২২৫ নং কিস্তি
দেশলাই কাঠি দিয়ে তিনটে মোমবাতি জাললাম। একটা তনুর হাতে একটা মিত্রার হাতে দিলাম। তনু একটা ধূপের প্যাকেট খুলে তার থেকে ধূপ বার করলো।
অদ্ভূত এই মুহূর্তে কিন্তু একটুও বাতাস বইছে না। মোমবাতির শিখাও কাঁপছে না। কেমন যেন স্থির।
মোমবাতির শিখায় ধূপ জালালাম।
গাছের তলাটা সামান্য অন্ধকার।
মোমবাতির মৃদু আলোয় মিত্রা তনুর চোখদুটো অসম্ভব উজ্জ্বল লাগছে।
ওখানে রাখ। ধূপগুলো মাটিতে পুঁতে দে। মিত্রার দিকে তাকালাম।
সম্মোহনের মতো ওরা আমার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলো।
আয় তিনজনে একসঙ্গে প্রণাম করি।
ওরা আঁচলটা গলায় জড়িয়ে আমার সঙ্গেই মাটিতে কপাল ছোঁয়াল।
প্রণাম করতে গিয়ে বাবার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। মায়ের মুখটাও স্পষ্ট দেখতে পেলাম। দুজনেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
অদ্ভূত এক অনুভূতি আমার শরীরে খেলা করছে।
আমি এ কি দেখছি!
জীবনে প্রথম চোখ বন্ধ করে বাবা-মার মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
মনে মনে বললাম।
মা, বাবা পীরসাহেবকে দেখেছিলেন। হয়তো তোমাকে তার গল্প বলেছিলেন। আমি পীরসাহেবকে এখনো দেখি নি। আজ এই মুহূর্তে পীরসাহেবকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি যদি অজ্ঞানত তোমাদের প্রতি কোন অন্যায় করে থাকি। তোমার সন্তান হিসেবে ক্ষমা করে দাও।
জানিনা আমাকে নিয়ে তোমাদের আশা-আকাঙ্খা পূরণ করতে পেরেছি কিনা। জানিনা তোমরা কেমন ভাবে আমাকে দেখতে চেয়েছিলে।
আমি নিজের মতো করে নিজেকে গড়ে তুলেছি মা।
আমার জীবনের সঙ্গে তনু-মিত্রাকে জড়িয়ে ফেলেছি। যেখানে তোমাদের দাহ করা হয়েছিল, সেখানে আমি নিজে গিয়ে তোমাদের কাছে সব কিছু স্বীকার করে এসেছি। ওরা যদি কোন অন্যায় করে থাকে, আমার মতো তোমার মেয়ে হিসাবে ওদের ক্ষমা করে দিও। ওরাও তো তোমার সন্তান।
তোমার আসল নকল নাতি-নাতনিরা সকলে আজ এখানে এসেছে। ওদের অনেক আদর-আব্দার। সব রাখতে পারি না মা। তুমি আমাকে পথ দেখাও।
যাঃ, আর একটা কথা তোমাকে বলতেই ভুলে যাচ্ছি।
মা, মাসীমনি এসেছে।
তোমরা একই মায়ের গর্ভজাত সন্তান। তোমার মাসীমনির শিরায়-উপশিরায় একই মায়ের রক্ত।
তোমাদের দুজনের শেষ আশ্রয় স্থলটুকু দেখে ভীষণ খুশি।
জীবনে প্রথম বোনের বাড়িতে এসেছে। মাসীমনিকে কথা দিয়েছি তোমাদের দুজনকে যেখানে দাহ করা হয়েছিল সেখানে নিয়ে যাব। বলো না মা, ভুল বলে ফেলেছি।
আমার কথা জানিয়ে মাসীমনিকে শেষ চিঠিটা তুমি লিখেছিলে।
আলমাড়িতে তোমাকে লেখা মাসিমনির একটা চিঠি থেকেই আমি আমার শেকড়ের সন্ধান পাই।
তোমার মনে আছে মা? আলমাড়িতে তুমি যে কাগজ পেতে রেখেছিলে। একবারে শেষ প্রান্তে কাগজের তলায় সেই চিঠি ছিল।
মা-বাবা দুজনে মিষ্টি করে হাসল।
তারপরেই কেমন যেন হঠাৎ একটা দমকা বাতাস বইলো। মনে হলো ঝড় উঠলো।
সবকিছু ওলট-পালট। লন্ডভন্ড। মা-বাবার হাসিহাসি মুখ দুটো কেমন অস্পষ্ট হয়ে মিলিয়ে গেল। ঝড়ের বেগে আমাকে কে যেন ঠেলে ফেলে দিল। মনে হলো একটা গাছের ডাল ভেঙে আমার মাথায় পরলো। চোখে মুখে অন্ধকার দেখলাম। চিরদিকে একটা হৈ হৈ শব্দ।
আমি সচেতন অবস্থাতেও কেমন যেন অচেতনের স্বাদ অনুভব করছি।
ভারি মজার জিনিষ।
চোখের অন্ধকার ভাবটা কিছুক্ষণের মধ্যে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়েগেল।
সম্বিত ফিরতে দেখলাম তনু-মিত্রা আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে।
চোখ-মুখ ভয়ে পাংশু।
মিত্রা তারস্বরে চেঁচাচ্ছে, বড়োমা বুবুন কেমন ভাবে তাকিয়ে আছে, কথা বলছে না।
তখনো ক্ষীণ হৈ হৈ এর শব্দ কানে বাজছে।
কারা যেন এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে।
অনেকের গলা ভেসে আসছে। কিছু শব্দ বুঝতে পারছি, কিছু বুঝতে পারছি না।
তনু চেঁচাচ্ছে। ছোটোমা শিগগির এসো অনি কথা বলছে না।
ওদের চোখে মুখে অসীম উৎকণ্ঠা। ভয়ে কাঠ হয়েগেছে।
চারিদিকে অবিরত চেনা মুখগুলো কেমন যেন অচেনা ঠেকছে।
আমার হাত পা কেমন অসাড়। ঠিক ভাবে নরতে-চরতে পারছি না।
সবার চোখে মুখে ভয়ের বাতাবরণ।
উৎকণ্ঠায় ভরা চোখমুখগুলো আমার দিকে কেমন ভাবে যেন তাকিয়ে আছে।
মাসিমনি, ছোটোমা, বড়োমা, বৌদি, জ্যেঠিমনি, সোনাআন্টি, দামিনীমাসি সবার চোখে জল।
সম্বিত ফিরে আসতেই মিত্রার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম।
জানিস মিত্রা প্রণাম করতে গিয়ে মা-বাবাকে দেখলাম। জীবনে প্রথম।
তোর কোথাও লাগে নি তো! মিত্রার চোখেমুখে বিষ্ময়।
মিত্রা আমাকে জাপ্টে ধরে আছে। কথা বলতে গিয়ে গলা কাঁপছে। চোখ ছল ছল।
না! কেন?
