সিন্ধুসভ্যতার সঙ্গে মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় সভ্যতার বাণিজ্যিক লেনদেন চলত। সিন্ধু অঞ্চলকে মেলুহা বলে উল্লেখ করা হয়েছে সুমেরীয় কিউনিফর্ম লিপিতে। দিলমুন, মাগান ও মারহাশি ছিল আরও কয়েকটি অঞ্চল, এদের সঙ্গেও মেসোপটেমিয়ার বাণিজ্য চলত।
দিলমুন যে আরবের দেশ বাহারিন, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা একমত। মাগান নিয়ে কিন্তু বিতর্ক আছে। বেশিরভাগ পণ্ডিত একে আরবের দেশ ওমান বলে চিহ্নিত করলেও কেউ কেউ মাগানকে বালুচিস্তান ও ইরান সন্নিহিত মাকরান উপকূল বলে দেগে দিয়েছেন। মাকরান থেকেই নাকি মাক্কান, তা থেকেই মাগান। তামার প্রাচুর্যের জন্যে মাগান ছিল সমধিক প্রসিদ্ধ। মেসোপটেমিয়ায় তামার জোগান যেত মাগান থেকে।
মাগান কি সত্যিই ওমান? নাকি বালুচিস্তান ও ইরানের দক্ষিণ অংশ?
তৎকালীন পারস্যের দক্ষিণাংশই কি মাগান দেশ ছিল? ইরান তথা পারস্যদেশের স্থাননামে এখনও মাগান নামটি পাওয়া যায়। একটি গ্রামের নাম মাগান, অন্য একটি গ্রামের নাম আমন মাগান।
মাগানের এক একটি বাণিজ্যতরী নাকি ২০ টন জিনিস বহনের উপযোগী ছিল। মাগানের সঙ্গে একদা মেসোপটেমিয়ার রাজা সার্গন অফ আগাডে (২৩৭১- ২৩১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) সার্বিক অসহযোগিতা করেছিলেন। কিন্তু বাণিজ্যের স্বার্থে মাগান, মেলুহা ও ডিলমুনের জাহাজকে তাঁর দেশের বন্দরে নোঙর করতে বাধা দেননি। সার্গনের উত্তরসূরী নারাম-সিন মাগান অধিকার করে নিয়েছিলেন একবার।
মাগানের ৩২ জন লর্ডের বিরুদ্ধে তাঁর আক্রমণ নেমে এসেছিল।
কিন্তু মাগানের রাজা মনিয়ামকে উপযুক্ত সম্মান দেখিয়েছিলেন। ‘রাজার সঙ্গে রাজার মতো’ ব্যবহার করেছিলেন। এমনকি পরাজিত মাগানরাজ মনিয়ামের নাম অনুসারে মেসোপটেমিয়ার একটি নগরের নামকরণ করেছিলেন মনিয়াম-কি।
মাগান যদি ইরান বা পারস্য হত, তবে অতীতে পারস্যের বাণিজ্যতরী কেমন ছিল আড়ে ও বহরে? প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, পারস্য সাম্রাজ্য তাদের বাণিজ্যকে আরও উন্নত করতে এবং প্রসারিত করতে জাহাজ ব্যবহার করত। তারা ভারত থেকে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত বাণিজ্য রুটে জাহাজ ব্যবহার করত বিভিন্ন পণ্য পরিবহন করত।
পারস্য সাম্রাজ্যের নৌবাহিনী তাদের সাম্রাজ্য রক্ষা করতে এবং তাদের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সাহায্য করত। তারা বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধজাহাজ ব্যবহার করত, যা তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করত।
পারস্যের জাহাজ নির্মাণ প্রযুক্তি ছিল খুবই উন্নত। তারা বিভিন্ন ধরনের জাহাজ তৈরি করত, বিভিন্ন উদ্দেশ্যে সেগুলো ব্যবহার করা হতো। তাদের জাহাজগুলো সাধারণত বড় এবং শক্তিশালী ছিল, যা দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার জন্য ছিল উপযুক্ত।
পারস্যের বাণিজ্যিক জাহাজগুলো প্রায়শই বিভিন্ন নদীর উপর চলাচল করত, যেমন শাট-আল-আরব, টাইগ্রিস, এবং পশ্চিমে নীল নদ, সেইসঙ্গে ভারতের সিন্ধু জলপথ। তারা বিভিন্ন ধরনের পণ্য যেমন কাপড়, মশলা, মূল্যবান ধাতু, এবং অন্যান্য জিনিসপত্র পরিবহন করত।
মাগান ছিল তামার জন্যে বিখ্যাত। বর্তমান ইরানের দক্ষিণে তামার বিরাট খনি রয়েছে। সুনগুন কপার মাইনস তার নাম। আরও কয়েকটি তাম্রখনি সেদেশে আছে। বালুচিস্তানেও আছে কপার মাইন। সিন্ধুসভ্যতার ভূখণ্ড থেকে মেসোপটোমিয়া যাওয়ার পথে পড়ত মারহাশি ও মাগান। মারহাশির সঙ্গেও মেসোপটেমিয়ার বাণিজ্য চলত। মারহাশি যে বর্তমান ইরানের দক্ষিণদিকে অবস্থিত ছিল, তা পণ্ডিতরাই বলেন। মাগান যদি বালুচিস্তানের দক্ষিণ ও ইরানের দক্ষিণ উপকূলে হয়, তাহলে সিন্ধু উপত্যকা থেকে মেসোপটেমিয়ার রাস্তাটা হত সোজা ও বাস্তবসম্মত। মাগান যদি ওমান হয়, তাহলে সিন্ধুসভ্যতার পণ্যবাহী জাহাজগুলিকে পারস্য উপকূলের অপরপারে যেতে হত। বাস্তবে সেটা খুব কষ্টসাধ্য ও ব্যয়সাধ্য।
তবে মাগান নামটি মাকরান বা মাক্কান থেকে নাও আসতে পারে। প্রোটোদ্রাবিড়ীয় ব্রাহুই ভাষা বালুচিস্তান ও ইরানের কিছু অংশে চলত। দ্রাবিড় ভাষায় মগান মানে পুরুষ। যে জনপদে পুরুষের সংখ্যা বেশি ছিল ও সমাজে পুরুষতন্ত্র কায়েম থাকত, তাকে মগান বা মাগানদেশ বলে ডাকা হত। আর মাগানের রাজার ‘ মনিয়াম’ নামটি তো তামিল নাম বা পদবি। সুব্রমনিয়ামও তো সমোচ্চারিত দক্ষিণী নাম। তাহলে কি সিন্ধুসভ্যতার ভূখণ্ড ছাড়িয়ে দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী আরও ছড়িয়ে পড়েছিল উত্তরপশ্চিমে? সে সম্ভাবনা খারিজ করা যায় না।