সেদিন মনীশ গুপ্ত পরিচালিত থ্রিলার মুভি “রহস্য” দেখছিলাম। ছবিতে অভিনয় করেছেন কে কে মেনন, টিসকা চোপড়া, আশিস বিদ্যার্থী, মিতা বশিষ্ঠ এবং অশ্বিনী কালসেকার। ছবিটি ২০০৮ সালের নয়ডা ডাবল মার্ডার কেস থেকে অনুপ্রাণিত। তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ের প্রমাণ গোয়েন্দাদের বিশ্বাস করে যে ড. শচীন প্রধান সন্দেহভাজন এবং তাকে বিচার বিভাগীয় হেফাজতে নেওয়া হয়। মামলাটি চলে যায় সেন্ট্রাল ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের অত্যন্ত বিচক্ষণ অফিসার সুনীল পরস্করের (কে কে মেনন) কাছে। যিনি শেষ পর্যন্ত কেসটি নিষ্পত্তি করেন। সিনেমায় দেখা যায় সুনীলবাবু বুদ্ধি বাড়াতে আখরোট খেতেন ও খাওয়ার পরামর্শ দিতেন। চিকিৎসকরা বলেন, আখরোট খেলে স্মৃতিশক্তি বাড়ে, নিউরোলজিক্যাল ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও কমে।
সিনেমার গল্পটি অনেকেই জানেন, সে কাহিনী বলতে আজ আমি আসিনি। আজকে আমি বলতে এসেছি আখরোট খাওয়ার উপকারিতা নিয়ে। শুনেই বলবেন এই গরমে আবার আখরোট!! তবে বলে রাখি ঠান্ডা কিম্বা গরম, সানডে ইয়া ফ্রাইডে – রোজ খান আখরোট। তাই গত ১৭ মে জাতীয় আখরোট দিবস পালিত হয়েছে।
সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে, বাদাম জাতীয় খাবার শরীরের জন্য খুব উপকারী। এদের মধ্যে উপকারী তালিকায় সবার উপরে রয়েছে আখরোট। চিকিৎসকরা বলেন, আখরোট খাওয়ার কয়েক ঘন্টা পর থেকে মানুষের শরীরে কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমে এবং ব্লাড ভেসেলের নমনীয়তা বেড়ে যায়।
আমার ফেসবুকের মহিলা বন্ধুদের জানিয়ে রাখি, ত্বক উজ্জ্বল, টানটান রাখতে নিয়মিত আখরোট খান কারণ এতে থাকা ভিটামিন ডি ও প্রচুর পরিমাণ এনটিঅক্সিডেন্ট ত্বককে free radical হাত থেকে রক্ষা করে এবং বলিরেখা ও বয়সের ছাপ পড়তে দেয় না। চুলের সৌন্দর্য বজায় রাখতে এর জুড়ি মেলা ভার। এতে উপস্থিত বায়োটিন (ভিটামিন বি ৭) চুলকে শক্তিশালী হতে সাহায্য করে, চুল পড়া কমায়, চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
আমাদের ছোটবেলায় কেউ কাশ্মীর বেড়াতে গেলেই তার প্রমাণ স্বরূপ নিয়ে আসতো আখরোট। আমি নিজেও স্কুলের বন্ধুদের জন্য একটা করে আখরোট নিয়ে এসেছিলাম। সাঁড়াশি দিয়ে ঠুকে, দরজার কব্জার মধ্যে ঢুকিয়ে আখরোটের খোলা ফাটানোর যে কি মজা, সেটা তারাই জানে, যারা এটা করে এসেছে। যদিও বা আজকাল নাট ব্রেকার দিয়ে খোলা ফাটানো হয়।
দিল্লি, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখন্ড, বিহার ইত্যাদি রাজ্যে শীতের সময় আখরোট অন্যান্য ড্রাইফুডের সঙ্গে মিশিয়ে মেওয়া হিসেবে খাওয়া হয়। এতে শরীরের শক্তি বৃদ্ধি হয় ও শীতের আক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়। কাশ্মীরের অধিবাসীরা আখরোটের তেল রান্নাবান্নাও করেন।
সারা বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৩.৫ মিলিয়ন টন আখরোট উৎপন্ন হয়। সেই উৎপাদনের সিংহভাগই হয় চিনে। নিখুঁত টপোগ্রাফির আশীর্বাদপ্রাপ্ত জম্মু কাশ্মীরের কুপওয়ারা জেলা আখরোট উৎপাদনে শিরোনাম অর্জন করেছে। আখরোট গাছ হিমাচল প্রদেশের পশ্চিমভাগ সিকিম কাশ্মীর খাসিয়া পাহাড় প্রভৃতি অঞ্চলে চাষ হয়। ইংরেজিতে বলা হয় ওয়ালনাট।
আখরোট গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Juglans regia যা জুগল্যান্ডাসি গোত্রের পর্ণমোচী বৃক্ষ। এই গাছ সাধারণত ১০ থেকে ৪০ মিটার (প্রায় ৩০ থেকে ১৩০ ফুট) লম্বা হয়। এই গণের লাতিন নাম Juglans য়ুগ্লান্স্ এসেছে Jovis glans য়ৌইস্ গ্লান্স্ যার অর্থ “জিউসের বাদাম”। বস্তুত এই নাম দিয়ে আখরোটকে দেবভোগ্য বলে রূপায়িত করা হয়েছে। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে চরক সুশ্রুতের সময় থেকে এর হদিশ পাওয়া যায়।
