বিষ্ণুপুরের কাছে জয়পুর। মল্লরাজাদের প্রাচীন রাজধানী। সেখানকার ময়নাপুরে দেওয়ান বাড়ির শতাব্দী প্রাচীন পুজো আজও সেই ঐতিহ্যের ধারা বজায় রেখেছে। পুজো এবার তিনশো একাত্তর বছরে পা রাখলো। পরিবারের এক প্রবীণ সদস্য জানালেন তাদের পূর্বপুরুষ শরোত্তর রায় প্রথমে বর্ধমান রাজার দেওয়ান ছিলেন। পরবর্তী কালে একটি ঘটনার মধ্যে দিয়ে মল্লরাজার সঙ্গে এই পরিবারের সখ্যতা হয়।
মল্ল রাজত্ব তখন প্রায় অস্তমিত। বিষ্ণুপুর তার গরিমা হারিয়ে বর্ধমানের করদ রাজ্য। একবার বকেয়া কর সময় মতন জমা না দেওয়ায় বর্ধমানের রাজা বিষ্ণুপুরের রাজাকে চিঠি লেখেন। সেই চিঠির প্রত্যুত্তরে বিষ্ণুপুরের রাজা কোনও কিছু না লিখে সাদা কাগজ পাঠান। এতে বর্ধমানের রাজা অপমানিত হয়ে বিষ্ণুপুর আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেন। ওই সময় শরোত্তর রায় সাদা চিঠি পাঠানোর রহস্য উদ্ধার করেছেন বলে তাঁকে নিরস্ত্র করেন। শরোত্তরবাবু জানতে পেরেছিলেন, বিষ্ণুপুর ওই সময় খুব দুর্ভিক্ষের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। সেজন্য সেখানকার রাজা কর দিতে পারেননি। বিষয়টি বর্ধমান রাজাকে এইভাবে বুঝিয়ে তখনকার মতো বিষ্ণুপুরকে আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করেন। তখন থেকে শরোত্তর রায়ের সঙ্গে বিষ্ণুপুরের রাজার সখ্যতা তৈরি হয়। মল্লরাজা তাঁকে পঁয়ষট্টিটি মৌজা দান করে দেন। তার মধ্যে ছিল ময়নাপুর। তখন থেকে শরোত্তর রায় ময়নাপুরে বসবাস শুরু করেন। কোন এক বছর মল্লরাজা নিজে পুজো দেখতে আসবেন বলেছিলেন। তিনি এসে প্রতিমা দর্শন করবেন তারপরই বিসর্জন হবে এরকমই কথা । কিন্তু কোন বিশেষ কারনে তিনি দশমীর মধ্যে আসতে পারেননি। এদিকে রাজামশাইয়ের অপেক্ষায় দশমী পেরলেও মণ্ডপে মূর্তি রেখে দেওয়া হয়। একদিন দু’দিন করে কালীপুজো পার হয়ে যায় সেই খবর পেয়ে মল্লরাজা না আসতে পারার জন্য দুংখ প্রকাশ করে বার্তা পাঠানোর পর ভাইফোঁটার দিন বিসর্জন হয়। সেই থেকে আজও একই ধারা চলে আসছে। জানালেন পরিবারের সদস্য নীলাদ্রী শেখর রায়।
আজও দুর্গা অভয়া (দুই হাত বিশিষ্ট) রূপে পুজিতা হন। দেবীকে বাড়ির মেয়ের মতোই পালকিতে করে আগমন ও বিদায় জানানো হয়। সপ্তমীর দিন শালকাঠ ও ঘি দিয়ে যজ্ঞকুণ্ড জ্বালানো হয়। নবমীর দিন পূর্ণাহুতি দেওয়ার পর দুধ ঢেলে তা নেভানো হয়। তিনদিন ধরে নিরবচ্ছিন্ন অক্ষয় প্রদীপ জ্বলে। ওইদিন এক হাজার আটটি বেলপাতা সহযোগে পূর্ণ আহুতি দেওয়া হয়। এছাড়াও সপ্তমীর দিন থেকে একটি ঘি ও একটি তেলের প্রদীপ জ্বলে। সেই কারনে একজনকে রাত জাগতে হয়। “আমাদের বাড়িতে মাকে মেয়ের মতো বরণ করা হয়। আবার মেয়ের মতোই বাক্সে সিঁদুর, আলতা, মিষ্টি, শাড়ি, কড়ি প্রভৃতি দিয়ে বিদায় জানানো হয়” জানালেন পরিবারের এক মহিলা সদস্যা। মল্লরাজাদের অনুকরণে জিতাষ্টমীর দিন থেকে দেওয়ান বাড়িতে পুজো শুরু হয়ে যায়। ওইদিন থেকেই ভোগ রান্না করা হয়। তা গ্রামবাসীদের মধ্যে বিতরন করা হয়। নবমীর দিন পর্যন্ত এরকমই চলে।
পুজোয় ছাগ, চ্যাং মাছ ছাড়াও ছাঁচি কুমড়ো ও আখ বলি দেওয়া হয়। বিদায়ের আগে মাকে মাছ-মুখ করানো হয়। মা তো সধবা, তাই মাছ না খাইয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো হয় না। প্রতি বছর পুজোয় চ্যাং মাছ ধরার জন্য এক ব্যক্তিকে একটি ডোবার সত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাঁরাই বংশ পরম্পরায় চ্যাং মাছ দেন। একইভাবে মৃৎশিল্পী, ঢাকি, মালাকার সকলেই বংশ পরম্পরায় এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন। প্রতিমা কালীপুজোতেও মণ্ডপে থাকে। সেই জন্য ওইদিন মন্দিরে বিশেষ পুজো হয়। নীলাদ্রি শেখর রায় আরও জানালেন, দেওয়ান বাড়ি থেকে কিছু দূরে ফাঁকা জায়গায় মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। সেই জন্য মন্দিরের চারপাশে চারজন কুলিন ব্রাহ্মণকে জমি দিয়ে বসতি স্থাপন করান হয়েছিল। পুরুষানুক্রমে ওনারাই পুজোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
কৃষ্ণানবমী থেকে পুজোর ভোগ বিলি শুরু হয়। তা শুক্লানবমী পর্যন্ত চলে। বাদশাভোগ চালের অন্নের সঙ্গে মাছ, শুক্তো, কুমড়ো পুঁইয়ের ঘণ্ট ছাড়াও ভোগের সঙ্গে পিঠে ও পায়েস থাকে। আর শেষপাতে মুলো বেগুনের চাটনি থাকতেই হবে। শোনা যায় দেবী খুবই জাগ্রত। রাতে আলোর ঝলকানি মোটেই সহ্য করেন না। সেই জন্য মন্দিরের আশেপাশে কোনও অনুষ্ঠান হলে রাত দশটার মধ্যে তা নিভিয়ে দেওয়া হয়। অথবা আলোর মুখ ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। দশমীর দিন ঘট বিসর্জন হলেও প্রতিমা নিরঞ্জন হয় ভাইফোঁটায়।
সুন্দর উপস্থাপনা। ময়নাপুরের দেবী মাহাত্ম্য জানলাম। দীর্ঘদিনের অভয়া দুর্গার মূর্তি অন্য ধরনের। মা এখানে রায় পরিবার ও গ্রামবাসীদের
সঙ্গে পূজো কদিন আনন্দ করেন। রায পরিবার কে
শুভেচ্ছা জানাই, তাঁরা বংশের দেবীকে দীর্ঘদিন ধরে আরাধনা করে যাচ্ছেন একই ভাবে।
আপনার ভাল লেগেছে জেনে খুশী হলাম।