হোসাং শাহ-এর সমাধি, মাণ্ডু
দিল্লির মসনদে তখন ফিরোজ শাহ তুঘলকের পুত্র মহম্মদ শাহ তুঘলক। তিনিই মালওয়া রাজ্যের গভর্নর হিসেবে পাঠালেন দিলওয়ার খান ঘোরিকে। দিলওয়ার স্বাধীনভাবে কাজ করলেও নিজেকে স্বাধীন সুলতান বলে ঘোষণা করেননি।
১৪০৫ সালে দিলওয়ার খান মারা গেলেন। তাঁর একটি পুত্র ছিলো, তার নাম অল্প খান। বাবার মৃত্যুর পরে নিজেই নিজের নাম পালটে হয়ে গেলেন : হোসাং শাহ। হোসাং প্রথমেই দিল্লির অধীনতা অস্বীকার করে নিজেকে মালওয়া রাজ্যের স্বাধীন সুলতান হিসেবে ঘোষণা করলেন।
পিতা দিলওয়ার খান তাঁর সাম্রাজ্যের রাজধানী করেছিলেন ‘ধার’ শহরে। যদিও তিনি প্রায়শই মাণ্ডুতে আসতেন। মাণ্ডু তাঁর প্রিয় জায়গা ছিলো। মাণ্ডুর নতুন নামকরণ করা হয়েছিল — শাদিয়াবাদ — আনন্দনগরী — City of Joy.
হোসাং শাহ তাঁর রাজধানী সরিয়ে আনলেন মাণ্ডুতে। তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিলো প্রবল। ফলে দিল্লির সুলতান সৈয়দ মুবারক শাহ, জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শাহ শার্কি, গুলবর্গার সুলতান আহমদ শাহ বাহমনি — সবার সঙ্গেই রীতিমতো গণ্ডগোল ও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তেন। … একবার তো গুজরাটের সুলতান মুজাফ্ফর শাহ এসে হোসাং শাহকে বন্দি করে গুজরাটে আটকে রেখেছিলেন। পরে মুক্তি দেন।
হোসাং এরপর অভিযান চালালেন ওড়িশার জাজনগরের রাজার বিরুদ্ধে। কারণটা হলো, জাজনগরের রাজার অনেক হাতি ছিলো, হোসাং ভাবলেন, কিছু হাতি তাঁরও প্রয়োজন, তাই জাজনগর থেকেই আনা যাক!!
১৪২১ খ্রিস্টাব্দে হোসাং একজন বণিকের ছদ্মবেশ ধরে এক হাজার বাছাই করা অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে মাণ্ডু থেকে যাত্রা শুরু করলেন। মালওয়া থেকে এক মাসের পথ জাজনগর। নিজের উদ্দেশ্যকে আড়াল করার জন্য তিনি তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন রঙের ঘোড়া নিয়ে গেলেন। সঙ্গে ছিলো অনেক ধরণের পণ্যদ্রব্য এবং অনেক মূল্যবান বস্তু যা নিজের দেশেও দুর্লভ বলে বিবেচিত হতো। জাজনগরের রাজার সভায় হাজির হয়ে হোসাং সর্বপ্রথম তাঁর উদ্দেশ্য জানালেন এবং রাজাকে পণ্যগুলি পরিদর্শন করার অনুরোধ করলেন। বললেন, এইসব মূল্যবান পণ্যগুলি রাজা অর্থ দিয়ে কিনতে পারেন কিংবা সমান দামের হাতি দিতে পারেন। … রাজা সেই বস্তুগুলো দেখতে রাজি হলেন। সময় ঠিক করা হলো।
