বৃহস্পতিবার | ২৬শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১১ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ১১:১৪
Logo
এই মুহূর্তে ::
কার্ল মার্কসের পরিজন, পরিকর (চতুর্থ পর্ব) : দিলীপ মজুমদার মৈত্রেয়ী ব্যানার্জি-র ছোটগল্প ‘জিঙ্গল বেল’ নোবেল বিজয়ী কথাসাহিত্যিক উইলিয়াম ফকনার : মনোজিৎকুমার দাস কার্ল মার্কসের পরিজন, পরিকর (তৃতীয় পর্ব) : দিলীপ মজুমদার সফলা একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত সুবিমল মিশ্র-র ছোটগল্প ‘বাব্বি’ হাইনরিখ হাইনে ও তাঁর ইতিহাসবোধ : মিনহাজুল ইসলাম আবার মহাভারত : শশী থারুর ভিয়েতনামের গল্প (দ্বিতীয় পর্ব) : বিজয়া দেব মহারানী ভিক্টোরিয়া ও মুন্সী আব্দুল করিম-এর অমর প্রেম : মাহবুব আলম শাড়িদিবসে এক শাড়িবিলাসিনীর ভালোবাসা : নন্দিনী অধিকারী আম্বেদকর প্রসঙ্গে বিজেপি দলিত বিরোধী তথা মনুবাদী রূপ প্রকাশ করে ফেলেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী যে আখ্যানে অভিজ্ঞতার উত্তরণ ঘটেছে দার্শনিকতায় : ড. পুরুষোত্তম সিংহ যেভাবে লেখা হলো ‘কবি’ উপন্যাস : জাকির তালুকদার শ্যামাপ্রসাদ ঘোষের ছোটোদের লেখা কবিতা — শব্দে-বর্ণে নির্মিত শৈশবের চালচিত্র : অমৃতাভ দে ভিয়েতনামের গল্প (প্রথম পর্ব) : বিজয়া দেব লেখা যেন কোনভাবেই মহত্ না হয়ে যায় : অমর মিত্র আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্ত : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন চাল চকচকে করতে বিষ, সবজিতেও বিষাক্ত হরমোন প্রয়োগ, চিন্তায় বিশেষজ্ঞরা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় কার্ল মার্কসের পরিজন, পরিকর (দ্বিতীয় পর্ব) : দিলীপ মজুমদার স্মিতা পাতিল — অকালে ঝরে পড়া এক উজ্জ্বল নক্ষত্র : রিঙ্কি সামন্ত কীভাবে রবীন্দ্রনাথ ‘ঠাকুর’ হলেন : অসিত দাস সর্ব ধর্ম সমন্বয় — ক্ষীর ভবানী ও শঙ্করাচার্যের মন্দির : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী কার্ল মার্কসের পরিজন, পরিকর (প্রথম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার হরিপদ দত্ত-র ছোটগল্প ‘আত্মজা ও পিতা’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় : আবদুল মান্নান সৈয়দ নবেন্দু ঘোষ-এর ছোটগল্প ‘ত্রাণ-কর্ত্তা’ অরণি বসু সরণিতে কিছুক্ষণ : ড. পুরুষোত্তম সিংহ অন্য এক ইলিয়াস : আহমাদ মোস্তফা কামাল খেজুর গাছের সংখ্যা কমছে, গাছিরা চিন্তায়, আসল সুস্বাদু খেজুরগুড় ও রস বাজারে কমছে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায়
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে বড়দিনের বিশেষ দিনে জানাই Merry Christmas! আন্তরিক শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

মৈত্রেয়ী ব্যানার্জি-র ছোটগল্প ‘জিঙ্গল বেল’

মৈত্রেয়ী ব্যানার্জি / ৩৯ জন পড়েছেন
আপডেট বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৪

