আর্নেস্ট চার্লস জোন্স (Ernest Charles Jones) (১৮১৯-১৮৬৯)
তাঁর জন্ম বার্লিনে। বাবা ছিলেন সেনাবাহিনীতে। ব্রিটিশ আর্মি মেজর। আর্নেস্ট জোন্স পড়াশুনো করেছেন মিডল টেম্পেলে। ১৮৪৪ সালে ব্যারিস্টার হয়েছেন।
১৮৪৫ সালে যোগ দিলেন চার্টিস্ট আন্দোলনে। সেই আন্দোলনে জনপ্রিয় হলেন। উদ্দীপক বক্তৃতায় বললেন শাসকের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের কথা। তাই তাঁকে গ্রেপ্তার করে কারারুদ্ধ করা হল। অন্ধকার কারাগৃহ অবদমিত করতে পারল না তাঁকে। প্রার্থনা বইএর পাতায় নিজের রক্ত দিয়ে লিখলেন এক মহাকাব্যিক কবিতা। নাম যার —‘দ্য রিভোল্ট অব হিন্দুস্তান’।
কারাগার থেকে বেরিয়ে ‘দ্য নোটস টু দ্য পিপল’ পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করলেন। যোগ দিলেন ‘দ্য পিপলস পেপার’ পত্রিকায়। ন্যাশনাল চার্টার আন্দোলনে অংশ নিলেন।
কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। মার্কস তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, ‘the most talented, consistent and energetic representative of Chrtism’ . মার্কস ও এঙ্গেলস তাঁর পত্রিকায় লিখতেন। ঔপনিবেশিকতা সম্বন্ধে তাঁর চিন্তা-চেতনা মার্কসকে প্রভাবিত করেছিল। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরূপ সমালোচনা করেছেন তিনি। ভারতের স্বাধীনতার জন্য প্রেসিডেন্সির সিপাহিদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন তিনি।
তাঁর উপন্যাস ‘দ্য মেড অব ওয়ারশ’, ‘উয়োম্যানস রংগস’; কাব্য ‘দ্য পেইনটার অব ফ্লোরেন্স’,দ্য ব্যাটেল ডে’, দ্য সং অব দ্য পুয়োর’, ‘দ্য সং অব দ্য ডে-লেবারার’, ‘দ্য ফ্যাকট্রি স্লেভ’।
উইলহেল্ম ওয়েটিং (Wilhelm Weitling) (১৮০৮—১৮৭১)
উইলহেল্মের জন্ম প্রুশিয়ার মাগডেবার্গে। খুবই গরিব, দিন-আনা-দিন-খাওয়া পরিবার। তার উপর অকাল মৃত্যু হল বাবার। এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। মা তখন পরিচারিকার কাজ করে সংসার চালাতে লাগলেন। এই রকম অবস্থায় প্রথাগত শিক্ষালাভ সম্ভব নয়। উইলহেল্ম দর্জির কাজ শিখতে লাগলেন।
লাইপজিগে এসে রাজনৈতিক আন্দোলন দেখে আগ্রহ জাগল রাজনীতিতে। সেই সঙ্গে লিখতেন ব্যঙ্গ কবিতা। সমাজের দুর্নীতি, অব্যবস্থা এইসব নিয়ে ব্যঙ্গ। ১৮৩৭ সালে যোগদান করলেন ‘লিগ অব দ্য জাস্টে’ (League of the Justa)। সুইজারল্যাণ্ড, জেনিভা, জুরিখে কমিউনিজমের প্রচার শুরু করলেন। ১৮৪৫ সালে গ্রেপ্তার হলেন। ‘দ্য পু্য়োর সিনারস গসপেল’ লেখার জন্য। কারাগার থেকে মুক্ত হবার পরে চলে এলেন প্রুশিয়ায়। ১৮৪৮ সালে জার্মানিতে বিপ্লব শুরু হলে চলে গেলেন সেখানে। আবার সেখান থেকে নিউইয়র্ক।
দর্জির কাজ শিখেছিলেন। নিউইয়র্কে সেলাই মেশিন নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন। ডাবল স্টিচ, বাটন হোল, এমব্রয়ডারি – এসবের উন্নতি করেন।
তাঁর বিখ্যাত বই — ‘গ্যারান্টিজ অব হারমনি অ্যাণ্ড ফ্রিডম’। সে বই-এর প্রশংসা করেছেন ব্রুনো বাউয়ার, লুডউইগ ফয়েরবাখ, মিখাইল বাকুনিন ও কার্ল মার্কস।
জর্জ জুলিয়ান হার্নে (George Julian Hearne) (১৮১৭-১৮৯৭)
দক্ষিণ-পূর্ব লণ্ডনের ডেপ্টফোর্ডে জুলিয়ান হার্নের জন্ম। জাহাজিবিদ্যা শেখার কথা মনে হল। ভর্তি হলেন। কিন্তু ভালো লাগল না। চাকরি নিলেন ‘পুয়োর ম্যানস গার্ডিয়ান’ পত্রিকার অফিসে। ‘লণ্ডন ওয়াকিং মেনস অ্যাসোসিয়েশনে’র সদস্য হলেন। ১৮৩৭ সালে ‘ইস্ট লণ্ডন ডেমোক্র্যাটিক অ্যাসোসিয়েশনে’র প্রতিষ্ঠা হল, তিনি যুক্ত হলেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্বাস করতেন সাধারণ ধর্মঘট রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে পারবে।
