কানন দেবীকে শুধু বায়োস্কোপের যুগের স্বপ্নসুন্দরী বললে কিছুই বলা হয় না। তাঁর জীবন শুরু নির্বাক ছবির আগের যুগে।
কানন দেবী (এপ্রিল ২২, ১৯১৬ থেকে জুলাই ১৭, ১৯৯২), যিনি কানন বালা নামেও পরিচিত ছিলেন। একজন ভারতীয় বাঙালি অভিনেত্রী এবং গায়িকা। যিনি ভারতীয় চলচ্চিত্রে নায়িকাদের মধ্যে প্রথম গায়িকা এবং বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম তারকা হিসেবে স্বীকৃত। সাধারণত দ্রুত লয়ে তার গান গাওয়ার ধরন ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
হাওড়ার এক দরিদ্র পরিবারে তাঁর জন্ম। নয় বছর বয়সে তাঁর পিতা মারা যান। অসহায় মাতা দুই কন্যাকে নিয়ে এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে ঝিয়ের কাজ করেন। সেখান থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর মা-মেয়েতে মিলে ঝিয়ের কাজ করেন। তাঁর আত্মজীবনী ‘সবারে আমি নমি (১৯৭৩)’ গ্রন্থে তাঁর বড় হয়ে ওঠার এসব কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।
কানন দেবী অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন। নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন। ১৯২৬ সালে, তখন তাঁর বয়স ১২/১৩, তিনি একদিন কলকাতার ম্যাডান চলচ্চিত্র স্টুডিওতে হাজির হন। সৌন্দর্যের জন্য তাঁর বয়স কম হওয়া সত্ত্বেও তিনি অভিনয়ের সুযোগ পান এবং প্রথম চলচ্চিত্র ‘জয়দেব’-এ অভিনয় করে পারিশ্রমিক হিসেবে পাঁচ টাকা উপার্জন করেন। পরের বছর অভিনয় করেন আর একটি ছবিতে। তবে তাঁর পুরোমাত্রার অভিনয়জীবন শুরু হয় ১৯৩০ সালে। তাঁর প্রথম সবাকচিত্র ‘জোর বরাত’ (১৯৩১)। ১৯৩৫ সালে ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’-এ নায়িকার অভিনয় করে খ্যাতি অর্জন করেন। এ সময়ে তিনি কানন বালা থেকে কানন দেবীতে পরিণত হন। অপরূপা কানন এতোই জনপ্রিয়তা অর্জন করেন যে, রাস্তার ধারে তাঁর আলোকচিত্র বিক্রি হতে শুরু করে এবং তাঁর পোশাক, অলঙ্কার, চলাফেরা ইত্যাদি নারীদের জন্যে ফ্যাশনে পরিণত হয়।
পরে সেকালের প্রখ্যাত নায়ক প্রমথেশ বড়ুয়ার সঙ্গে ‘মুক্তি’ (১৯৩৭) এবং আরও কয়েকটি ছবিতে নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেন। তাঁর জনপ্রিয় ছবিগুলোর মধ্যে আছে বিদ্যাপতি, সাথী, পরিচয়, শেষ উত্তর, এবং মেজদিদি। ১৯৪৮ সালে তিনি চলচ্চিত্র প্রযোজনা শুরু করেন এবং ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত বিশেষত মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেন।
অভিনয় ছাড়া, তিন দশক ব্যাপী তিনি সবচেয়ে জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী হিসেবে বাংলা সঙ্গীত জগতে অসাধারণ অবদান রাখেন। বিশেষ করে রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি এবং আধুনিক বাংলা গানকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় এবং নজরুল ইসলামের কাছে তিনি গান শেখার সুযোগ পান। এছাড়া, সেকালের বিখ্যাত গায়ক ও সুরকার রাইচাঁদ বড়াল, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, ওস্তাদ আল্লারাখা, পঙ্কজ মল্লিক, অনাদিকুমার দস্তিদার, ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্র প্রমুখের কাছে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে গান শিখেছিলেন।
কানন দেবীর প্রথম বিবাহ হয় সিটি কলেজের অধ্যাপক কট্টরপন্থী হেরম্ব মৈত্রের পুত্র অশোক মৈত্রের সঙ্গে। অভিজাত পরিবারের বিলেতে পড়া ছেলে অশোক। সেই বিয়েটা টেকেনি। তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে হয় হরিদাস ভট্টাচার্য্য এর সঙ্গে। ১৯৪৯-এ কানন দেবীর বর হওয়ার আগে থেকেই কিন্তু হরিদাস ভট্টাচার্য কেউকেটা।
যখন বিয়ে হচ্ছে, তখন তিনি ক্যাপ্টেন হরিদাস ভট্টাচার্য। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ড. কৈলাসনাথ কাটজুর এডিসি। কলকাতার মোস্ট এলিজিবল ব্যাচেলারদের এক। হঠাৎ একদিন এই যুবকের চোখ পড়ল কানন বালার ওপর।
হরিদাস ওঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন….
