২২৬ নং কিস্তি
অর্জুন এসে আমাকে পেছন থেকে জাপ্টে ধরলো।
ওর মতো শক্ত সামর্থ্য ছেলেও আজ চোখের জলে আমার পিঠ ভাসাচ্ছে।
আমাকে ঘিরে যারা দাঁড়িয়ে আছে। তাদেরও চোখ ছল ছলে।
তাই তোমাদের দুজনকে আমি কোনও মূল্যেই হারাতে চাইনি।
আমি থেমে থেমে কথা বলছি।
অর্জুনও….আমার গলা ধরে এলো। বুকের ভেতরটাও যে চিন চিন করছে না তা নয়।
তুমি আমার শৈশব ফিরিয়ে দিয়েছিলে। দেবা আমার শৈশব কেরে নিয়েছিল। ওর হাল আমি টোডির থেকেও খারাপ করে দেব। লোকে দেখবে ওর দেহটা শেয়াল, কুকুরে টানাটানি করে ছিঁড়ে খাচ্ছে।
আমার গলাটা গম গম করে উঠলো।
নেহি।
বিকট একটা শব্দ আমার গলা ছাপিয়ে চরম নিস্তব্ধতাকে খান খান করে টুকরো টুকরো হয়ে চারদিকে ছরিয়ে পরলো। সেই শব্দের রিনিঝিনিতে সবাই চমকে তাকাল।
আমার শরীর থেকে আফতাবভাই, দিদি, অর্জুনের অর্গল খসে পড়েছে। ওদের চোখে মুখে বিষ্ময়।
বিনদ পায়ে পায়ে সামনে এসে দাঁড়াল।
বেঁটে খাটো কালো শরীরটা ফুলে ফুলে উঠছে। চেনা মানুষটা আমার কাছে এই মুহূর্তে অচেনা ঠেকছে। চোখ দুটো গন গনে আগুনের কয়লার টুকরো।
উসকা জান মেরে হাত মে লিখ্খা হ্যায়। এ গন্ধি কাম দেওতা লোককো নেহি।
আমি বিনদের চোখে চোখ রাখলাম।
হিসাব মেরা সাথ হুয়া, তেরা সাথ নেহি। গলার স্বর নামিয়ে নিলাম।
তো।
ও মেরা ফ্রেন্ড থা, তেরা নেহি।
উয় অর্জুনকা আম্মি, মেরা মৌসি থা।
হেসেফেললাম। বিনদের দু-কাঁধে হাত রেখে প্রচন্ডে বেগে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বললাম।
তেরা গুস্সা কিঁউ আতা হ্যায়। সোচ সমঝকে কাম করনা চাহিয়ে। বাত জীনে কে লিয়ে হোতা হ্যায় মারনে কি লিয়ে নেহি।
বিনদের চোখের আগুন দপ করে নিভে গেল। আমাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ রাখলো।
আলতাফ, ঝিনুক, অভিমন্যু এগিয়ে এসেছে। পেছনে নেপলা, সাগির, অবতার। তার পেছনে চাঁদ, চিনা, রতন, আবিদ, ওমর।
কারুর চোখ মুখ সুবিধার নয়। আমি একটু বেচাল হলেই স্ফুলিঙ্গে ঘৃতাহুতি পরবে।
খুব জোর নিজেকে সামলে নিলাম।
বাধ্য হয়ে রসিকতার ঢঙে বলে উঠলাম।
আরে কালিয়া এক আদমিকে লিয়ে ইতনা সারি আদমি।
তোমার ছক বাজি এখানে চলবে না। অবতার পেছন থেকে গড়গড় করে উঠলো।
ব্যাটা তুই কি জানিষ, ভাগ এখান থেকে, খালি বক বক। ডাকবো দেখবি কবিতাকে।
তবু কেউ হাসলো না। আমার মুখের দিকে স্থির দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে।
দাদা মেরে কুছ কাম দে দো বহুত দিন শুখ্খা হ্যায়। অভিমন্যু বোকা বোকা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
গাছের তলায় ফলের ঝুড়িগুলো রয়েছে, নিয়ে আয়। সকলকে ভাগ করে দে।
আমি অভিমন্যুর দিকে তাকিয়ে।
মোমবাতি, ধূপকাঠি জ্বালিয়েছিস?
