ভেরা ইভানোভনা জাসুলিচ (Vera Ivanovna Zasulich) (১৮৪৯-১৯১৯)
জাসুলিচ ছিলেন রাশিয়ার সমাজকর্মী, বিপ্লবী ও লেখক। সেন্টপিটাসবার্গে চাকরি করতে গিয়ে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। সেজন্য তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারপর তিনি কিয়েভে চলে যান। সেখানে মিখাইল বাকুনিনের নৈরাজ্যবাদী দলের সঙ্গে তাঁর সংযোগ ঘটে। সেন্টপিটাসবার্গের অত্যাচারী গভর্নর কর্নেল ট্রেপভকে হত্যা করতে গিয়ে তিনি ধরা পড়েন।
জাসুলিচ সুইজারল্যাণ্ডে আশ্রয় গ্রহন করেন। সেখানে তিনি মার্কসবাদে দীক্ষা গ্রহণ করেন। জর্জি প্লেখানভ ও পাভেল অ্যাক্সিরডের সঙ্গে গঠন করেন ‘এমানসিপেশন অব লেবার গ্রুপ’। এই সংগঠনের নির্দেশে জাসুলিচ কার্ল মার্কসের রচনা রাশিয়ান ভাষায় অনুবাদ করেন। রাশিয়ায় মার্কসবাদ প্রসারে ও ‘রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টি’ গঠনে এই অনুবাদকর্মের ভূমিকা ছিল।
হেলেন ম্যাকফারলেন (Helen Macfarlane) (১৮১৮ -১৮৬০)
চার্টিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন হেলেন ম্যাকফারলেন। ১৮৫০ সালে লণ্ডনে তাঁর সঙ্গে মার্কস-এঙ্গেলসের পরিচয় হয়। সমাজতান্ত্রিক মতবাদের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন। তিনি ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র ইংরেজি অনুবাদ করেন। সেই অনূদিত বই প্রকাশিত হয় জর্জ জুলিয়ান হার্নের ‘রেড পাবলিকেশন’ নামক প্রকাশনা সংস্থা থেকে। এই অনুবাদ সম্পর্কে মার্কস বলেন, ‘the only collaborator on his spouting rag who had original ideas’.
‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র প্রারম্ভিক যে পংক্তির সঙ্গে আমরা পরিচিত তা হল, ‘A spectre is haunting Europe, the spectre of Communism’.
কিন্তু হেলেন ম্যাকফারলেনের অনুবাদে সেটি ছিল এই রকম, — ‘A frightful hobgoblin stalks throughout Europe. We are haunted by a ghost, the ghost of Communism’. বলা বাহুল্য চার্টিস্ট আন্দোলনের প্রভাবেই এই ‘hobgoblin’ শব্দটি এসেছিল।
১৮৫১ সালে জর্জ জুলিয়ান হার্নের সঙ্গে বিচ্ছেদের ফলে হেলেন রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান।
লুডভিগ ফয়েরবাখ (Ludwig Feuerbach) (১৮০৪-১৮৭২)
ফয়েরবাখ ছিলেন এক জার্মান দার্শনিক। তিনি হেগেলের ভাববাদের সমালোচনা করেন এবং ধর্মের মানবতাবাদী ও বস্তুবাদী ব্যাখ্যা করেন। খ্রিস্টধর্মের বিরোধিতা ও স্বাধীন সংবেদনশীল ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন তিনি।
সাম্যবাদী দার্শনিক কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস এবং খ্রিস্টধর্মবিরোধী লেখক ডেভিড ফ্রেডারিখ স্ট্রাউসের উপর ফয়েরবাখের প্রভাব পড়েছিল। ফয়েরবাখ ব্যক্তি ও তার চাহিদার উপর যে জোর দেন, তাতে মার্কস ও এঙ্গেলস সমাজের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার দেখা পান, এভাবে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ভিত্তি গঠিত হয়। ফয়েরবাখ ধর্মের যে মনস্তাত্ত্বিক, সমাজতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা প্রদান করেন, তা মার্কস-এঙ্গেলেসের কাছে ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
কার্ল মার্কস ‘থিসিস অন ফয়েরবাখ’ শিরোনামে যে সব প্রবন্ধ রচনা করেন, সেগুলি ১৮৮৮ সালে ফ্রেডারিখ এঙ্গেলসের ‘লুডভিগ ফয়েরবাখ’ নামক গ্রন্থে প্রকাশিত হয়।
মিখাইল আলেক্সান্দোভিচ বাকুনিন (Mikhail Alexandrovich Bakunin) (১৮১৪-১৮৭৬)
সামরিক বিভাগে চাকরি করতে করতে তিনি পোলিশ বিদ্রোহীদের প্রতি রুশ সরকারের অমানবিক আচরণ দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে চাকরিতে ইস্তফা দেন। হেগেলের দর্শন পড়ার জন্য চলে আসেন জার্মানিতে। সেখানে চরমপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হন। জার্মাতি থেকে প্যারিসে আসেন। সেখানে মার্কস, এঙ্গেলস ও প্রুধোঁর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়।
