আয়েষা নিজের মতো সব গুছিয়ে নিয়ে এসেছে। একে একে থালা থেকে বাটিগুলো মাটিতে নামিয়ে রাখছে।
তোর কোথয়?
ওইতো, তুই খেয়ে যতটুকু অবশিষ্ট থাকবে আমাকে দিবি, আমি খাব।
যা দু-তিনটে বাটি আর একটা চামচ নিয়ে আয়। আমি ততক্ষণ মাখি।
কেন! তোর এঁটো খাওয়াতে সঙ্কোচ লাগছে।
তা কেন, আমি খাব তুই বসে থাকবি তা হয় নাকি?
হওয়ালেই হবে। আয়েষা মাথা নীচু করে রইলো।
আচ্ছাই গাঢ়ল তো, দেব পিঠে গুম গুম।
আয়েষা খিল খিল করে হেসে উঠলো। উঠে ঘরের বাইরে চলে গেল।
আমি মাখা মাখি শুরু করলাম। মিনিট দুয়েকের মধ্যে আয়েষা ফিরে এলো।
কি গন্ধ ছেড়েছেরে অনি। কতদিন পর খাব।
ধুপ করে আমার সামনে বসে পরলো।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে হাসছি।
গ্রামে থাকতে খেতাম, তারপর সব ভুলেই গেছিলাম।
আয়েষার মুখের দিকে তাকালাম। চোখদুটো চক চক করছে।
তোর ছেলের জন্য একটু রাখ।
ও এসব খায় না।
মায়ের ইতিহাস তাকে বলেছিস।
জন্মেছে বেশ্যা পট্টিতে, মা বেশ্যা-বাইজী এই ইতিহাসটুকু জানে।
আয়েষার মুখের দিকে তাকালাম।
ও জানে না আমি ওর মা।
মানে!
আয়েষার তিরিশ বছরের ইতিহাস তুই কয়েক ঘণ্টায় জেনে ফেলবি হয় কি করে?
আমি শূন্য বাটিগুলো টেনে নিয়ে ভাগাভাগি করলাম। আয়েষা আমার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে।
নে খা।
তুই খা।
আমি শুরু করলাম।
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ।
পাঠশালার কথা তোর মনে পরে।
হ্যাঁ।
কার কার কথা তোর মন পরে?
কারুর না। একমাত্র তোর মুখটা আর চিকনার মুখটা মনে পড়তো।
কেন!
চিকনা আমি তোর নেওটা ছিলাম, তাই।
হাসলাম।
আমার নয় বছরের মুখের সঙ্গে আঁটত্রিশ বছরের মুখের অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
তা হয়েছে।
তাহলে?
তুই প্রথম যেদিন আফতাবভাই-এর সঙ্গে এলি সেদিন তোকে দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম। আমার কেমন যেন লেগেছিল। আমার ঘরে প্রথম কেউ এই পোষাকে এলো নাচগান শুনতে। তাও এক বিধর্মীর সঙ্গে। ঠিক মেলাতে পারছিলাম না।
তবে এটুকু বুঝেছিলাম তুই আফতাবভাই-এর খুব কাছের মানুষ। আফতাবভাই সচরাচর এখানে কাউকে নিয়ে আসে না।
তুই মন দিয়ে আমার নাচগানে আংশগ্রহণ করলি। দু-একটা গানের কথা বললি, আমি গাইলাম।
তখনই আমার মন বলছিল তুই বেশ সমঝদার মানুষ। মাঠে ঘাটে ঘোরা সাধু নোস।
কেন, আফতাবভাই আমার পরিচয় তোকে দিয়েছে। আমি আফতাবভাই-এর খাস লোক। ইন্ডিয়ার বিজনেস ড্রিলটাও আমার জন্য।
ঠিক। তবে ওই যে বললাম, মেলাতে পারছিলাম না। ভোর হতে না হতেই তুই চলে গেলি।
দুপুরে আফতাবভাই-এর সঙ্গে শুলাম। কথায় কথায় তোর প্রসঙ্গ এলো। কথায়-বর্তায় এটুকু বুঝলাম তুই আফতাবভাই-এর শুধু কাছের লোক নোস। ওর পরিবারের একজন।
তারপর বললো, তুই বাঙালী।
কথাটা শুনে আরও অবাক হলাম। বললাম তোমার সঙ্গে ওর আলাপ কি করে?
