শ্রীশ্রীনিস্তারিণীদেবী কালীমন্দির, বেথুন রো, কলকাতা
১৮৬৫ সালে ঈশ্বরচন্দ্র নান শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের রথযাত্রার দিন প্রায় ছয় কাঠা জমির উপর শ্রীশ্রীনিস্তারিণীদেবীর নবরত্ন মন্দিরের কাজ আরম্ভ করেন। মন্দির প্রতিষ্ঠার দিন থেকে অদ্যাবধি রথযাত্রার দিনটি দেবীর জন্মোৎসব পালন করা হয়। তাঁর ইচ্ছা অনুসারে বর্তমানে ওই দিনটিউৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে পূজাপাঠ, ফল-মিষ্টান্ন ও সামান্য তৈজসপত্র দ্বারা ৫০ জন ব্রাহ্মণকে আপ্যায়ন করা হয়।
প্রত্যেক অমাবস্যার দিন বিশেষ পূজা-পাঠ-হোম হয়ে থাকে। এখানেমায়ের পূজা সম্পূর্ণ বৈষ্ণবমতে হয়। তাই মন্দিরে পশুবলির প্রচলন নেই। বৈশাখ, কার্তিক ও মাঘ মাসে প্রত্যহ ভোররাতে মায়ের মঙ্গল আরতির প্রচলন আছে। বর্তমানে ঈশ্বরচন্দ্র নানের বংশধরেরা মায়ের সেবা করেন।
ডাকাত কালী, পূর্ণদাস রোড, কলকাতা
দুর্ধর্ষ ডাকাত মনোহর বাগদি এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সময় এখানে প্রতি অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় চালু ছিল নরবলি। পাথরের কালীমূর্তিটিতে কোনও অলঙ্কার ছিল না। দেবী ছিলেন আয়ুধভূষিতা, মুণ্ডমালা-বিভূষিতা আর হাতে ছিল নরবলি হওয়া কোনও হতভাগ্যের করোটি। এই কালীপূজা করে মনোহর ডাকাত তার দলবল নিয়ে ডাকাতি করতে বের হতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শুরু হয়নি। চারদিকে চলছিল অরাজকতা। সেই সময় কালীঘাট-সহ দক্ষিণ কলকাতা পুরোটাই ছিল গভীর জঙ্গলে ভরা, তার মাঝ দিয়ে বয়ে যেত আদিগঙ্গা। কালীঘাট দর্শনের জন্য লোকজন এই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে অথবা নৌকাপথে আসতো। আজ আর জঙ্গল নেই, আছে আদিগঙ্গা, পাহাড়ের মতো বড়ো বড়ো বাড়ি আর তার মাঝে এই মনোহর ডাকাতের কালীমন্দির। বর্তমানে নিত্যসেবা হয় মায়ের। তবে পুরোহিতরা কেউই মনোহরের বংশধর নয়। পূর্ণ দাস রোডে এই মন্দির অবস্থিত।
শ্রীশ্রীমা আনন্দময়ী (বসাকালী) মন্দির, ছাতুবাবুর বাজার, কলকাতা
আজ থেকে প্রায় ২৯৪ বছর আগের কথা। তখন ছিল মিত্রদের জমিদারি এইখানেতে। আজ যেখানে ছাতুবাবুর বাজার, তখন এর চারপাশে জঙ্গল ছিল। শ্রী মতিলাল বন্দ্যোপাধ্যায় স্বপ্নাদেশ পেয়ে মিত্তিরদের জঙ্গল খুঁড়ে বসা অবস্থায় কালীমূর্তি দেখতে পান এবং মিত্রদের জমি লাভ করে সেখানে দেবীমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। লাল রঙের দালান মন্দির প্রাচীনত্বের ছাপ রাখে। মূর্তিটি মাটির তৈরি। নাটমন্দিরের লাগোয়া গর্ভমন্দিরে শায়িত শিবের বুকে দেবী কালিকা বসে আছেন বাবু হয়ে। কলকাতার প্রাচীন কালীর মধ্যে বসাকালী রঙে-রূপে-আকৃতিতে একদম অনন্যা ও জাগ্রত বলে প্রসিদ্ধ। কালীপুজোতে শোল মাছ দেওয়ার রীতি আছে। বাড়ি থেকে বলি দেওয়া হয় না। কিন্তু বাইরের কেউ দিতে চাইলে দিতে পারেন। বর্তমানে বাড়ির দুই কন্যা সদস্যা শ্রীমতী তনুশ্রী চক্রবর্তী ও মধুশ্রী চ্যাটার্জি মায়ের সেবায় আছেন।
শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির, কুমোরটুলি, কলকাতা