ওপর থেকে….।
তোরা ভয় পেয়েছিস? ওটা কিছু না। এখানে ভয়ের কিছু নেই।
গাছের তলায় চোখ চলে গেল। মোমবাতির আলো থিরি থিরি কাঁপছে। ধূপের ধোঁয়া কুন্ডলী পাকিয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে।
আমাকে ছাড়। ভয় পাচ্ছিস কেন, আমি তো আছি।
বড়োমা পাশে এসে বসলো জড়িয়ে ধরলাম। হেসে ফেললাম।
জানো বড়োমা, প্রণাম করতে গিয়ে আজ মা-বাবার মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম।
বড়োমার মুখটা কেমন দুমড়ে মুচরে গেল।
তোকে কামরায়নি। বড়োমার গলাটা ভারি ভারি।
কে কামরাবে! কেন কামরাবে?
মিত্রাদের অর্গল থেকে মুক্ত হলাম।
বড়োমা ডুকরে কেঁদে উঠলো।
বার বার আমার মাথায় হাত বোলাচ্ছে।
কাঁদছো কেন বলবে তো!
তোর মাথায় লাগে নি।
না। আমার কিছু হয় নি। প্রণাম করতে গিয়ে বাবা-মার মুখটা দেখতে পেলাম। মাকে বললাম মাসীমনিকে নিয়ে এসেছি। মা হাসলো। তারপর কেমন যেন একটা ঝড় উঠলো বুঝলে, বাবা-মার মুখটা কেমন অস্পষ্ট হয়ে গেল। চোখে মুখে অন্ধকার দেখলাম।
জ্যেঠিমনি পাশে এসে বসলো। তার পাশে ছোটোমা, মাসীমনি। দামিনীমাসি তখনো কেমন ভাবে যেন দাঁড়িয়ে আছে। চোখদুটো স্থির।
সাবাই আমার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে।
ওদের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করলাম। আবার হাঁটু মুরে বসলাম।
মিত্রার দিকে তাকালাম।
একবার অনিসা, অনিকা, নম্রতাকে ডাক।
ওরা আমার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে।
ডাক।
ওরা এখানে দাঁড়িয়ে আছে।
ভিড়ের দিকে চোখ চলে গেল। অনিসাদের মুখেও ভয়ের ছায়া। ইশারায় ডাকলাম।
আয় কাছে আয়।
ওরা তিনজনে আমার কাছে এলো।
চিকনা কোথায়?