এই ফলের শাঁস থাকে একটি কাঠের গোলকের আবরণের মধ্যে। প্রকৃতির এ এক অপরূপ সৃষ্টি, দেখে যেন মনে হয় গোলকটি মাঝখান থেকে অর্ধেক করে জোড়া। খোলা ফাটিয়ে দেখলে ভিতরের ফলটির সঙ্গে মস্তিষ্কের (ব্রেন) খুব সাদৃশ্য দেখা যায়।
বিশ্বাস করা হয় যে আখরোট গাছের বয়স প্রায় ৭০০ বি.সি। চতুর্থ শতাব্দী এ ডি-তে, রোমানীয়রা প্রচুর ইউরোপীয় দেশে আখরোট প্রবর্তিত করে যেখানে সেটি সেই সময় থেকে আজও ফলানো হয়। আমরা যে বাণিজ্যিক আখরোটের সাথে পরিচিত তা স্থানীয় মূলত ভারতের এবং ক্যাস্পিয়ান সমুদ্রের আশপাশের অঞ্চলের।
গবেষণা বলে আখরোট খেলে ওজন বৃদ্ধি পায় না, হার্টের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ভরপুর আখরোট কোলেস্টরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
আখরোটে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমানোর গুণ রয়েছে। যে নারীরা সপ্তাহে দুই দিন ২৮ গ্রাম আখরোট খেয়েছেন তাদের টাইপ টু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ২৪% কমে। এই উপকারিতা ছেলেদের ক্ষেত্রেও একই রকমভাবে কার্যকরী।
পুরুষের শুক্রানুসংখ্যা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে আখরোট। ওমেগা ৩-ফ্যাটি অ্যাসিড ও আলফা-লিনোলেনিক, উচ্চ মাত্রায় অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট ও মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টস সমৃদ্ধ আখরোট পুরুষের বন্ধ্যত্বের সমস্যা হ্রাস করতে সাহায্য করে।
বিশেষ কয়েক প্রকার ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে এবং ঘুম বাড়াতে সাহায্য করে আখরোট। বাদামে এলার্জি সমস্যা না থাকলে গর্ভবতী মহিলাদের জন্য আখরোট খুব উপকারী।
যদিও আখরোটগুলি দিনের যে কোনও সময় খাওয়া যেতে পারে, তবে খাওয়ার সেরা সময় নির্ধারণ করার সময় কিছু বিষয় বিবেচনা করতে হবে। যেমন ধরুন —
১) স্ন্যাকস্ হিসাবে — আখরোটগুলি তাদের উচ্চ ফাইবার এবং প্রোটিন সামগ্রীর কারণে একটি দুর্দান্ত স্ন্যাকসের বিকল্প তৈরি করে, যা আপনাকে খাবারের মধ্যে পূর্ণ এবং সন্তুষ্ট বোধ করতে সাহায্য করতে পারে। জলখাবার হিসাবে এক মুঠো আখরোট খাওয়া অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ করা রোধ করতে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে।
২) প্রাতঃরাশের টপিং হিসাবে — আপনার প্রাতঃরাশের সাথে আখরোট যোগ করা আপনার খাবারের পুষ্টি উপাদান বাড়াতে সাহায্য করতে পারে একটি সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর ব্রেকফাস্টের জন্য ওটমিল, দই বা স্মুদি বাটিতে আখরোট যোগ করার চেষ্টা করুন।
৩. ব্যায়ামের পরে — ১০০ গ্রাম আখরোটে ১৫.২৩ গ্রাম প্রোটিন থাকায় আখরোট একটি দুর্দান্ত পোস্ট ওয়ার্কআউট স্ন্যাকসের বিকল্প। ব্যায়ামের পরে আখরোট খাওয়া শক্তির সঞ্চয় পূরণ করতে এবং পেশী পুনরুদ্ধারে সহায়তা করতে পারে।
৪. ঘুমানোর আগে — ঘুমানোর আগে আখরোট খেলে ঘুম বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। উপরন্তু, আখরোটের স্বাস্থ্যকর চর্বি রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল করতে সাহায্য করতে পারে, রাতে খিদে পেলে ফ্রিজ খুলে এটাসেটা না খেয়ে একমুঠো আখরোট ক্ষুধা নিবারণ করতে সাহায্য করে।
পুষ্টিবিদদের মতে, সম্পূর্ণ পুষ্টিগুণ পেতে এবং হজম শক্তি বাড়াতে ৪/৫টি আখরোট জলে ভিজিয়ে রেখে সকালে খেতে পারলে উপকার বেশি পাওয়া যেতে পারে৷ তবে যে কোন জিনিস খাওয়ার আগে অতি অবশ্যই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া বাঞ্ছনীয়।
বেশ ভালো প্রতিবেদন।
থ্যাঙ্ক ইউ