অভিমন্যু মাথা নীচু করে নিল।
আমি হাসছি।
বিনদ। তুই অর্জুন তখন গাছ থেকে আম পেরেছিলি। আমার জন্য রেখেছিস।
বিনদ আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার বুকে মুখ গুঁজে রয়েছে। কিছুতেই মুখ তুলছে না।
সামনের দিকে তাকালাম। মোমবাতির সামনে মাম্পি, মিকি, বাবান, পিপটু বসে নিজেদের মধ্যে কিচ কিচ করছে।
রতন, মাম্পিদের ওখান থেকে তুলে আন। মোমবাতি জ্বলছে। দেখ যেন হাত না দেয়।
রতন ঘুরে তাকাল। পায়ে পায়ে ওদের দিকে এগিয়ে গেল।
কিরে অভিমন্যু কাম চেয়েছিলি, কাম দিলাম। করছিস না কেন? এতটা পথ ফিরে যেতে হবে।
অভিমন্যু আমার দিকে তাকিয়ে কোনও কথা বলছে না।
তুমকো সমাঝনা বহুত মুস্কিল কা বাত। আলতাফ বলে উঠল।
আমি হাসলাম।
চিকনা।
বল।
এদের মাথার ঘুরঘুরে পোকা নরে গেছে। থামতে একটু সময় লাগবে।
বিনদ বুক থেকে মুখ তুললো। হাতের তালু দিয়ে চোখ মুছছে।
যা পুকুরে গিয়ে চোখে মুখে জল দিয়ে আয়।
বড়োমার মুখের দিকে তাকালাম। চোখ নামিয়ে নিল।
এতক্ষণ ফাদার চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। পায়ে পায়ে গাছের তলায় এগিয়ে গিয়ে মোমবাতি ধূপকাঠি জালিয়ে আমার কাছে এসে দাঁড়াল।
ফাদারের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
ভীষণভাবে গডকে অনুভব করছি বুঝলি অনি। একঝলক তাঁকে চোখেও দেখলাম।
আমি ফাদারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। চোখে মুখে অদ্ভূত প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়েছে।
সত্যি এখানে কিছুক্ষণ বসে থাকলে অশান্ত মন শান্ত হয়ে যাবে।
ফাদারের হাত দুটো চেপে ধরলাম। বুকের কাছে ক্রশটা চাঁদের আলোয় চক চক করছে।
চলো ওখানে গিয়ে সবাই একটু বসি।
চল।
ফাদারের হাত ধরে এগিয়ে এলাম।
মীরচাচা আধো অন্ধকারে একলা দাঁড়িয়ে কাঁধের গামছা দিয়ে চোখ মুছছে।
কাছে এসে থমকে দাঁড়ালাম।
আমাকে দাঁড়াতে দেখে মীরচাচা শব্দ করে কেঁদে উঠলো।
কেঁদে কি করবে চাচা।
চাচী এখনো বাঁইচে আছে। জানে নি।
আমি তোমাদের ওখানকার কাউকে সেইভাবে চিনি না। তুমি তো জানো। আয়েষা আমাদের সঙ্গে পড়তো। চিকনা আমি বাসু….।
বাসু বলছে।
কি করবো চাচা। মনাকাকাকেও দোষ দিতে পারি না। তখনকার সমাজ এখনকার সমাজের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য।
অর্জুনকে একবারটি মোর দুয়ারে লিয়ে যাব। মোর বংশের খুন।
নিয়ে যেও।
তুই মোর বংশের খুনকে এতদিন আইগলে রাখছু।
আয়েষা আমাকে বিশ্বাস করেছিল। হয়তো ভেবেছিল তার বাল্য বন্ধু এই কাজটুকু দায়িত্ব নিয়ে করতে পারবে।
তোর ঋণ মোর বংশ কুনদিন শোধ করতে পারবে নি।
এটা তোমার অভিমানের কথা।
তুই বিশ্বাস কর অনি। তুকে জম্মাতে দেখছি। মীরচাচা আমার হাতদুটো ধরে ফেললো।
চাচীকে এখন কিছু বলো না।
ফকির চলিইছে।
কেন তোমরা এরকম করো।
তুই বল, মনকে লেয়।
কিছু বললাম না।
বড়োমারা সবাই ঘাসের বিছানার ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে গোল হয়ে বসেছে। চাঁদের আলো চারদিকে থিক থিক করছে। আলোছায়া মাখা এক মোহময়ী পরিবেশ।
ডাক্তারদাদা, দাদা, অনিমেষদা, বিধানদা, শুভরদাদু, মল্লিকদা কাউকে দেখতে পেলাম না।
বড়োমা, দাদারা কোথায়?
তোর স্কুলের মাঠে ঘুরছে।
কেন?
তোর এরকম গল্প শুনলে কার মন ভাল থাকে।
বিশ্বাস করো আমি বলতে চাই নি। বলা হয়েগেল। নিজের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ ছিলাম।
কই এতদিন বলিস নি।
কত বলবো তোমাদের।
জানিনা আয়েষার মুখটা চিকনা বাসুর মনে আছে কিনা। ওদের জিজ্ঞাসা করো, আমি একটুও মিথ্যে বলি নি। সত্যিতো ও হারিয়ে গেছিল। আমিই বা তাকে খুঁজে পেলাম কেন?
এই বিশাল পৃথিবীতে তাকে খুঁজে পাওয়া সহজ কাজ নয়।
যখন তাকে দেখলাম তখন অনিসা অনন্য পৃথিবীর আলো দেখে ফেলেছে। সময়টা কম নয়।
অদ্ভূত ব্যাপার কি জান, আমি আয়েষাকে চিনতে পারি নি। আয়েষা চিনতে পেরেছিল।
আমার অনেক কাজের সাক্ষী আয়েষা। হয়তো সেই জন্য ওকে পৃথিবী থেকে খুব তাড়াতাড়ি চলে যেতে হল। তাও ওর সহপাঠীর হাতে।
সেটাও আমার জীবনের আর এক অধ্যায়।
বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
আমি থামলাম।
ম্যাডাম এগুলো কোথায় রাখবো।
তাকালাম। পচা, পাঁচু একটা ঝুড়ি আর বড়ো কেটলি নিয়ে এসেছে।
মিত্রা-তনু এগিয়ে গেল।
পক্কে, ঘণ্টারা একটু দূরে দাঁড়িয়ে। আধো অন্ধকারেও ভিকি, বাসন্তীর মুখটা দেখতে পেলাম। কেমন যেন থম থমে। কবিতা দামিনীমাসির পাশে।
পক্কে। মিত্রার গলা পেলাম।
বলো।
একবার দাদাইদের ডেকে আন। কনিষ্ক মামারা পুকুরের ওপারে আছে ওদের একবার ডাক।
পক্কে হন হন করে হেঁটে চলে গেল।
বড়োমা। মিত্রা আবার ডাকল।
বল।
এখন দিই।
তোর দাদারা আসুক।
ফলের ঝুড়ি বাড়িতে নিয়ে যাবে।
হ্যাঁ।
ছোটোমা।
বল।
একবার এদিকে এসো।
যা যা বলেছিলি সব নিয়ে এসেছে।
হ্যাঁ।
কিসে দিবি।
শালপাতার ঠোঙা বানিয়ে নিয়ে এসেছে।
দিতে আরম্ভ কর।
তুমি একবার এসো না।
ছোটোমা উঠে ওদের কাছে গেল। নিজেদের মধ্যে কি কথা বলছে এখান থেকে শোনা যাচ্ছে না।
দাদারা পুকুরের ওপার থেকে ধীর পায়ে এগিয়ে এল। ছোটোমাদের কাছে থামলো।
ছোটো গলা শুকিয়ে গেছে।
বসুন গিয়ে দিচ্ছি।
অনি কোথায়?
