কথাকার অমর মিত্র কবি। তিনি কথাসাহিত্যের কবি। অমর মিত্রের উপন্যাসভুবন থেকে কবি অমর মিত্রকে আবিষ্কার করা খুব বেশি কঠিন কাজ নয়। আসলে নিজস্ব ভাষাবল ও স্নিগ্ধ বাক্যজালে কাব্যময়ভুবন নির্মাণে তিনি সিদ্ধহস্ত। গদ্যের স্বচ্ছ অনাবিল প্রবাহ ও মায়াময় পরিচ্ছেদ বিন্যাসে লিরিকের সংমিশ্রণ আখ্যানকে বহু পরিসরে কাব্যসত্যে উত্তীর্ণ করেছে। কবি, কবিতা, লিটল ম্যাগাজিনের দায়বদ্ধতা, কবিতা পত্রিকার জীবনসত্য, কবির পাগলামিকে সামনে রেখে লিখেছেন ‘নতমুখ চরাচর’ উপন্যাস। গৌতমবুদ্ধকে (বীরেন মণ্ডল) সামনে রেখে কবিতা সংসারের চৌহদ্দি নির্মাণ এবং কবির পারিপার্শ্বিক কাব্যবলয়কে (অবন্তিকা, সেলিম, চন্দন) রহস্যজালে বাঁধার এক নতুন পরিসর, যা উপন্যাসভুবনে ম্যাজিক।
এ যেন এক কবির দেশ। কবির অনুভূতির ভুবনময় চিত্রশালা। কাব্য সাম্রাজ্যেও যে নিষ্ঠুর সত্য উচ্চারিত হতে পারে, সত্যদ্রষ্টা কবিই যে সভ্যতাকে প্রকৃত পথ দেখাতে পারে সেই বয়ান। কবিতার সত্য, কবির দায়বদ্ধতা, কবির বর্ম, সমাজ চিন্তা ও মানবিক ভাবনা নিয়ে চরাচরের অকথিত সত্যের খুঁটিনাটির অসমান্তরাল বিন্যাস। কবিতার দর্শন, পাগলামি, ভবঘুরে চিন্তা, দিকশূন্যপুরের অভিলাস নিয়ে এ এক মায়াময় আখ্যান। কবি মানেই উদাসীন পাগল, বাউল। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার থেকেও বহেমিয়ান জীবনযাপন পাঠককে বেশি আকর্ষণ করেছে।
এ আখ্যান গৌতমবুদ্ধ নামে এক কবির ঘর সংসার। প্যাশন, জীবনচিন্তা, কাব্যভাবনা, লিটল ম্যাগাজিন, কবিতার উৎসভূমি নিয়ে একলা মানুষের হইহই কোলাহল। আপাত দৃষ্টিতে পাগল মনে হতে পারে কিন্তু গভীর জীবনতৃষ্ণায় সেই বয়ান ভেঙে যায়। বলা ভালো আপতিক জীবনচিন্তার পরিসর লেখক ভেঙে দেন। এ যেন কবিতার সঙ্গে ঘর গেরস্থি। যাবতীয় কথাবার্তা জীবনবোধ, জীবনবিন্যাস, ঝগড়াঝাঁটি, মান-অভিমান ভালোবাসাবাসি সব কবিতাকেন্দ্রিক। এই গদ্যে একটা লিরিক আছে। একটা সুরেলা প্রবাহ আছে। ছন্দের দোলাময় বাক্যস্রোতে কাহিনি ভেসে গেছে কাব্যসাগরে। ছন্দের দোলায় রাষ্ট্রের দাসত্ব, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ সবই আছে। কবির ধর্ম, কবিতার ধর্ম বজায় রেখেও কল্পনায় ভেসে যাবার আকাঙ্ক্ষা আছে। এ এক মিস্টিসিজমের উপন্যাস।
এ এক কবিতার মেলা। প্রবীণ কবি, নবীন কবি। কবিতা দপ্তর। কবিতা ক্যাম্পাস। উল্লাস, হইহল্লা। আসলে অমর মিত্র নিজেও এক প্রাণবন্ত মানুষ। হইহই করা উত্তাল স্রোত আখ্যানে তীব্র গতি সঞ্চার করে। নির্জন কবি, দলবাজির কবি, দলছুট কবি, পথহারা কবি। কত কবি এই চরাচর থেকে হারিয়ে গেছে। আমরা পড়িনি, জানিনি। অথচ অসম্ভব ভালো কবিতা লিখত। এই উপন্যাস কবিতা কালচারের উপন্যাস। কবিতার মায়াভূমিই এই আখ্যানের প্লট নিয়ন্ত্রক। ভেজালহীন উন্মাদ গৌতমবুদ্ধ। রহস্যময় অনেকান্তিক উদ্ভট চিন্তা করে চলেন। কবি বলেই তা সম্ভব। তেমনি কবিই এই মহাপৃথিবীর ঈশ্বর। মহাপৃথিবীর ভিতর আরেক জগৎ নির্মাতা। বিকল্প ভাবনার দিশারী।
