বঙ্গবিভূষণ কাশীকান্ত মৈত্রের জন্মশতবর্ষ পূর্তি উৎসবকে কেন্দ্র করে কৃষ্ণনগরে স্থাপিত হলো কাশীকান্ত মৈত্রের একটি আবক্ষমূর্তি এবং প্রকাশিত হলো ‘বঙ্গবিভূষণ কাশীকান্ত মৈত্র স্মারকগ্রন্থ’। কাশীকান্ত মৈত্র জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটির পক্ষ থেকে এই গ্রন্থটি প্রকাশ করা হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (রবিবার) সন্ধ্যায় কৃষ্ণনগর পৌরসভার দ্বিজেন্দ্রমঞ্চে মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের হাত দিয়ে গ্রন্থটির আবরণ উন্মোচিত হয়। সেই সময় মঞ্চে একাধিক বিশিষ্টজন উপস্থিত ছিলেন। মৈত্র পরিবারের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন কাশীকান্ত মৈত্রের মেয়ে শমিতা রায়, জামাতা সুদীপ রায় ও পুত্রবধূ ড. চৈতালী মৈত্র। উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস, কৃষ্ণনগর পৌরসভার চেয়ারপার্সন রীতা দাস, কিরণময় নন্দ, বিধায়ক কল্লোল খাঁ, বিমলেন্দু সিংহ রায়, রুকবানুর রহমান-সহ একাধিক রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এবং কাশীকান্ত মৈত্র জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটির সভাপতি শংকরেশ্বর দত্ত, কার্যকরী সভাপতি শিবনাথ চৌধুরী, সম্পাদক সত্যেন ব্যানার্জি এবং স্মারকগ্রন্থের সম্পাদক ড. দীপাঞ্জন দে। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন সংগীতশিল্পী শুভময় সরকার।
বঙ্গবিভূষণ কাশীকান্ত মৈত্র (১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৫—২৯ আগস্ট, ২০২০) ছিলেন মানবদরদি, বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী প্রকৃত জননেতা। রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী, ছ’বারের বিধায়ক, কলকাতা হাইকোর্টের বর্ষীয়ান আইনজীবী কাশীকান্ত মৈত্রকে ২০১৩ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ‘বঙ্গবিভূষণ’ সম্মানে ভূষিত করা হয়। ২০২০ সালের ২৯ আগস্ট ছিয়ানব্বই বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি প্রয়াত হন। ২০২৪ সালে কাশীকান্ত মৈত্রের জন্মশতবর্ষ উদযাপনের লক্ষ্যে কৃষ্ণনগরে পণ্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র স্মৃতি সমাজ কল্যাণ কেন্দ্রের উদ্যোগে ‘কাশীকান্ত মৈত্র জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটি’ গড়ে ওঠে। তাদের উদ্যোগে বছরব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠান, কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে কাশীকান্ত মৈত্রকে শ্রদ্ধা-স্মরণ করা হয়। ২০২৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণিতে পণ্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র স্মৃতি সমাজ কল্যাণ কেন্দ্রের ভবনে কাশীকান্ত মৈত্রের শততম জন্মদিবস পালনের মধ্যে দিয়ে তাঁর জন্মশতবর্ষ উদযাপনের সূচনা হয়। ‘কাশীকান্ত মৈত্র জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটি’-র পক্ষ থেকে তাঁর জন্মশতবর্ষকে কেন্দ্র করে একটি স্মারকগ্রন্থ নির্মাণের পরিকল্পনার সূচনাও সেই সময় থেকে। সেই ভাবনা থেকেই তৈরি হয় স্মরণিকা উপসমিতি। যেটি ছিল এইরূপ— দেবাশিষ মণ্ডল, সম্পদনারায়ণ ধর, রামকৃষ্ণ দে, অলোক সান্যাল এবং ড. দীপাঞ্জন দে (আহ্বায়ক)। লেখা ও তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হয়, ক্রমান্বয়ে গ্রন্থের কলেবর বৃদ্ধি পায়। গ্রন্থটির নাম দেওয়া হয় ‘বঙ্গবিভূষণ কাশীকান্ত মৈত্র স্মারকগ্রন্থ’ (ISBN: 978-93-92251-64-1)। প্রায় চারশো পৃষ্ঠার (তেইশ ফর্মা) এই স্মারকগ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন ড. দীপাঞ্জন