ওখানে আছে।
ওর কাজ শেষ হয়েছে।
হ্যাঁ।
দাদা কাছে এগিয়ে এলো।
পেছন পেছন ডাক্তারদাদা, বিধানদা, অনিমেষদা তার পেছনে মল্লিকদা, শুভরদাদু।
দাদা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে পিঠে গোটা কয় চাপ্পর মারলো।
জব্বর গল্প বলেছিস। ডাক্তার শুনে কেঁদে ফেললো। ও যে এরকম শিশুর মতো কাঁদতে পারে ভাবি নি। ওকে সামলাতে সবাই মিলে একটু মাঠের দিকে গেলাম।
আমি দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে। দাদা আমার দু-কাঁধে হাত রেখেছে।
আমারও একটু মনটা খারাপ হয়েছিল।
ডাক্তারদাদা কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার দিকে তাকিয়ে হাসল।
আমি ডাক্তারদাদার মুখের দিকে তাকিয়ে।
কি জানি, কেন মনটা খারাপ হলো। এসব তো বিশ্বাস করি না। আজ কেন জানি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করলো। তুই গল্পটা বলার পর কেন জানি না মেয়েটাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল।
ডাক্তারদাদার গলাটা কেমন ধরা ধরা।
ওই বয়সের ছবি আমার চোখে আঁকা রয়েছে। চিকনা বাসু মনে করতে চাইলে, হয়তো মনে পরতে পারে। একটু বেশি বয়সের ছবি অর্জুনের কাছে আছে। আমার সঙ্গেও আয়েষার অনেক ছবি অর্জুনের কাছে আছে।
মিত্রা শালপাতার ঠোঙায় করে মিষ্টি নিয়ে এসে দাঁড়াল।
একটা দাদার হাতে তুলে দিল, আর একটা ডাক্তারদাদার হাতে।
আমরা দুজন?
ট্রে নেই তাই হাতে হাতে দিচ্ছি।
কবিতা, সুরো, মিলি, টিনারা সবাই ওখানে জরো হয়েছে। হাতে হাতে কাজ করতে শুরু করেছে।
দেখলাম ছানার জিলিপি। নিশ্চই পড়্যা ঘরের বুড়োর কাছ থেকে নিয়ে এসেছে।
চপ, দেব এক থাপ্পর। মাম্পি চেঁচিয়ে উঠলো।
হো হো করে হাসির শব্দ ভেসে এলো।
পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম নেপলারা ভিড় করে ওখানে দাঁড়িয়ে। সকলেই ঢেউ তুলে হাসছে।
মাম্পি কোমরে হাত দিয়ে ওদের দিকে কট কট করে তাকিয়ে আছে।
সত্যি কি দস্যি মেয়েরে বাবা। ও মিলি। বড়োমা চেঁচিয়ে উঠলো।
মিলি মিত্রাদের কাছে ছিল। ওখান থেকেই চেঁচাল।
বলো।
দেখ তোর মেয়ে কাকে থাপ্পর মারছে।
যা পারে করুক।
সুরো।
বলো।
যা না মা একটু।
পারবো না।
তখনো পেছন থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসছে।
দেখবি, আঙ্কেলকে বলবো।
অর্জুন মনে হয় গাল টিপে দিল। মাম্পি আরও খেপে গেল।
ওখান থেকেই চেঁচাল, আঙ্কেল।
রতন। আমি চেঁচালাম।
ওরা তখনো হেসে চলেছে।
মাম্পি, মিকি ফাঁক পেয়ে ছুট লাগাল। পেছনে বাবান, পিপটু।
ধর তো।
হাসি থেমে নেই।
আঙ্কেলকে ধরে নিয়ে যাব দাঁড়া। বিনদ চেঁচাল।
ওরা ছুটে চলে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে।
বকো তো। বাবান বললো।
কি হয়েছে বলবি তো।
দিদি….বাবানের ছোট্ট বুকটা ওঠা নামা করছে….সাদি।
নেপলারা ওখান থেকেই তারস্বরে সকলে হেসে উঠলো।
সেটা আবার কি।
মাম্পি তখনো ফুঁসছে।
কি হয়েছে রে মাম্পি।
তুমি আগে মার।
কাকে মারবো বল।
দাড়ি লোকটাকে।
নেপলারা হাসতে হাসতে এগিয়ে এসেছে।
কি করেছে বল।
মাম্পি কোন কথা বলছে না।
অর্জুন কাছে এগিয়ে আসতেই মাম্পি আবার চেঁচিয়ে উঠলো।
চপ।
আঙ্কেল তো।
দুষ্টু।
না ওরা ভাল। তোকে ক্যান্ডি দেবে।
না।
কেন তোরা ওকে ওরকম করিস। ভালো মেয়ে। আমি অর্জুনের দিকে তাকালাম।
মাম্পি আঙ্কেলকো বোল দুঁ। অর্জুন বললো।
নেহি। পিপটু চেঁচিয়ে উঠলো।
মিলি নেপলাদের হাতে হাতে শালপাতার ঠোঙা ধরাচ্ছে।
নেপলা হাসতে হাসতে মিলিকে বললো, কি তেজ গো।
অনিদা লায় দিয়ে আরও বাড়িয়েছে। একটু আধটু পেটাপিটি না করলে চলে।
আমি একবার মিলির দিকে তাকালাম।
মিকি কি হয়েছে রে। মাম্পির প্যান্টু খুলে দিয়েছে।
মাম্পি কট কট করে আমার মুখের দিকে তাকাল। অন্য কেউ হলে বলতো এক থাপ্পর।
কথাটা মাম্পি বেশ ভাল শিখেছে।
মিকি ঘার দোলাল। না।
তাহলে।
মাম্পিকে বিয়ে দেবে বলেছে।
কার সঙ্গে!
