দুর্গাপুজো মহাপূজা। কল্পারম্ভ থেকে বিজয়া — পূজার নানান নিয়মকানুন ও রীতিনীতির রেওয়াজ আছে। আয়োজন ও উপাচারের এই বিশালতায় দুর্গা পূজোকে বলা হয় কলির অশ্বমেধ যজ্ঞ। মহাপুজোর একটি প্রধান অঙ্গ হল দেবীর মহাস্নান।
সপ্তমী বিহিত পূজার প্রারম্ভে “প্রিয়ানাং প্রিয়তম” স্নানাভিষেকের মধ্যে দিয়ে জগজ্জননীর বিশ্বরূপা মূর্তিটি সুন্দরভাবে রূপায়িত করা হয়। নবপত্রিকা স্নানের পর শুরু হয় দেবীর মহাস্নান। দেবীর মহাস্নান তিনটি পর্যায়ে সম্পন্ন হয়, প্রথমে নবপত্রিকাস্নান, তারপর মহাস্নান ও অষ্টকলস স্নান।
নবপত্রিকা আদতে নবদুর্গারই প্রতীক। কদলী বা রম্ভাতে (কলা গাছ) ব্রহ্মাণী, কচুতে কালিকা; হরিদ্রা (হলুদ গাছ) গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী উমা; জয়ন্তী গাছের দেবী কার্তিকী; বিল্বতে (বেল গাছ) দেবী শিবা, দাড়িম্বয় (ডালিম/বেদানা গাছ) দেবী রক্তদন্তিকা, অশোক গাছে দেবী শোকরহিতা; মানকচুতে চামুণ্ডা, ধান গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা করা হয়। একটি সপত্র কলা গাছের সঙ্গে অপর আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদ একত্র করে এক জোড়া বেল-সহ শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লাল পাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দেওয়া হয়।
বিধি মতে পুজোর পর নবপত্রিকা সিঁদুরচর্চিত করে সপরিবার প্রতিমার ডান দিকে দাঁড় করিয়ে পুজো করা হয়। প্রচলিত ভাষায় নবপত্রিকার নাম কলাবউ। চৈতন্য দেয়নি দূর্গা রূপা মহেশ্বরী শারদ সবে দেবী মাতৃকা রূপে, মৃন্ময়ী প্রতিমায় বিল্ববৃক্ষের ও নবপত্রিকায় আবিভূত ও আরাধিতা হন। তাই দেবী দুর্গার আরেক নাম শাকম্বরী। সর্বজীবের প্রাণ রক্ষার্থে শাকের দ্বারা পৃথিবীকে পালন করেন বলে দেবী শাকম্বরী নামে পরিচিতা। দশমীর বিসর্জন পর্বে নবপত্রিকারূপিণী দুর্গার বিসর্জন দেওয়া হয় কিন্তু ধানগাছটি বিসর্জিত না করে ঘরে ফিরিয়ে আনা হয়।
নবপত্রিকা স্নানের পর শুরু হয় দেবীর মহাস্নান। মহাস্নানের উপাচার হিসাবে ব্যবহার হয় শুদ্ধজল, নদীর জল, শঙ্খজল, গঙ্গাজল, উষ্ণ জল, সুগন্ধি জল, নারকেলের জল, মুক্তাজল, কুশ ঘাসের দ্বারা ছিটানো জল, ফুলের দ্বারা ছেটানো জল, ফলের জল, সব তীর্থের মাটি, সাগরের জল, ঔষধি মেশানো জল, বৃষ্টিজল, সরস্বতী নদীর জল, পদ্মের রেণু মেশানো জল, ঝরনার জল, গোমূত্র, গোময়, আখের রস, মধু, দুধ, দধি, তিল তেল, বিষ্ণু তেল, শিশিরের জল, রাজদ্বারের মাটি, চৌমাথার মাটি, বৃষশৃঙ্গমৃত্তিকা, গজদন্তমৃত্তিকা, বেশ্যাদ্বারমৃত্তিকা, নদীর দুই তীরের মাটি, গঙ্গামাটি, পঞ্চগব্য, সহস্রধরা ইত্যাদি। মহাস্থানের পাত্র হলো অষ্টকলস ও ভৃঙ্গার।