দে। গ্রন্থটি সংকলনে সহায়তা করেছেন শিবনাথ চৌধুরী ও সত্যেন ব্যানার্জি। গ্রন্থের অলঙ্করণ ও মুদ্রণে গেটওয়ে গ্রাফিক্স (হাবড়া, উত্তর ২৪ পরগনা)। নামাঙ্কন করেছেন সৌরভ ধর জয় (বাংলাদেশ), গ্রন্থসজ্জা ও প্রচ্ছদ করেছেন ড. দীপাঞ্জন দে। ‘কাশীকান্ত মৈত্র জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটি’-র পক্ষ থেকে সম্পাদক সত্যেন ব্যানার্জি কর্তৃক কৃষ্ণনগর, নদিয়া থেকে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশকাল ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রি.। মুদ্রিত মূল্য চারশো টাকা।
স্মারকগ্রন্থটির বিন্যাস এইরূপ— মুখবন্ধ লিখেছেন শংকরেশ্বর দত্ত, শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার মাননীয় স্পিকার বিমান ব্যানার্জি, ভূমিকা লিখেছেন শিবনাথ চৌধুরী, প্রকাশকের কথা লিখেছেন সত্যেন ব্যানার্জি, প্রাক্-কথন লিখেছেন সম্পাদক ড. দীপাঞ্জন দে। এরপর ‘স্মরণে-মননে কাশীকান্ত মৈত্র’ শীর্ষক পর্বে রয়েছে— কাশীকান্ত মৈত্র— সংক্ষিপ্ত জীবনী: শিবনাথ চৌধুরী, জ্ঞান-প্রদীপের সান্নিধ্যে: ড. চৈতালী মৈত্র, আমার চোখে ‘বাবা’: শমিতা রায়, কাশীকান্ত মৈত্র— শততম জন্মদিনে স্মরণ: রামকৃষ্ণ দে, জননেতা কাশীকান্ত মৈত্রের শতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি: অসিতকুমার সাহা, প্রাণের চেয়েও প্রিয়: ড. বাসুদেব সাহা, আজকের প্রবীণ, সেদিনের হিরো কাশীদা: চন্দন সান্যাল, চরণ ধরিতে দিও গো আমারে: পার্থপ্রতিম কুণ্ডু, বন্যা প্রতিরোধে নগেন্দ্রনগরে বাঁধ নির্মাণ: শংকরেশ্বর দত্ত, স্মরণে কাশীদা: রেবতীমোহন রায়, তোমার নির্মম পদপ্রান্তে রেখে যাই আমার প্রণতি: হিমাংশু হালদার, অনেক কিছু শিখেছি: প্রবোধচন্দ্র সিনহা, ও তো কাশীকান্ত আমাদের লক্ষ্মীদার ছেলে: শ্রীকান্ত মৈত্র, খাদ্য আন্দোলন, কাকাবাবু ও আমি: জয়ন্ত পাল, হৃদয় মাঝারে রাখি তাঁহারে: প্রবীর পাল, কাশীকান্ত মৈত্র— যেমন দেখেছি: সম্পদনারায়ণ ধর, শত বরষে তোমারে প্রণাম: প্রতুলচন্দ্র দত্ত, পুরানো সেই দিনের কথা: সত্যেন ব্যানার্জি, আমার দেখা কাশীকান্ত মৈত্র: সত্যরঞ্জন চৌধুরী এবং জন্মশতবর্ষে শ্রীমৈত্র ফিরে দেখা: রাজেন্দ্রপ্রসাদ বিশ্বাস। এরপর ‘কবিতা’ পর্বে কাশীকান্ত মৈত্রকে স্মরণ করে লেখা দুটি কবিতা রয়েছে— একটি নক্ষত্র: রাধেশ্যাম পাল এবং শতবর্ষে কাশীকান্ত স্মরণ: রবীন্দ্রকুমার হালদার। তারপর রয়েছে ‘প্রয়াণ-লেখ’ পর্বটি, যেখানে কাশীকান্ত মৈত্রের প্রয়াণের পর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদগুলি সংগ্রহ করে একজায়গায় সন্নিবদ্ধ করার প্রচেষ্টা হয়েছে।
‘বঙ্গবিভূষণ কাশীকান্ত মৈত্র স্মারকগ্রন্থ’-এর পরিশিষ্ট অংশটির কথা বিশেষকরে বলতে হয়। সংখ্যায়নের ভিত্তিতে এই অংশটি সাজানো হয়েছে, যেখানে ২৮টি পর্ব রয়েছে। পরিশিষ্ট ১: বিধানসভায় কাশীকান্ত মৈত্রের ভাষণ, পরিশিষ্ট ২: ‘ন্যায়শাস্ত্রী’ ছদ্মনামে ভূমিকা, পরিশিষ্ট ৩: কাশীকান্ত মৈত্র জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটি, পরিশিষ্ট ৪: কাশীকান্ত মৈত্র জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে মুদ্রিত প্রচারপত্র, পরিশিষ্ট ৫: রাজ্য ট্রেড ইউনিয়ন সম্মেলন: এক ফর্মার পুস্তিকা, পরিশিষ্ট ৬: বঙ্গবিভূষণ ও বঙ্গভূষণ সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র, পরিশিষ্ট ৭: কাশীকান্ত মৈত্রকে লেখা প্রখ্যাত মৃৎশিল্পী কার্তিকচন্দ্র পালের পত্র, পরিশিষ্ট ৮: শ্রীমতী হিরণবালা দেবীকে লেখা পণ্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মৈত্রের পত্র, পরিশিষ্ট ৯: লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ডে সম্মানিত করার পত্র, পরিশিষ্ট ১০: States Merger Scheme: Magic or Logic?, পরিশিষ্ট ১১: বর্ধমানে নিহতদের সমাজবিরোধী বলায় কাশীকান্ত মৈত্রের ক্ষোভ, পরিশিষ্ট ১২: বিধানসভা ভবনে কাশীকান্ত মৈত্রের তৈলচিত্র স্থাপনের অনুরোধ-পত্র, পরিশিষ্ট ১৩: শততম জন্মদিবস পালনের প্রচারপত্র, পরিশিষ্ট ১৪: প.