প্রায় ৫০০ বছর আগের কথা। তখন গঙ্গা আজকের ট্রামলাইনের উপর দিয়ে বইতো। চারদিকে বেত বনে ভরা। সেই সময় রঘু ডাকাত দেবীমূর্তি (মা কালী) বানিয়ে পূজা করে ডাকাতি করতে বেরোতো। আর ফল লাভের আশায় মায়ের কাছে নরবলি দিতো। ইংরেজরা আসার পর ১৬০৪ সালে নরবলি বন্ধ হয়ে যায়।
উত্তরের হিমালয় থেকে এক তপস্বী স্বপ্নে আদেশ পেয়ে দক্ষিণমুখে যাত্রা করেন সতী মায়ের অঙ্গক্ষেত্র খুঁজে বের করতে। সেই তপস্বীর নাম ছিল কালীবর তপস্বী। ভুলবশতগঙ্গার ধারে হাড়গোড় পড়ে থাকতে দেখে এবং মায়ের মূর্তি দেখে এইখানেতে মাতৃ অঙ্গ আছে ভেবে তিনি পঞ্চমুন্ডির আসন করে বসে পড়েন এবং মাতৃ আরাধনা করেন। তিনি এখানে সিদ্ধিলাভ করেন ও মায়ের দর্শন পান। পুনরায় তপস্বী আবার স্বপ্ন পেয়ে মাতৃ অঙ্গ খুঁজে বের করতে বেরিয়ে পড়েন। যাওয়ার আগে তাঁর দুই শিষ্যকে মাতৃপূজার দায়িত্ব দিয়ে যান। অবশেষে কালীবর তপস্বী সতী অঙ্গক্ষেত্র খুঁজে পান এবং প্রতিষ্ঠিত করেন। আজ যা কালীঘাটের কালী বলে আমরা জানি। পরে তপস্বী আবার হিমালয় মুখে যাত্রা করেন। বহু বছর কেটে যাওয়ার পর একদিন রঘু ডাকাতের দল দেখতে পায় গঙ্গায় ভেসে যাচ্ছে একটা আট চালা আর তাতে আঁকড়ে ধরে আছে ছোটো দুই মানবসন্তান। পরে জানতে পারে তারা দুই ভাই-বোন। তাদের উদ্ধার করে নিয়ে এলো পূজারির কাছে। তারা মনস্থ করল ছোটো ছেলেটিকে মায়ের পায়ে নিবেদন করবে। কিন্তু ছেলেটির গলায় পৈতে থাকায় ব্রাহ্মণ সন্তান বলে রক্ষা পেয়ে যায়। তখন ছেলেটিকে দীক্ষা দিয়ে মায়ের পূজার ভার দিলেন আর মেয়েটিকে পূজার বাকি কাজ। এরা দুইজন ছিল চক্রবর্তী বংশোদ্ভূত।
বলাগড়ের এক জমিদার রামধন মুখোপাধ্যায় নদীপথে যাবার সময় মায়ের মন্দির (সেই সময় হোগলার চাল ছিল) দেখে দাঁড়িয়ে পড়েন এবং দর্শন করেন। এই সময় সুন্দরী ব্রাহ্মণ কন্যা দেখে ভালো লাগে এবং বিবাহ করে নিজ গৃহে নিয়ে যান। চক্রবর্তী কন্যাকে বিবাহের অপরাধে তাঁকে সস্ত্রীক ফিরে আসতে হয়েছিল মন্দির প্রাঙ্গণে। রাজা নবকৃষ্ণদেব তাঁর জমিদারি থেকে কিছুটা জমি দান করেছিলেন। সেই থেকে রামধন মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর বংশধরেরা এই মন্দিরে মায়ের নিত্য সেবা করে আসছেন। এই মন্দির পরে ওই অঞ্চলের আরেক জমিদার শ্রী গোবিন্দরাম মিত্র তৈরি করে দেন এবং মন্দিরের মাথায় ছিল কাঠের প্যাগোডা। ১৬০০ সালে প্রবল ঝড়ে ওই প্যাগোডা ভেঙে পড়ে। পুনরায় মন্দিরের মাথায় আর চূড়া তৈরি করা হয়নি। এই মাতৃমন্দিরে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব এসেছিলেন। গিরীশ ঘোষ পাণ্ডুলিপি লিখে মায়ের পায়ে ঠেকিয়ে নিয়ে যেতেন। বর্তমানে সেবাইতের এক ভাই শক্তিপ্রসাদমুখোপাধ্যায়ের পিতা শ্রী নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়ের পৈতের পরে মায়ের বাড়িতে নিয়ে গেলে ‘মা’ (সারদা মা) তাঁকে নিজের হাতে মিষ্টি খাওয়ান। তপস্বী কালীবর এই স্থানে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন বলে আজ শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী কালী নামে পরিচিত। এই মন্দির কুমোরটুলি ট্রামলাইনের ধারে অবস্থিত।
ফিরিঙ্গি কালী, বউবাজার