ওইপাশে গেল। নম্রতা বললো।
আমি এখানে আছি। চিকনার গলা পেলাম।
চিকনা।
বল। চিকনার গলাটা কেমন কাঁদকাঁদ শোনাল।
এতবার এখানে একা একা এলি, রাতের পর রাত এই গাছের তলায় বসে থাকলি, এখনো ভয় পাচ্ছিস।
না।
পুকুর থেকে একটু জল নিয়ে আয়।
ফুল নিয়ে আসবো।
নিয়ে আয়।
বসির।
আমি এখানে।
মা যা তো মোমবাতি ধূপকাঠি নিয়ে আয়।
অনিসা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
আমি উঠে দাঁড়ালাম।
পায়ে পায়ে গাছের তলায় এগিয়ে গেলাম। গাছের গোড়া থেকে কিছুটা মাটি তুলে নিয়ে এলাম। গাছের তলায় পরে থাকা একটা অশ্বত্থ পাতা তুলে নিলাম।
নিজের জায়গায় এসে বসলাম।
ওরা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
চিকনা ফুলের ঝুড়ি আর একটা ঘটি করে জল নিয়ে এসেছে।
বড়োমার মুখের দিকে তাকালাম।
পূজো করবে বললে।
বড়োমা কোন কথা বললো না।
ওই মোমবাতি থেকে তোমরা মোমবাতি জালিয়ে ওখানেই রেখে দাও। ঝুড়ি থেকে একমুঠো ফুল গাছের গোড়ায় দিয়ে এসে প্রণাম করো।
ওরা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
চারিদিক নিস্তব্ধ আমি অশ্বত্থ পাতার ওপর মাটি রেখে জল দিলাম। কিছুটা কাদাগুলে মিত্রার দিকে তাকালাম।
আয়।
মিত্রা এগিয়ে এলো। ওর কপালে ফোঁটা পরিয়ে দিলাম। তনু এগিয়ে এলো তনুর কপালে লাগিয়ে দিলাম।
ওরা সবাই একে একে মোমবাতি ধূপকাঠি জেলে প্রণাম করে আমার পাশে এসে বসলো।
এতো মানুষ তবু যেন চারিদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।
বসির।
জি।
অনিকার ব্যাপারে তুই সব খোঁজ খবর নিয়েছিস।
বসির চুপ করে রইলো।
বাবা-মা যা চাইছে তুই কি নিজের মন থেকে তা মেনে নিচ্ছিস।
বসির কোন কথা বললো না। মাথা নীচু করে রয়েছে।
এই পৃথিবীতে কারুর মতামতের কোন মূল্য নেই। যদি তোরা দুজনে নিজেদের ভেতর থেকে একে অপরকে চেয়ে নিস।
বসির আমার মুখের দিকে তাকাল।
অনিকার সঙ্গে আমার কোন রক্তের সম্পর্ক নেই। ও ইসলামভাইয়ের সন্তান। ছোটোমার ভাইঝি।
তোর মা যেমন আমার দিদি। অনিকার মাও আমার দিদি ছিলেন।
আমি ওকে দেখাশুন করেছি। ও বড়ো হয়ে উঠেছে উসমান আর ফাদারের কাছে।
তোকে আমি যেমন ছোট থেকে দেখছি, ওকে আমি জন্মাতে দেখেছি।
তোরা দুজনে দুজনকে যদি মন থেকে মেনে নিস আমার কোন আপত্তি নেই।
ছোটোমা, ইসলামভাই, উসমান আর ফাদারের কাছে ওকে চেয়ে নে।
তুই আমার মুখ থেকে পীরবাবার থানের গল্প শুনেছিস। আজ নিজের চোখে দেখ। আমি এই গাছের কাছে অনেক কিছু চেয়েছি। পেয়েছিও। তোরাও চাইতে পারিস।
বসির তবু চুপচাপ মাথা নীচু করে পাশে বসে রইলো।
এবার তুই তোর ব্যক্তিগত ধর্মীয় আচার-আচরণ পালন করে ওই গাছের গুড়ি থেকে মাটি তুলে অনিকার কপালে লাগিয়ে দে।
অনিকা বসির দুজনেই নিঃশব্দে উঠে গেল।
শুভ।
বলো।
তোর অনিসার কথা তোদের ছোটোমা, বড়োমা আমাকে বলেছে।
দুজনেই মাথা নীচু করে নিল।
আমার বিশেষ কিছু বলার নেই। তোর ওপর আমার অনেক আশা-ভরসা। তোর বাবা- মার কাহিনী তুই নিশ্চই নেপলামামা, বিনদ আঙ্কেলের কাছে শুনেছিস। নিজেকে ভাসিয়ে দিস না।
তোরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিস আমি তা সঠিক বলেই মনে করছি।
আবেগ অবশ্যই থাকবে….
শিশু কণ্ঠের কান্নার আওয়াজ পুকুরের ওপার থেকে ক্ষীণ ভাবে ভেসে আসছে। চমকে তাকালাম।
সামনেটা অন্ধকার হয়েগেছে। চাঁদের আলোয় চারদিক থিক থিক করছে। চোখের সামনে মোমবাতির শিখা লক লক করে জলছে। তারই আলোয় আমার সামনে বসে থাকা মুখ গুলোর ওপর চোখ বোলালাম।
মিত্রার দিকে তাকালাম।
কে কাঁদছে?
মাম্পি। মিত্রা আস্তে করে বললো।
কেন!
মিত্রা মাথা নীচু করে নিল।
মিলি। নিস্তব্ধতা খান খান করে গম গম করে উঠলো আমার গলাটা।
ভয় পেয়েছে তাই ও নিয়ে মাঠের দিকে গেছে। মিত্রা বললো।
সুরো। চেঁচিয়ে উঠলাম।
ওদের নিয়ে আসতে গেছে। মিলির গলাটা কাঁপছে।
শুভ।
শুভ আমার দিকে তাকাল।
দুজনে ওখানে মোমবাতি ধূপ জালিয়ে দে। ওখানে গিয়ে প্রণাম কর।
ওরা দুজনে উঠে আমার কাছে এলো। নীচু হয়ে পা ছুঁতে গেল। আমি ওদের হাতটা ধরলাম।
এখানে প্রণাম করতে নেই।
মাম্পির কান্না ভেঁজা গলা আবার কানে ভেসে এলো।
আমি আঙ্কেলের কাছে যাব।
বড়ো মুস্কিল, একটা দুধের শিশুকে তোমরা সামলাতে পার না।
আমি পেছন ফিরে তাকালাম।
দেখলাম কনিষ্ক সুরো দুজনকে কোল থেকে নামিয়ে দিল। ওরা প্রাণপনে ছুটে আসছে আমার কাছে। ছুটতে ছুটতে দুজনেই এসে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পরলো। গলা জড়িয়ে ধরলো।
তখনো ফোঁপানি বন্ধ হয় নি। চোখ জলে ভিঁজে গেছে।
আমি দুজনকে জড়িয়ে ধরে আছি।
কাঁদছো কেন, বলো।
ভয়। মাম্পি কান্নাভেঁজা গলায় বলে উঠলো।
কিসের ভয়, এই তো আমি আছি, মা আছে, বাবা আছে, বোম বোম আছে, দিদাইরা আছে।
মিকি একবার আমার মুখের দিকে তাকায় একবার মাম্পির মুখের দিকে।
ভয় কিসের বলো।
সাপ। মিকি বলে উঠলো।
কোথায় সাপ!