ওর মেয়ের ঘটনা বললো। এও বললো তোর দুবাইতে বিশাল ব্যবসা।
ব্যবসায়ী মানুষ সাধুর পোষাক পড়ে! চুল দাড়ি রয়েছে। কেমন যেন খটকা লাগলো।
দেখলাম আফতাবভাই পুরো ব্যাপারটা কিছুতেই ভাঙলো না।
তারপর আফতাবভাই চলে গেল। তুই আমার মনের মধ্যে স্থায়ী ছাপ ফেললি।
জীবনে প্রথম এরকম একজন অদ্ভূত মানুষের দেখা পেলাম। বাইজী বাড়িতে এসেও সে নিরাসক্ত।
দিনান্তে তোর মুখটা একবার না একবার স্মৃতিতে ভেসে উঠতো।
বড়ো জ্বালা।
আমার কাছে যে মেয়েটা সব সময় থাকে তার নাম আমিনা।
ওকে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার নামখানার একটা গ্রাম থেকে তুলে আনা হয়েছিল। এই মহল্লায় তুই পশ্চিম বাংলার প্রচুর মেয়ে পাবি। খাওয়া-দাওয়ার পর একদিন দুপুর বেলা ওর সঙ্গে বসে গল্প করছি। কথা প্রসঙ্গে ও বললো, জানো আম্মি তোমার কাছে যে সাধুটা এসেছিল তার নাম প্রেমানন্দ নয়, অনি।
নামটা শুনে আমার বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করে উঠলো। সারাটা শরীর কাঁপছে। ওকে বুঝতে দিলাম না।
পাঠশালায় পড়ার সময় তোর সেই মুখটা, নামটা আর বাঁপায়ের কাটা দাগটা ছাড়া আমার স্মৃতিতে আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। বকুল গাছের গুঁড়িতে তুই হেলান দিয়ে বসে টিঁ টিঁ করে বকুল বাঁশি বাজাতিস। আমি তোর পায়ের কাটা জায়গাটায় হাত বোলাতাম। মাঝে মাঝে তুই বলতিস বড্ড চুলকচ্ছে জায়গাটা। একটু চুলকে দেতো।
বার বার স্মৃতিতে তোর ওই মুখের ছবিটা ভেসে উঠতো।
আমিনার সঙ্গে গল্পের ফাঁকে ফাঁকে টোকা দিয়ে জানতে পারলাম। ও জেনেছে আসাদুলের কাছে।
আসাদুল আফতাবভাই-এর দেহরক্ষী। দিল্লীতে থাকে। আফতাবভাই ইন্ডিয়াতে এলে ওর সঙ্গে সেঁটে যায়। ওরও বেশ ভাল একটা টিম আছে। আফতাবভাই-এর হরেক রকমের ব্যবসা। একটা আসাদুল দেখে। আমার এখানে এলে, আমিনার সঙ্গে শোয়।
হাসলাম।
হাসবি না। তোর মতো অতো ভাষা নেই। এখানে দু-চারজন বাঙালি আছে বলে তবু বাংলাটা বলছি, না হলে ভুলে যেতাম।
ঠিক আছে বল।
বেশ কয়েকদিন পরে আসাদুল এলো। চেপে ধরতে কিছুতেই শিকার করে না। বলে আমি এরকম কথা কখনই আমিনাকে বলতে পারি না। ও ভুল শুনেছে।
তবে ওর মুখ চোখ দেখে বুঝতে পেরেছিলাম ও ধরা খেয়ে গেছে।
কাকে দিয়ে তোর খোঁজ নিই? সেরকম বিশ্বস্ত লোক কিছুতেই খুঁজে পাই না।
তারপর তুই প্রথম বার আমার এখানে একা এলি। ঘণ্টা খানেক আমার এখানে থাকলি। এক গ্লাস জলও তোকে খাওয়াতে পারলাম না। কাজ বুঝিয়ে তুই চলে যাবার সময় আমি তোর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে গেলাম। তুই আমার হাতটা ধরে ফেললি। তবু আমি জোড় করে তোর পায়ে লুটিয়ে পরলাম। বাঁ পায়ের সেই নিশানা চোখে পড়ে গেল। বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো।
মনের কথা কাকে বলি। যেখানে যাই যা কিছু করি তোর মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কিছুতেই এখনকার মুখের সঙ্গে তোর সেই সময়ের মুখের মিল খুঁজে পাই না।
বেশ কয়েকদিন গান বাজনা বন্ধ কলাম। আমার শয়নে স্বপনে তখন তুই।
আমার কুঠি থেকে বেরলেই দেখবি রাস্তার ওপারে একটা পানের দোকান আছে। ভদ্রলোকের যথেষ্ট বয়স হয়েছে। আমি চাচা চাচা বলে ডাকি। ওনার বাড়ি আমাদের জেলার পানিপারুল।
চাচা দেশ থেকে ফিরলে এটা সেটা আনে। আমাকে ভালোবেসে দেয়। বেটি বেটি করে। আমার জেলার সঙ্গে সম্পর্ক বলতে এইটুকু। তবে আমি যে ওই জেলার মেয়ে আজও জানে না।
আয়েষার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম।
আমি হাওড়ার আমতার মেয়ে।
হাসলাম।
চাচাকে একদিন ডাকলাম। কথায় কথায় বললাম চাচা তুমি কবে বাড়ি যাবে?
চাচা আমার কথা শুনে অবাক। কাজের বাইরে চাচার সঙ্গে কোনও দিন এইভাবে কথা বলি নি।
কেন বলতো বেটি!
বলো না।
এখন যাবার মতলব নেই। কেন! কি দরকার বল?
তোমার বাড়ি থেকে কেউ আসবে না?