ঘুমচোখে উঠে কোনরকমে দরজাটা খুলে দিয়েই আবার বিছানায় ড্রাইভ মারে সুতপা। পাশে পিংপং ঘুমিয়ে কাদা। বিছানায় শুয়ে জেনি মাসির গজগজানি শুনতে পায় সুতপা। সিঙ্কে বাসনের ডাঁই দেখে সম্ভবত এই গজগজানি। কাল রাতে পার্টি ছিল মস্ত। হ্যাভক মস্তি হয়েছে কাল। অনেক রাত পর্যন্ত পার্টি চলেছে, তাই ঘুমোতে প্রায় শেষ রাত। অনু থেকে যেতে চেয়েছিল, সুতপা থাকতে দেয়নি। কাউকেই দেয় না ও রাতে থাকতে। ও একা থাকতে ভালবাসে। পছন্দ করে প্রিভেসি। সেজন্য বিয়েটাও করল না। বয়েস নয় নয় করে তেত্রিশ পেরোতে চলল। আগের কালে ছিল কুড়ি পেরলেই বুড়ি, এখন চল্লিশেও দিব্যি ছুঁড়ি থাকা যায়। তবু মা গজগজ করে, বিয়ে কর বিয়ে কর বলে। সুতপা তাই বাড়ি ছেড়ে এই ফ্ল্যাট নিয়েছে, একা থাকবে বলে। মা খুবই রাগ করেছিল প্রথম প্রথম। বাবা বিশেষ কিছু বলেননি। শুধু বলেছিলেন, “এত একা থাকার শখ যখন, তখন থাকো একা। একদিন দেখবে নিজেই হাঁপিয়ে গেছ। তখন মানুষকে চাইবে।”

মনে মনে হেসেছে সুতপা। সে চাইবে মানুষ! সারাদিন মানুষের মধ্যে থাকা যায়… কিন্তু অফিস ছুটির পর আর কাউকে পাশে দেখতে চায় না সে। গোটা সন্ধে, গোটা রাত তার একার, তার নিজস্ব। এটাই সুতপা। বাইপাশের ধারে ফ্ল্যাট কেনার সময় মা খুব অশান্তি করেছিল। বলেছিল, সোমত্থ মেয়ে, এরকম ভাবে একা থাকে নাকি! লোকে কি বলবে! লোকে বলবে, নিশ্চয়ই এ মেয়ের কোনো ব্যাপার আছে, নাহলে কেউ নিজের কলকাতার বুকে বাড়ি থাকতেও একা থাকার জন্য ফ্ল্যাট কেনে!

সুমনা, সুতপার বোন, তিনবছর হল বিয়ে হয়ে গেছে, ও বলেছিল, “হ্যাঁ রে! দিভাই, আমিও তো এখন বাড়িতে নেই, ভাই ব্যাঙ্গালোরে, তাহলে তুই কার জন্যে বাড়ি ছাড়ছিস? মা বাবাকেও সহ্য করতে পারছিস না?” এটা কাউকে বোঝানো যায় না, ব্যাপারটা সহ্য করার নয়, ব্যাপারটা নিজেকে নিয়ে থাকার।

“চিরকাল একলষেঁড়ে দিদিটা। কাউকে মানিয়ে নিতে পারে না। ছোটবেলায় আমাকে আর দিদিকে এক খাটে শুতে হত, দিদি আমাকে প্রায় খাট থেকে ফেলে দিতে পারলে শান্তি পেত। ও যা বলবে তাই মেনে নিতে হবে। ও বিয়ে করে নি একরকম ভাল… কেউ ওকে মানিয়ে নিতে পারবে না।” সুমনা খাটে পা ঝুলিয়ে বসে মায়ের হাতের মুড়িমাখা খেতে খেতে বলল।

“তুই থাম তো! এই এক এলেন, সুযোগ পেলেই দিদির নিন্দে করা। তুই বুঝি ওকে কম হিংসে করিস! ও পড়াশোনায় তোর থেকে হাজার গুণে ভাল… খেলা ধুলোয় মেডেল আনত, তা দেখে তুই হিংসে করিস নি? ওরে, ও হিংসুটে নয়। ও একটু একলা থাকতে ভালবাসে। মানুষ কি একরকমের হয়? তা নয়, যখন তখন দিদির নামে যা তা বলা।” বিজয়ার কথায় মুখ হাঁড়ি হয় সুমনার। সেটা বুঝে চা আনতে যায় বিজয়া।