গাছ থেকে। মাম্পি ফাঁপাতে ফাঁপাতে অশ্বত্থ গাছের দিকে আঙুল তুললো।
আমি ওপরের দিকে তাকালাম।
কোথায় দেখতে পাচ্ছি না।
বল, আঙ্কেলকে বল। মিকি বলে উঠলো।
আমি মাম্পির চোখ মুছিয়ে দিলাম। তখনো ও ফুঁপিয়ে চলেছে।
সবাই আমাদের তিনজনের দিকে স্থির দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে।
কাঁদবি না। ঠিক করে বল কি হয়েছে। কোথায় সাপ!
ইয়া বড়ো। মিকি দুদিকে হাত ছড়িয়ে দিল।
এততততো বড়ো!
হুঁ। মাম্পি তখনো ফুঁপিয়ে চলেছে।
পেছন থেকে হাসির শব্দ ভেসে এলো।
চিকনার দিকে তাকালাম।
কিছু না। ছোট মানুষ অন্ধকারে ঠিক দেখতে পায় নি।
চিকনার কথা বলার ভঙ্গিতেই বুঝলাম ও কিছু গোপন করতে চাইছে।
তুমি নীচু হয়ে নমো করছিলে। ওপর থেকে ধুপুস। মাম্পি বললো।
দুটো। মিকি আঙুল তুলেছে।
কোথায় পরলো?
তোমার মাথায়।
কথাটা বলেই মিকি আমার মাথা দেখার জন্য ঝুঁকে পরলো।
তোমায় কামরেছে? মাম্পি চোখ মুখ কুঁচকে বললো।
না।
তুমি এ্যাল।
মাম্পি জিভ বার করলো।
কোথায় আমি এ্যাল, এই তো তোদের ধরে আছি।
ওরা বলছে।
ছোটোমা হেসে মুখ নীচু করে নিল।
তোরা বলবি না তো কি হয়েছে। ওকে বলার লোকের অভাব। নিজের চোখে দেখ। কিরকম কুটুর কুটুর করে লাগাচ্ছে। বড়োমা বললো।
বল বল। মিকি বললো।
একটা উই দিকে চলে গেল। আর একটা উই পাশ দিয়ে চলে গেল।
মাম্পি মিকি দুজনে দুদিকে আঙুল তুললো।
তোরা দেখলি।
হুঁ। দুজনেই ঘার দোলাচ্ছে।
তোদের সঙ্গে কথা বলে নি।
না।
মাম্পি-মিকি দুজনেই মাথা দোলাল। না।
দাড়িদাদাই বারন করেছে।
বুঝলাম ইকবালভাই-এর কথা বলছে। যেহেতু ইকবালভাই-এর দাড়ি আছে তাই দাড়ি দাদাই।
কেন বারন করলো।
ঠাকুর। নমো করো।
মাম্পি আমার হাতদুটে টেনে নিয়ে জোড়া করার চেষ্টা করলো।
তোরা নমো করেছিস?
কেঁদেছি।
এ মা ঠাকুর দেখলে কেউ কাঁদে নাকি। বোকা কোথাকার।
মিকি কেঁদেছে আমি কাঁদি নি। মাম্পি বললো।
ঠানদিদি। ছোটোমা বললো।
পেছন থেকে সামান্য হাসির শব্দ ভেসে এলো।
আমার সামনে মোমবাতি জলছে। আগুনের শিখায় মোমবাতির শরীর বেয়ে গলা মোম নরম ঘাসের বুকে জমা হচ্ছে। চারদিকে ধূপের গন্ধ ম ম করছে।
আঙ্কেল আঙ্কেল। মাম্পি আমার থুতনি ধরে ওর দিকে ফেরাল।
আমি মাম্পির দিকে তাকালাম।
বাবানকে আন্টি মেরেছে।
কেন!
বোমবোম তোমাকে ধরে কানছিল।
মিত্রার দিকে তাকালাম।
মিত্রা মুখ নীচু করে হাসল। মাম্পির মুখের দিকে তাকালাম।
বাবান কথায়?
মাঠে।
চিকনার দিকে তাকালাম। ওদের একবার ডেকে নিয়ে আয়।
চিকনা উঠে দাঁড়াল।
তখন কষ্ট করে ফল পারলি। ফলের ঝুড়িটা নিয়ে আয়।
মোমবাতি জালবো। মাম্পি কোলের মধ্যে ছটফট করতে শুরু করলো।
দাঁড়া বাবান আসুক। পিপটু দাদা কোথায়?
বকেছে।
কে বকেছে।
আন্টি।
বড়োমার দিকে তাকালাম।
ব্যাপারটা কি বলোতো! মাথায় ঢুকছে না?