দেবীর মহাস্নানের জন্য আহ্বান করা হয় ব্রহ্মা-বিষ্ণু মহেশ্বর থেকে সমস্ত দেবতা দানব গন্ধর্ব পূর্ণ তীর্থ মহারাজা প্রভৃতি স্থাবর জঙ্গমের সমস্ত সত্তাকে। বছর মাস পক্ষ দিন প্রভৃতি কাল, পরিমাণ, কৃতী লক্ষ্মী পুষ্টি তুষ্টি শ্রদ্ধা ইত্যাদি মহৎ ভাব ও গুনারাজিকেও আহবান করতে হয় মায়ের অভিষেক ক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য। এমনকি যাঁর মহাস্নান, তাঁরই বিভিন্ন শক্তিকে বিভূতি ও মূর্তিকেও আহবান করতে হয়। যে বৃহৎ কাজ মানুষের চেষ্টার অসাধ্য তাই সাধন করার জন্য মাতৃনিষ্ঠ সন্তান শেষ পর্যন্ত মাতৃশক্তিরই শরণাপন্ন হন।
মহাস্নানের আয়োজনটিও বৃহৎ। আর হবে নাই বা কেন!! এ যে জগৎ জননীর মহাস্নান। বৈদিক ও পৌরাণিক মিলিয়ে কম-বেশি ৯১টি মন্ত্রে দর্পণে মহামায়ার মহাস্থান সম্পন্ন হয়। মহাস্নানের সময় নানা রাগরাগিনীতে বিভিন্ন বাদ্য বাজানোর নিয়মটিও লক্ষণীয়। যেমন —
উষ্ণজলপূর্ণ ঘটের জলে দেবীর স্নানকালে বিভাস রাগের মাধ্যমে মন্ত্র পাঠ করতে হয় এই সময় বাজে ঢাক, ঢোল প্রভৃতি দুর্গোৎসবের বাদ্য; দেশাগরাগে সমুদ্র কোলাহল বাদ্য, ললিত রাগে দেববাদ্য, কেদার রাগে ইন্দ্রাভিষেক বাদ্য, মালবগৌড় রাগে বংশধ্বনি বাদ্য, ভাটিয়ালি রাগে সমুদ্রত্থান বাদ্য, হিন্দোল রাগে কংশ্যবাদ্য এবং অষ্টম কলসে ধানেশ্রী রাগ বিজয়বাদ্য বা ভৈরববাদ্য সহযোগে সুসম্পন্ন হয়। ভৈরব শিব রূপের প্রকাশ। মা দুর্গা লক্ষ্মীস্বরূপা। ধানেশ্রী রাগের সঙ্গে ভৈরববাদ্য যেন শিবশক্তির মিলনকে সূচিত করে।
আগেকার দিনে আচার্য বা পুরোহিতদের এসব রাগ রাগিনীর বিষয়ে সম্যক জ্ঞান ছিল। কিন্তু বর্তমানে অষ্টকলস স্নানে রাগ আলাপ-সহ বাদ্য প্রথা প্রায় অবলুপ্ত। এছাড়া রাগসঙ্গীতের আসর থেকে মালব, বরাটী ও ধানেশ্রী রাগ লুপ্তপ্রায়। ফলতঃ মন্ত্রগুলি উচ্চারণের সময় কেবল সর্ববাদ্যময়ী ঘন্টাধ্বনি বাজে।
দেবীর মহাস্নানের এসব বিচিত্র উপকরণের মধ্যে দিয়ে বিশ্বরূপা মহামায়া জগৎমাতার বিশেষ বিশেষ শক্তি বা বিভূতিরই প্রকাশ পায়। দেবীপুরাণ মতে, দেবীর মহাস্নান ও অষ্টকলস স্নান দর্পণে করানো হয়। মায়ের মৃন্ময়ী রূপকে নষ্ট না করে স্নান করানো হয়। মাটি যাতে গলে না যায় তাই তামা বা মাটির পাত্রে ধাতু নির্মিত দর্পণ রাখা হয়, তাতে দেবী দুর্গার প্রতিবিম্ব এসে পড়লে, স্নানপর্ব সম্পন্ন হয়েছে বলে মনে করা হয়।
দেবীকে দর্পণ প্রতিবিম্বে মহাস্নান করানোর পর চলে গুরবাদী পঞ্চদেবতাদির পূজা, দেবীর চক্ষুদান ও প্রাণপ্রতিষ্ঠা। প্রাণ প্রতিষ্ঠার সময় দেবীকে কিছুক্ষণ পর্দা দিয়ে ঘিরে রাখা হয় কারণ প্রাণ সুক্ষ শরীরের অংশ, সুতরাং তা দৃষ্টির অগোচর।
সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে এই মহাস্থান সমাজের পূর্ণাঙ্গ সংহতির ছবি তুলে ধরে। প্রথমে দেবীকে পঞ্চশস্য (ধান গম জব ভুট্টা ডাল), পঞ্চরত্ন (সোনা, রুপা, তামা, ব্রোঞ্জ, হীরা), পঞ্চকষায় (জাম, বকুল, কুল, বেরেলা, শিমুল), পঞ্চগব্য (দুধ, দই, ঘি, গোমূত্র, গোময়) দিয়ে স্নান করানো হয়। এছাড়া শিশির, বৃষ্টির জল থেকে শুরু করে সপ্ত নদী সপ্ত সাগরের জল এমনকি অভিষিক্তা নারীর গৃহমৃত্তিকাও স্থান পায় এই ক্রিয়া অনুষ্ঠানে। বিশ্বাস করা হয়, কোন পুরুষ পতিতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পাপ সংগ্রহ করে ও পতিতালয়ের দরজায় তার জীবনের সঞ্চিত সমস্ত পুণ্য ফেলে যায়। তাই পতিতালয়ের মাটি পরম পবিত্র।
এই সকল ক্রিয়া অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে সমাজের কৃষিসম্পদ, খনিজ সম্পদ, বনজ সম্পদ, জল সম্পদ, প্রাণিজ সম্পদ,ভূমি সম্পদ প্রভৃতি রক্ষা করার জন্য সাধারণ মানসে বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়। নৈতিকতা স্থাপনে সর্বভূতে দেবীরই অধিষ্ঠানস্বরূপ পতিতোদ্ধারের ভাবটিও ফুটে ওঠে এই মহাস্নানে এমনকি চাষাভূষা মুচি মেথর থেকে শুরু করে ব্রাহ্মণ মালিক কুম্ভকার তন্তুবায় নরসুন্দর ঋষি দাস প্রভৃতি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ, বিশ্ব সংহতি ও বিশ্বের কাছে এক অসম্প্রদায়িক সম্প্রদায়ের সমন্বয়ের বার্তা প্রেরণ করে। ‘আমি’ আর ‘তুমি’ মিলেমিশে সেই পুণ্য জ্যোতির মহাসাগরে ডুবে গিয়ে একাকার হয়ে যায়।
এক কথায় সার্বিক সমাজ কল্যাণ চিন্তা ফুটে ওঠে এই মহাস্নানে। সুতরাং এক সঙ্ঘবদ্ধ জাতি গঠন ও রাষ্ট্রভাবনাকে সামনে রেখেই এইসব ক্রিয়াকান্ড নিখুঁতভাবে অনুষ্ঠিত হয় দুর্গাপূজায়। এটি মহাস্নানের ফলপ্রাপ্তি।
যখন কাশফুল শ্বেত পরিধানে,শিউলি সুবাস ঘ্রাণে
আনে সংবাদ আশ্বিনের পবিত্র সকালে,বাঙ্গালীর
বাংলা উচ্চারণে ঠাই পায় মহা সঙ্গীত মহালয়ার
হাত ধরে ঘরে ঘরে ধ্বনিত হয় আগমনী বার্তা-
মা আসছেন।মন গেয়ে ওঠে-“জাগো তুমি জাগো”
সুরেলা আহ্বান। ঠিক সেই সময়ে আপনার মহান পুজা অনুষ্ঠানের “মহা স্নান পর্ব”র অসাধারণ
প্রতিবেদন বাংলা বাঙ্গালী আবার নুতন করে জানে দশভূজার দশ দিক আলো করা পবিত্রতার
হাজার প্রকার আচার আচরণ।মা দুর্গার আবাহনে
সব বাঙ্গালীরা মেতে ওঠে অসংখ্য ধ্যান ধারনার
মাধ্যমে দেবীকে প্রসন্ন করার রীতি রিওয়াজে।যার
সুন্দর প্রতিফলন আপনার প্রতিবেদনটিকে শ্রী দুর্গা
আশির্বাদ ধন্য বলে নত মস্তক করবে বাঙ্গালীকে।
শারদ শ্রদ্ধা প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোলাগা ভালোবাসা
বাহ্ খুব সুন্দর বললেন। আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই আপনাকে শ্রদ্ধেয় 🌹