ল.মৈ. স্মৃতি সমাজ কল্যাণ কেন্দ্রের বর্তমান পরিচালন সমিতি, পরিশিষ্ট ১৫: ‘গণতন্ত্র মুখোশ ও মুখশ্রী’ গ্রন্থের ভূমিকা, পরিশিষ্ট ১৬: ‘মার্কসবাদ ও লেনিনবাদ তত্ত্বে ও প্রয়োগে’ গ্রন্থের ভূমিকা, পরিশিষ্ট ১৭: ‘রাজনীতি বিপ্লব কূটনীতি’ গ্রন্থের ভূমিকা, পরিশিষ্ট ১৮: জন্মশতবর্ষে নিজভূমে ব্রাত্য কাশীকান্ত, পরিশিষ্ট ১৯: কাশীকান্ত মৈত্র রচিত পুস্তিকা ‘বাংলার লুপ্ত অঞ্চল’, পরিশিষ্ট ২০: কাশীকান্ত মৈত্র জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটির লেটারহেড, পরিশিষ্ট ২১: শান্তিপুর কলেজ কর্তৃপক্ষের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, পরিশিষ্ট ২২: শান্তিপুর পৌরসভার সম্বর্ধনা জ্ঞাপন, পরিশিষ্ট ২৩: কলকাতার টাউন হলে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন, পরিশিষ্ট ২৪: সুন্দরবন বিষয়ক দপ্তর ও সুন্দরবন উন্নয়ন পর্যদের শ্রদ্ধার্ঘ্য, পরিশিষ্ট ২৫: কলকাতার টাউন হলে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন, পরিশিষ্ট ২৬: কাশীকান্ত মৈত্র জন্মশতবর্ষে আঞ্চলিক পত্রিকায়, পরিশিষ্ট ২৭: কাশীকান্ত মৈত্রের জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠান ও আমন্ত্রণপত্র এবং পরিশিষ্ট ২৮: জীবনপঞ্জি। পরিশিষ্ট অংশটির পরে রয়েছে লেখক পরিচিতি, যেখানে পঁচিশজন লেখকের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হয়েছে। আর সবশেষে রয়েছে চিত্রাবলি, যেখানে কাশীকান্ত মৈত্রের কর্মজীবন ও মৈত্র পরিবার সম্পর্কিত প্রাসঙ্গিক ৩১টি গুরুত্বপূর্ণ চিত্র মুদ্রিত করা সম্ভব হয়েছে। এছাড়াও গ্রন্থের দ্বিতীয় প্রচ্ছদের ইনার-ব্ল্যার্ব এবং তৃতীয় ও চতুর্থ প্রচ্ছদের ব্লার্বে কয়েকটি প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপিত করার প্রচেষ্টা করা হয়েছে।
কাশীকান্ত মৈত্র জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটি এবং পণ্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র স্মৃতি সমাজ কল্যাণ কেন্দ্রের উদ্যোগে স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের দিন বিকেলে কৃষ্ণনগরের নেদিয়ারপাড়া মোড়ে কাশীকান্ত মৈত্রের একটি আবক্ষমূর্তিও স্থাপিত হয়। মূর্তিটি উন্মোচন করেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। সার্বিক দিক থেকে বলতে হয় যে, আবক্ষমূর্তি স্থাপন, শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রতিযোগিতা, সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ প্রভৃতির মধ্যে দিয়ে কৃষ্ণনগরে বঙ্গবিভূষণ কাশীকান্ত মৈত্রের জন্মশতবর্ষ বিশেষভাবে পালিত হলো। বঙ্গবিভূষণ কাশীকান্ত মৈত্র সম্পর্কে জানতে আগামী প্রজন্মের গবেষকদের কাছে নিশ্চয় আকর হিসেবে বিবেচিত হবে এই স্মারকগ্রন্থটি। কাশীকান্ত মৈত্রের পিতা, ভারতের সংবিধান প্রণেতাদের মধ্যে অন্যতম পণ্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র-সহ সমগ্র মৈত্র পরিবার সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি এই গ্রন্থের দুই মলাটের ভিতরে সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে। কাশীকান্ত মৈত্রের জন্মশতবর্ষে তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা-স্মরণকে আশা করি স্থায়িত্ব দেবে এই নির্মাণ।
লেখক : সম্পাদক, ‘বঙ্গবিভূষণ কাশীকান্ত মৈত্র স্মারকগ্রন্থ’।