আমার সঙ্গে।
সেই জন্য মাম্পি রেগে গেছে।
মিকি মাথা দোলাচ্ছে।
তুই কি বললি।
মাম্পি আমার বন্ধু।
ঠিক।
কেউ আর মুখ বুঁজে নেই। সকলে হো হো করে হাসছে।
আঙ্কেল আঙ্কেল আমার প্যান্টু খুলে দিয়েছে। বাবান আমার হাতটা নাড়িয়ে বলে উঠলো।
হাত দিয়েছে নাকি।
বাবান মাথা দোলাল। হ্যাঁ।
কে?
আঙুল তুললো অর্জুনের দিকে।
ওরা সকলে হেসেই যায়। অর্জুনের দিকে তাকালাম। গাল টোপলা হয়ে আছে। বললাম, বিষম লাগবে। আসতে হাস।
আবার বাবানের দিকে তাকালাম।
নিয়ে নেয় নি তো?
বাবান মাথা দোলাচ্ছে, না।
অনিদা তুমি থামবে। মিলি হাসতে হাসতে বলে উঠলো।
মিষ্টি দাও। মুখ বন্ধ করি।
মাম্পির দিকে তাকালাম।
মিষ্টি খাবি।
মাথা দোলাল খাবে।
ওদিকে না নেই। মিলি বলে উঠলো।
কেন না বলবে। নিজেরটাও খাবে আঙ্কেলেরটায় ভাগ বসাবে। নেপলা বললো।
যা দিদানের কাছে যা।
আমার হাত ছারলো না। বুঝলাম যাওয়ার ইচ্ছে নেই।
বাধ্য হয়ে আমি বসে পরলাম।
ওরা চারজনে এঁটুলে পোকার মতো জড়িয়ে রইলো।
বেশ কিছুক্ষণ ওখানে হই হই করে সবাই বেরিয়ে পরলাম। গেটের মুখটায় দাঁড়িয়ে একবার অশ্বত্থ তলার দিকে তাকালাম। তখনো কয়েকটা মোমবাতি ধিকি ধিকি জলছে। আধো অন্ধকারে গাছের গোড়ার সাদা ফুলগুলো ঝক ঝক করছে।
ছোটোমা আমার কাছ থেকে মাম্পিদের টেনে নিয়ে গেছে।
একটা ট্রলিতে দেখলাম মিত্রা, তনু, ইসি, নয়না বসেছে।
চাঁদনী রাতে ট্রলিতে করে আসতে বেশ ভাল লাগছিল। ঝিরঝিরে বাতাস বইছে। অনিসাদের ট্রলি থেকে গানের কলি ভেসে আসছে। লম্বা করে মাঠের মাঝখান দিয়ে পর পর ট্রলি চলেছে।
যে কটা মটর বাইক এসেছিল সব আগে আগে চলে গেছে।
আমার ট্রলিতে অর্জুন, বিনদ, নেপলা।
নেপলা তুই এখানে কতবার এসেছিস। বিনদ বললো।
গুনি নি।
অর্জুন হাসছে।
বাচ্চের বাড়িটা দেখাবি।
এখন আর নেই। কয়েকটা মাটির দেওয়াল দাঁড়িয়ে রয়েছে।
ওইটুকু দেখবো।
কাল সক্কাল সক্কাল বেরবার কথা। কখন দেখবি।
আজ রাতে।
চল চিকনাদাকে বলি।
কেন।
মানুষের ভয় নেই। শেয়াল-টেয়াল আছে।
দাদাকো ঘর মে বাত্তি নেহি।
বাত্তি হ্যায় পাওয়ার নেহি। জেনারেটর হ্যায়। পিছে দেখ।
অর্জুন, বিনদ তাকাল। অনেকক্ষণ স্কুল বাড়িটার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
পীরসাহেবের থান এই চাঁদনী রাতে আবঝা দেখা যাচ্ছে। তার তলায় মোমবাতির আলো আর দেখা যাচ্ছে না। চাঁদনী রাতে ঘন সবুজের রং কেমন বদলে গেছে।
বহুত খুবসুরত লাগতা হ্যায়।
আবার নিস্তব্ধতা। ট্রলির চাকার ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ।
বাঁধে বাঁধেই আমরা চলে এলাম বাজার। সবাই ট্রলি থেকে নামলো।
আমি বাসুর দোকানে গিয়ে বসলাম।
কুলাসনীর শিবকে সবাই প্রণাম করলো।
এখন আমাকে বিশেষ গাইড করতে হয় না। তনু-মিত্রাই বেস্ট গাইড। অপিরিচিতদের পরিচিত করার দায়িত্ব ওরাই নিয়েছে। চিকনা এলো।
বড়োমারা চলে যাক, আমরা একটু পরে যাব।
তাহলে একটু চায়ের ব্যবস্থা কর।
এখন সব বন্ধ লতাকে বলি।
ওবাড়িতে যায় নি?