আর ঢুকিয়ে কাজ নেই।
আফতাবভাইরা কোথায়?
ওদের মন খারাপ হয়ে গেছে।
কেন!
একটা অঘটন ঘটলো।
কি ঘটলো বলবে তো!
পরে বলছি।
ওদের ডাকো। নমাজ পরবে বললো।
নম্রতাকে কিছু বললি না।
নম্রতার দিকে তাকালাম। পিকুকে ডাক।
পিকু। কোল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মাম্পি চেঁচিয়ে উঠলো।
সবাই হেসে উঠলো।
পাকা বুড়ী। ছোটোমা বললো।
পিকু তোর বন্ধু।
মিকির।
বাবান, পিপটু এসে সামনে দাঁড়াল।
দুজনেরই চোখ ছল ছলে।
কি হলো কাঁদছিস কেন।
দুজনেই একবার করে সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছে।
ভূত দেখেছিস।
বাবান সোজা মাম্পি মিকিকে সরিয়ে কোলে ঢুকে পরলো। পিপটু গলা জড়িয়ে ধরেছে।
তুই ছাড় আঙ্কেলের ব্যাথা লাগবে। মাম্পি বললো।
নেহি।
বাংলায় বলতে পারিস না। মাম্পি ঝগড়ুটে মেয়ের মতো চেঁচিয়ে উঠলো।
মিত্রা তনু দুজনেই হেসে উঠলো।
চিকনা ফলের ঝুড়ি নিয়ে এসেছে।
শুভর দাদু কোথায়?
পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।
সবাইকে ডাক। মোমবাতি জেলে দিয়ে যাক।
পিকু কাছে এসে বসলো।
ইসি কোথায়।
ওখানে বসে আছে।
কেন।
আপসেট হয়েগেছে।
পিকুর দিকে তাকালাম।
হ্যাঁগো একটা বিশ্রী ঘটনা ঘটলো। সবার মনটা খারাপ।
কি ঘটনা!
তোমাকে নাকি সাপে কামরেছে।
আমার জ্ঞান হওয়ার পর থকে এই জায়গায় বহুবার এসেছি। আজ পর্যন্ত কোন বিশ্রী ঘটনা ঘটেনি, আশারাখি কোনওদিন ঘটবে না।
আমার গলার স্বরে এমন কিছু ছিল পিকু চমকে তাকাল।
পৃথিবীর চরমতম সত্য এই জায়গার চারপাশে লেখা আছে। তুমি চরম অশিক্ষিত। তাই সেই বর্ণ-গন্ধের অক্ষর পড়তে পারছো না।
আবার পরিবেশটা কেমন থম থমে হয়েগেল।
নম্রতাকে নিয়ে ওখানে ধূপ আর মোমবাতি জালিয়ে দে। অশ্বত্থ পাতায় কিছুটা মাটি গুলে রেখেছি। নম্রতার কপালে লাগিয়ে দে। তোর মনিকে আমি এখানে এইভাবে গ্রহণ করেছিলাম।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। নম্রতার দিকে তাকালাম।
কয়েকটা মোমবাতি নিয়ে আয়।
নম্রতা চলেগেল।
মাম্পি, মিকি, বাবান, পিপটু আমাকে জড়িয়ে রয়েছে।
পিপটু মা কাঁহা।
উধার গায়া।
আমি এখানে অনিদা।
নাগেশকে নিয়ে একবার এখানে আয়।
আমি ওদের চারজনকে নিয়ে গাছের গুঁড়িটার কছে এলাম।
এখানে নমো কর।
ওরা চারজনে মাটিতে শুয়ে পরলো।
নাগেশ, নম্রতা, বনি, পিকু আমার পাশে এসে দাঁড়াল।
নমো করো। মাম্পি বলে উঠলো।
মাম্পি বনির মুখের দিকে তাকাল। বনি হাসছে।
ওরা প্রণাম করে উঠতেই মাম্পি বলে উঠলো।
টিপ দাও।
ওই পাতাটা নিয়ে আয়।
মাম্পি ছুটে গিয়ে পাতাটা নিয়ে এলো।
নম্রতা আমার দিকে মোমবাতির প্যাকেটটা এগিয়ে দিল। প্রত্যেকের হাত একটা করে মোমবাতি দিয়ে বললাম ওখানে জালিয়ে রেখে এসো। মাম্পিদের মোমবাতি আমি জালিয়ে গাছের গোড়ায় রাখলাম।
একে একে সবাই মোমবাতি ধূপ কাঠি জালাল।
আফতাবভাই, অর্জুন, সাগির, অবতাররা সকলে নামাজ পরলো।
যার যার নিজের মতো করে ধর্মীয় আচার-আচরণ পালন করলো।
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।
চিকনার ফলের ঝুড়ি ছাড়াও আরও কয়েকঝুড়ি ফল এসেছে। মিষ্টি এসেছে।
বড়োমা, ছোটোমা, জ্যেঠিমনি, মাসীমনি সামলাচ্ছে।
একে একে সকলকে ডেকে ডেকে মোমবাতি ধূপকাঠি দিচ্ছে।
ওরা চারজন আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। নিজেদের মধ্যে কিচ কিচ করছে।
দিদি, আফতাবভাই নমাজ পরার পর আমার কাছে এসে আমার হাতটা চেপে ধরলো।
চোখ ছল ছল।
আবার কি হলো। তোমার পাওনা গন্ডা মিটিয়ে দিয়েছি।
অনেক দিন পর খুব শান্তি অনুভব করছি। তোর কাছে গল্প শুনেছি, আজ চাক্ষুষ দেখলাম।
আমি দিদির মুখের দিকে তাকিয়ে।
একটা অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইলাম। আমার জীবনে এরকম ঘটনা এই প্রথম। আফতাবভাই বললো।
হাসলাম।
আমি একা নয়, সবাই দেখেছে।