মাকে বোঝা ভার! এই বড় মেয়ের নিন্দে করবে, আর যেই সুমনা কিছু বলবে, অমনি দিদির প্রশংসা! নাহ্, আজ আর মায়ের সীতাহারের কথাটা তোলা যাবে না, মা আবার দিদির সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করে দেবে। দ্যাখ, ও কত বড় চাকরি করে নিজের ফ্ল্যাট কিনে ফেলল, আর তুই আমার গয়নার দিকে তাকিয়ে আছিস। সুতপা কিন্তু একটা গয়নাও নেয়নি। আসলে মায়ের ট্যাঁকটেঁকে স্বভাবটাই দিদি পেয়েছে, তার সঙ্গে একলা থাকার বাতিক। মনে মনে বলে সুমনা।

সকলের চা সামনের ছোট টেবিলে রাখে জেনি মাসি। সুতপা চায়ে চুমুক দিয়ে মাসির দিকে তাকিয়ে দ্যাখে তখনও দাঁড়িয়ে মাসি। “কিছু বলবে?”

“বড়দিনে ছুটি নোবো। তুমি তো রাঁধতে পার না। খাবে কি?”

“সে নিয়ে তোমায় চিন্তা করতে হবে না। আমি বুঝে নেব। কিন্তু তুমি পিংপংকে যত্ন কোরো। ও একটু মনমর়া হয়ে আছে।”

“মনমরা হবে না? একা থাকতে পারে? তোমার কি দরকার ছিল বাপু ওকে নিয়ে আসার? তুমি একা মানুষ, এ সব কুকুর রাখলে বাড়িতে অন্য লোক থাকতে হয়। আমি কি সারাদিন থাকি তোমার বাড়ি? তাছাড়া আমি বুড়ো হয়েছি, ও কুকুর ভীষন দুষ্টু। আমি পেরে উঠি না। ”

“ঠিক আছে, ঠিক আছে, তুমি যেটুকু সময় থাক, সেটুকু সময়ই ওকে দেখো।” মাসি বেরিয়ে যেতেই অদ্ভুত কান্ডটা ঘটল।

সুতপা দেখল, না না, দেখল না, শুনল… নাকি! উপলব্ধি করল! সে যাই হোক গে যাক! পিংপং ওর কোলে বসেছিল, আদরে লেজ নাড়ছিল। এবার ওকে কোল থেকে নামিয়ে স্নানে যেতে হবে, তাই নামাবার আগে পিংপং এর নাকে নাক ঠেকাল সে। পিংপং আল্লাদে ওর নাক চেটে দিয়ে নিজের কান দুটো খাড়া করে তুলে একটু হাসলো। হ্যাঁ। হাসল। তারপর গম্ভীর মুখে বলল, “সু, আমি এতটা ছোটো নই, যতটা তুমি ভাবো। তুমি নতুন কুকুর পুষেছ তো, তাই তোমার আমাদের সম্বন্ধে কোনো ধারণা নেই… আমার মন খারাপের কারণ তুমি। তুমি না থাকলে আমার কিছু ভাল লাগে না। ওই বুড়ি মাসি কে রাখার দরকার নেই, তুমি অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে এস। তাহলেই আমার মন ঠিক থাকবে।”

সুতপা অনেকক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে রইল। সে কি ঠিক শুনছে! কাল একটু নেশা করেছিল বটে, কিন্তু তাতে এখনও ঘোর কাটেনি! নাহ্, সে চা খেয়েছে, মাথা ভার হয়ে নেই, গলা টকটক নেই, মানে আ্যসিডিটি নেই। তাহলে! কুকুর কথা বলছে! এও কি সম্ভব! কোল থেকে পিংপং কে নামিয়ে দ্রুত বাথরুমে ঢুকল সুতপা।  তার কি একা থেকে মাথা খারাপ হয়ে গেল! কেউ কোনোদিন শুনেছে কুকুর কথা বলে! হ্যাঁ, ছোটবেলায় সত্যজিত রায়ের একটা গল্প পড়েছিল বটে, এখন আবছা মনে পড়ছে ‘অসমঞ্জবাবুর কুকুর’। সে হাসত। কিন্তু সে তো গল্পে। আর কে না জানে, গল্পের গরু গাছে ওঠে! কিন্তু পিংপং তো সত্যি সত্যি কুকুর হয়ে কথা বলছে। স্নান সেরে বেরিয়ে আড়চোখে একবার পিংপং এর দিকে তাকিয়ে খেতে গেল সুতপা। মাসি আজ সুতপার আব্দার রাখতে কলাইয়ের ডাল, আলুপোস্ত, বড়িভাজা, আর মাছ ভাজা করেছে। আচ্ছা, একবার মাসিকে বলবে কথাটা? না বাবা, থাক, দরকার নেই। কাজের মাসিদের কাজই হচ্ছে এ ঘরের কথা ওঘরে লাগানো। বলা যায় না, এও বলতে পারে যে সুতপা পাগল হয়ে গেছে।