না।
চুপ করে রইলাম।
তুই আমাকে খুলে বল। সেরকম দরকার থাকলে যাব।
তোমাকে বিশ্বাস করতে পারি।
চাচা হাসলো।
আমার কুঠিতে যে সাধুটা এসেছিল দেখেছো।
দেখেছি।
আমি একটু ওঁর সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিতে চাই।
তার জন্য আমাকে বাড়ি যেতে হবে কেন। আমি যা জানি তোকে বলবো।
তুমি কি জান!
আমাদের এই তল্লাট যারা দেখাশুনো করে তারা ওর কাছে ছিঁচকে। শুনেছি বম্বের আলতাফ, ভিখুরা ভদ্রলোককে ভীষণ সম্মান করে।
তুমি গাঁজা দিও না।
বিশ্বাস কর।
কিরকম শুনি।
আফতাবভাই-এর সঙ্গে যেদিন প্রথম এখানে এসেছিল সেদিনই আমার চোখে পড়েছিল। বাইজী কুঠিতে সন্ন্যাসী! তোর মতো আমারও একই অবস্থা। তারপর একটু খোঁজ খবর নিলাম। এই তো কয়েকদিন আগে তোর কাছে এসেছিল।
হ্যাঁ।
ওর গাড়িতে মারানের লোক ছিল। তোর কুঠিতে ঢোকার পর এই তল্লাটে অনেক নতুন মুখ দেখেছিলাম। পরে আমাদের তল্লাটেরগুলো বললো ওরা সব আলতাফ, ভিখুর লোক।
আমার কাছে অন্য খবর আছে।
কি বল?
ভদ্রলোক বাঙালী।
বলতে পারবো না।
শুনেছি তোমার বাড়ির কাছে ঘর।
এ্যাঁ।
সেই জন্যই তোমাকে বলছি। ভদ্রলোকের অন্য কোনও অভিসন্ধি আছে কিনা আমাকে জানতে হবে। আমাকে তো বাঁচতে হবে।
গ্রামের নাম বল।
কাজলদীঘি।
নামটা শুনে চাচা কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল।
তুমি চিনতে পারছো।
হ্যাঁ।
চুপ করে থাকলাম।
আমাকে কয়টা দিন সময় দে।
কথাটা যেন সাত কান না হয়।
হবে না।
চাচা চলে গেল। আমার মন মানে না।
আমিনা বার বার খোঁচায়, তোমার কি হয়েছে বলো না? কি বলি ওকে বল।
সাত দিনের মাথায় চাচা একদিন দুপুর বেলা এসে আমাকে সব বললো। শুনে তো আমি আকাশ থেকে পরি। এও বললো সেই নামের ব্যক্তি একটা এ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে।
হাতটা ধুতে হবে।
থালাতেই ধুয়ে নে।
তোর বাথরুমেও কি একটু যেতে দিবি না?
আয়েষা হাসলো।
চল।
আমি উঠে দাঁড়ালাম, আয়েষা সব গুছিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
কি হলো দাঁড়িয়ে রইলি কেন?
তুই আগে আমি তোর পেছন পেছন।
ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। সরু প্যাসেজটার শেষ প্রান্তে এসে দেখলাম ডানদিকে টানা বারান্দা। আরও বেশ কয়েকটা ঘর।
এটা বাথরুম, তুই যা। আমি একটু জায়গাটা মুছে নিই।
হাসলাম। আমি বাথরুমে ঢুকে নিজের কাজ সারলাম। বেরিয়ে দেখলাম আয়েষা বারান্দায় দাঁড়িয়ে। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো।
বাথরুম দেখা হলো?
আমি হাসছি।
এবার আয়েষা কেমনভাবে বেঁচে আছে সেটা দেখার খুব ইচ্ছে করছে, তাই তো?
তুই একবারে পাকা খেলোয়াড় হয়ে গেছিস।
বেঁচে থাকার জন্য হতে হয়েছে, বুঝলি অনি।
আমি আয়েষার মুখের দিকে তাকিয়ে। ওর মুখটা কেমন থম থম করছে।
জানিস অনি, জামিলভাই যেদিন কানপুর থেকে আমাকে তুলে নিয়ে এসে এখানে রাখলো, সেদিন ভেবেছিলাম, শরীরটা বেচতে বেচতে একদিন হয়তো শেষ হয়ে যাব।
জামিলভাই!