কবিতার সত্যভূমি থেকে আধুনিক কবি অনেক দূরে সরে এসেছেন। নিভৃত সাধনা, কবিতাচর্চা অপেক্ষা দলাদলি, সিন্ডিকেট বড় হয়ে উঠেছে। প্রকৃত কবিকে প্রমোট করার কোনো দায়বদ্ধতা নেই। অহম সর্বস্ব মানসিকতা বাংলা কবিতার সমূহ সর্বনাশ করেছে। অবন্তিকা, গৌতমবুদ্ধের মধ্য দিয়ে লেখক আসলে কবিতার নান্দনিক চালচিত্রের গভীর বলয়ে প্রবেশ করেন। কত কবি লিটল ম্যাগাজিনেই হারিয়ে গেছে। বাণিজ্যিক প্রকাশনী দায়বদ্ধতা পালন করেনি। প্রতিষ্ঠিত কবি সার্টিফিকেট দেয়নি বলে বই হয়নি। তবে সব হারিয়ে যায়নি। কেউ কেউ মনে রেখেছে। বহু পরে আবিষ্কার করেছে। পড়েছে। সত্য উচ্চারণ করেছে। বিনয় মজুমদার, শম্ভু রক্ষিত, তুষার রায়। আমাদের আবহমান সাহিত্য তথা কবিতা চর্চা ভণ্ডামি, দলবাজিতে ভর্তি। প্রকৃত সত্য বলার লোক নেই। বললে তাকেও সেম সাইডে গোল খাইয়ে দেওয়ার ক্রমবর্ধমান চেষ্টা চলছে।
এ এক সাংস্কৃতি বয়ান। সমাজ পরিবেশ পরিস্থিতি সহ গত শতকের সাতের দশকের উত্তাল আবহ, সময়ের জটিলতা, রাজনীতি ও ব্যক্তি মানুষের দ্বিরালাপ। কবিমনের অনুভূতিতে সব দেখা-বোঝা-জানা। আবেগ রোমান্টিসিজম বলতে বলতেই জীবনের ভিতরে, সময়ের ভিতরে উঁকি ঝুঁকি দেন। কেন এই আখ্যান লেখার প্রয়োজন হল এই কুজ্ঝটিকাপূর্ণ সময়ে? কবি তার দায়বদ্ধতা থেকে সরে এসেছেন। কেন কবিতা লিখি এই বয়ানে বিবিধ জবাবদিহি উঠে আসে। ভালোলাগা, আনন্দ দান, কাজ নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কবিতাই তো দেশকে, মানুষকে পথ দেখাবে। কবির সেই সমাজচেতনা, দায়বদ্ধতা অস্তগামী হয়েছে। জীবনের বেলাভূমিতে কবিতা কোন পথে যাত্রা করবে? বিষাদময় সময়ে, সন্ত্রাসের পটভূমিকায়, রাষ্ট্রীয় নির্যাতনে কবি ও কবিতা কতখানি গ্রহণযোগ্য তার হিসাব নিকেশের পক্ষ-বিপক্ষের আখ্যান ‘নতমুখ চরাচর’।
গত শতকের ছয়ের দশকে কবিতা আন্দোলন দেখা দিয়েছিল। আবহমান কবিতার পরিসর থেকে নতুন উৎসে যাত্রার প্রবণতাই প্রধান ছিল। প্রচলিত সত্যকে ভেঙে ক্ষুধার্ত আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল। সেসময় কবিতায় প্রবল জোয়ার এসেছিল। প্রথাগত পরিসর ভেঙে সামান্য মানুষও কবিতায় আশ্রয় নেয়। জীবনের মর্মমূলের বোধকেই প্রকাশ করতে চান। সেই ছয়ের দশকের কবিতা আন্দোলনের সময় গৌতমবুদ্ধ যুবক। স্বভাবতই কবিতার মায়াবী রূপমোহ হৃদয় ছুঁয়েছিল। কলকাতা কেন্দ্রিকতা থেকে কবিতার সরস্বতী দূরে গেছে। তবুও মানুষ সাহিত্যের জন্য আজও কলকাতামুখী। লেখক সময়ের অলিগলি ধরে সাহিত্যের হালচালের খবর দিতে থাকেন। কবিতার জন্য জেল যেমন সত্য হয়ে দাঁড়ায় তেমনি বন্দিমুক্তির কবিতা রচিত হতে থাকে। একজন কবিকে সাতের দশকে কবিতার জন্য জেলে যেতে হয়েছে। এমন বহু কবিই আছেন। আজও ভারাভারা রাওদের জেলে যেতে হয়। সভ্যতা কবিকে ভয় পায়, সেই সত্যনিকেতনের সদর দরজা লেখক খুলে দিয়েছেন।