চিন্তার সূত্র ছিঁড়ে গেল মাসির গলার আওয়াজে। “বড়দিনে কিছু কিনে দেবে না ?”

“কিনেও দেব, আবার টাকাও দেব, বাড়ির জন্যেও তো কিছু কিনবে তুমি।” বলল সুতপা। মাসির মুখ পলকে উজ্জ্বল। “তুমি কি ভাল গো দিদিমণি! বোসবাবুরা খুব কিপটে। হাত থেকে জল গলে না।”

জম্পেশ করে খেয়ে বেসিনে হাত ধুতে ধুতে সুতপা ভাবে আজ অনুকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখবে। ওরই বাড়ির কুকুরের ছানা পিংপং। ছোট্ট, কান ঝোলা, গায়ে ঝুমরিঝামরি সাদা আর গ্রে কালারের লোম। চোখ দুটো চকচকে। নাকটা গোলাপি। ছোটো লোম ওলা লেজটা সর্বদাই পুটুক পাটুক নড়ছে। দেখেই ভালবাসতে ইচ্ছে করে । অনুর অনেকগুলো কুকুর হয়ে গেছে বাড়িতে, আর সুতপা একা ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করতে পিংপংকে গিফট হিসেবে দেয়। প্রথমে একটু কিন্তু কিন্তু ছিল। তারপর যখন দেখল ও অনুর বাড়ি গেলেই কুকুরটা ওর গা ঘেঁষে বসে তখন আর না নিয়ে পারেনি। অনু ওকে ডাকত ‘লাটসাহেব’ বলে। সুতপা আদর করে নাম দিল ‘পিংপং’। দুমাসের ওপর এসেছে পিংপং। আজই প্রথম কথা বলল।

অফিসে আজ খুব একটা কাজের চাপ ছিল না। অনুকে কয়েকবার কথাটা বলতে গিয়েও বলা হল না। আজ অফিস ছুটির পর অনুর সঙ্গে মলে কেনাকাটা করতে গিয়ে বলতে হবে কথাটা। ভাবতে ভাবতে নিজের টেবিলে যেতে গিয়ে জোর ধাক্কা লাগল নতুন আসা ‘অভিরূপের’ সঙ্গে। অভিরূপ লজ্জায় লাল হয়ে বারবার সরি বলতে লাগল। আর সুতপার বারবার মনে হতে লাগল এ গলাটা কোথায় শুনেছে! কোথায় শুনেছে! তারপরই ধাঁ করে মনে পড়ে গেল, আরে! অভিরূপের গলা আর পিংপং এর গলা একদম এক! এমনকি কথা বলার ধরণও! নাহ্, হয় সুতপা নিজে পাগল হয়ে গেছে, নয় খুব শিগ্গির পাগল হয়ে যাবে। আর ব্যাপারটা চেপে রাখলে হবে না, অনুকে বলতেই হবে।