তুই চিনিস, সেও তোকে ভাল করে চেনে। আমার ছেলেকেও তুই দেখেছিস। এখন সে ষন্ডাগন্ডা হয়েছে। এই গল্প তোকে পরে বলছি।
তোর তো ইউপির কোথায় যেন বিয়ে হয়েছিল।
বিয়ে হয় নি। আব্বু কিছু টাকার বিনিময়ে বেচে দিয়েছিল। আমার বিয়ের সব খরচ তারা দিয়েছিল। বরং কিছু বেশি টাকা আমার আব্বুর হাতে গুঁজে দিয়েছিল।
এক নিঃশ্বাসে কথাটা বলে আয়েষা থামলো। বারান্দা দিয়ে মসজিদটার দিকে তাকাল।
নয় বছরের একটা মেয়ের সঙ্গে পঁচিশ বছরের একটা ছেলের বিয়ে হলো।
আমাদের সমাজে এসব হয়। মেনে নিয়েছিলাম। ওই বয়সে কি প্রতিবাদ করবো বল।
বেরিলি থেকে একটু দূরে সীতারামপুর গ্রাম। নয় বছরের একটা মেয়ে শ্বশুর বাড়িতে এলো। আমাদের গ্রামের সঙ্গে কিছুই মেলে না। চারদিক কেমন ফাঁকা ফাঁকা।
পঁচিশ বছরের ছেলের ভার, নয় বছরের মেয়েটা অতিকষ্টে দু-বছর সহ্য করেছিল।
আব্বু এরমধ্যে একবার এসেছিল আমাকে নিতে, এরা যেতে দেয় নি।
অর্ধেক দিন শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে রক্তারক্তি অবস্থায় পরে থাকতাম। দেখার মতো কেউ ছিল না। তারপর বললো, আমি বাঁজা। আমার বড় আর একটা বিয়ে করলো। সে আমার থেকে একটু বড়ো, বছর ঘুরতেই তার বাচ্চা হলো। আমি অচ্ছ্যুত।
খেতে না পেলে শরীরে মাংস লাগবে কি করে বল।
আমার স্থির দৃষ্টি আয়েষার মুখের ওপর নিবদ্ধ। বারান্দার এক পাশে বিকলের সূর্যের আলো এসে পড়েছে। আয়েষার চোখ কখনো ছল ছল করে উঠছে। কখনো ঝলসানো আগুনের কয়লার টুকরো। আপন মনে কল কল করে চলেছে। আমি তার নীরব সাক্ষী।
বুকের জগদ্দল পাথরটাও মনে হয় এই ফাঁকে কিছুটা হাল্কা করে নিচ্ছে।
একদিন বাড়ির কাজের লোক হিসেবে এক মাসীর হাত ধরে কানপুরে চলে এলাম। সঙ্গে আমার বাবার দেওয়া টিনের বাক্স। অনেক পরে জেনেছিলাম আমাকে বিক্রী করা হয়েছিল।
গ্রাম ছেড়ে শহর। আয়েষা আয়েষাই রইলো।
এসে দেখলাম সেখানে নাচগান হয়। আমি ফাই ফরমাস খাটি।
যাক খাওয়া দাওয়াটা ভাল পেলাম। শরীরে মাংসো লাগলো। ডাগুর ডুগুর দেখতে হলাম।
অনেকেই গায়ে হাত বোলায়।
মানুষ পরিবেশের দাস। ওদের গান শুনে শুনে দু-এক কলি গান গাইতাম। তারপর দেখলাম আমি একদিন বাইজী বনে গেছি। আমিও কারুর রাখেল হয়ে গেছি।
আয়েষার মৃত্যু হলো, জন্মনিল জিন্নাতবাই।
মাসীকে আমি আম্মি বলতাম। মাসী মারা যেতে আমি ব্যবসার হাল ধরলাম।
তখন আমার কতই বা বয়স, কুড়ি-বাইশ। ধীরে ধীরে ব্যবসা জমালাম। কিন্তু সেইভাবে নাম করতে পারি নি। আমি আম্মির কাছে যে গান শিখেছি। সেই গান কেউ শুনতে চায় না। আমিও খরিদ্দাররা যে গান শুনতে চায় সেই গান গাইতে পারতাম না। তবে সপ্তাহে এক-দুজন আমার গান শুনতে আসতো।
বেশিরভাগ গানের বদলে ফুর্তি করতে চাইতো। প্রথম প্রথম না চাইলেও ব্যবসা টিঁকিয়ে রাখার জন্য বুঝ শুনে গা ভাসালাম।
একবার বেনারসে গেলাম গান গাইতে। যার আমন্ত্রণে গেলাম সে খুব নামজাদা লোক। শুনলাম কোন রাজার বংশধর। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। অর্জুনকে পেটে ধরলাম।
যাই হোক বাঁজা নামটার অপবাদ থেকে মুক্ত হলাম।
এই নামটাও খুব শোনা শোনা লাগছে।
বললাম তো, তুই আমার ছেলেকে দেখেছিস, হয়তো মনে নেই।
কানপুরে কিন্তু আমি সাতদিন কাটিয়ে এসেছি।
রাজনাথকে ধরার জন্য।
তুই জানলি কি করে! সরি। তুই তো বলেছিস, আমার সম্বন্ধে ভাল হোম ওয়ার্ক করেছিস।
আয়েষা আমার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি হাসলো।
ছেলেটাকে মানুষ করতে চেয়েছিলাম বুঝলি অনি। যতই হোক রাজ বংশের রক্ত। হলো না।
জামিলভাই আমাদের ওই তল্লাটটা দেখতো। একদিন এসে বললো। তোমার আর এখানে থাকা হবে না। ব্যবসা পত্তর সব গুটিয়ে নাও। তুমি আগ্রায় চলো।
আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।
জামিলভাই কিছুতেই আমার কথা শুনলো না। জোড় করে আমাকে এখানে নিয়ে এলো।
এই বাড়িটা জামিলভাই-এর। ওর পছন্দের মেহমান ছাড়া এখানে কারুর প্রবেশ নিষেধ।
জামিলভাই-এর মুখের ওপর কথা বলার লোক এই তল্লাটে খুব কম আছে। প্রথমে ভেবেছিলাম জামিলভাই আমাকে রাখেল হিসেবে রাখবে। তারপর দেখলাম আমার সঙ্গে একটা দূরত্ব রেখে জামিলভাই চলে।
আফতাবভাই ওর হাত ধরেই এ বাড়িতে পা রেখেছে।
আমি আয়েষার মুখের দিকে তাকিয়ে।
আয়।
কোথায়?
