুঁইয়ের চারাতে, কারণ সে জানে ফুল হলে গন্ধটা সারা পাড়া ভরিয়ে তুলবে। অথচ পৃথিবীর উষ্ণতা বেড়ে চলেছে। আমাদের পরিবেশ আজ বিপন্ন, বিপন্ন মানব সভ্যতা। এই পৃথিবীকে আগামী শিশুর বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার যে অঙ্গীকার করেছিলেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য, তা বাস্তবায়িত করতে পারব তখনই যখন পরিবেশকে সুস্থ পরিচ্ছন্ন সুন্দর রাখার মহতী উদ্যোগে সামিল হবো আমরা সকলে। বর্তমানে পৃথিবী নানা সমস্যার সম্মুখীন। বিশ্ব উষ্ণায়ন আজ প্রতিটি দেশেরই মাথাব্যথার কারণ। মানুষের সচেতনতার অভাবই আজ পৃথিবীকে নিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের দিকে। সুস্থ শরীরে সুস্থ মন বাসা বাঁধে, আর সুস্থ শরীরের জন্য দরকার সুস্থ পরিবেশ।
প্রকৃতি তো আমাদের বাড়ি, আমাদের ঘর। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন ‘প্রকৃতি আমাদের সব প্রয়োজন মেটাতে পারে কিন্তু আমাদের লোভ মেটাতে পারে না’। বন-জঙ্গল আমাদের সম্পদ, তাকে অবাধে ধ্বংস করলে বিপন্ন হবে যেমন বন্যেরা, তেমনি বিপন্ন হবো আমরা। অস্ত্র প্রহরায় নয় গাছ বাঁচাতে হবে সামাজিক সচেতনতার প্রহরায়।’ পরিবেশ দপ্তরের চেষ্টা আমাদের পথ দেখায়। স্কুলে স্কুলে তারা সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দিতে সচেষ্ট। তাদের তৈরি করা স্লোগান, পোস্টার তরুণ মনে প্রভাব ফেলুক, তারা উচ্চারণ করুক “শহর হোক নগর হোক/ হোক উন্নয়ন/ তার সাথে গাছ লাগানোও/বড্ড প্রয়োজন।”জীবাশ্ম সম্পদকে নষ্ট হতে দিলে চলবে না, জলাভূমিকে বুঝিয়ে ইমারত তৈরি করে বাস্তুতন্ত্রকে হত্যা করলে চলবে না, নদীর স্বাভাবিক গতিকে রুদ্ধ করলে চলবে না।বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া জলঙ্গি নদীকে দেখে কান্না পায়। অঞ্জনা, চূর্ণী, গঙ্গা-ভাগীরথী নদীগুলির অবস্থা দেখলে কষ্ট হয়। অথচ মানুষের লড়াই কিন্তু থেমে নেই। পরিবেশপ্রেমী মানুষেরা তাদের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। একদল সন্ন্যাসী গঙ্গাকে দূষণের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য আমৃত্যু অনশন করে চলেছেন। সবুজপ্রেমী মানুষেরা দলে দলে পথে নামছেন গাছ লাগানোর, গাছ বাঁচানোর বার্তা নিয়ে। আমারও বলতে ইচ্ছে করে —
চলো না সবাই গাছের জন্য একটা কবিতা লিখি
চলো না সবাই রঙ দিয়ে আজ গাছেদের ছবি আঁকি
চলো না সবাই সবুজ আলোয় পৃথিবীটা ভরে তুলি
আজ মনে হয় ওদের সঙ্গে কত কথা আছে বাকি
ছন্দে ছন্দে ওরা যেন বলে”আমরা তো ভালো নেই,
এই পৃথিবীর রঙিন আভায় আমরা বাঁচতে চাই।”
চলো না সবাই মন দিয়ে আজ ওদের কথাই শুনি
চলো না সবাই ওদের কাছেই ভালোবাসা নিয়ে যাই।