গত শতকের সাতের দশকের রাষ্ট্রীয় সংকট থেকে আজকের বাংলা কবিতার বাজারে আখ্যান পরিক্রমা করেছে চক্রাকারে। কবিতা নিবেদিত গৌতমবুদ্ধ, মহাজাগতিক তার গাণ্ডিব। সারথি অবন্তিকা। আপাত লিরিক কাব্যস্রোতের মধ্য দিয়ে কবিতাভুবনের যাবতীয় সত্য বের করে আনেন। বাংলা কাব্যের ইতিহাস লেখার এ যেন নতুন ঢঙ। কথাকারের কল্পনার চোখে কাব্য আন্দোলন, কবি জীবনের বাস্তবতা দেখা ও সাহিত্যের গতিপ্রকৃতির নিরূপণ। রাষ্ট্র ক্রমেই ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে থাকে। কবির সত্যচিত্রের কণ্ঠরোধ করতে সিদ্ধহস্ত হয়। প্রকৃতপক্ষে সাহিত্যকে গলাটিপে মারার যে ভয়ংকর দুর্দিন এসে উপস্থিত হয়েছিল সেই সময় বিভীষিকা আখ্যানে গুরুত্ব পায়। রাষ্ট্র যতই সাহিত্যকে কণ্ঠরোধ, কবিতার সত্যে চাবুক চালাবে ‘নতমুখ চরাচর’এর মতো আখ্যান ততই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, চিরকালের সত্যে পর্যবসিত হবে।
আখ্যানে পুলিশ বনাম কবির লড়াই বড় চমৎকারভাবে রূপায়িত হয়েছে। বিষয়ই স্বতন্ত্র করে তুলেছে আখ্যানকে। যা নকশাল পর্বের ইতিহাস, সেই সত্য ভিন্ন বয়ানে উপন্যাস সত্যে আলোড়িত হয়েছে। নির্মাণ-বিনির্মাণ প্রক্রিয়া এভাবেই আখ্যানকে আধুনিক করে তোলে। এই চরাচর কবিতাময়। নিসর্গভূমি যেন কবিতার সূতিকাগার। খুঁজে নিতে পারলেই কবিতার জন্ম হবে। চাই ভাষা বয়নের দক্ষতা। কবিতার স্বপ্ন, পত্রিকার স্বপ্ন মানুষকে কীভাবে বাঁচিয়ে রাখে, জীবনের তৃষ্ণা-বিতৃষ্ণা, লজ্জা-ঘৃণা, ব্যর্থতা সব ভুলিয়ে কীভাবে নতুন প্রেরণা দেয় বাঁচার, আখ্যান সেই সত্যে উপনীত করে পাঠককে।
আখ্যানভূমিতে মায়াবাস্তব, পরাবস্তব, অলীক বাস্তব, ফ্যান্টাসি, রোমান্টিসিজম মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। গত শতকের বইছাপা, ছাপাখানা-পত্রিকা সহ বয়ানে লুকিয়ে থাকে বইপাড়ার অচেনা পরিসর। এ এক কবির আত্মকথা, কবিতার আত্মকথা। মহাজাগতিক জীবনময় কবির বেঁচে থাকার জীবনদর্শন। কিছু না পেয়েও, সব ত্যাগ করেও পাগলামিকে নির্ভর করে যে বাঁচা যায়, কিছু মানুষকে ভাবিয়ে তোলা যায় এ আখ্যান সেই চেতনাবলয়ের মণিমুক্তা। ছাপাখানা নির্ভর বিগত সময়ের পত্রিকার হাদিসনামা, সাহিত্য-পত্রিকা-কবিতা সবটাই উদ্দীপনা, সেই জীবনবোধে লেখক পৌঁছতে চেয়েছেন বারবার। প্রাণভ্রমরা ভর না করলে সাহিত্য অসম্ভব। সেই প্রাণভ্রমরাই গৌতমবুদ্ধকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
নকশাল আন্দোলন পর্বে তিমিরকান্তি ঘোষ, দ্রোণাচার্য ঘোষদের মৃত্যু ঘটেছিল। সেই আভাস আখ্যানে রেখে লেখক কবিতার তত্ত্ব, জীবনবোধ, রাষ্ট্রীয় বেড়াজালে বন্দি কবিতার শত্রু, কবির আত্মগত জগৎ, কবিতার সত্য, চরাচর জুড়ে কাব্যভুবনের অলংকার, কবির মায়াভূমি-ভাবভূমি, কবির বিবিধ সত্যে যাত্রা নিয়ে এ এক কাব্যের জলাভূমি। কাব্যের মণিমুক্তা যেমন কাব্যপাঠে উঠে আসে তেমনি কবির আত্মদর্শনের ভিন্ন বয়ান এই আখ্যান। অমর মিত্রের লেখার বড় বৈশিষ্ট্য মায়াবী ভাষায় আখ্যানভুবনে ঘোর তৈরি করা। একই বৃত্তে অজস্র কথাজালে ঘুরতে ঘুরতে কথাচক্র সৃষ্টি করা। একই কথার নানা বৃন্তলগ্ন পুনরাবৃত্তি করে মূলসত্যকে ভিন্নপথে প্রতিষ্ঠা করা। ব্যতিক্রম নয় এ আখ্যানও। তিনি অসম্ভব গল্প বানাতে জানেন। বাস্তবের ভিতর অবাস্তব, কাহিনির ভিতর উপকাহিনি, চরাচরের নগ্ন সত্যের মধ্যেও পাগলামি ঢুকিয়ে এক আশ্চার্য জগৎ গড়ে তোলেন। যা আপাত অর্থে বাস্তব আবার বাস্তবের ঊর্ধ্বে। আসলে জগতে কত প্রকার সত্য, জীবনবোধ রয়েছে যা আমাদের জানা সম্ভব নয় তাই তিনি নির্মাণ করেন। কবিতার ভিতর কবিতা, পত্রিকার ভিতর পত্রিকা এনে সাহিত্যের ভুবনময় সংগীত বাজিয়ে যান।
আখ্যানভুবনে ফেলে আসা সময়ের ছাপাখানার ভূতগুলি বারবার বেজে উঠেছে। স্মল পাইকা, পাইকা বোল্ড, স্মল পাইকা বোল্ড। নতুন সময়ের মানুষের কাছে এ এক অচেনা পরিসর। এইভাবে সামাজিক ইতিহাস লিখিত হয়। কবি গৌতমবুদ্ধ চরাচরকে নিজের মতো করে উপলব্ধি করতে চান। কবির জগৎ থেকে বাস্তব জগতের অমিল অনেক। অর্থকারী মানুষ, ভোগী আত্মস্বার্থ মানুষ কবির চেতনা বোঝে না, একজন কবিকে পাগল বলে চিহ্নিত করে, কবি সভ্যতার কাছে বিদ্রূপ পেয়ে নিঃসঙ্গ হয়। সভ্যতার চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে যেতে চায়। নকশাল আন্দোলনের ডাক দিলেও বিপ্লব হয়নি। সমাজ পরিবর্তন হয়নি। ক্রমে সরকার সব নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষের কোনো মূল্য থাকেনি। ক্ষমতাবাণ আবার সব দখল করে নিয়েছে। গিরিধারী অধিকারীরা বিপ্লবের ডাক দিয়ে ব্যর্থ হয়ে ভালুকচরায় চলে গিয়েছিল।
এ আখ্যান যেন কবিতার শত্রু-মিত্র। সাতের দশকে রাষ্ট্র কবি-কবিতার ধ্বংসসাধনে মেতেছে, অন্যদিকে কিছু মানুষ কবিতা, লিটল ম্যাগাজিন বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছে। এই দুই সত্য, দোলাচলের মধ্য দিয়ে কবি-কবিতার যাত্রাপথের সন্ধ্যাকালীন রোমান্টিক নীরব ভাষ্য আখ্যানে উঁকি দিয়েছে। রাষ্ট্র নিজস্ব মানচিত্র থেকে কবিতাকে মুছে ফেলতে চেয়েছে কেননা কবিরাই সভ্যতার বড় শত্রু, সভ্যতার ক্ষয়ক্ষতি কবিরাই চিহ্নিত করতে সক্ষম। অন্যদিকে স্রোতের বিপরীতে, ঘর ছেড়ে, সংসার ছেড়ে আত্মগোপন করে কবিতাকে বাঁচিয়ে রাখার জেহাদ পদাবলি এ আখ্যান। কখন গড়ে উঠবে কবিতা? কখন আসবে কবিতা লেখার প্রকৃত সময়? দেখে নেওয়া যাক আখ্যানভুবন—
“মানুষ সব মেরে খেয়েছে। না হলে মেরে আনন্দ পেয়েছে। ধরে ডানা ছেঁটে দিয়েছে যাতে উড়তে না পারে। খাঁচায় ভরেছে। একদিন পাখিরা খাঁচা বানিয়ে মানুষকে পুরে দেবে তার ভিতর। খাঁচার সামনে এসে বাঘ সিংহরা ভয় দেখাবে। সব কামান, বন্দুক তারা মুখে করে নিয়ে গিয়ে গাঙে ভাসিয়ে দেবে। হলদি নদী দিয়ে ভেসে যাবে খড়কুটোর মতো যত বন্দুক, পিস্তল, বোমা আর সাঁজোয়া গাড়ি। এসব তাঁর কথা নয়। মহাকবি কালিদাসের কথা। তখনই আসবে কবিতার মুহূর্ত।”১
এই ভুলভুলাইয়া ভুবনজোতে কত ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন, ভগ্ন, সত্য-অর্ধসত্য, বিকৃত সত্যের কবিতা পড়ে রয়েছে। পরশপাথরের পাগলের মতো খুঁজলেই কবিতা পাওয়া সম্ভব। এ পৃথিবী কবিতাময়। নিসর্গ কবিতাকেন্দ্রিক। জীবনজগৎ কবিতার মাতৃভূমি। চরাচরে আঘাত না করে, কিছু নষ্ট না করে চোখ খুলে দেখলেই কবিতার বিন্দু বিসর্গের খোঁজ মিলবে। চরাচরের প্রান্তে যে কৃষিকেন্দ্রিক সভ্যতা আমরা ফেলে এসেছি, ইট কাঠের বিপরীতে যে চাষবাসকেন্দ্রিক গ্রামীণ জীবনের সতেজ উষ্ণতা যা আসলে সভ্যতার প্রাণ সেই জীবনবীক্ষণই এই উপন্যাসের প্রাণভূমি। আখ্যান শেষপর্যন্ত মানবিক বোধের আখ্যান হয়ে উঠেছে। কবিতা মানুষকে শুভবোধে নিয়ে যায়। মানুষের ভুলত্রুটি, সভ্যতা-রাষ্ট্রের শোষণ-লাঞ্ছনা ক্ষয়ক্ষতি চিহ্নিত করে মানুষকে এক শুভ বোধের চেতনায় ফিরিয়ে আনে। এই আখ্যানও সেই ভূমিকা পালন করে চলে।
সভ্যদেশ, নগর, রাষ্ট্র, পুলিশতন্ত্র থেকে শেষ পর্যন্ত কবির নির্বাসন ঘটে। অমর মিত্রের আখ্যানে নির্বাসন বারবার সত্য হয়ে ওঠে। অচেনা অজানার উদ্দেশে পাড়ির মধ্য দিয়ে আখ্যান অনন্ত ব্যাপ্তি লাভ করে। লেখক আখ্যানকে ভূখণ্ডে না বেঁধে মেঘের মতো চরাচরা ভাসিয়ে নিয়ে যান। ভাসমান অক্ষিগোলায় যে কাব্যসত্যের বেলাভূমি মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে অথবা মানুষই হয়ে ওঠে কাব্যদ্বীপের নিয়ন্ত্রা সেই রহস্যময় আলো-আঁধারের রোমন্থন আখ্যানকে অলীক বাস্তবতার ঊর্ধ্বে অন্য রাজ্যে অন্যরাজ্যে নিয়ে যায়।
তথ্যসূত্র :
১. নতমুখ চরাচর, অমর মিত্র, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা-৭৩, প্রথম প্রকাশ, এপ্রিল ২০২২, পৃ.-১০১।
** স্মৃতিহীন বাঙালির স্মৃতি ফিরিয়ে আনতেই বুদ্ধদেব বসুর গ্রন্থ নামেই প্রবন্ধের শিরোনাম করেছি, মাননীয় পাঠক আপনার অসুবিধা হলে শিরোনাম হিসেবে ‘কবিতার সাইলেন্ট জোন’ মনে মনে বসিয়ে নিতে পারেন।
লেখক : অধ্যাপক, রায়গঞ্জ সুরেন্দ্রনাথ মহাবিদ্যালয়।