আয়েষার অন্যান্য ঘরগুলো দেখবি না।
হাসলাম।
আয়েষা আমার হাতটা শক্ত করে ধরলো।
চল।
একে একে আয়েষা অর্জুনের ঘর, আমিনার ঘর, মেহমান এলে তার থাকর ঘর, রান্নাঘর….।
শেষে যে ঘরটায় আমাকে নিয়ে এলো সেই ঘরটা দেখে আমি অবাক হলাম।
একটা ছোটখাটো ব্যক্তিগত লাইব্রেরী। আমার চোখ দেখে আয়েষা বুঝতে পেরেছিল।
জানিস অনি, আম্মি আমাকে নিজে হাতেধরে পড়াশুন শিখিয়েছিলেন। অনাদি মাস্টার….না থাক, তুই বলেছিস, তিনি আমাদের শিক্ষাগুরু।
এই লাইব্রেরীটা আম্মির। অবসর সময়ে পড়াশুন করি। আম্মি বলেছিল, ভাল বাইজী হতে গেলে কম বেশি সব বিষয়ে জ্ঞান থাকতে হবে। না হলে মেহমানদের মন জয় করবি কি করে।
ছেলেটাকে মানুষ করতে পারলি না?
ওই জন্য তোকে দিলাম। আমার সন্তানের ওপর একমাত্র তোর অধিকার আছে।
আমি আয়েষার মুখের দিকে তাকিয়ে।
ওর দু-চোখে পরিতৃপ্তির কাজল, অনেক না বলা কথা আত্মগোপন করে আছে।
চল।
কোথায়!
আমার ঘরে।
আমি নিজে যেতে পারবো। তুই বরং একটু চা করে নিয়ে আয়।
তেজপাতা দিয়ে চা খাবি?
হাসলাম। কর।
আমি টানা বারান্দা পেরিয়ে সোজা চলে এলাম আয়েষার ঘরে। ওই মুহূর্তে ঘরটা আমার কাছে স্বপ্নের মতো লাগছে। আমার শৈশবের সাথীর হারিয়ে যাওয়া অনেকগুলো বছর এই ঘরের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ইজি চেয়ারটায় নিজের শরীরটা এলিয়ে দিলাম। চোখদুটো বুঁজে এলো। ক্লান্তি নয় সামান্য আবেশ। আমি আয়েষা দুজনেই যেন পাঠশালার সেই জীবনটা খুঁজে পাওয়ার আপ্রান চেষ্টা করছি।
কিরে চা চেয়ে ঘুমিয়ে পরলি।
চোখ মেলে তাকালাম। আয়েষার পোষাক বদল হয়েছে। খুব সুন্দর একটা শালোয়ার পড়েছে।
মুচকি হাসলাম।
তুই কিন্তু আমার মাথাটা এবার খারপ করে দিবি।
খারপ হলেও সে ভয় আমার নেই।
আয়েষা ট্রে-টা খাটের ওপর রাখলো।
আয়।
উঠতে ইচ্ছে করছে না।
দাঁড়া। তাহলে ছোট্ট টেবিলটা নিয়ে আসি।
আয়েষা বেরিয়ে গেল।
আমি শরীরটা আবার এলিয়ে দিলাম। বার বার মনে হচ্ছে, আয়েষার জীবনের গল্পটা দামিনীমাসির তল্লাটের কোনও মেয়ের থেকে একবারে আলাদা নয়। কোথাও না কোথাও এক সুরে বাঁধা।
আয়েষা ঘরে ঢুকে টেবিলটা আমার সামনে রাখলো। খাট থেকে চায়ের ট্রে নিয়ে এসে নিজে চা ঢাললো। আমার পায়ের কাছে বসলো।
আমি একটু ঝুঁকে চায়ের কাপটা নিয়ে ঠোঁটে ছোঁয়ালাম। আয়েষাও ঠোঁটে কাপ ছুঁইয়েছে।
তেজপাতাটা একটু বেশি পড়ে গেছে। অভ্যেস নেই তো।
আমি আয়েষার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
আমার কথা অনেক শুনেছিস এবার তোর কথা বল।
সব কথা এখনো বলিস নি।
বলেছি।
আমার একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করছে।
বল।
ধর তুই এতক্ষণ যা বললি সব ঠিক, তবু আমি অনি নই প্রেমানন্দ।
আমি উর্বশী মুনি-ঋষির ধ্যান ভাঙাতে আমার বেশিক্ষণ সময় লাগে না। আর অভিশাপের কথা বলবি। আমার মতো অভিশপ্ত জীবন কজনের আছে বল।
কাপটা টেবিলের ওপর রাখলাম।
তুই তখন রাজনাথের ব্যাপারটা বললি।
চাচা তোর সম্বন্ধে আমাকে যা বলেছিল, আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারি নি। চাচা মারানের নাম মুখে উচ্চারণ করেছে। মারানের নামটা জামিলভাই-এর মুখে বহুবার শুনেছি। আফতাবভাই-এর সঙ্গে মারানের যে একটা সম্পর্ক আছে সেটাও ভাষা ভাষা জানতাম।
মারানকে কখনো দেখেছিস?