পরিবেশবন্ধুরা রাস্তায় বাজারে প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করার জন্য মানুষের কাছে কত না অনুরোধ করছেন। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা রক্তদান শিবিরে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন গাছের চারা। জন্মদিনে সচেতন বাবা-মায়েরা তুলে দিচ্ছেন সবুজ চারা। বিয়ের আসরে নিমন্ত্রিতদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু পরিবেশের বন্ধু সবুজ গাছ। কেউ কেউ হয়তো প্রশ্ন করতেই পারেন এই গাছগুলিই বা লাগানো হবে কোথায়? গাছগুলি যত্নে থাকবে তো? এগুলি রক্ষণাবেক্ষণই বা কিভাবে হবে? উত্তর দেওয়া হয়তো কঠিন। কিন্তু একজন মানুষের একক প্রচেষ্টাতেই যখন গড়ে উঠতে পারে একটি সুন্দর বাগান, তখন আমরা চেষ্টা করলেই পারি প্রত্যেকেই তাদের নিজেদের মতো করে সবুজ বাগান গড়ে তুলতে, আর আগামী প্রজন্মকে অন্তত গাছ লাগানোর, গাছ বাঁচানোর শপথ গ্রহণ করাতে। প্রসঙ্গত কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার সেই লাইনগুলি মনে পড়ছে-
‘গাছগুলো তুলে আনো বাগানে বসাও’। আসলে ‘শহরের অসুখ হাঁ করে কেবল সবুজ খায়’।
একশ্রেণির শিক্ষিত সাধারণ মানুষের এবং এক শ্রেণির সুযোগসন্ধানী দেশনেতার উদাসীনতাই পৃথিবীর সুস্থ থাকবার পথের বাধা। কিন্তু সেই বাধাকে অতিক্রম করা খুব একটা কঠিন নয়। চলুন নদীকে বয়ে যেতে দিই স্বাভাবিক ছন্দে। শব্দ মধুর, আবার সেই শব্দই বেদনাবিধুর। শব্দের সীমিত ব্যবহার কাম্য। পরিবহনবহুল শহরে অটোমোবাইল এমিশন শূন্য করার লক্ষ্যে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে- “দূষণ নিয়ন্ত্রিত পরিবহণ/ চাপমুক্ত জীবন।”
কিছুদিন আগেই পাহাড়ের একটি গ্রাম থেকে ঘুরে এলাম। খুব কম মানুষের বাস সেখানে যদিও, তাই হয়তো পরিবেশ সেখানে একেবারেই অন্যরকম, কিন্তু তবু সেই মানুষগুলোই আমাদের শেখান জলের সীমিত ব্যবহার, জৈব সারের প্রয়োগ, অরণ্যকে রক্ষা করবার আন্তরিকতা। আমাদের ব্যবহৃত প্লাস্টিকের জলের বোতলগুলিকে তারা ব্যবহার করছেন রঙবেরঙের বাহারি ফুলের আধার হিসাবে। ব্যবহৃত জলকেই চাষের কাজে লাগাচ্ছেন। অথচ আমাদের গ্রামীণ-নাগরিক জীবনে পথের দু’ধারের কলগুলি দিয়ে কত না জল প্রতিদিন অকারণে বয়ে যাচ্ছে। অথচ এই পংক্তিগুলি আমাদের কাছে খুবই পরিচিত —
“কলের জল যাচ্ছে বয়ে
এই অপচয় বন্ধ হোক
ভেবে দেখো প্রয়োজনে
জল পায় না কত লোক “
জলের পরিমিত ব্যবহারই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য জল সংরক্ষণ করতে পারে। কমে আসছে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা, কমে যাচ্ছে শামুক, গেঁড়ি, গুগলি, খলসে, ন্যাদোশ, সরপুটি মাছ। বাঁচাতে হবে পুকুর খাল-বিল। প্লাস্টিকের ব্যাগ জল নিকাশি ব্যবস্থায় বাধার সৃষ্টি করে চরম বিপদ ডেকে আনে। এগুলি জমিকে বিষাক্ত এবং দূষিত করে তোলে। চলো না সবাই মিলে আবার পুরনো চটের থলেতেই ফিরে যাই। সবজি বাজার, মাছের বাজারে প্লাস্টিক ব্যাগের বিকল্প হিসেবে নিয়ে যায় চটের থলে কিংবা স্টিল বা অ্যালুমিনিয়ামের টিফিন কৌটো। কবিতার জন্ম দিতে ইচ্ছে করে-
চলো না সবাই একসাথে বলি —
‘প্লাস্টিক আর নয়’
প্লাস্টিক মানে সবুজ পৃথিবী
ধ্বংস হবার ভয়।
সমুদ্রবুকে প্লাস্টিক জমে
প্লাস্টিক গেলে মাছ
সময় হয়েছে, বিকল্প খুঁজে
পৃথিবী বাঁচাও আজ।
পাহাড়ের গ্রাম ছবির মতন
আগামীর কথা ভাবে
আমাদের মন অবুঝ ভীষণ
বুঝতে শিখবে কবে।
প্লাস্টিক মানে কত না অসুখ
বিষাক্ত পরিবেশ
চলো না সবাই গড়ে তুলি আজ
প্লাস্টিকহীন দেশ।