রাজা আসবেন বলে পণ্যগুলিকে চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হলো। হঠাৎ আবহাওয়া খারাপ হওয়ার কারণে, সুলতান হোসাং লোকদের বললেন যে বৃষ্টি হলে জিনিসপত্রগুলি ক্ষতিগ্রস্থ হবে, অতএব ঢেকে রাখো। রাজার ভৃত্যরা অবশ্য তাদের মনিব না আসা পর্যন্ত জিনিসগুলো খুলে রাখার জন্য জোর দিচ্ছিল।
দীর্ঘ সময় পরে রাজা উপস্থিত হলেন, কিন্তু সেইসময় বৃষ্টি শুরু হলো। রাজার হাতির পায়ে কিছু জিনিস নষ্ট হয়ে গেল। সেই অজুহাতে হোসাং তাঁর দলবলকে হুকুম দিলেন, আক্রমণ করো।
ছোটখাট যুদ্ধ হয়ে গেল। রাজাকে বন্দি করলেন হোসাং। এবার নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, হাতি চাই, নইলে বন্দিত্ব স্বীকার করুন।
রাজা বাধ্য হয়ে ৭৫টি হাতি দিতে রাজি হলেন।
রাজাকে বন্দি অবস্থায় সঙ্গে নিয়ে হোসাং ফিরে চললেন। রাজার রাজ্যের সীমানা নির্বিঘ্নে পার হওয়ার পরেই রাজাকে ছেড়ে দিলেন।
মোটামুটি ২৭ বছর মাণ্ডুকে রাজধানী করে সমগ্র মালওয়া রাজ্য শাসন করেছিলেন হোসাং। ১৪৩২ সালের ৭ আগস্ট হোসাং শাহ মারা গেলেন। হোসাংকে প্রথমে হোসাঙ্গাবাদ শহরে অস্থায়ীভাবে সমাধিস্থ করা হয়। পরে মাণ্ডুতে সমাধিস্তম্ভ তৈরি হওয়ার পরে তাঁর মরদেহ মাণ্ডুতে আনা হয়।
হোসাং-এর অত্যন্ত প্রীতি ও রুচি ছিলো স্থাপত্যের প্রতি। যে কারণে, মাণ্ডুকে শুধুমাত্র ভারতের সবচেয়ে দুর্ভেদ্য দুর্গগুলির মধ্যে একটি নয়, একটি দুর্দান্ত সুন্দর শহরও করে তুলেছিল। তিনি সেখানে বহু সংখ্যক রাজকীয় স্থাপত্য নির্মাণ করেন, যার মধ্যে রয়েছে জামা মসজিদ, দিল্লি দরওয়াজা এবং তাঁর নিজের সমাধি।
শ্বেতপাথরের সমাধিস্তম্ভ পরবর্তী কালের তাজমহলকে মনে পড়িয়ে দেয়।
সমাধিস্তম্ভের চারপাশে চওড়া কক্ষযুক্ত করিডোর ঘুরে গেছে। আমরা সেই করিডোরে রোদ্দুর বাঁচিয়ে এক পাক ঘুরে নিলাম।
জাহাজমহল, মাণ্ডু
দুই দিকে দুটি সরোবর — সামনে কাপুর তালাও এবং পিছনে মুঞ্জ তালাও — এই দুইয়ের মাঝখানে, মনে হবে গভীর সমুদ্রে নোঙর করা একটি বিশাল জাহাজ ভেসে আছে।
অনুমান করি, বর্ষা ঋতুতে, যখন আকাশে কালো মেঘের কুণ্ডলি ও চরাচর ভাসিয়ে সাদা বৃষ্টির অবগুণ্ঠন — তখন এই জাহাজমহলে একবার আমাকে আসতেই হবে — দেখবো ১৫ হাজার সুন্দরী রমণীর কলহাস্যে মুখর হয়ে উঠবে ক্ষুধিত পাষাণ!!
