বিরাট দুর্ঘটনা ঘটল আসমুদ্রহিমাচল জনজোয়ারের কুম্ভমেলায় আছড়ে পড়ার জন্যেই। কতজন মারা গেল, ৩০ না আরও বেশি, তার মধ্যে যাচ্ছি না। তবে এবারের মতো উন্মাদনা আগে কখনও দেখা যায়নি।
ভারতীয় ধর্মের পণ্ডিত জেমস লোচটেফেল্ডের মতে, কুম্ভ মেলা শব্দটি এবং এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক তথ্য প্রামাণিক ভারতীয় গ্রন্থে অনুপস্থিত। লোচফেল্ড বলেন, এই ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলি “স্পষ্টভাবে বৃহৎ সংগঠিত স্নান-উৎসব প্রকাশ করে”। এগুলো বার্ষিক বা বৃহস্পতি গ্রহের বারো বছরের চক্রের উপর ভিত্তি করে অনুষ্ঠিত হয়। হিন্দু তপস্বী এবং যোদ্ধা-সন্ন্যাসীদের সাথে সম্পর্কিত পাণ্ডুলিপিতে — ইসলামি সালতানাত এবং মুঘল সাম্রাজ্যের যুগের সাথে লড়াই করা আখড়াগুলি — স্নান, উপহার প্রদান, বাণিজ্য এবং সংগঠনের সাথে সম্পর্কিত ধর্মীয় উৎসবগুলিতে স্নান তীর্থযাত্রা এবং হিন্দুদের একটি বড় পর্যায়ক্রমিক সমাবেশের উল্লেখ রয়েছে। হরিদ্বার কুম্ভ মেলার একটি প্রাথমিক বিবরণ ক্যাপ্টেন টমাস হার্ডউইক ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ করেছিলেন।
হিন্দু যোগ পাণ্ডুলিপি এবং সন্ন্যাস সম্প্রদায়ের পণ্ডিত জেমস ম্যালিনসনের মতে, প্রয়াগে তীর্থযাত্রীদের বিশাল সমাবেশের সাথে স্নান উৎসবগুলি কমপক্ষে প্রথম সহস্রাব্দের মাঝামাঝি থেকে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে, যদিও মধ্যযুগীয় সময় থেকে অন্যান্য প্রধান পবিত্র নদীগুলিতে অনুরূপ তীর্থযাত্রার বিবরণ পাওয়া যায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে (ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগ) এর মধ্যে চারটি কুম্ভ মেলা শাসক পরিচালিত মেলায় রূপান্তরিত হয়েছিল। শাসক যুদ্ধ-প্রবণ সন্ন্যাসীদের নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল এবং এই হিন্দু তীর্থযাত্রার উৎসবগুলিতে লাভজনক কর ও বাণিজ্য রাজস্ব নিজহাতে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল। পুরোহিতরা ব্রিটিশ প্রশাসনের কাছে এই উৎসবকে স্বীকৃতি দিতে এবং তাদের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন বেশ কয়েকবার।
মহাকুম্ভ শেষ হয়েছিল ১৪৪ বছর আগে, ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে। এই প্রয়াগেই হয়েছিল।
সেবারের মহাকুম্ভও ছিল ঘটনাহুল।সেবারেও ভক্তরা সেখানে সহিস্নান তথা শাহি-স্নানের জন্যে ভিড় করেছিল। নাগা সন্ন্যাসীরা তখনও স্বমহিমায় বিরাজ করত। তখন যাতায়াতের ব্যবস্থা ছিল অপ্রতুল। পদব্রজে ও গরুর গাড়িতে অনেকে সেখানে যেত। ট্রেনের তখন প্রাথমিক দশা। কম লোকজনই ট্রেনে যাওয়ার সামর্থ্য রাখত। আর ছিল ডুলি বা পালকি। বাংলা থেকেও গরুর গাড়ি ও পালকি করে তীর্থযাত্রীরা সেখানে যেত।
তখন দেশে ব্রিটিশ রাজত্ব চলছে। ইংরেজের ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি তখনও চলতো। তাই হিন্দু ভাবাবেগে আঘাত দেওয়ার জন্যে ইংরেজ প্রশাসন চার বছর পরে ১৮৮৫-র কুম্ভমেলার ম্যানেজার নিযুক্ত করেছিল একজন সংখ্যালঘু ব্যক্তিকে। তাঁর নাম ছিল হুসেন।
এই হুসেন আবার ছিলেন ইংরেজের নেওটা। তিনি কুম্ভমেলার সময় ইংরেজ রাজকর্মচারী ও কুম্ভমেলা দেখতে আসা সাহেবমেমদের গঙ্গাবক্ষে ভ্রমণের জন্যে বোটিংয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেখানে মদ, গোমাংস, নর্তকীর অঢেল জোগান দিয়েছিলেন। চব্বিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া সিপাহী বিদ্রোহের ধাঁচে ইংরেজ শাসক তার বদ মতলব প্রকাশ করে ফেলেছিল।
আমেরিকার নামকরা লেখক মার্ক টোয়েন এখানে এসেছিলেন সেবার। তিনি ভক্তদের হতদরিদ্র, বুভুক্ষু, ছিন্নবস্ত্র বলে অভিহিত করেছিলেন, কিন্তু তাদের গভীর বিশ্বাস ও ভক্তিকে তিনি কুর্নিশ জানিয়েছিলেন।
গতবারের মহাকুম্ভের সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর। বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদনায় বঙ্গদর্শন মাসিকপত্র তখন ৩ বছরে পা দিয়েছে। পত্রিকার কোনও লেখায় এই কুম্ভমেলার কথা আছে কিনা জানা যায় না।
তখনকার স্টেটসম্যান পত্রিকা (ফ্রেন্ডস অফ ইন্ডিয়া), হিন্দু প্যাট্রিয়ট, দি পায়োনিয়ার, ইংলিশম্যান ইত্যাদি ইংরেজি পত্রিকায় এই কুম্ভমেলার বিবরণ পাওয়া যেতে পারে।
বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শন তখন তিন বছরে পা দিয়েছে।
এলাহাবাদ থেকেই প্রকাশিত হত দি পায়োনিয়ার। ১৮৬৫ থেকে প্রকাশিত দি পায়োনিয়ার পত্রিকার ১৮৮১ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির সংখ্যাগুলি আর্কাইভে গিয়ে দেখা যেতে পারে। সেবারে বড় কোনও দুর্ঘটনা ঘটেছিল কিনা, দি পায়োনিয়ার পত্রিকায় সে কথা থাকতেও পারে। ইন্টারনেট সার্চ করে দেখলে ক্ষতি কী!
তখন উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সুবোধকুমার চক্রবর্তী জন্মাননি। জলধর সেনের কলম তখন সক্রিয়। তবে তিনি হিমালয় নিয়ে লিখলেও কুম্ভমেলা নিয়ে সম্ভবত লেখেননি। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কোনও লেখায় কুম্ভপ্রসঙ্গ এসেছে কিনা জানি না। কালকূটের অমৃতকুম্ভের সন্ধানে তো অনেক পরের ব্যাপার।