ঠিক বলেছিস। মাথায় ছিল না। দাঁড়া দেখি কানাইদা খুলে রেখেছে কিনা।
দেখ।
চিকনা চলে গেল।
আমি একা বসে আছি। টিম টিম করে লাইট জলছে। লো ভল্টেজ।
একটা সময় সন্ধ্যের পর কুলাসনীতে লোক আসতে ভয় পেত। একদিকে মরাচীর (গ্রামের ভাষায় শ্মশানকে মরাচীর বলে) আর একদিক বুরো শিব। সপ্তাহে একদিন হাট বসতো। সোমবার। সেই দিনই এখানে যা একটু লোকজন হতো। তাও সন্ধ্যে হয়ে আসার আগেই সব শুন শান। শশী জানা প্রথমে এখানে একটা ভুসিমালের (গ্রামের ঘরে মুদি খানার দোকানকে ভুসিমালের দোকান বলে) দোকান করে। তারপর মাইতি ঘরের ছেলেটা একটা ওষুধের দোকান করে। সেই সময় এই তল্লাটে ওষুধের দোকান ছিল না।
মাইতি ঘরের ঝন্টু টাউনে এক ডাক্তারের কাছে বেশ কয়েক বছর ছিল। তারপর সে নিজেই কোয়াক ডাক্তার বনেগেল। এখানেই কানা সামন্ত ডিসপেনসারি করেছিল।
তৃতীয় দোকানটা বাসুর। তাও আমি যখন টুয়েলভ পাস করলাম তার পর বাসু দোকানটা করেছে। তারপর এখানে এসেছি ঠিক কিন্তু কয়েক ঘণ্টার জন্য। আবার কলকাতা ফিরে গেছি। তখন আমার জীবনে টালমাটাল অবস্থা। নিজেরই অস্তিত্ব বিপন্ন।
কিরে এখানে ভূতের মতো একা একা বসে আছিস।
বাইরের দিকে তাকালাম।
মিত্রা, তনু, ইসি, নয়না দোকানের বাইরেটায় দাঁড়িয়ে।
বড়োমা আর খোঁজা খুঁজি করতে হবে না। বুবুন বাসুর দোকানে। মিত্রা চেঁচাল।
চারজনেই ভেতরে চলে এলো।
বাড়ি যাবি না?
তোদের পূজো দেওয়া হলো।
বড়োমার কি আর শেষ আছে। সকলকে ধরে ধরে ঘার হেঁট করাল।
অনিমেষদা, বৌদি?
অনিমেষদা ওপরে যায় নি। বৌদি দেয়ালে মাথা ঠুকেছে।
তুই কিছু বলিস নি।
দিদিভাই বলেছে, বললো নাতির হয়ে মাথা ঠুকলাম।
তনু ম্যাডাম ওইভাবে তাকিয়ে আছো কেন।
দিদিকে তুমি আয়েষার জায়গাটা দেখাও নি?
হাসলাম।
হাসলে যে।
ওটা একটা গল্প।
তোমার জীবনে কোনটা গল্প কোনটা বাস্তব এবার তাই নিয়ে রিসার্চ করতে হবে।
করতে পার, হয়তো নতুন কিছু মিলে যেতে পারে।
একটা ছেলে চায়ের গ্লাস নিয়ে ভেতরে এলো। আমাদের দেখে একটু অবাক।
চিকনাদা বললো, এখানে একটা চা দিতে, কি হবে?
মিত্রা তাকাল ছেলেটার দিকে। হাসছে।
আর চারটে নিয়ে আয়।
ছেলেটা চায়ের গ্লাসটা রেখে বেরিয়ে গেল।
আয়েষার বাড়িটা আশাপুরা স্কুলের কোনদিকে?
মিত্রার দিকে তাকালাম।
পশ্চিম পাশে।
আশাপুরা, কানপুর, বম্বে জটটা একটু ছাড়িয়ে দিস।
চা খা।
ওটা তোর। আমাদের জন্য আনতে গেছে।
চিকনা, বাসু ঢুকলো।
পেছনে সেই ছেলেটি। একটি এ্যালমনিয়ামের ডিসের ওপর চারটে চায়ের কাপ।
কিরে চা তো ঠান্ডা হয়ে গেল। চিকনা বললো।
এই তো এবার খাব। তোদের কোথায়?
