কচু মানেই স্রেফ ‘কচুপোড়া’, ‘কচু হয়েছে’ নয়, কচুর বহু স্বাস্থ্যগুণ। স্বয়ং কবিগুরুও সেকথা বুঝেছিলেন। তা সত্ত্বেও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, ব্যঙ্গের বিষয়ে হয়ে থেকে গিয়েছে সে যুগ যুগ ধরে। তাকে জগত সভায় স্বাস্থ্যের শ্রেষ্ঠ আসনে নথিভুক্ত করতেই আজকের এই লেখা।
গবেষণার কথায় পড়ে আসছি। তার আগে বরং কচু নিয়ে পপুলার কালচারে একটু উঁকি মেরে নেওয়া যাক।
নারকেল কোরা কিম্বা ইলিশ মাছের মাথা কিম্বা কুচো চিংড়ি দিয়ে কচু শাক বাটা আর গরম গরম ভাত খেতে কার না ইচ্ছা করে বলুন তো! আসলে বাঙালি তো সর্বদাই কব্জি ডুবিয়ে খেতে ভালোবাসে। তাই শীতের সময় মা-ঠাকুমার হাতের সেই সাবেকি পদগুলি পেতে যে মন চায় না, এমন মিথ্যা কথা বলার ক্ষমতা আমার অন্তত নেই।কিন্তু সময়ের অভাবে নাকে মুখে চোখে গুঁজে ক্রমে দিনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে বাঙালি। তাই ক্রমে বাঙালির পাত থেকে প্রায় উঠে যেতে চলেছে নস্টালজিয়া সেসব রান্না।
কচুকে সম্মান জানিয়ে কবিগুরু লিখেছিলেন, — ‘কচু কহে গন্ধ শোভা নিয়ে খাও ধুয়ে/ হেথা আমি অধিকার গাড়িয়াছি ভুঁয়ে/ মাটির ভিতরে তার দখল প্রচুর/ প্রত্যক্ষ প্রমাণে জিত হইল কচুর।’
গুরুদেবের অন্যতম পছন্দের মিষ্টি ছিল মানকচুর জিলাপি। শুনে অবাক হলেন তো?
একবার নাকি ঠাট্টাচ্ছলে স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে মানকচুর জিলিপি বানাতে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিলেও পরে কিন্তু নিজে হাতে মানকচুর জিলিপি বানিয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন মৃণালিনী দেবী। সাধারণ জিলিপির চেয়ে আরও খেতে ভালো ছিল সেটি।
বাংলা ভাষার প্রথম রান্নার বই ‘পাকরাজেশ্বর’র লেখক বিশ্বেশ্বর তর্কালঙ্কার বইতে উল্লেখ করেছেন কচু জিলিপি এবং তার প্রণালীর কথা। যারা মনে করতেন, কচু দিয়ে জিলিপি তৈরি হবে — ‘কচু’, সুযোগ হলে এই বইটি অবশ্যই পড়ে নেবেন।
উপকূলীয় এলাকায় কচু সেদ্ধ করে মসলা দিয়ে ভেজে খাওয়া হয়, এটির নাম আরবি। এটি তরকারি, ভাজা এবং নানাভাবে তৈরি করা যায়। গুজরাতের বাসিন্দারা কচু পাতায় বেসন, নুন, হলুদ, লঙ্কার গুঁড়া, তেতুলের প্রলেপ লাগিয়ে ভাপান, তারপর ভাজেন একে বলে পাতরেল।
সিন্ধিরা একে কাচালু বলে ; তারা এটিকে ভাজে, সংকুচিত করে এবং টুক নামক একটি থালা তৈরি করার জন্য এটিকে পুনরায় ভাজে যা সিন্ধি তরকারিকে স্বাদু বানায়।
অবাঙালিরা বিশেষ করে ওড়িশাতেও এই সবজির জনপ্রিয়তা রয়েছে।
এমনিতেই শাশুড়ি বৌমার সম্পর্ক আদায় কাঁচকলায়।আজও গ্রামের শাশুড়িরা বৌমাকে জব্দ করতে প্রয়োগ করে কচু অস্ত্র। কুচো চিংড়ি, নারকেল কিংবা মাছের মাথা দিয়ে রান্না করা কচুশাকবাটা খেয়ে যদি বাড়ির কর্তার গলা না চুলকায়, তাহলেই নতুন বৌমা পরীক্ষায় পাশ।
কচু শাক বা কচু খেলে অনেক সময় গলা চুলকায়। কারণ এতে অক্সলেট নামক উপাদান রয়েছে। এই জন্য কচু রান্না করার সময় লেবুর রস বা ভিনিগার কিংবা তেঁতুল গোলা জল ছিটিয়ে ব্যবহার করা উচিত। তাহলে আর সেই কচুতে গলা চুলকায় না।
বনে জঙ্গলে যেসব কচু আপনাআপনি জন্মায় সেগুলোকে সাধারণত ‘বুনো কচু’ বলা হয়। এর সবগুলো মানুষের খাবারের উপযোগী নয়। খাবার উপযোগী জাতগুলোর অন্যতম হচ্ছে কচুমুখী, পানিকচু, পঞ্চমুখী কচু, ওলকচু, দুধকচু, মানকচু, শোলাকচু ইত্যাদি।
অনুমান করা হয়, কচুর উৎপত্তি ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। প্রায় দু’হাজার বছর আগেও কচুর চাষ হত বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। নাইজেরিয়া বিশ্বের বৃহত্তম কচু উৎপাদনকারী দেশ।
যতই আগাছা বলি আমরা কচুকে, কচুতে রয়েছে প্রচুর আয়রন। ফলে রক্তের পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করে কচু। সেই কারণেই গর্ভাবস্থায় কচু শাক খাওয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। কচুর লতি খেলে মাতৃদুগ্ধ বৃদ্ধি পায়।