পার্কস্ট্রিটে যখন পৌঁছল তখন গোটা কলকাতা আলোর মালায় সেজে অপরূপ হয়েছে। সকলের জন্য কেনাকাটা সেরে ওরা কফির অর্ডার দিয়ে বসল একদম ধারের টেবিলে, যেখান থেকে পুরো রাস্তাটা দেখা যায়। মুখোমুখি বসে কফিতে চুমুক দিতে দিতে সুতপা বলল, “জানিস অনু! পিংপং আজ কথা বলেছে, একদম মানুষের গলায়। বলেছে, সে আমাকে ছেড়ে থাকতে পারে না। আর ওর গলাটা না একবারে আমাদের অফিসের নতুন ছেলেটার মত।” না, এই পর্যন্ত বলতে পারে নি সুতপা। তার আগেই অনু বিষম টিসম খেয়ে, কফি উল্টে এক যাচ্ছেতাই কান্ড ঘটিয়ে বসল। প্রায় মিনিট কুড়ি লাগল ওদের টেবিল পরিষ্কার করে আবার কফি দিয়ে যেতে। অনু তখনও অল্প অল্প কাশছে। সুতপা অপরাধী অপরাধী মুখ করে বসে আছে, যেন তার জন্যেই এত কান্ড। এবার কফিতে চুমুক দিয়ে অনু বলল, “সব শুনে মনে হচ্ছে তোকে আর একলা থাকতে হবে না। জীবনের বাকি দিনগুলো দুজনের সাথে শেয়ার করতে হবে।”

“মানে?”

“মানে, খুব সোজা… বাড়ি ফিরে পিংপং-এর সঙ্গে আলোচনা করে নিস।”

“কিন্তু তুই তো একবারও বলিস নি যে পিংপং কথা বলতে পারে?”

“কি করে বলবো? ও তো কোনোদিন আমার বাড়িতে কথা বলে নি। যদি বলত, তাহলে কি তোকে এত দামী জিনিস গিফট করে দিতাম? যাক গে, যা বলেছিস বলেছিস। আর কাউকে বলিস না। তোর পিংপং চুরি হয়ে যেতে পারে।”

অনেক রাতে বাড়ি ফিরে সুতপা দ্যাখে ফ্ল্যাটের দরজা আধখোলা! সর্বনাশ! তাহলে কি ইতিমধ্যেই লোকে জেনে গেছে ওর পিংপং কথা বলতে পারে, হাসে, আর পাঁচটা কুকুরের মত নয়! কেউ ডাকাতি করতে এসেছে নির্ঘাত! একে উৎসবের মরসুম, মানুষের মন এসময় ঢিলেঢালা ফুরফুরে থাকে। তাই এসময় সবথেকে বেশি চুরি, রাহাজানি বেড়ে যায়। পা টিপে টিপে ঘরে এন্ট্রি নেয় সুতপা। ও মা! ডাকাত কোথায়? এ যে তার অফিসে নতুন জয়েন করা অভিরূপ। চা খাচ্ছে আর কোলে পিংপং। সামনে মাসি দাঁড়িয়ে। ওকে দেখেই থতমত খেয়ে মাসি বলল, “এই দ্যাকো, এই বাবু অনেকক্ষণ তোমার জন্যে অপিক্ষে করচে। এবার তুমি এসে গ্যাচো। আমার ছুটি। বাপরে বাপ! পিংপং কি সোজা কুকুর! সারাদিন আমাকে ছুটিয়ে মেরেচে। তুমি বাপু ওকে আগলানোর অন্য লোক রাকো। আমি বুড়ো মানুষ।” সুতপা মাসির হাতে নতুন কিনে আনা উপহারের প্যাকেট ধরিয়ে দিতেই মাসির মুখে কনে দেখা আলো।

“আপনি! কি মনে করে?” সোজাসুজি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় সুতপা।

“না, মানে, আমি অনেক দূর থেকে আসি তো, তাই এখানে থাকার জন্য ঘর ভাড়া খুঁজছি। অনুশ্রী আমাকে আপনার কাছে আসতে বলেছিল। তাই… যদি আপনি আপনার একটা ঘর আমাকে ভাড়া দেন, বা পেয়িং গেস্ট রাখেন। আমি রান্নাবান্না একদম পারি না।”

“কভী নেহী। আপনি আসতে পারেন। আমি একা থাকতে ভালবাসি। একা থাকবো। আপনার মত একটা দামড়া আমার ঘরে ঘোরাফেরা করছে এটা আমি স্বপ্নেও নিতে পারব না। চা খাওয়া হলে আপনি আসতে পারেন, আমি খুব ক্লান্ত।” অভিরূপ পিংপংকে আদর করে করুণ মুখে চলে যায়।