ভোলা ময়রা, ঠাকুর সিংহ, হরু ঠাকুরের মতো প্রখ্যাত কবিয়ালের উপস্থিতিতেও কবিয়াল হিসেবে অ্যান্টনি হয়ে উঠেছিলেন অত্যধিক জনপ্রিয়। তিনি যে দেবী সিদ্ধেশ্বরীর কৃপা দৃষ্টি লাভ করেছিলেন। কথিত আছে, ধর্মভীরু বাঙালি বিধবা সৌদামিনীকে পত্মীরূপে গ্রহণ করেন।
মন্দির প্রতিষ্ঠার দিন অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির সঙ্গে ভোলা ময়রার কবিগানের লড়াই হয়েছিল এই মন্দির প্রাঙ্গণে। ফিরিঙ্গি কালী শুধু হিন্দু নয়, অন্যান্য ধর্মের মানুষের কাছেও জাগ্রত। ইংরেজ আমলে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেবরাও এসে এখানে পুজো দিতেন। আজও ধূমধাম করে ফিরিঙ্গি কালীর পুজো হয়ে আসছে। দ্বীপান্বিতা অমাবস্যার পূণ্যতিথিতে সেজে ওঠে ফিরিঙ্গি কালী। আজও এই কালীর মহিমা অপার। জাতপাতের বিভেদ ভুলে ভক্তদের ভিড়েও তাই জমজমাট হয়ে ওঠে দক্ষিণাকালী পুজোর রাতের এই ফিরিঙ্গি কালী মন্দির।
তবে ফিরিঙ্গি কালীর প্রতিষ্ঠা নিয়ে অন্যমতও প্রবল। অ্যান্টনি কবিয়াল নিত্য এই মন্দিরে আসতেন বলে কালেভদ্রে এই কালী মন্দির ফিরিঙ্গি কালী বলে প্রচারিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এর প্রতিষ্ঠা আরও আগে বলেই বিশ্বাস একাংশ ভক্তমণ্ডলীর। অনেক ইতিহাসবিদও তাই মনে করেন। আজ থেকে পাঁচশো বছরেরও আগের কথা। তখন গঙ্গা বয়ে চলেছে আজকের বউবাজার অঞ্চলের ওপর দিয়ে। গঙ্গার পাশেই গভীর জঙ্গলের মধ্যে শ্মশানে একটি ছোট্ট একচালা কুঁড়েঘরে থাকতেন শ্রীমন্ত পণ্ডিত নামে এক তন্ত্রসাধক।
অ্যান্টনি কবিয়ালের স্মৃতিবিজড়িত ফিরিঙ্গি কালীমন্দিরে আজও সর্বধর্মসমন্বয়ের পুজো হয়। তিনি সদাই দেবী শক্তির আরাধনায় নিয়ত থাকতেন। জঙ্গলেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শিব ও কালীর মূর্তি। সেটা ছিল আনুমানিক ১৪৩৭ সাল। আজও মন্দিরের গায়ে খোদাই করা স্থাপিত সন ৯০৫। ওই সাল বঙ্গাব্দ ধরলে পাঁচ শতাধিকই হয় মন্দিরের বয়স।
কিন্তু কী করে ফিরিঙ্গি কালী হয়ে উঠল শ্রীমন্ত পণ্ডিত প্রতিষ্ঠিত ওই মন্দির? জব চার্নক কলকাতা তরী ভিড়িয়েছেন। তিনি ওই অঞ্চলে আসার পর থেকে ফিরিঙ্গিদের বসবাস বাড়তে লাগল এলাকায়।
সেইসময় এলাকায় বসন্ত রোগ ছড়ায়। ফিরিঙ্গিরাও আক্রান্ত হন দুরারোগ্য এই ব্যাধিতে। তখন তাঁরা শ্রীমন্ত পণ্ডিতের শরণাপন্ন হন। বসন্ত রোগের চিকিৎসা করাতে এসে আরোগ্য লাভের জন্য দেবী মায়ের পুজোও দিতে থাকেন তাঁরা। তারপরই ধীরে ধীরে লোকমুখে এই কালীর প্রচার। আর ফিরিঙ্গি সাহেবদের মুখে মুখে এই কালী মায়ের প্রচার হেতুই ফিরিঙ্গি কালী মন্দির নামে পরিচিতি পায় বউবাজার এলাকার বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিটের এই কালী মন্দির।
তারপর এই মন্দিরে এসেই কবিত্বলাভ করেন অ্যান্টনি হেনসম্যান। এই মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে যায় অ্যান্টনি কবিয়ালের নামও। মন্দিরের মূল বিগ্রহ ত্রিনয়নী মৃন্ময়ী সিদ্ধেশ্বরী কালী। রয়েছে শিব, দুর্গা, শীতলা, মনসা, গনেশ, রাধাকৃষ্ণ প্রভৃতি মূর্তি। এখানে অমাবস্যায় মহানিশি পুজো হয়, হয় অন্নকূট ভোগ। তবে বলির প্রথা নেই।