না।
তারপর।
জামিলভাইকে ফোন করে কানপুর থেকে ডাকলাম। জামিলভাই এলো।
ওকে বললাম, এই সাধুকে আমার ঠিক ভাল ঠেকছে না।
জামিলভাই হাসলো।
শুধু বললো, ওই সাধুর জন্য আজ তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি জিন্নাত।
আমি শুনে অবাক! জামিলভাই বলে কি! তারপর তুই যে সাতদিন কানপুরে ছিলি রাজনাথকে ধরার জন্য তার গল্প বললো, এও বললো, সে খতম হয়ে গেছে। মারান করিয়েছে।
তুই অর্জুনকে কানপুর স্টেশনে দেখেছিলি?
হ্যাঁ, এইরকম একটা ঘটনা মনে পড়ছে।
তখন আমার কাছে একবার যেতে পারতিস।
তাহলে তোকে এত কষ্ট করতে হতো না।
কেন?
তখন আমি এই পোষাক পরা শুরু করিনি। মনাকাকা বেঁচে আছেন।
জানিস তারপর জামিলভাই বললো, অনিদা….কথাটা বলেই একহাত জিভ বার করে বললো, মাফ কিজিয়ে জিন্নাতবাই প্রেমানন্দ।
আমি হেসে মরি। জামিলভাইও হাসে।
হাসি থামিয়ে বললো, আমাকে অর্জুনের দিকে নজর দিতে বলেছিলেন। কিন্তু অর্জুনকে তোমার কাছ থেকে সরিয়ে নিলে তুমি কষ্টপাবে, সেটা উনি সহ্য করতে পারবেন না। তাই তোমাকেও ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে এলাম।
তারপর জামিলভাই-এর মুখ থেকে তোর সম্বন্ধে যা শুনলাম তাতে উনি তোকে শুধু সম্মান করেন না, তুই চাইলে নিজের জানটা পর্যন্ত দিয়ে দিতে পারে। তখন বুঝলাম কেন আমি জামিলভাই-এর রাখেলের মর্যাদা না পেয়ে বহিনজীর মর্যাদা পেয়েছি।
তবে ওর সঙ্গে তোর সেরকম কোন যোগাযোগ নেই। যা কিছু মারানের কথা মতো ওকে চলতে হয়। মারান ওর বস। তুই মারানের বস।
এটা তোকে বাড়িয়ে বলেছে।
আয়েষা হাসলো। এর বেশি কিছু আমাকে বলতে চায় নি।
বরং আমাকে পরামর্শ দিল, তুমি যদি ওনার সঙ্গে ব্যবহরটা ঠিক রাখতে পার, তাহলে তোমার জীবনটাই বদলে যাবে। এরকম অনেক লোকের জীবন নাকি তুই বদলে দিয়েছিস। জামিলভাই নিজে চোখে দেখে এসেছে।
জানিস অনি, কাউকে তো মনের কথা খুলে বলতে পারি না। কে বুঝবে বল। সেই দিন থেকে তোর প্রতীক্ষায় রয়েছি। প্রত্যেকদিন শোবার আগে টিনের বাক্সটা খুলে জামাটায় হাত বুলতাম, মনে মনে তোর স্পর্শ অনুভব করতাম। নামাজ পরে উঠে প্রত্যেকদিন প্রার্থনা করতাম, একবার অনির মনে আয়েষার কথাটা মনে পড়িয়ে দাও।
আয়েষার চোখদুটো আবার ছল ছল করে উঠলো।
গত সপ্তাহে জামিলভাই খবর পাঠাল জিন্নাতবাই প্রেমানন্দ তোমার কাছে কাল আসবে।
বিশ্বাস কর কথাটা শোনার পর সারারাত ঘুমতে পারলাম না। তোর প্রতীক্ষা, কখন তুই আসবি। কত ভাবলাম কি করে তোকে আমার কথাটা মনে করাই। কিছুতেই ভেবে পাই না।
তুই এলি। তোর ওই নির্লিপ্ত ভাব ভঙ্গী আমাকে আরও পাগল করে তুললো।
রামজান মাস। আল্লাহর নাম স্মরণ করে তোকে নিমন্ত্রণ করলাম। তুই গ্রহণ করলি।
রাতে খাওয়ার আগে নামাজ পরার সময় পালের বাগানে ঈদের দিনের ঘটনাটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। মনে হলো আমি যেন পথ খুঁজে পেয়েছি। পরের দিন টিনের বাক্স থেকে জামা আর প্যান্টটা বার করলাম। এই মহল্লায় যত দোকান আছে আমার সাইজের ফ্রক আর খুঁজে পেলাম না। মনটা খারপ হয়ে গেল। তোকে আমার আর পাওয়া হলো না।
