কালীপ্রসন্ন সিংহের জন্ম ২৩শে ফেব্রুয়ারী ১৮৪১। বাংলা সাহিত্যে তার অমর অবদানসমূহের জন্য চিরস্মরনীয় হয়ে আছেন। সেগুলি হল বৃহত্তম মহাকাব্য মহাভারতের বাংলায় অনুবাদ, এবং তার বই হুতোম প্যাঁচার নক্শা । তিনি একজন লোকহিতৈষী ব্যক্তি হিসাবেও স্মরনীয় ব্যক্তিত্য যিনি চরম দুর্দশাগ্রস্ত বহু মানুষের এবং বাংলা-সাহিত্য আন্দোলনের প্রভূত সাহায্য করেছিলেন। কালীপ্রসন্ন সিংহ ঊনবিংশ শতকের একজন সাহিত্যকার এবং সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। মাত্র উনত্রিশ বছরের জীবনে তিনি সাহিত্য ও সমাজের উন্নয়নের জন্য বহু কাজ করে গিয়েছেন।
জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত “সিংহ” পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন নন্দলাল সিংহ। তাঁর পিতামহ জয়কৃষ্ণ সিংহ ছিলেন হিন্দু কলেজের একজন পরিচালক। কালিপ্রসন্নের মাত্র ছয় বছর বয়সে তাঁর পিতা মারা যান। বাবু হরচন্দ্র ঘোষ, যিনি নিম্ন আদালতের বিচারক ছিলেন, পিতার মৃত্যুর পর তাঁর অভিভাবক হিসাবে নিযুক্ত হন। তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনকালে, কালিপ্রসন্ন অবিশ্বাস্য বহুমুখী গুণাবলীর একজন মানুষ ছিলেন। খুব অল্প বয়স থেকে তিনি অদ্ভূত স্মরণশক্তির অধিকারি ছিলেন, মাত্র একবার দেখলে কিংবা শুনলেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে ১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর বাংলাভাষা চর্চার জন্য বিদ্যোৎসাহিনী সভা প্রতিষ্ঠা এই ক্ষমতার অদ্ভূত ক্ষমতার একটি সাক্ষ্য বহন করে। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর এই তরুণের অনেক বৃদ্ধ সহযোগীদের সঙ্গে একাত্মতা এবং এই ধরনের বিনোদনমূলক থিয়েটারের সংগঠন হিসাবে তাদের এই কাজে ব্রতী করতে পারা দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। হুতোম প্যাঁচার নক্শা হল তাঁর সেই অমর সৃষ্টি যেখানে উনবিংশ শতকের কলকাতার বাবু সম্প্রদায়ের একটি পরিষ্কার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তার উপন্যাস সেই সময় লেখার সময়, প্রতীকী হিসাবে কালিপ্রসন্ন চরিত্রের পুনঃনির্মাণ করে নবীনকুমার নামে সমকালিক চরিত্রের অন্তর্ভুক্তি ঘটিয়েছেন। কালিপ্রসন্ন ১৮৫৪ সালে বাগবাজারে র লোকনাথ বসুর কন্যার সঙ্গে বিবাহ করেন, কিন্তু কয়েক বছর পর তাঁর স্ত্রী বিয়োগ হয়। কিছুদিন পরে, কালিপ্রসন্ন রাজা প্রসন্ন নারায়ণ দেবের নাতনী এবং চন্দ্রনাথ বসুর কন্যা শরত্কুমারী দেবীকে বিবাহ করেন।
কালিপ্রসন্ন বর্তমানে প্রেসিডেন্সি কলেজ হিসাবে পরিচিত, তত্কালীন হিন্দু কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। ১৮৫৭ সালে তিনি কলেজ ত্যাগ করেন। তিনি বাড়িতেই তাঁর ইংরেজি, বাংলা সংস্কৃত শিক্ষা অব্যাহত রেখেছিলেন। তিনি মিস্টার ক্রিকপ্যাট্রিক নামক একজন ইউরোপীয় শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে তাঁর ইংরেজির জ্ঞান উন্নত করেছিলেন। পরবর্ত্তী জীবনে তিনি একজন লেখক, সম্পাদক , প্রকাশক, একজন লোকহিতৈষী, একজন সামাজিক কর্মী, এবং শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির একজন মহান পৃষ্ঠপোষক হিসাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর অবদান রেখে গেছেন।