খেয়ে এলাম।
চায়ের গ্লাসে চুমুক দিলাম।
বড়োমাদের পাঠিয়ে দিলাম।
মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
তোমাদের বসার জায়গা নেই। বাসু বললো।
হ্যাঁ।
তাহলে দাঁড়িয়ে আছ।
বাসু হাসলো।
ভেবেছিলাম তোমার দোকানে উঁকি মেরে চলে যাব। দেখলাম ও বসে আছে। মিত্রা বললো।
আজ অনেকদিন পর অনি আমাদের এক স্কুলের বান্ধবীর কথা মনে করিয়ে দিল। আয়েষা নামে আমাদের যে এক বান্ধবী ছিল সত্যি ভুলেই গেছিলাম।
তোমরা মনে করতে পার।
কেন পারবো না। কত খেলেছি একসঙ্গে।
কই এতদিন বলো নি।
সেইভাবে কোনদিন মনে দাগ কাটে নি। দেখলে না, মীরচাচার আত্মীয়, মীরচাচাই অবাক হয়েগেছে। আমরা সকলে জানতাম আয়েষা মরে গেছে।
অর্জুন ওর ছেলে এটা বিশ্বাস করো!
প্রথমটা গল্প মনে হয়েছিল, এখন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। মীরচাচার চাচীকে দেখলে? বাসু বললো।
কোথায়?
অর্জুনকে নিয়ে গেল।
তারমানে আয়েষা মীরচাচার বোন!
সম্পর্কে বোন হয়।
ওরা এত দিন খোঁজ খবর করে নি।
প্রথম প্রথম করেছিল। ইউপিতে না কোথায় বিয়ে দিয়েছিল। ওদেরই দূর সম্পর্কীয় এক আত্মীয়ের সঙ্গে। সে কত কাল আগের কথা বলোতো।
চায়ের গ্লাসটা নিঃশেষ করে বাসুর কাছে একটা সিগারেট চাইলাম। বাসু প্যাকেটটা এগিয়ে দিল।
ওই বকুল গাছটা এখন নেই বুঝলে ম্যাডাম।
কেন! আমি দেখেছি। বুবুন দেখিয়েছে।
ছিল। এই তো কয়েকদিন আগে জায়গাটা মাপ জোক করে একজন কিনেছে। স্কুলের ঠিক পেছনেই ঘর করেছে। বকুল গাছটা কেটে দিয়েছে।
তাই!
হ্যাঁ।
মিত্রা বাসুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
আগে জানলে জায়গাটা আমরাই কিনে নিতাম। অন্ততঃ বকুলগাছটা কাটা পরতো না। আমরাও সেই সময় অনেক বকুল বাঁশি বাজিয়েছি।
বাসু চিকনাকে একটা সিগারেট দিয়ে নিজে ধরাল।
মাঝে মাঝে অনির মতো আমারও এখন সেই সময়কার কথা মনে পরে। সব মনে করতে পারি না। কেমন যেন গুলিয়ে যায়।
তোমার স্মৃতির ক্যামেরায় ফাংগাস পরে গেছে। বুবুনের পরে নি। ও তো রেগুলার পরিষ্কার করে।
বাসু মিত্রার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকাল।
খুব সুন্দর কথা বললে।
তোমার বন্ধুর ছোঁয়া লেগেছে।
বাসু হেসে ফেললো।
তবু তুমি দু-একটা কথা বলো। চিকনাকে দেখ। মুখে সব সময় গুরুমা গুরুমা করে চলেছে। যেই কিছু জিজ্ঞাসা করবো। বলবে মনে করি দাঁড়াও। তারপর বলছি। এ জন্মে ওর আর মনে পরে না।
চিকনা ফিক ফিক করে হাসছে।
কেন আমি তোমাকে বলি না।
বলো, পেটে আশিভাগ রেখে মুখে কুড়িভাগ বলো।
বলি তো।
গুরুর মতো ধরি জল না ছুঁই পানি।
চিকনা শরীরে ঢেউ তুলে হাসছে। আমার দিকে তাকাল।
তুই কিছু বল।
তোর গুরুমার সঙ্গে তোর কথা হচ্ছে, আমি এর মধ্যে মাথা গলাব কেন।
মাথা থাকলে তো গলাবি। মিত্রা বললো।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। হাতের সিগারেটটা একটু সামনের দিকে এগিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম।
এবার চল, ট্রলি যারা চালাচ্ছে তাদেরও ঘর সংসার আছে।
ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। মিত্রা বললো।
এতোটা পথ অন্ধকারে হাঁটতে পারবি?
কেন আগে তোর সঙ্গে হাঁটি নি।
ঠিক আছে রাতে সময় দেব, ঘুমবো না।
তনু, ইসি শরীরে ঢেউ তুলে জোরে হেসে উঠলো। নয়না মুখ নীচু করে হাসছে।
আমি মিত্রার দিকে তাকিয়ে।
এই কথাটা আদায় করার জন্য এতটা ভাঁজা ভাঁজি করছিলি তাই তো?
মিত্রা গম্ভীর, তবু না হেসে পারছে না। চোখ দুটো চক চক করছে।
বাসু চিকনা হেসেই চলেছে।
ছুটকি তুই ওর সঙ্গে পারবি না।
মিত্রা ইসির দিকে তাকাল।
আয় উঠে আয়। অনেক ঘটনা ঘটেছে। গল্পের গরু এবার গাছে উঠে যাবে। আমি বললাম।
তার জন্য দায়ী তুই নিজে।
অস্বীকার করেছি।
তাহলে বলছিস কেন।
আমি বাইরে এসে দাঁড়ালাম। একে একে ওরা সবাই বেরিয়ে এলো। বাসু দোকান বন্ধ করলো।
বাজার এখন শুনশান। ব্যাঙ্কের ভেতরে মনে হয় কেউ আছে। ওপরের ঘরে লাইট জলছে।
চিকনা ব্যাঙ্কে কে আছে?
কেউ নেই।
তাহলে ওপরের ঘরে লাইট জলছে।
গ্রামের তিনজন রাতে থাকে।
পাহারাদার।
হ্যাঁ।
বাজারে কেউ থাকে না।
পালা করে থাকে।
আগে ভূতের ভয়ে এখানে কেউ আসতো না। এখন চোরের ভয়ে পাহারাদার?
কি করবো বল।
ঠিক। ভূত যাতে বংশ বৃদ্ধি করতে পারে তার ব্যবস্থা কর।
ইসিরা আবার হেসে উঠলো।
আমরা ধীর পায়ে বাজার থেকে বেরিয়ে এলাম। নদী বাঁধ ধরে হাঁটছি।
চাঁদের আলো গাছ গাছালির ফাঁক দিয়ে রাস্তায় এসে লুটোপুটি খাচ্ছে। ইসিরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। আমি বাসু চিকনা সামনে। সধন বাঁকুড়ার ঘর পেরতেই দুটো ছায়ামূর্তি পথ আগলে দাঁড়াল। চিকনা বাসু দুজনেই হেসে উঠলো। সম্বিত ফিরতে দেখলাম ছুরকি। পাশে একটা মেয়ে।
এতক্ষণে একা ধরতে পেরেছে। চিকনা বলে উঠলো।
চিকনার মুখের দিকে তাকালাম।
অনেকক্ষণ তোকে ধরার চেষ্টা করছে। এতো ভেজাল নিজের কথা বলে কি করে বল।
ছুরকির মুখের দিকে তাকালাম।
ওখানে যাস নি?
গেছলি।
কই দেখলাম না।
ফাঁকে ফাঁকে ছিলি।
মিত্রারা হাসাহাসি করছে।
মামনি হাসবনি।
কেনি হাসবনি। তনুরা মিত্রার কথা শুনে আরও জোরে হেসে উঠলো।
ছুরকি মেয়েটা মুখ নীচু করে ফিক ফিক করে হাসছে।
চিনতে পারিস। চিকনা আমার দিকে তাকাল।
আমার চোখ মুখ বলছে না।
চিকনা আকা তুমি কইবনি।
না কইলে তোর অনি আকা কইবে তার বাপকে গুবনে দেখছে। সেই তেরশ্যাম বছর। তুই তার মেয়েকে ধরছু।
বাসু খুব জোর হেসে উঠলো।
চিকনা আমার মুখের দিকে তাকিয়েছে।
অধর জ্যেঠুর নাতনি।
খগনার মেয়ে!
হ্যাঁ।
খগনা বিয়ে করল কবে?
এই তুই শুরু করে দিলি।
দেখে তো ওর বয়স খারাপ বলে মনে হচ্ছে না।
ওর আঠার ওর বাপের আটত্রিশ।
ছুরকি, মেয়েটা ততক্ষণে আমার পা ছুঁয়ে ফেলেছে।
করেছিস কি ছুরকি! তোর মা তো আমাকে ঝাঁটা পেটা করবে।
সেদিক থেকে ছুরকি সব ফিটিং ফাটাং করে নিয়েছে। চিকনা বলছে আর হেসে যাচ্ছে।
এদিকে?
খগনা প্রথমে রাজি হয় নি। তারপর বোঝালাম তোর মেয়েতো গ্রাম ছেড়ে ভালপাহাড়ে যাবে না। তোর অসুবিধে কোথায়। গ্রামের ব্যাপারটা আমরা বুঝে নেব। তখন খগনা রাজি হয়েছে।
ওতো ইঁদুর পুরা পান্তা খায় না।
ছুড়কি খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। অনেক কন্ডিসন আছে তোকে পরে বলবো।
বাবাঃ এতো?
অনিআকার ভূত ভেতরে আছে না।
এই সেদিন ঘুরে এলাম। শ্যাম আমাকে কিছু বললো না। চূড়াও কিছু বলে নি।
বলবে কি তুই যদি গাল দিউ।
আমরা কথা বলি ওরা দুজন মুখ নীচু করে হাসে।
কাল যাবি তো আমাদের সঙ্গে।
হ।
এটাকে সঙ্গে নিবি।
লিব।
নিয়ে চল মোড়লের সঙ্গে কথা বলি।
আমি কইছি।
কি বললো।
তুমি যা মত দিব।
আমি আর কি মত দেব। রাত দুপুরে আমাকে ঘিরে ধরলি। না মত দিলে পিটা পিটি করবি। তার থেকে মত দেওয়াই ভাল।
মিত্রারা হেসেই যায়। ওদের দিকে তাকালাম।
তোরা জানতিস।
শুনেছিলাম। চূড়া ওখানে যেতে বলেছিল। আজ পীরবাবার থানে ছুরকি দেখাল।
মোমবাতি জেলেছে।
হ্যাঁ।
কই আমার চোখে পরলো না।
তুই তখন ঘোরে ছিলি।
খাওয়া দাওয়া কোথায় করবি ওর দরে না আমার দরে।
তুমার ঔঠি।
যা ওকে ছেড়ে দিয়ে আয়।
ওরা বাঁধ থেকে নেমে মদন প্রামানিকের ঘরের পেছন দিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়েগেল।
আমরা আবার হাঁটতে শুরু করলাম।
চিকনা।
বল।
এখানে এরকম ঘটনা ঘটলে খগনাকে সমাজ এক ঘরে করে দেবে না?
ছুরকির আগেও দু-চারটে এরকম ঘটনা ঘটেছে। চেষ্টা যে হয় নি তা নয়। আমি বাসু রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। দেখলাম মীরচাচাকেও সঙ্গে পেলাম। আস্তে আস্তে সমাজটা ভাঙছে। কিছুটা বদলে যাচ্ছে।
চিকনার কথাটা শুনে ভীষণ ভাল লাগছে।
আধুনিক হচ্ছে।
হ্যাঁ।
আমি চিকনার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
তোর আমার সময়ে এন্টারটেনমেন্ট বলতে আমরা বন্ধুরা মিলে চকে যেতাম বাস দেখতে। সপ্তাহের ওই একটা দিন আমাদের কাছে অনেক কিছু ছিল। এখন ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, টিভি। যাদের ঘরে এখনো বিদ্যুৎ পৌঁছয় নি তারা সোলার লাইট জালছে। আমরা অনেকটা এগিয়েছি।
চিকনা থামল আমরা নিস্তব্ধে পথ চলেছি।
ব্যাড এফেক্ট কিছু নেই যদি বলি তাহলে ভুল। আছে। আগে দু-একটা হাতে গোনা ভানু কালীচরণের ঝি ছিল। এখন আকছার এ ঘটনা ঘটছে। সময় বুঝে একটু পিটাপিটি করে দিলাম। কিছুদিন থামাথামি। বেশি বেয়াদপি করলে ধরে বিয়ে দিয়ে দিলাম। কত সামলাই বল।
পায়ে পায়ে খামারে চলে এসেছি। চারদিক অন্ধকার। শুধু এই তিনটে বাড়িতে আলো জলছে।
খামার থেকেই আমি নিজের ঘরের দিকে পা বারালাম। মিত্রা হাতটা ধরে ফেললো।
কোথায় যাচ্ছিস।
জামাকাপরটা ছাড়ি।
শোয়ার সময় ছাড়িস।
ওর মুখের দিকে তাকালাম। বারান্দার দিকে চোখ চলেগেল।
অনিমেষদা, বিধানদা, ডাক্তারদাদারা সব বসে আছে। বড়োমা, ছোটোমারও গলা পেলাম।
কেউ বাদ নেই। জোর মজলিস চলছে।
একবার দেখা করে এ বাড়ি চলে আসিস।
চল।
তোরা যা আমি একটু পেছন পাশটা দেখে আসি। চিকনা বললো।
কেন।
রান্নাবান্না চলছে।
বাসু, চিকনা দুজনেই চলে গেল।
খামার পেরিয়ে বারান্দায় এলাম।
অনিমেষদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।
বড়োমা, ছোটোমা, আন্টি, জ্যেঠিমনি, বৌদি বেঞ্চে বসে। আরোও সবাই আছে। চেষ্টা করলে চেপে চুপে একটা জায়গা হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আন্টি জ্যেঠিমনির মঝখানে নিজেকে গুঁজে দিলাম।
অনিমেষদা তখনো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
বুঝলাম মিত্রার সঙ্গে চোখে চোখে কথা হলো।
মাসীমনি চেয়ারে বসে। আমার মুখ থেকে চোখ সরায় নি।
তোরা কি এখন বাজার থেকে আসছিস? অনিমেষদা মিত্রার দিকে তাকাল।
হ্যাঁ। আর একটু আগে আসতাম। ছুরকি রাস্তায় ধরলো।
ওটাকে যেন ওখানে দেখলাম মনে হলো।
মিত্রা হাসছে।
আজকে সব গণ পার্মিসন পেল। তনু বললো।
মিত্রারা হাসছে।
ছোট, বড়ো দাদাদের দেখলি? অনিমেষদা বললো।
মিত্রা মাথা দোলাচ্ছে, না।
দেখ তারা আবার কোথায় ঘোঁট পাকাচ্ছে। মাঝে হঠাৎ দপ করে জলে উঠেছিল। ভাগ্যিস ঠান্ডা হয়েগেল।
মীরচাচা অর্জুনকে নিয়ে গেছে।
সে খবরটা পেয়েছি।
নীপাকে বল একটু চা খাওয়াতে। মিত্রার দিকে তাকালাম।
কেন তুই বলতে পারছিস না।
চুপ করে গেলাম।
প্রবীর তোকে খুঁজছে। অনিমেষদা আমার দিকে তাকাল।
আমার ফোন খোলা আছে।
অনুপ।
বলুন।
তোমার ফোন থেকে প্রবীরকে একটা ফোন করো। বলো অনি ফিরে এসেছে। ফোন করতে বলছে।
তোর ফোনটা দে। মিত্রা হাত বাড়াল।
কেন।
প্রবীরদাকে ফোন করি।
তোর ঘটে যদি বুদ্ধি থাকতো তাহলে চাইতিস না।
অনিমেষদা জোরে হেসে উঠলো।
বিধানদা, মাসীমনিও হাসছে।
মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে।
ওই জন্য তোকে বার বার বলি। ওর ঘটে যদি বুদ্ধি থাকতো, সংসারটা লাটে উঠে যেত। নেই বলে বাঁচোয়া। তবু একটু চা, জল পাচ্ছি। অনিমেষদা বললো।
(আবার আগামীকাল)