যখনই কোনও পোড়ো প্রাসাদে পা রাখি, রবীন্দ্রনাথের ক্ষুধিত পাষাণের অনিবার্য প্রাণ যেন জেগে ওঠে। এই কক্ষগুলিতে একসময় সুন্দরী রমণীদের পায়ের আওয়াজ শোনা যেত। ঘুঙুরের আওয়াজ, উচ্চস্বরে ভেসে আসা গানের কলি, বিশ্রম্ভালাপ … হামামে স্নানের আনন্দ — সবই কালের নিয়মে অবলুপ্ত হয়ে গেছে, এখন পড়ে আছে একরাশ বিষাদ ও ঘরভর্তি শূন্যতা! … এত রোদ-বৃষ্টি-ঝড়-ভূমিকম্প সহ্য করে প্রাসাদটি দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে — আর কতোদিন এর আয়ু? মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে পর্যটকের মনোরঞ্জনের দায়িত্ব নিয়েছে ৫০০ বছরের প্রাসাদ।
মাণ্ডুর সুলতান হোসাং শাহ —মারা গেলেন ১৪৩২ সালের ৭ আগস্ট — তাঁর পুত্র গজনি খান বসলেন মাণ্ডুর সিংহাসনে। কিন্তু গজনি-র জ্ঞাতিভ্রাতা মাহমুদ খান (যাঁর বাবা মুগিত খান ছিলেন মাণ্ডুর খুব বিখ্যাত আমলা) — পরিচারককে ঘুষ দিয়ে গজনি-র পানীয়ে মিশিয়ে দিলেন বিষ। গজনি মারা যেতেই মাহমুদ খান — মাহমুদ খান খিলজি নাম নিয়ে মাণ্ডুর শাসক হয়ে মসনদ দখল করলেন। সেটা ১৪৩৬ খ্রিস্টাব্দ।
৩৩ বছর রাজত্ব করে ১৪৬৯ সালে মারা গেলেন মাহমুদ খান খিলজি।
সেই মাহমুদ খিলজির পুত্র গিয়াসউদ্দিন খিলজি — পঞ্চদশ শতকে তাঁর ১৫ হাজার রানির জন্য বানিয়েছিলেন জাহাজমহল। তাঁর শৌখিনতার কারণে অনন্য কারিগরিতে নির্মিত হয়েছিল জাহাজমহল।
১৫ হাজার রানি? বাপ্ রে !!! আমরা একবিংশ শতাব্দীর নিরীহ ভিতু মানুষ, আমার তো মাথা ঘুরতে শুরু করেছে !!!
কারা ছিলেন হারেমে ওই ১৫ হাজার নারী?
এঁদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষিকা, সঙ্গীতশিল্পী, নর্তকী, সূচিশিল্পী মহিলা, ধর্মগ্রন্থ পাঠ করার জন্য মহিলা এবং সমস্ত পেশা ও ব্যবসার মহিলারা।
তাঁর রাজসভায় ডানদিকে ইউনিফর্ম পরে ধনুক এবং তরবারিতে সজ্জিত হয়ে, দাঁড়িয়ে থাকত পুরুষের পোশাক পরা পাঁচশত সুন্দরী তুর্কি যুবতী এবং তাদেরকে বলা হত তুর্কি প্রহরী।
গিয়াসউদ্দিনের বাম দিকে ইউনিফর্ম পরিহিত ও আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত পাঁচশত আবিসিনিয় (হাবসি) মহিলা প্রহরায় থাকত।
গিয়াসউদ্দিন নিজের জন্য একটি হরিণ-উদ্যান বানিয়েছিলেন, যেখানে হারেমের মেয়েদেরকে নিয়ে মাঝেমধ্যে শিকারে যেতেন।
বিচিত্র চরিত্রের লোক ছিলেন এই গিয়াসউদ্দিন খিলজি। অত্যন্ত ধর্মপ্রবণ। কোনও রকম নেশা ছিলো না। মদ বা তামাক ছুঁয়েও দেখতেন না। আজমের শরিফের তোরণ নাকি তিনিই বানিয়েছিলেন সাধক মইনুদ্দিন চিশ্তির স্মরণে। কিন্তু নারীদের প্রতি দুর্বলতা ছিলো ভয়াবহ!