নদী তো বাঁচুক, মাটি তো বাঁচুক
প্রকৃতি সাজুক গানে
প্লাস্টিকহীন পৃথিবীতে বাঁচো
শ্যামল স্নিগ্ধ প্রাণে।
এখন তো স্মার্ট টিভি, স্মার্ট মোবাইলের যুগ। আমরা এখন এমন একটা স্মার্ট বাড়ি তো চাইতেই পারি যেখানে সূর্যের তাপ, বায়ুর বেগ, আর বৃষ্টির জলকে কাজে লাগাতে পারবো আমরা। ‘বন্ধুত্বের উষ্ণতা বাড়ুক, বিশ্বের নয়।’
বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হবে প্রতিবছর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। পৃথিবীও একটু একটু করে এগিয়ে যাবে ধ্বংসের পথে। আমরা সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হবো, ভীতসন্ত্রস্ত হবো পৃথিবীর ধ্বংসের কথা ভেবে। অথচ কবে সচেতন হবো? যদি পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই তাহলে অবশ্যই আমাদের সকলকে হাতে হাত রেখে বন্ধুত্বের উষ্ণতা বাড়াতে হবে। পৃথিবীকে সবুজ আলপনায় ভরিয়ে তুলি। আমাদের সমস্ত পাপ ধুয়ে যাক অমৃত রসধারায়। বিষময় মন উড়ে যাক দূরে। রঙিন পালক নিয়ে সে নেমে আসুক সদ্যফোটা রজনীগন্ধার উপর। আমাদের শৈশব ছবি আঁকুক এক স্বপ্নের পৃথিবীর…. সবুজ পাহাড়, মেঠোপথ, স্বচ্ছ নীল জল, পানকৌরি, চড়ুই-শালিকের। শান্তি নামুক বনস্পতির বুকে, শান্তি নামুক অন্তরীক্ষে। অমৃতের আভা আজন্ম প্রিয় আমার পৃথিবীর উপর ছড়িয়ে পড়ুক।
লেখক : অমৃতাভ দে দোগাছি উচ্চ বিদ্যালয়ের বাংলা শিক্ষক, কথার ঘর, শিবতলা লেন, ঘূর্ণি, কৃষ্ণনগর নদিয়া।
জরুরী উচ্চারণ
খুব ভালো লেখা।
বড্ড প্রয়োজন সবুজ রক্ষার। আসুন সবাই মিলে এই মহান ব্রতে ব্রতী হই।💖💖💖💖
বর্তমান সময়ের পরিবেশের বিপন্নতা বিষয়ক বাস্তব সমস্যাকে সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে এই নিবন্ধে। সেই সঙ্গে এই সমস্যা নিরসনের জন্য আমাদের করনীয় কী, তারও পথনির্দেশ দেওয়া হয়েছে এখানে। তাই, নিবন্ধটি আমার খুব ভালো লেগেছে।
“বন্ধুত্বের উষ্ণতা বাড়ুক পৃথিবীর নয়” – প্রবন্ধ টা যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে পড়লাম। খুব ভাল লেগেছে। লেখনীর শব্দচয়ন, শব্দের বুনন নতুনত্বের দাবী রাখে, সর্বপরি লেখনীর প্রতিটি ছন্দে রন্ধ্রে প্রকৃতি মা কে দুষন দারা রক্তাক্ত অবস্থায় দেখলাম। কিন্তু প্রবন্ধ টা পড়তে পড়তে দুটো একটা প্রশ্ন মনের কোণে উঁকি মারলো তাই লিখে প্রকাশ করছি।
১/ তথাকথিত শিক্ষিত অশিক্ষিত ব্যাক্তিরা কি প্রকৃতি মা এর যে সমস্ত স্থান এখনো বিষাক্ত হয় নি সেই সমস্ত গ্রাম্য পরিবেশ কে ভালবেসে সেখানে তাদের বাসস্থান এর যায়গা করছে?
২/ যাদের সামর্থ্য আছে তারা গ্রামের দুষনমুক্ত পরিবেশ ছেড়ে শহরের বিষাক্ত দুষিত পরিবেশে গিয়ে কয়েকটা গাছের জায়গা দখল করে নিয়ে বিষাক্ত পরিবেশ কে কি আরো বিষাক্ত করছে না?
৩/ বিভিন্ন ধরনের লেখনী, পরিবেশ কে সক্রিয় অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য যে সব সরকারি ও বেসরকারি পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়েছে সে গুলো কি সঠিক লক্ষে পৌঁছাতে পারছে? নাকি “বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদছে”।
খুব ভালো লাগলো।