ধড়াম করে দরজা বন্ধ করে সুতপা। রাগে গরগর করতে করতে অনুকে ফোন করে তখনই। অনু ফোন ধরল না। ফোনটা ডিভানের ওপর ফেলে বাথরুমে ঢুকতে যাবে, সেই সময় পিংপং আবার বলে ওঠে, “লোকটা কিন্তু খারাপ নয়। রাখলে খারাপ হবে না।” “এই চোপ! একদম চুপ করে থাকবি তুই। কেউ কখনো শুনেছে, কুকুর কথা বলে? তোর জন্যে আমার মাথা খারাপ হবার জোগাড়। চুপ করে বসে থাক হতভাগা।” রেগে বাথরুমে ঢুকে যায় সুতপা। মনে হল পিংপং মুচকি হাসল!

আজ নিয়ে চারদিন হয়ে গেল সুতপা অনুর সঙ্গে কথা বলেনি, হাসেনি, এমন কি তাকায়নি পর্যন্ত। অভিরূপের সঙ্গেও নয়। আজ ভাবছে অফিস ছুটির পর মায়ের কাছে যাবে, আজ না হলে কাল। উপহারগুলো দিতে হবে, তাছাড়া কদিনই মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে সুতপার। অফিস করে পিংপংকে সঙ্গে নিয়ে, মাসিকে দু দিনের ছুটি দিয়ে বাবার পছন্দের মিষ্টি, কেক নিয়ে রওনা দিল।

দরজা খুলেই মা খুব খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, “আয়, আয়, কে এসেছে দেখবি আয়। সেই যে মনোরমা কাকীমা আর মনোতোষ কাকুর বাড়ি আসানসোলে, মনে আছে তোর?” সুতপা হাঁ হয়ে রইল। কিছুই মনে নেই তার। কবে বাবা আসানসোলে পোস্টিং ছিলেন, সেখানকার প্রতিবেশী… মনে থাকে কারো? মা ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলতে থাকল, “আহারে! মনোরমার ছেলে কলকাতায় এসে থাকতে পাবে না! তাই কি হয়? আমি তো সোজা ওকে বলে দিয়েছি, আমার মেয়ের ফ্ল্যাটে তুমি একশো বার থাকবে। আজকাল ওসব কেউ মনে করে না।” বলতে বলতে যার সামনে এনে মা দাঁড় করিয়ে দিল, তার সামনে উত্তর কলকাতার যতো মিষ্টি আছে সব জড়ো করা, ছেলেটি অম্লান বদনে সেগুলির সদ্ব্যবহার করছে।

সুতপার বাবা ছেলেটির সঙ্গে গদগদ হয়ে গল্প জুড়েছেন। সুতপার কোল থেকে পিংপং ছেলেটিকে দেখেই লাফিয়ে গিয়ে ওর কোলে উঠে নাক চেটে দিল। বেইমানের দল সব। বাবা ওকে দেখেই বললেন, —

“এই দ্যাখ মামনি, এ অভিরূপ। তোদের অফিসে নতুন এসেছে। তোর সঙ্গে বোধহয় আলাপ নেই। খুব ভাল ছেলে, আরে আমাদের মনোতোষদার ছেলে। আলাপ কর।” সুতপা দেখল, অভিরূপ ওকে দেখে হাত জোড় করে নমস্কার করল, যেন ওকে নতুন দেখল।

যাক গে! উৎসবের সময়। এখন অশান্তি করে লাভ নেই। দেখা যাক না কোথাকার জল কোথায় গড়ায়! আপাততঃ নতুন বছর থেকে পাশাপাশি রুম শেয়ার করে দেখাই যাক, বয়সও তো বাড়ছে। পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে ‘জিঙ্গল বেল, জিঙ্গল বেল…’।


আপনার মতামত লিখুন :

One response to “মৈত্রেয়ী ব্যানার্জি-র ছোটগল্প ‘জিঙ্গল বেল’”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন