সেবার আকাল পড়ল রেগিস্তানে। ধূ ধূ বালির ঝড়ে ঘূর্ণিপাক খায় মানুষের হাহাকার। ঘরে ঘরে নেই একদানা আনাজ। সারিসারি রাখা পানিমটকার জল তলানিতে। ভোপাদের রাবণহত্তার একটানা মিঠে সুর লুকিয়ে পড়েছে আগুন ঝরা আকাশের চোখরাঙানিতে। কবে থেকে তাদের রঙচঙে ছবি আঁকা কাপড়ের ফাদ খোলাই হয়নি। গুটিয়ে রাখা রয়েছে ঘরের এককোণে। তার ওপর ধূলোর আস্তরণ। কতদিন গাঁও গাঁও ঘুরে ঘুরে রাজপুতদের শৌর্যবীর্যগাথা, ঢোলামারুর মধুর প্রেমকাহিনী গাওয়া হয় নি। সব গল্পই এখন তেঁতো হয়ে গেছে ভুখা পেটের জ্বলুনিতে। এখন কে’ই বা গান শুনবে, কেই বা দুটো পয়সা দেবে!
ভোপা কিষেণরাম শমী গাছের তলায় তার দুর্দশার কথা বসে বসে ভাবছিল। ভাবছিল আর শমী গাছের কাছে প্রার্থনা করছিল। ছেলেপুলে নিয়ে বেঁচে থাকার প্রার্থনা।
কিষেণরামের বাপু বলেছিল, “শুনো বেটা এ বড়াহি আনমোল পেড় হ্যায়। স্বয়ং রামজী সীতা উদ্ধারের সময় এই গাছকে পূজো করেছিল। এই পবিত্র গাছের কাছে রাবণ বিজয়ের প্রার্থনা করেছিল। মহাভারতে পান্ডবভায়েরা মৎস্যপ্রদেশে বিরাটরাজার রাজসভায় অজ্ঞাতবাসে গেল। তার আগে তাদের হাতিয়ার লুকিয়ে রেখেছিল আমাদের এই শমী বা খেজরী গাছের মগডালে। এরপর কৌরবরা বিরাট রাজার রাজ্য আক্রমণ করল। অর্জুন শমীবৃক্ষকে প্রণাম জানিয়ে সব হাতিয়ার আবার উদ্ধার করল। শমী বৃক্ষ সযত্নে তাদের অস্ত্রশস্ত্র একবছর ধরে লুকিয়ে রেখেছিল।
তুম জান লো বেটা শমীকা পাত্তে চড়ানেসে মহাদেব প্রসন্ন হোতে হ্যায়। গণেশজীর চরণে এই পাতা দিয়ে পুজো করলে সৌভাগ্য সুনিশ্চিত।এমনকি শনি মহারাজের ক্রোধ প্রশমিত হয় শমীর পাতায়। আমাদের ভের-বকরী-উটেদের সারাবছর বাঁচিয়ে রাখে এই কাঁটেদার খেজরী পের। ইসকো অ্যয়সে ব্যয়সে মত সমঝ না! হামেশা ইসকা মান রাখ না”। এতদিন পর বাপুর সব কথা আবার মনে পড়ে গেল কিষণরামের। খেজরী পের কি আমাদের দুর্দশা দ্যাখে না! যে গাছ কোন রামায়ণ মহাভারতের সময় থেকে পবিত্র হয়ে উঠেছে, সে কি আমার বিনতি শুনবেনা! বিড়বিড় করে কপালে হাত ঠেকাল কিষেণরাম।
মরুর দেশে বেশ খানিক’টা দূরে দূরে সবুজ প্রাণের টিমটিমে আলোর মত জেগে থাকে রাজস্থানের এ কল্পবৃক্ষ শমী বা খেজরী গাছ। খেজরীর সাথী ক্যের গাছ ও তাই। ঝাঁকে ঝাঁকে সবুজ তোতারা ক্যের ফল খেয়ে, মাটিতে ছড়িয়ে আবার দলবেঁধে উড়ে চলে যায়। আঁধি, তুফান, গর্মি, ঠান্ডী কোনোকিছুই এই দুই গাছকে টলাতে পারে না। না এদের যত্ন করতে হয়, না প্রয়োজন হয় জলসিঞ্চনের। তারা অজেয়! কি অদ্ভুত এ ভগবানের লীলা!
কিষেণরাম আবার চিন্তামগ্ন হয়, আচ্ছা খেজরীর সাংরী ফল মবেশীয়রা খেয়ে দিব্যি বছরের পর বছর বেঁচে আছে। তাদের তো কিছু হয় না। তব আদমী তো খা শকতে হ্যায় না! হজম করতে পারব তো! বালবাচ্চের ক্ষুধার্ত, খিন্নমুখ দেখতে যে আর তার ইচ্ছে করে না। গাছের তলায় পড়ে থাকা শিমের মত খেজরীগাছের কিছু শুকনো ফল কুড়িয়ে নিল কিষেণরাম। ঝোপড়িতে এসে বিবিকে বলল, “আর তো কিছু পেলাম না পুনিয়া কি মাঈ। আজ শুখা সাংরীকো হি সব্জি য্যায়সে বনা। দেখা যাক খেতে পারি কি না! মরে যাবার আগে শেষ চেষ্টা করে দেখি”।
জানকী কি ভেবে সাংরীকে জলে ভিজিয়ে রাখল বেশ কয়েকঘন্টা। তারপর চুলা ধরিয়ে খেজরীর ফল সাংরীকে সামান্য নুন জলে সেদ্ধ করে নিল। বাচ্ছারা ক্যেরফল কুড়িয়ে এনেছিল। তাই দিয়ে মার্বেল খেলছিল। ঘরে আছে না কয়েকটা! সাংরীর সঙ্গে গরম জলে সেদ্ধ হতে দিল দু-চারটে সবুজ ক্যের। ঘরে রাখা ছিল সামান্য নুন, হলুদ, শুখা মশালা, ঘিউ। তাই দিয়ে বানানো হল ক্যেরসাংরী সব্জি। ক্যেরের টকভাব সাংরীদানার সঙ্গে মিশে অদ্ভুত এক স্বাদু ব্যঞ্জন হয়ে উঠল জানকীর হাতের গুণে। ছেলেবুড়ো সবাই চেটেপুটে খেল। জঠরাগ্নি নিবৃত্ত হল তাদের।
পশুপাখিদের খাবারে ভাগ বসিয়ে ধীরে ধীরে রাজস্থানের সিগনেচার ডিশ হয়ে উঠল ক্যের সাংরী। আকাল চিনিয়ে দিল জীবনকে বাঁচিয়ে তোলার সঞ্জীবনী বুটি।
আমার একসময়ের পড়োশিনী বাড়মেড়ের মেয়ে প্রেমলতার সঙ্গে আমার খাবারের বাটি আদানপ্রদান হত। পালা পার্বণে আমাদের ডাক পড়ত তাদের বাড়িতে। গাট্টে কা সবজি, মুগ ডালের হালুয়ার সঙ্গে তার বাড়িতেই আমার প্রথম খাওয়া ক্যেরসাংরী। আমাকে প্রেম বলেছিল, “এ আমাদের খাঁটি দেশজ পদ। একদিন বানিয়ে তিনদিন আরামসে খাওয়া যায়। বিনা ফ্রীজেও কিচ্ছু খারাপ হয় না।” প্রথমে অদ্ভুত লাগলেও খেতে খেতে এর স্বাদ ভালো লাগতে শুরু করে। করোনার প্রবল গ্রাস প্রেমলতাকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। তবে তার হাসি মুখ, তার হাতের রান্নাকে ভুলতে পারিনি।
এবার রাজস্থানের শেখাওয়াটিতে গিয়ে দেখি নতুন ডালপালা মেলে উদ্ভাসিত ক্যের গাছ। যেন নববসন্তের আনন্দে নৃত্যরত। প্রতিবছর এ গাছের ডালপালা ছেঁটে দেওয়া হয়। আবার নতুন পাতায়, ফলেফুলের গয়নায় সেজে ওঠে ক্যেরগাছ। আকাল কে জয় করে ক্যের গাছ বলে, “তুমি যদি সাত বার দহন করো চারপাশ আমিও সাত সাতবার ফলেফুলে ভ’রে উঠব।”
ক্যের খেজরী পদের যতটাই পৌষ্টিক গুণ, ততটাই রাজস্থানে সে জনপ্রিয়। তাদের বিয়ের উৎসবে, পার্টিতে, পাঁচতারা হোটেলের মেনুতে এ পদ থাকবেই। ভারতের বিখ্যাত শেফেরাও সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্যেরসাংরীর রন্ধন প্রণালী শিখিয়েছেন। শুকনো বুনো গাছের এই ফল সম্প্রতি জি আই ট্যাগ পেয়েছে। দই আর মেওয়া দিয়ে রেঁধে ক্যের সাঙ্গরীর পদ আরো অভিনব করে তোলা হচ্ছে ।
সোনার কেল্লা দেখতে গিয়ে এবার ডালবাটি চূর্মার সঙ্গে এই সবজিটি ও চেখে দেখুন। ভালো লাগবে। ক্যের আপনারা নিশ্চয়ই খেয়েছেন। মিক্সড আচারের ছোটো ছোটো সবুজ ফলগুলিই ক্যের। রাজস্থানের শুকনো আবহাওয়ায় ক্যের কা আচার নিত্য গ্রহণীয়।
কাঁটাভরা খেজরী বা সাংরী ফলের গাছে নিশ্চিন্তে সংসার পাতে চড়ুই পাখি। ক্যের গাছের ডালে নিপুণ ভাবে বাসা বোনে বাবুই পাখি। আমি রাজস্থানের সেই চেনা ছবি আবার মানসচক্ষে ফিরে দেখি। সোনালী বালিতে পদচিহ্ন রেখে একসারি উট চলেছে মুখটি তুলে। তাদের দেহে গোরবন্ধ সাজ। গলার ঘন্টা বাজছে ঢং ঢং ঢং ঢং। তাদের পিঠে মাথায় মস্ত লাল পাগড়ি, সাদা ধুতি আর আঙরাখা পরা যাযাবর রাইকারা। মাঝে মাঝে তারা বিশ্রাম নিচ্ছে খেজরী গাছের নিচে। সঙ্গের পুঁটলি খুলে খাচ্ছে বিবিজানের বানানো বাজরার মোটা মোটা রুটি। ক্যেরসাংরীর আচার। তাদের বাহন চোখ বুজে, পরম আলস্যে চিবিয়ে যাচ্ছে সাংরী ফল, খেজরীর কাঁটাভরা ডালপালা।
খুব সুন্দর লাগল,চলে গেলাম মরুরাজ্যে
ভালোবাসা মল্লিকা। শুভরাত্রি।
বাহ্ বেশ ভাল লাগল
থ্যাঙ্কু দিদি ♥️
আহা বড় সুন্দর!
খুশি 😊❤️