সাহিত্যে তাঁর অবদান ছাড়াও অন্য বিষয়ে, যেমন বাংলা থিয়েটারে ও কালিপ্রসন্নের অপরিমেয় অবদান ছিল। মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে তিনি বিদ্যোৎসাহিনী সভা (শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহীদের জন্য একটি মঞ্চ) প্রতিষ্ঠা করেন। এটা সম্ভবত ১৮৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। কৃষ্ণদাস পাল, আচার্য কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য, প্যারীচাঁদ মিত্র, এবং রাধানাথ শিকদারের মত বিশিষ্ট ভদ্রলোকেরা এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। বিদ্যোৎসাহিনী সভা প্রধানত হিন্দু থিয়েটার তুলে ধরার জন্য দায়বদ্ধ ছিল, এবং বিদ্যোৎসাহিনী মঞ্চ ১৮৫৭ সালে কালিপ্রসন্নের বসত বাড়িতে স্থাপিত হয়েছিল। এই দলের সদস্যরা
১৮৫৭ সালেই “শকুন্তলা” নামক থিয়েটারটি মঞ্চস্থ করেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মত অনুযায়ী ‘কলকাতার সিমলায় মঞ্চস্থ ‘শকুন্তলা’ থিয়েটারটি, যদিও একটি ব্যর্থ প্রয়াস ছিল, তবুও এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, কারণ ‘শকুন্তলা’ থিয়েটারটি হল একটি সেরা শিল্পকর্ম, যেটার উপস্থাপনার জন্য প্রয়োজন বহুমুখী এবং সুসম্পূর্ণ প্রতিভা, যা তত্কালীন সময়ে এদেশে খুবই বিরল ছিল”। পরে কালিপ্রসন্ন “বেণীসংহার” থিয়েটারটি অভিনীত করেন, যা একটি উষ্ণ সাড়া পায় এবং সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় অভিনয়টি প্রশংসিত হয়। তরুণ কালিপ্রসন্ন, “ভানুমতী” নামক একটি মহিলা চরিত্রের ভূমিকায় অভিনয় করেন। পরে মাত্র ১৮৫৭ সালে, কালিপ্রসন্ন নিজই কালিদাসের সংস্কৃত রচনার উপর ভিত্তি করে “বিক্রমোবর্শী” নাটক লিখেছেন। কালিপ্রসন্ন রাজা পুরুরবার ভূমিকায় অভিনয় করেন যেখানে উমেশচন্দ্র ব্যানার্জ্জীর মত বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বও এই নাটকে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অভিনেতা হিসেবে কালিপ্রসন্নের অভিনয়ক্ষমতা সহ নাটকটি দর্শকের কাছে অত্যন্ত সমাদৃত হয়। বিদ্যোৎসাহিনী সভার মাধ্যমে তিনি বাংলা কবিতায় ফাঁকা পদ্য প্রবর্তনের জন্য মাইকেল মধুসূদন দত্ত কে সমাদৃত করেন। কালিপ্রসন্ন একটি শংসাপত্র ও একটি রৌপ্য গোঁজ দিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত কে পুরস্কার প্রদান করেছিলেন। এছাড়াও নীলদর্পণ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করবার জন্য রেভারেন্ড জেমস লং সাহেবকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। এই সভার মুখপত্র বিদ্যোৎসাহিনী পত্রিকা ছাড়া আরো দু-একটি পত্রিকা কালীপ্রসন্ন সম্পাদনা করেছিলেন। পরবর্তীকালে কালিপ্রসন্ন, ১৮৫৪ সালে বাবু, ১৮৫৭ সালে বিক্রমোবর্শী, ১৮৫৮ সালে সাবিত্রী-সত্যবান এবং ১৮৫৯ সালে মালতী-মাধব-এর মত বেশ কিছু নাটক লেখেন। তিনি বিদ্যোৎসাহিনী থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত ছাড়াও সেই থিয়েটারে নিজের রচিত।
তিনি লোকান্তরিত হন ২৪ জুলাই ১৮৭০ সালে। উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের অবিস্মরণীয় কালীপ্রসন্ন সিংহ আজ স্মৃতির অন্তরালে একথা মানতেই হবে।
মনোজিৎকুমার দাস, কথা সাহিত্যিক, লাঙ্গল বাঁধ, মাগুরা, বাংলাদেশ।