‘‘এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম ড. কাটজুর সঙ্গে। সেখানেই দেখা কানন বালার সঙ্গে। প্রায় বাধ্য হয়েই সেখানে এসেছিল ও। সারাক্ষণ মঞ্চে থেকেও একটি কথাও বলেনি।’’
এর পর দ্বিতীয় দেখা রাজভবনে গান গাইতে এলেন যখন কানন। সেই আমন্ত্রণও হরিদাসই জানিয়েছিলেন।
এর পর ফের সাক্ষাৎ যখন নায়িকার ছবির শ্যুটিঙের পারমিশন জোগাড় করে দিলেন রাজ্যপালের এডিসি। কারণ লোকেশন হল সরকারি ঘেরাটোপের ফলতা। কাননের প্রেমের সঙ্গে আবার জুড়ে গেল ফলতা।
কানন দেবী বলেছেন যে, একজন জীবনসঙ্গীর কাছে যা কিছু তাঁর চাওয়ার ছিল, সবই পেয়েছিলেন হরিদাসের কাছে।
সব চেয়ে বড় পাওয়া হরিদাসের মনের জোর। কাননের অতীত নিয়ে কোনও প্রশ্ন বা কৌতূহল ছিল না ওঁর। প্রযোজিকা হিসেবে কানন দেবী এবং পরিচালক হিসেবে হরিদাস ভট্টাচার্য এক দুরন্ত হিট জুটি।
শ্রীমতী পিকচার্সের প্রথম হিট ‘মেজদিদি’-তে হরিদাস সহ পরিচালক। তিনি স্বাধীন ভাবে পরিচালনায় এলেন ‘নববিধান’ ও ‘দেবত্র’-য়। ‘দেবত্র’-য় একবারই মাত্র কানন দেবী, উত্তম ও সুচিত্রা ত্রয়ী এক সঙ্গে পর্দায় এলেন।
তবে হরিদাস ভট্টাচার্যকে আমরা ভুলিনি, ভুলব না, ‘আঁধারে আলো’, ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, ‘ইন্দ্রনাথ, শ্রীকান্ত ও অন্নদাদি’, ‘অভয়া ও শ্রীকান্ত’ এবং থ্রিলার ছবি ‘শেষ অঙ্ক’-র জন্য।
আর কানন দেবীকে তো বাঙালি প্রেমে পড়ে, নিন্দে করে, ভালবেসে, গাল পেড়ে, তার পর বুকে ধরে কাটিয়ে দিয়েছে যুগের পর যুগ।
‘আমি বনফুল’ গেয়ে বাঙালিকে এক কালে মাতিয়েছিলেন যে-নায়িকা তাঁকে আর প্রশ্ন করার ছিল না ‘তুমি কোন কাননের ফুল, কোন গগনের তারা’? শেষ দিন অবধি অবশ্য হরিদাস ও কানন একসঙ্গে থাকতে পারেননি। ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল।
যদিও তার মাত্র ক’বছর আগে কানন দেবী আত্মকথায় লিখছেন, ‘‘যখন হরিদাস ভট্টাচার্যকে বিয়ে করি তখন লোকের ধারণা ছিল এ বিয়ে পনেরো দিন টিকলে হয়। সেই বিয়েই তো চব্বিশ বছর টিকে গেল।’’
১৯৭৭-এর জানুয়ারিতে হরিদাস ও কানন জোড়ে গিয়েছিলেন দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে। কানন দেবী সে দিন দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার নিলেন। যদিও এ বিয়ে এক সময় ভেঙে যায়।
অভিনয়ের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ নায়িকা এবং দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার-সহ বহু সম্মানে ভূষিত হন।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:-
তথ্য : উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া।
মনোজিৎকুমার দাস, লাঙ্গলবাঁধ, মাগুরা, বাংলাদেশ
বিগত কালের জনপ্রিয় গায়িকা-অভিনেত্রীকে নিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ লেখাটি একালের শ্রদ্ধা নিবেদন। ভালো লাগলো।