কিন্তু ফরাসি সরকার তাঁকে বহিষ্কৃত করে তাঁর চরমপন্থী মতবাদ প্রচারের জন্য। তিনি জার্মানিতে আসেন। ১৮৪৯ সালে ড্রেসডেন বিদ্রোহে অংশগ্রহণের জন্য তাঁকে রুশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়, পরে তাঁকে সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত করা হয়। বাকুনিন সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে শেষে আশ্রয় গ্রহণ করেন সুইজারল্যাণ্ডে। সেখানে ১৮৬৯ সালে গঠন করেন ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স’; পরে সেই সংগঠনকে যুক্ত করে দেন মার্কসের ‘ইন্টারন্যাশনাল ওয়াকিংমেনস অ্যাসোসিয়েশন’-এর সঙ্গে।
চরমপন্থী মতবাদের জন্য মার্কসের সঙ্গে তাঁর মতান্তর হয়, তাই বিতাড়িত হতে হয় অ্যাসোসিয়েশন থেকে। বাকুনিন বিভিন্ন ভাষায় নানা পুস্তিকা ও প্রচারপত্র লিখে নৈরাজ্যবাদী তত্ত্বের প্রচার করেছিলেন। নৈরাজ্যবাদী তত্ত্বকে তার চূড়ান্ত লক্ষ্যে নিয়ে যাবার জন্য তিনি অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন বিপ্লবের উপর।
আউগুস্ট বেবেল (August Babel) (১৮৪০-১৯১৩)
দরিদ্র পরিবারের সন্তান বেবেল জীবিকার সন্ধানে দক্ষিণ জার্মানি ও অস্ট্রিয়া ঘুরে লাইপজিগে স্থায়িভাবে বসবাস করেন। এখানে তিনি ‘ওয়ার্কাস এডুকেশনাল অ্যাসোসিয়েশন’-এর সঙ্গে যুক্ত হন, পরে তার সভাপতি হন। এখানেই তাঁর রাজনৈতিক চেতনা বিকশিত হয়। তবে তখনও তিনি ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ বা তার রচয়িতা কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন না।
১৮৬৩ সালে উইলহেল্ম লাইবনেখট লাইপজিগে এলে তাঁর সঙ্গে বেবেলের পরিচয় হয়। বিসমার্কের বিরুদ্ধবাদী ছিলেন বেবেল। তিনি উত্তর জার্মান রাইখস্ট্যাগের সদস্য হন। পার্লামেন্টে তিনি বিসমার্কের ‘বৃহত্তর প্রুশিয়া’ নীতির তীব্র বিরোধিতা করেন। এসবের জন্য বেবেল ও লাইবনেখটকে ১৮৭২ সালে কারাগারে প্ররণ করা হয়। ১৮৮৩ সালে প্রকাশিত হয় বেবেলের বিখ্যাত বই ‘ওম্যান অ্যাণ্ড সোশ্যালিজম’।
গিওরগি ভালেন্তিনোভিচ প্লেখানভ (Georgi Valentinovich Plekhanov) (১৮৫৬-১৯১৮)
সামরিক অ্যাকাডেমি ত্যাগ করে সেন্ট পিটার্সবার্গে মেটালর্জি ইন্সটিটিউটে ভর্তি হন। সেখানে পাভেল অ্যাক্সেলরডের প্রভাবে রাজনীতিতে আসেন। ১৮৭৪ সালে তিনি পপুলিস্ট আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ল্যাণ্ড অ্যাণ্ড ফ্রিডম’ গ্রুপের নেতা হন। দুবার গ্রেপ্তার হন। জারের পুলিশ সংগঠন ‘ওখরানা’-র অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে রাশিয়া ত্যাগ করে সুইজারল্যাণ্ডে চলে যান। ‘নারদানা ভালিয়া’ নামক এক নতুন সংগঠন গড়ে তোলেন, যার উদ্দেশ্য ছিল সন্ত্রাসবাদের পথ অনুসরণ করে জারকে উচ্ছেদ করা।
১৮৮৩ সালে তিনি প্রথম রাশিয়ার মার্কসীয় বিপ্লবী সংগঠন’লিবারেশন অব লেবার’ প্রতিষ্ঠা করেন; এই সংগঠনই পরবর্তীকালে ‘রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক ওয়ার্কাস পার্টি’তে পরিণত হয়। তিনি যে দ্বি-পর্যায়ের বিপ্লবী পরিকল্পনা বর্ণনা করেছিলেন, তা রাশিয়ার মার্কসবাদী চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করেছিল। লেনিনও তাঁর অনুগামী ছিলেন। ১৯০৩ সালে পার্টি বিভক্ত হবার পর প্লেখানভ যোগ দান করেন মেনশেভিকদের সঙ্গে।
এডুয়ার্ড বার্নস্টাইন (Eduard Bernstein) (১৮৫০-১৯৩২)
১৮৭১ সালে বার্নস্টাইন ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি’তে যোগ দেন। বিসমার্কের সমাজতন্ত্র বিরোধী আইনের তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি। জার্মানি থেকে তাঁকে নির্বাসিত করা হয়। তিনি সুইজারল্যাণ্ডে আশ্রয় নিলেও সেখান থেকে বিতাড়িত হতে হয়। বার্নস্টাইন আসেন লণ্ডনে। এখানেই তাঁর সঙ্গে ফ্রেডারিখ এঙ্গেলসের পরিচয় ও বন্ধুত্ব। ১৯০১ সালে জার্মানিতে তিনি ফিরে আসেন এবং সংশোধনবাদী মতবাদের প্রবক্তা হয়ে ওঠেন। [সমাপ্ত]