বড়োমা আফতাবভাই-এর মুখের দিকে তাকাল। আফতাবভাই চুপ করে গেল।
তোর কাছে একটা কথা ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে।
আফতাব। বড়োমা ডেকে উঠলো।
না বড়োমা, ওটা বলছি না।
আফতাবভাই আমার মুখের দিকে তাকাল।
আমরা বিধর্মী। এখানে এসে দেখলাম তুই তোর ভিটে-মাটি গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবার। রাঘবনকে দেখেছি, তোকেও দেখছি। ঠিক মেলাতে পারছি না।
আমি আফতাবভাই-এর দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
নিশ্চই এর কোন রিজিন আছে।
হয়তো আছে, হয়তোবা নেই।
কেন এ কথা বলছিস।
বলতে পারবো না। তবে খুব ছোট সময়ে আমি একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম। তাই হয়তো এখনো তোমাদের মধ্যেই তাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি।
আফতাবভাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। চারিদিকে এতো মানুষ। তবু কারুর মুখ দিয়ে একটি শব্দও বেরচ্ছে না।
সত্যি বলতে কি আমার বড়ো হয়ে ওঠাটা কোন নিয়ম শৃঙ্খলায় আবদ্ধ ছিল না।
গাছ যেমন মাটি ফুঁড়ে তার আপন খেয়ালে বেড়ে ওঠে। আমিও খানিকটা তাই।
আমার জীবনে কখনো এসেছে কালো মেঘ, কখনো ঝকঝকে আকাশ। কখনো আকাশ ভাঙা বৃষ্টি। কখনো কাটফাটা রোদ। গ্রীষ্মের কাটফাটা রোদে চাতক পাখি জলের জন্য যেমন হাহুতাশ করে, আমারও এক এক সময় সেরকম গেছে। সেই হিসেবে আমার অবলম্বন কেউ ছিল না। কারুর কাছে কিছু চাইব সেই আশ্রয়টুকু আমার সেইভাবে ছিল না।
একটু আধটু আব্দার করতাম কাকীমার কাছে। একদিন বুঝলাম তারও সামর্থ সীমিত।
জীবনে প্রথম যেদিন এই গাছের কাছে একলা একলা এসেছিলাম। সেদিন কেমন যেন অনুভব করলাম। এই গাছটা আমার সঙ্গে কথা বলে। সেই দিন থেকে আমি একা একা এখানে আসি।
রহস্যের কথা যদি বলো। আজও উন্মোচন করতে পারি নি। কিন্তু অনুভব করি।
তখন মনে হয় আমি ক্লাস টু কিংবা থ্রিতে পরি।
এই গ্রামের বর্ধিষ্ণু ব্রাহ্মণ পরিবার হিসাবে আমাদের বেশ সুনাম আছে।
তার ওপর যে তিন ঘর ব্রাহ্মণ এই গ্রামে থাকে, তার মধ্যে আমরা অন্যতম। আমাদের বাড়িতে প্রাচীন গৃহ দেবতা আছেন। বাৎসরিক তার উৎসব হয়। উৎসবের দিন গ্রাম শুদ্ধ সবাই উপচে পরে।
তাছাড়া এই পরিবারটা শিক্ষিত পরিবার। এই পরিবারের একজন এই ব্লকের একমাত্র হাইস্কুলের শিক্ষক। তিনি মনাকাকা।
আমাকেও গ্রামের সকলে চেনে।
তখন আমার তিনটে প্লাস পয়েন্ট, আমি মাতৃ-পিতৃ হারা সন্তান। আমার বাবাও মনামাস্টারের সঙ্গে একই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন, গত হয়েছেন। মা-বাবার অবর্তমানে মনাকাকা আমার গার্জেন। সবচেয়ে বড়ো আকর্ষণ আমরা ব্রাহ্মণ। জাতি শ্রেষ্ঠ।
হয়তো খুব দুষ্টু ছিলাম। তাই কাকীমা স্কুলে বেরবার সময় প্রত্যেক দিন বলতেন স্কুলে গিয়ে দুষ্টুমি করবে না। ভালভাবে থাকবে।
সেদিন সকালে বাড়ি থেকে বেরবার সময় কাকীমা বললেন, স্কুলে একবারে বাঁদরামো করবি না, প্রত্যেকদিন মানুষটার কাছে মার খাস, ভালো লাগে না।
মাথা দুলিয়ে ছুটটে চলে গেলাম নদী বাঁধের ওপর। কাঁধে বাজারের থলির মধ্যে স্লেট-পেনসিল, সহজপাঠ, বর্ণপরিচয়, নামতার বই। বাঁধের ওপর দিয়ে যেতে যেতেই রাস্তা থেকে কয়েকটা মাটির ঢেলা তুলে নিয়ে নদীর বুকে ছুঁড়ে মারলাম।
ডুব করে একটা আওয়াজ হয়ে জলটা কেমন গোল হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পরলো, বেশ লাগতো। শিশু মনের খেলা। কিছুতেই সেই সময় কাকীমার কথা মনে থাকতো না। হাতের কাছে মাটির ঢেলা পেলে হাতটা কেমন নিষপিষ করতো।
স্কুলের সামনে খোলা মাঠে এসে দাঁড়াতেই দেখলাম অনাদিমাস্টার স্কুলের বারান্দায় বেত হাতে দাঁড়িয়ে।
বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে উঠলো, এতক্ষণ কোথায় ছিলি?