তিনি নারী শিক্ষায় আগ্রহী ছিলেন এবং তাঁর দরবারের মহিলাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য সারাংপুরে একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন। গৃহশিক্ষকরা রাজকন্যাদের শেখানোর জন্য নিযুক্ত ছিলেন এবং সত্তরের বেশি মহিলা কোরানপাঠে পারদর্শী ছিলেন।
সুলতান গিয়াসউদ্দিন শিল্প প্রেমিক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন।
‘The Economist’ পত্রিকায় উইলিয়াম ডালরিম্পল লিখেছেন : “সুলতানকে যেগুলো সবচেয়ে বেশি আনন্দ দিত, সেই জিনিসগুলো লিপিবদ্ধ করার কাজ শুরু করলেন। তাঁর বই, ‘নিয়ামতনামা’ বা ‘বুক অফ ডিলাইটস’ আজ ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে টিকে আছে, মুঘল ও টিপু সুলতানের উৎসুক হাত এড়িয়ে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ১৭৯৯ সালে বিজয়লাভ করে লণ্ডনের ধূসর আকাশে বস্তাবন্দী করে উড়িয়ে নিয়ে চলে যায়।” বইটি ফার্সি এবং প্রাক-ইসলামিক ভারতীয় শৈলীর সংমিশ্রণে সমৃদ্ধভাবে চিত্রিত। বইটিতে পঞ্চাশটি ছবি রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে সুলতান, ভৃত্য, ল্যাণ্ডস্কেপ এবং ভবনের পাশাপাশি খাবার তৈরির ছবি।
উইলিয়াম ডালরিম্পল লিখেছেন : “বইটিতে সমস্ত ধরনের বিষয়ে পরামর্শ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যেমন শিকার অভিযান — (আপনার প্রিয়জনের ছবি ছাড়া বাড়ি থেকে বের হবেন না, আপনার পায়ে কর্পূর ঘষে নিন, আপনার সঙ্গে নিন সেরা চড়ুই বা বাজপাখি এবং একটি বা দুটি চিতা)। রেসিপির পৃষ্ঠাগুলি রয়েছে, যা নিখুঁত সামোসা তৈরি করার দশটি ভিন্ন উপায় থেকে শুরু করে মধ্যযুগীয় ভারতীয় ভায়াগ্রার সমতুল্য ওষুধ তৈরির নির্দেশাবলী । … পারফিউমের জন্য নিবেদিত বেশ কয়েকটি অধ্যায় রয়েছে, সে সম্পর্কে পুরো বইটিতে কিছু বিশদ পরামর্শ রয়েছে। আছে একটি সুগন্ধি পেস্টের রেসিপি যা ‘আবির’ নামে পরিচিত, যার সুগন্ধ বাড়ানোর জন্য উপাদানগুলির একটি অসাধারণ তালিকা যোগ করা হয়েছে।”
১৫০০ খ্রিস্টাব্দে গিয়াসউদ্দিনের বয়স যখন ৮০ বছর, তাঁর পুত্র নাসিরউদ্দিন সিংহাসনের লোভে পিতাকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করেন।
তার ১০ বছর পরেই পিতৃহন্তা নাসিরউদ্দিন প্রবল জ্বরের কবলে পড়ে মারা যান।
এর ১০৭ বছর পরে সম্রাট জাহাঙ্গীর একবার মাণ্ডু এসেছিলেন, তখন পিতৃহন্তা নাসিরউদ্দিনের সমাধিতে গেছিলেন। জাহাঙ্গীর লিখে গেছেন, “আমি যখন নাসিরউদ্দিনের সমাধিতে গেলাম তখন আমি ওই কবরে বেশ কয়েকটি লাথি মেরেছিলাম এবং উপস্থিত চাকরদেরকে কবরে লাথি মারার আদেশ দিয়েছিলাম। এতেও সন্তুষ্ট না হয়ে আমি কবরটি উন্মুক্ত করে তার অপবিত্র দেহাংশ আগুনে নিক্ষেপ করার নির্দেশ দিলাম। তখন আমার মনে হল যে, আগুন যেহেতু আলো, সেহেতু তার নোংরা শরীরকে আগুনে পুড়িয়ে ঈশ্বরের রশ্মিকে অপবিত্র করাটাও দুঃখজনক, তাই তার ক্ষয়ে যাওয়া অঙ্গসহ তার চূর্ণ-বিচূর্ণ হাড়গুলোকে নদীতে নিক্ষেপ করার নির্দেশ দিলাম।”
হঠাৎ পেয়ে পড়ে ফেললাম। চমৎকার লাগল।