অনেক ভেবে রং মিলিয়ে ঘাগরা কিনলাম। প্যান্টটাও পেলাম অনেক কষ্টে। চাচার হাতে টাকা গুঁজে দিলাম। বললাম, যেখান থেকে পার আমাকে গোটা চারেক শালপাতা জোগাড় করে দাও।
চাচা প্রথমে একটু অবাক হলেও, কথা রেখেছিল।
সবাইকে বলে দিলাম ঈদের দিন আমি একা থাকবো, যে যেখানে পার ঘুরতে চলে যাও, ঈদের পরদিন সকাল দশটার মধ্যে সবাই চলে আসবে।
একমাত্র জামিলভাইকে জানালাম। প্রেমানন্দকে নিমন্ত্রণ করেছি ঈদের দিন আসার জন্য, তোমার কোনও আপত্তি আছে।
জামিলভাই বললো, যদি আসে একবারটি আমায় খবর দিও, একবার গিয়ে দেখা করবো।
কোনও সন্দেহ প্রকাশ করে নি?
কি জানি করেছে হয়তো, আমি তখন তোকে পাওয়ার জন্য পাগল। ওই দিকে ভববার মতো মন ছিল না।
সবাই রাতে চলে গেল। শুধু আমিনা রইলো আমার সঙ্গে। ও বললো কাল সকালে আসাদুল আসবে ওকে নিতে। আমি ঘরে এলাম। যেদিকে তাকাই মনে হচ্ছে তুই দাঁড়িয়ে আছিস।
কিছুতেই ঘুম আসে না। আমিনা একবার এসেছিল। বললাম, আমাকে একা থাকতে দে। জানলা দিয়ে মসজিদটার দিকে তাকিয়ে থাকি। চারিদিকে ঈদের আমেজ।
চাঁদ উঠলো। আমিনা এসে খবর দিল, আম্মি চাঁদ উঠেছে। ছাদে উঠে চাঁদ দেখলাম। স্নান করে নমাজ পরে উঠে প্রার্থনা করলাম, আল্লাহ ও যদি আমার সত্যি কারের অনি হয় এই মুহূর্তে আমি ওর কণ্ঠস্বর শুনতে পাব।
তোকে ফোন করলাম। তুই রিসিভ করলি। বিশ্বাস করবি না তখন কি আনন্দ হচ্ছিল।
কাল সারারাত আমি আর ঘুমই নি। আমাকে দেখে একটুও বুঝতে পারছিস।
তোর তো কই মাছের জান।
স্লেটের বাড়ি মারবো।
কি হবে একবার পা ফালা করেছিলি এবার কপাল কানা করবি।
আয়েষা হেসেফেললো।
তারপর।
খুব মজা লাগছে শুনতে, তাই না?
আমি হাসছি।
আমিনা চলে যাবার পর, আমি আয়েষা সাজলাম। মনে মনে ঠিক করে নিলাম, তুই যদি স্বীকার করে না নিস তোকে শরীর বিক্রির ঘরে ঢুকিয়ে অচ্ছ্যুত করে দেব।
সকাল থেকে আমি ঠায় ওই ঘরের জানলায় দাঁড়িয়ে। ওই ঘরের জানলা দিয়ে রাস্তাটা দেখা যায়। আমার প্রতীক্ষার পালা যেন আর শেষ হয় না। একবার তো ভাবলাম তুই হয়তো আর আসবি না। কিন্তু মন মানে না। বার বার রাস্তায় চোখ চলে যায়।
একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলাম। হঠাৎ দেখলাম গেটের কাছে তোর গাড়িটা এসে দাঁড়াল। তুই গাড়ি থেকে নেমে এলি। বুকের ভেতরটা তোলপাড় হতে শুরু করলো। হাত-পা কেমন ঠান্ডা হয়ে আসছে। আমি যেন নরতে-চরতে পারছি না।
তুই ড্রাইভারটাকে টাকা দিলি। তারপর আমার বাড়ির দরজায় পা রাখলি।
ওই টুকু সময়। তবু আমার কাছে মনে হলো কয়েক যুগ। বার বার মন বলছে কেন তুই বেল বাজাচ্ছিস না। তারপর ভাবলাম কাউকে দেখতে না পেয়ে হয়তো তুই চলে যাচ্ছিস। ছুটটে জানলার কাছে চলে এলাম। রাস্তার দিকে তাকালাম। নীচে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। তাহলে কি তুই…।
তারপর বেল বাজলো।
এই টুকু পথ, তবু আমার কাছে যেন মন হচ্ছে কিছুতেই পথটুকু শেষ হচ্ছে না।
আয়েষা টেবিলের ওপর মাথাটা এলিয়ে দিল। চোখ বন্ধ করলো। দু-ফোঁটা জল চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো।
চারদিক নিস্তব্ধ। আয়েষা চোখ মেলে তাকাল।
জানিস অনি, আসার পর থেকে তোর চোখ দুটো আমি লক্ষ্য করেছি। তুই আমাকে ঠিক ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারিস নি।
একবারে সত্যি কথা বলেছিস।
তোর জায়গায় আমি থাকলেও তাই করতাম।
আয়েষা ভেঁজা ভেঁজা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে।
এখন তুই শালোয়াড় পরে আছিস, ঘাগড়াটা পরে থাকলে বলতাম, আর একবার তুলে দেখা। তাহলে যদি বিশ্বাসের বনিয়াদটা পোক্ত হয়।
আয়েষা সোজা উঠে দাঁড়িয়ে, আমার মাথাটা নীচু করে পিঠে গুম গুম করে গোটা কয়েক কিল বসিয়ে দিল। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠলো।
দেখার সখ মিটেছে।
আমি উঃ উঃ করে উঠেছি।
ও নিজেও হাসছে, আমিও হাসছি।
কেমন লাগলো বুঝলি।
আমি হাসতে হাসতেই মাথা দোলাচ্ছি।
হাসির রিনিঝিনি শব্দ ঘরের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। আয়েষার চোখে জল মুখে হাসি।
হাসতে হাসতেই আয়েষা বলে উঠলো, তোর লেগেছে।
একটুও না।
হাসি থামিয়ে, আয়েষা আমার পায়ের কাছে এসে বসলো। আমার বাঁ পা-টা ওর কোলের ওপর টেনে নিল। জোড় করে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। পারলাম না।
কাটা জায়গাটায় হাত বোলাতে বোলাতে বললো।
আজ থেকে ওই পোষাকটা টিনের বাক্সে ঢুকে যাবে। অনেক সাধ্য সাধনা করে তোকে পেয়েছি।
সেদিন ওর ঘড় থেকে দু-জনের কেউ বেরই নি। আমাকে নিয়েই ওর খুশির ঈদ। মাঝে ও একবার আঁখের গুড়ের পাটালি ছোলাসেদ্ধ আর মুড়ি নিয়ে এলো।
ব্যাপারটা কি বলতো।
কি।
তুই এই সব পেলি কি করে।
তুই কি ভাবলি আমি সব ভুলে গেছি।
না, মানে!
পাটালি আর ছোলা সেদ্ধ মাথায় নিয়ে কতবার বেল্কির হাটে বিক্রি করতে গেছি।
হাসলাম।
আম্মির মতো ঠিক করে বানাতে পারি নি। গুড়ের পাকটা ঠিক হয় নি। গ্যাসে কি আর এই সব হয়। এর জন্য কাঠের জালন দরকার।
দু-জনে বসে বসে পাটালি খাচ্ছি আর গল্প করছি।
জানিস অনি মাঝে মাঝে গ্রামের কথা মনে পড়ে। মনটা যে খারাপ হয় না তা না। খুব যেতে ইচ্ছে করে, তারপর ভাবি কে আমাকে চিনবে। আমার পরিবারের কাছে আমি মৃত। তাছাড়া….।
তোর যেতে মন চাইলে তুই যা। আমি চিকনাকে বলে দিচ্ছি।
আমার মাথার দিব্যি রইলো, এ কথা তুই আমি ছাড়া তৃতীয় কোনও ব্যক্তি যেন না জানে।
তুই তো একবারে….।
তুই আমি একই গ্রামের ছেলে মেয়ে। হিন্দু মুসলমানের একটা বিভেদ আমাদের মধ্যে নিশ্চই ছিল। কিন্তু আমাদের মহরমের অনুষ্ঠানে তোরা আসতিস, আমরাও বাসন্তী পূজোর সময় প্রসাদ খেতে যেতাম। আম্মিতো একবার বাসন্তী ঠাকুরের কাছে কি মানত করেছিল মাস্টার মশাইকে ধরে এক কিলোর একটা বাতাসা দিয়েছিল বাসন্তীমাকে।
তখনও কিন্তু অনাদি মাস্টার খ্যাঁক খ্যাঁক করেছিল। বরং মাস্টার মশাই বলেছিল মায়ের কাছে সবাই সন্তান। এতে কোনও অন্যায় হয় না।
আমি এক দৃষ্টে আয়েষার মুখের দিকে তাকিয়ে ওর কথা শুনছিলাম।
তোকে কাছে পেয়ে আজ বড্ড বেশি করে গ্রামের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। এইরকম একটা ইদের দিনেই আমার জীবনে একটা বিপর্যয় ঘটেছিল। আজ সেই ইদের দিন। আল্লাহ তোকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে। আজ আব্বু আমাকে মারবে না। মাস্টার মশাই তোকে মারবে না।
আমি হাসলাম।
(আবার আগামীকাল)