চার্টিস্ট কনসোলিডেশনের সময় ঠিক হয় সাধারণ ধর্মঘট হবে। ১৮৩৯ সালের ১২ আগস্টে। জুলিয়ান মেতে গেলেন সেই ধর্মঘট সফল করতে। উত্তেজক বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতে লাগলেন নানা সভায়। তাই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল শাসক। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হল।
সেই সাধারণ ধর্মঘট সফল হল না। নিরাশ হয়ে জুলিয়ান চলে গেলেন স্কটল্যাণ্ডে। শেফিল্ডের চার্টিস্ট সংগঠক হয়ে ফিরে এলেন। ১৮৪২ সালে আবার ধর্মঘট। তখন জুলিয়ান গ্রেপ্তার হলেন। কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে ‘নর্দান স্টারে’ সাংবাদিকতা শুরু করেন। পরে এই পত্রিকার সম্পাদক হন।
সার্বিক ভোটাধিকারের আন্দোলন তাঁর জীবনের একটা বড় ঘটনা। ১৮৪৫ সালে গড়ে তুললেন ‘ফ্র্যাটার্নাল ডেমোক্র্যাটস’ নামে একটি সংগঠন। এই সংগঠনের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হল কার্ল মার্কস ও তাঁর সহযোগী ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের সঙ্গে। ‘নর্দান স্টারে’ তিনি তাঁদের লেখার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। এই পত্রিকার মাধ্যমে তিনি সমাজতন্ত্র ও সর্বহারার আন্তর্জাতিকতার প্রচার চালাতে শুরু করলেন।
১৮৫০ সালে তাঁর উদ্যোগে প্রকাশিত হল ‘রেড রিপাবলিকান’ পত্রিকা। এই পত্রিকায় ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র প্রথম ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ইংরেজি অনুবাদ করেন হেলেন ম্যাকফারলেন। এর পরেও জুলিয়ান হার্নে যে সব পত্রিকায় কমিউনিজমের কথা প্রচার করেন সেগুলি হল : ‘ফ্রেণ্ড অব দ্য পিপল’ (১৮৫০), ‘স্টার অব ফ্রিডম’ (১৮৫২), ‘দ্য ভ্যানগার্ড’ (১৮৫৩)। তারপরেও তিনি ‘নর্দান ট্রিবিউন’ ও ‘জার্সি ইন্ডিপেনডেন্ট’ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছেন। ১৮৬৩ সালে আমেরিকা গিয়ে ১৪ বছর ম্যাসাচুটেসের স্টেট হাউজে কেরানির কাজ করেছেন। সেখান থেকে ফিরে আসেন ইংল্যাণ্ডে। মৃত্যু হয় ১৮৯৭ সালে।
ফার্দিনান্দ ফ্রেইলগড় (Ferdinand Freiligrath) (১৮১০-১৮৭৬)
জার্মান কবি, অনুবাদক, ‘ইয়ং জার্মানি’ আন্দোলনের অংশীদার ফার্দিনান্দের জন্ম ডেটমণ্ডে। তাঁর বাবা ছিলেন শিক্ষক। ডেটমণ্ডের জিমনাসিয়ামে তিনি শুরু করেন পড়াশুনো। তারপর বাণিজ্যিক শিক্ষালাভের জন্য সোয়েস্টে আসেন। ফরাসি আর ইংরেজি সাহিত্য চর্চা শুরু হল। সেই সঙ্গে কাব্যচর্চা। ‘রাইনিশে ওডিয়ন’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করলেন। ‘মুজেন আলমানাখ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হতে লাগল তাঁর কবিতা। প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হল ১৮৩৮ সালে। জনপ্রিয় হল সেই কাব্যগ্রন্থ। অনেকে তার মধ্যে ভিক্টোরীয় যুগের প্রভাব দেখতে পেলেন। ১৮৪২ সালে প্রাশিয়ার রাজা তাঁকে পেনশন দিলেন।
আমেরিকার কবি হেনরি ওয়ার্ডসওয়ার্থ লংফেলোর সঙ্গে বন্ধুত্ব হল। ফার্দিনান্দ রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করলেন। প্রত্যাখ্যান করলেন রাজার দেওয়া পেনশন।
বেলজিয়ামে কার্ল মার্কসের সঙ্গে দেখা হল। মার্কসের মতামত তাঁর মনে ছাপ ফেলল। বেলজিয়াম থেকে ফার্দিনান্দ সুইজারল্যাণ্ড, ইংল্যাণ্ড গেলেন। বন্ধু কবি লংফেলোর আহ্বানে ঘুরে এলেন আমেরিকা থেকে।
জার্মানিতে ফিরে বসবাস করতে লাগলেন ডুসেলডর্ফে। ‘নিউ রাইনিশে সাইতুং’ পত্রিকার সাহিত্য বিভাগের সম্পাদক হলেন। এতেই প্রকাশিত হল তাঁর কবিতা—‘দ্য ডেড টু দ্য লিভিং’। সেই কবিতার জন্য রাজরোষে পড়তে হল। তিনি চলে গেলেন ইংল্যাণ্ড। ১৮৬৮ সালে ফিরে এসেছিলেন জার্মানিতে। ১৮৭৬ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। [ক্রমশ]