বোবার শত্রু নেই, মাথা নীচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।
প্রার্থনা করতে হবে না।
সবাই লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে পরলাম।
অনি। অনাদি মাস্টারের ষাঁড়ের মত গলায় চমকে তাকালাম।
শুরু কর।
প্রথমে ধনধান্যে পুষ্পে ভরা…, তারপর হওধর মেতে ধীর হওকর মেতে বীর…, শেষে জনগনমন অধিনায়ক জয় হে।
গাওয়ার পরেই যে যার ক্লাসে যাওয়ার কথা।
আমাদের ক্লাসরুম সামনের বটতলায়। দঙ্গল বেঁধে সেদিকে হাঁটা লাগালাম।
অনি। স্যারের ডাকে আবার ফিরে তাকালাম।
একপ্রিয়েড হয়ে ছুটি, গিয়ে পাঁচের ঘর পর্যন্ত নামতা পর।
আমি ক্লাসের মনিটর। লিডার।
মনে আনন্দ ধরে না হৈ হৈ করে চলে এলাম বটতলায়।
আমার পাশে বাসু, চিকনা। আমরা সব হরিহর আত্মা।
অনি পরাবি না। কাকলি চেঁচিয়ে উঠলো।
তোরা পর আমি পরে পরাচ্ছি।
চিকনাকে বললাম, আজ কিসের ছুটি রে?
চাঁড়াল। জানিস না।
দেখলাম পেছন থেকে সবাই হেসে উঠলো।
অলাউঠা। দিলাম একটা ঘুঁসি চিকনার পিঠে।
মারলু কেন।
বেশ করছি, গাল দিলু কেন, তোকে বলেছি কিসের ছুটি।
আজ মুসলমান পাড়ায় পরব আছে।
সামনের দিকে চোখ চলে গেল। কাউকে যেন নিবিড় করে খুঁজতে শুরু করে দিলাম।
সেই জন্য আজ আয়েষা আসে নি।
মনটা খরাপ হয়ে গেল।
আয়েষা স্কুলে এলে আমাদের সঙ্গেই বসে, আমাদের সঙ্গেই খেলা করে।
বাড়ি থেকে তাল পাটালি চুরি করে নিয়ে এসে আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেয়।
কেমন যেন লাগল, নামতা পরতে ইচ্ছে করলো না।
চিকনারা তারস্বরে চেঁচিয়ে চলেছে একে একে এক, একে দু-এ দুই, একে তিনে তিন….।
উঠে দাঁড়ালাম।
কুথা যাচ্ছিস। চিকনা হাতটা ধরলো।
আসছি।
সোজা চলে এলাম স্কুলের পেছনে, আমার প্রিয় বকুল গাছটার তলায়। চারিদিক নিস্তব্ধ। পাখির ডাকের কিচির মিচির, চারদিক ম ম করছে। কয়েকটা পাকা বকুল ফল কুড়িয়ে গাছের তলায় বসলাম।
প্রায় দিনই আয়েষা আমাকে হাত ধরে এখানে নিয়ে চলে আসতো। কনোদিন পেয়ারা, কনোদিন শসা, কনোদিন পাটালি খাওয়ায়।
একদিন ওকে বলেছিলাম, তুই আমাকে একা দিস কেন, চিকনাদের দিস না কেন।
তোকে দিতে ভালো লাগে।
দুজনে বেশ বকুলগাছের তলায় দাঁড়িয়ে মজা করে খেতাম।
কখনো এক্কা দোক্কা খেলতাম।
বাড়ি ফেরার পথে, আমরা সকলে দঙ্গল বেঁধে বেরতাম, আসার পথে বেণীর মোর বলে একটা বাঁক আছে। সেখান থেকে ডানদিকের মেঠো পথ ধরে আয়েষা চলে যেত ওর বাড়ির দিকে আমি চলে আসতাম আমার বাড়ির পথে।
ওই দিকটা একচুয়েলি মুসলমান পাড়া।
সেদিন আয়েষা এলো না, আমার পাটালি খাওয়া হলো না।
স্কুল ছুটি হয়ে গেল।
চিকনারা স্কুল ছুটির পর খেলতে গেল। আমার খেলতে যেতে ইচ্ছে করলো না।
একা একা ফিরে আসছি বাড়ির পথে।
বেণীর মোড়ে আসতেই দেখলাম মাঠের ওপর দিয়ে আয়েষা ছুটতে ছুটতে আসছে। তারস্বরে চেঁচাচ্ছে অনি অনি অনি।
আমি দাঁড়িয়ে পরলাম।
ওকে দেখেই মনটা কেমন ভালো হয়ে গেল।
কাছে আসতেই দেখলাম ও হাঁপাচ্ছে।
তুই স্কুলে গেলি না কেন। আজ এক প্রিয়েডে ছুটি হয়ে গেল। অনাদি মাস্টার খালি পাঁচ পর্যন্ত নমতা পড়েতে বলেছিল, ভালো লাগলো না। পরি নি।
আয়। আয়েষা আমার হাতটা শক্ত করে ধরলো।
কোথায়!