এতে উপস্থিত ভিটামিন, আইরন, ক্যালসিয়াম শুধু গর্ভবতী মহিলারা নয় যে কোন মানুষের জন্য উপকারী।তবে এলার্জি থাকলে কচু না হওয়াই ভালো।চুলের ভঙ্গুরতা ও চুল ওঠা বন্ধ করতে কচুর উপকারিতা অনেক।
কচুতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায় ভিটামিন এ আছে। ফলে রাতকানা রোগ প্রতিরোধে এটি ভীষণ কার্যকরী।
ভিটামিন এ-সমৃদ্ধ কচুর শাক আমাদের চোখকে রক্ষা করার পাশাপাশি বার্ধক্যজনিত ম্যাকুলার অবক্ষয় প্রতিরোধে সহায়ক।
কচু শাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফাইবার রয়েছে, তাই এটি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, হজমের জন্য বিশেষ সাহায্য করে।
প্রচুর লতিতে চিনির পরিমাণ কম থাকায় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নয় নিশ্চিন্ত খেতে পারেন কচুর কোন অংশই ফেলনার নয়।
কচু রক্তের কোলেস্টেরল কমাতে বিশেষভাবে সাহায্য করে। উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের কচু বিশেষ উপকারী।
কচুতে আয়োডিনের পরিমাণও অনেক। যাদের গ্যাস্ট্রিক বা অ্যাসিডিটি রয়েছে তাদের জন্য কচু অনেক উপকারী।
গবেষণায় দেখা গেছে যারা কচুর লতি সপ্তাহে আমাদের তিন চার দিন খান তাদের কোলন ক্যান্সার এবং স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকটাই কম।
মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত শরীরের প্রতিটি অঙ্গের ক্ষমতা বাড়ানোর উপকারী উপাদান মজুদ রয়েছে কচুতে। জ্বরের সময় রোগীকে দুধকচু রান্না করে খাওয়ান, জ্বর কমে যাবে।
কচুর ডাটিতে প্রচুর পরিমাণে জল থাকে ফলে এটি রান্না করে খেলে শরীরের জলের ঘাটতি পূরণ হয়। কচুতে উপস্থিত এন্টি ইনফ্লেমেটরি এবং এন্টি মাইক্রোবিয়াল উপাদান রয়েছে। ফলে শরীরে প্রদাহ কমাতে এটি সাহায্য করে।
মুখী কচুতে ক্যালশিয়াম, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, জিংক, আইরন, ফসফরাস, সোডিয়াম, কপার, ভিটামিন-ই এবং এ, বিটা কেরোটিন, রিবোফ্লাভিন, নিয়াসিন, ক্রিপটোজেন্থিন নামক খনিজ উপাদান যা ভালো এন্টিঅক্সিডেন্ট। বহু রোগের বিরুদ্ধে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলি সুরক্ষা দেয়। বয়স বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে ধীর করে।
তবে যাদের অ্যালার্জির সমস্যা রয়েছে তাদের কচু না খাওয়াই ভালো। কচু খাওয়ার পর অনেকেরই বুক জ্বালাপোড়া হতে পারে। যাঁদের সমস্যা আছে তাদেরও সাবধানে খেতে হবে কচু।
যাইহোক এতক্ষণে বুঝতে পারলেন কচুর কদর কেন করবেন। ব্যস্ততার যুগে নারকেল কোড়া, ছোলা দিয়ে কচুর ঘন্ট খাওয়া আজ তেমন হয়ে ওঠে না কিন্তু মনের কোণের ইচ্ছাটা তো রয়ে গেছে ষোলো আনা।
কচুপ্রেমীদের জন্য বলি ,রোজ একঘেয়ে তরকারি খেতে খেতে নিশ্চয়ই বোর ফিল করছেন? তাই স্বাদ বদলাতে ট্রাই করতেই পারেন কচুর নয়া নয়া রেসিপি। সময় পেলে গাঠি কচুর তরকারি, নিরামিষ শোলা কচুর তরকারি, কচু রসা, কচু পাতুরি….। কুকপ্যাড কিংবা ইউটিউবে দেখে নিন ঘরোয়া পদ্ধতিতে কী ভাবে বানাবেন কচুর রেসিপি ।
ঝামেলায় যদি জড়াতে চান তাহলে খুব সহজ পদ্ধতিতে প্রেসার কুকারে নুন কাঁচা লঙ্কা দিয়ে ভাপিয়ে নিন ছাল ছাড়িয়ে কচু। ভাপানোর জলটা ফেলেও দিতে পারেন নাও ফেলতে পারেন। সেদ্ধ কচু সামান্য সর্ষে বাটা, লেবু মেখে গরম ভাতে খান। দুর্দান্ত খেতে লাগবে।
ছোটবেলায় একবার কচুর লতি দিয়ে সটাং সঠাং করে মায়ের কাছে মার খেয়েছিলাম, কি কারণ ঠিকঠাক মনে নেই। কচুর নাম শুনে বহু জনই নাক সিঁটকয়। ফেসবুকের বন্ধুরা যারা কচু পছন্দ করে না, আমার লেখা পড়ার প্লিজ আমাকে ফ্রেন্ডলিস্টে কচুকাটা করবেন না। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
কভারর ছবি : গাঁঠি কচু বাটা যার স্বাদ অতুলনীয়