খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ ভারতের মধ্য ও পূর্বাঞ্চলের মোট জনসংখ্যার ৮.২ শতাংশ আদিবাসীদের বাস। একইভাবে মধ্য ভারতের ছত্তিশগড় রাজ্যের বস্তার বিভাগে মোট জনসংখ্যার ৬৭ শতাংশ আদিবাসী এবং তফসিলি উপজাতি। আদিবাসীদের জীবনযাত্রায় জল, জঙ্গল, জমিন হল সম্পদ। কিন্তু পুঁজিবাদ, অর্থনৈতিক উদারীকরণ এবং কৃষি সংস্কারে তাঁদের বিশ্বাস গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে। যুগ যুগান্ত ধরে তাঁরা স্ব-শাসনের পথ বেছে নেওয়ায় ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ প্রশাসন আদিবাসীদের “বর্বর” চিহ্নিত করেছিল। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে এবং তাঁদের জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ বনের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়ায় ১৮৬৪ সালে বন বিভাগ, ১৮৭৮-এ ভারতীয় বন আইন এবং ১৯২৭ সালে আরও কঠোর বন আইন তৈরি হয়। এই সময় থেকেই আদিবাসী জনগোষ্ঠী ভূমি এবং পরিবেশের সাথে তাদের সংযোগ রক্ষা এবং স্থিতিশীল জীবিকা নিশ্চিত করার জন্য লড়াই করে আসছে।
পরবর্তীতে ঔপনিবেশিক বন ব্যবস্থাপনায় আদিবাসী সংস্কৃতির সম্পূর্ণ বিপরীত ব্যক্তিগত সম্পত্তি প্রবর্তন হওয়ায় স্থানীয় গোন্ড উপজাতিরা প্রান্তিক হয়ে পড়ে। এরপর “উন্নয়নের” নামে উপজাতিদের জমি থেকে বিচ্ছিন্ন করার ধারাবাহিক প্রচেষ্টা শুরু হলে তাঁরা বিদ্রোহ করে। উল্লেখ্য, ১৯১০ সালের বস্তার বিদ্রোহ (ভূমকল) সরকারী নীতির বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম। স্বাধীনতা পরবর্তী নতুন শতকে রাজ্য সরকার উন্নয়নের উদ্দেশ্যে খনি কোম্পানিগুলিকে অচাষযোগ্য জমি দেওয়ার পরিকল্পনা করলে হাজার হাজার আদিবাসী বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় পড়েন ফলে অস্থিরতা শুরু হয়। আদিবাসীদের ভূমির অধিকারচ্যুতির বিরুদ্ধে, খনি কোম্পানি, পুলিশ ক্যাম্প এবং রাষ্ট্রের অত্যাচারের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের সংগঠিত করতে মাওবাদীরা সাহায্যের হাত বাড়ায়। সেই সময় দেশের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ছত্তিশগড়ে মাওবাদীদের বিদ্রোহকে দেশের জন্য সবচেয়ে বড় “অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকি” অভিহীত করায় প্রায় ৪১টি ব্যাটালিয়ন, কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ৩১,০০০ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ বাহিনীর কোবরা (কমান্ডো ব্যাটালিয়ন ফর রেজোলিউট অ্যাকশনস) দুটি বিশেষ ইউনিট সহ বিশাল সামরিক মোতায়েন হয়েছিল।
মাওবাদীদের দমন করতে “অপারেশন গ্রিন হান্ট”, তিন দিনের একটি বিশাল যৌথ অভিযান, যেখানে কোবরা এবং রাজ্য পুলিশ মাওবাদী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে। এর ফলে ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং মহারাষ্ট্রের সীমান্তে নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন আরও বৃদ্ধি পায়। ফলস্বরূপ, “চিরুনি ও তল্লাশি” অভিযান, বেআইনি হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা তীব্রতর হয়, যার ফলে মাওবাদী, আদিবাসী এবং রাজ্যের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া সালওয়া জুদুম অভিযান হয়, এই মিলিশিয়া ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর চেয়েও নির্দয় ছিল, এই অভিযান নিরীহ বেসামরিক আদিবাসীদের নানাভাবে হয়রান করেছে, অনেক গ্রামবাসীকে মিলিশিয়ায় যোগ দিতে বাধ্য করেছে। এমনিতেই নিরাপত্তা বাহিনী ছত্তিশগড়ের সুকমা জেলার তাদমেতলা গ্রামে কমপক্ষে ৩০০টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়, নৃশংস আক্রমণে একাধিক পুরুষ নিহত এবং মহিলারা ধর্ষণের শিকার হন। অভিযোগ, বিভিন্ন সরকারি সংস্থার সালওয়া জুদুম হত্যা, গণধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট এবং গ্রামবাসীদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করার জন্য দায়ী। সালওয়া জুদুমের সহিংসতা থেকে বাঁচতে প্রায় ৩০,০০০ আদিবাসী ছত্তিশগড় ছেড়ে অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তেলেঙ্গানায় বসতি স্থাপন করতে পালিয়ে যায়। ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্ট অবশেষে এই মিলিশিয়াকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
কিন্তু ছত্তিশগড়ের প্রত্যন্ত বস্তারে মাওবাদী দমনের নামে আদিবাসীদের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং রাষ্ট্রীয় মদতে খুন ও গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। বিজেপি সরকারের দাবি অনুযায়ী শাসনের প্রথম আট মাসে ১৪৭ জন মাওবাদী এনকাউন্টারে নিহত হয়েছেন, ৬৩১ জন আত্মসমর্পণ করেছেন এবং ৭২৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই পরিসংখ্যানে কতজন আসলে মাওবাদী এবং কতজন নিরীহ আদিবাসী, তা তদন্তের বিষয়। তবে সরকারের দাবি অনুযায়ী, বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর মাওবাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছে। প্রমাণ হিসেবে তারা এনকাউন্টারে নিহত, আত্মসমর্পণকারী, অথবা গ্রেফতারের পরিসংখ্যান উপস্থাপন করে। ছত্তিশগড় রাজ্য গঠনের পর থেকে কংগ্রেস ও বিজেপি মাওবাদী নিধনের পরিসংখ্যান দেয়, কিন্তু বাস্তবতা হল, বাস্তার ব্যাপকভাবে সশস্ত্র এবং আজও প্রতি ৯ জন নাগরিকের মাথার দিকে একজন আধাসামরিক সৈন্যের বন্দুক তাক করা আছে। বাস্তার রেঞ্জে প্রতি ২-৭ কিলোমিটার দূরে একটি নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প রয়েছে। বিজেপি ক্ষমতায় আসার এক বছরের মধ্যেই গ্রামে গ্রামে প্রায় ৫০টি শিবির স্থাপন করা হয়, ‘যোজনা’ তৈরি করে প্রকল্পের একটি খুব সুন্দর নাম দেওয়া হয় — নিয়াদ নেল্লানার অর্থাৎ মেরা গাঁও খুশি যোজনা!
কিন্তু আদিবাসীরা কি সরকারের এই আওয়াজ সমর্থন করছে? না কারণ, নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প, প্রকল্প তাদের নিপীড়নের জন্য, তাঁদের জমি-জঙ্গল ধ্বংস করে তৈরি করা হয়েছে। বিজেপি শাসনামলে আবুঝামাদে সেনাবাহিনীর যুদ্ধ অনুশীলন রেঞ্জ তৈরির প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। এর জন্য ৫৪,০০০ হেক্টর (১.৩৫ লক্ষ একর) জমি প্রয়োজন। নারায়ণপুর জেলার কোহকামেটা তহসিলের ১৩টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ৫২টি গ্রামকে উচ্ছেদ করে এই জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এই ৫২টি গ্রামের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১০,০০০। মাওবাদী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও, প্রশ্নটি অবশ্যই এসে পড়ে যে সেনাবাহিনীর জন্য যুদ্ধ অনুশীলন রেঞ্জ তৈরির এই প্রকল্পে বস্তারের কতটা উন্নয়ন হবে? ৫২টি গ্রামের উচ্ছেদ কি পেসা (PESA) বা পঞ্চায়েত সম্প্রসারণ তফসিলি অঞ্চলের স্ব-শাসনের অধিকার অনুসারে আদিবাসীদের সম্মতিতে করা হবে নাকি বন্দুকের মুখে? আসল কথা হল মাওবাদ দমন একটি অজুহাত, কার্যত বস্তারের প্রাকৃতিক সম্পদ কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে যে কণ্ঠস্বর তাকে চিরতরে স্তব্ধ করা। কর্পোরেটদের হাতে আদিবাসীদের জঙ্গল এবং জমি হস্তান্তরের বিরোধিতা এবং পেসা এবং বন অধিকার আইনের দাবিতে আন্দোলনের নেতা রঘু মিদিয়ামির গ্রেপ্তার জানিয়ে দেয় যে ছত্তিশগড়ে গণতান্ত্রিক অধিকার সীমাবদ্ধ। “উন্নয়নের” নামে সেখানে বছরের পর বছর ধরে আদিবাসী নির্যাতন আর মানবাধিকার লঙ্ঘন চলছে।