আয় না।
দুজনে রাস্তার ডনদিকে পালের ঘরের বাঁশ বাগানে চলে গেলাম। সামনের বিরাট ঝিলটায় থরে থরে শালুক ফুল ফুটে রয়েছে। বকগুলো হাঁটু জলে চোখ বুঁজে ধ্যান করছে।
জানিষ অনি, আজ আমাদের পরব।
পরবটা কি রে।
ঈদ রে ঈদ।
সেটা কি!
তোদের যেমন দুগ্গাপূজো, আমাদের তেমনি ঈদ।
আয়েষা ওর জামায় হাত দিল।
নতুন জামা পরেছি, নতুন প্যান্ট পরেছি। তোরা দুগ্গাপূজোর সময় পরিস না?
আমি মাথা দোলালাম।
আমাকে দেখতে ভালো লাগছে।
হাসলাম।
আম্মি স্কুলে আসতে দিল না। বললো স্কুল ছুটি।
এক প্রিয়েড হয়েছে।
কাল চাঁদ উঠতে দেরি করলো যে।
আমি কেমন যেন অবাক হয়ে তাকালাম আয়েষার মুখের দিকে। হাসি হাসি মুখ, চোখ দুটো অসম্ভব সুন্দর লাগছিল, কপালে কুমকুমের টিপ। মাথায় লাল ফিতে দিয়ে টেনে বিনুনি করেছে।
কাল চাঁদ ওঠেনি তো অন্ধকার পক্ষ ছিল।
তুই দেখিস নি। আমরা দেখেছি।
আমি আয়েষার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে।
আয় এদিকে।
আয়েষা আমার হাতটা আবার শক্ত করে ধরলো।
কোথায় যাবি?
আয় না।
আমাকে বাঁশ ঝাড়ের আড়ালে নিয়ে গেলো।
এখানে বোস।
কেন।
বোস না।
আমি মাটিতে বসে পরলাম।
আয়েষা জামাটা তুলে ধরলো।
ওর লাল ইজের প্যান্টটা দেখতে পেলাম।
জামাটা ধর, বার করি।
আমি জামাটা ধরলাম।
আয়েষা ইজের প্যান্টের গুটিয়ে রাখা ভাঁজ থেকে একটা কাগজের মোড়ক বার করলো।
উঠবি না। এখানে বসবি।
ছুটে চলে গিয়ে একটা শুকনো বড় শালগাছের পাতা তুলে নিয়ে এলো।
কাল রাতে নামাজ পড়ার পর যখন খেলাম, আমার থেকে তোর জন্য তুলে রেখেছিলাম।
পাটালি?
আয়েষা আমার সামনে বসলো।
কাগজের মোড়ক থেকে খেঁজুর, কিসমিস, আখরোট, কাজুবাদাম বার করে কুরিয়ে আনা বড় শাল পাতায় রাখলো।
খা।
তুই খাবি না।
আমি খেয়েছি। এটা তোর জন্য।
একটু খা।
আমি একটা খেঁজুর একটু খানি কামড়ে ওর মুখের সামনে তুলে ধরলাম।
আয়েষা ঠোঁট ফাঁক করে মুখে নিল।
আমি খাই আয়েষা আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর চোখে যেন বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা।
জানিস অনি আম্মি বলছিল তোর বাবা বিরাট বড় মাস্টার ছিল, মনা মাস্টারের থেকেও বড়। আমার চাচাতো দাদা ওনার কাছে পড়েছে।
কি জানি।
তখন সত্যি আমার আয়েষার কথার দিকে মন নেই, আরাম করে কাজু, কিসমিস খাচ্ছি।
আয়েষা তার মতো বলে চলেছে।
খাওয়া হয়ে যেতে উঠে দাঁড়ালাম। সামনের ঝিলে হাত ধুলাম।
কাল স্কুলে যাবি।
যাব।
আগে আগে যাবি। তোকে বকুলবাঁশি বানিয়ে দেব।
আচ্ছা।
আমি এগিয়ে চললাম।
বাঁকের মুখটায় একবার পেছন ফিরে তাকালাম। আয়েষা দাঁড়িয়ে, হাত নারল।
আমিও হাত নারলাম।
বাড়িতে ঢুকতেই দেখলাম কাকা বারান্দায় বসে।
কাছে ডাকল।
গেলাম।
ঠাস করে গালে একটা রাম থাপ্পর।
কাঁধ থেকে ব্যাগ ছিটকে মাটিতে লুটো পুটি।
বেদম প্রহার চললো কিছুক্ষণ। কাকীমা ছুটে এসে কোন প্রকারে রক্ষা করলো।
এই বয়সে পাকাম। মান-সম্মান মাটিতে মিশিয়ে দেবে। শয়তান ছেলে।
রাগের চোটে কাকীমার হাত থেকে ছিটকে চলে গেলাম পেছনের পুকুর ধারে। হাতে পায়ের থাইতে বেতের দগদগে দাগ। হাত বোলাই আর প্রাণ খুলে কাঁদি।
মনটা খারাপ হয়ে গেল।
কেন কাকা বললো, আমি কাকার মান-সম্মান ধুলোয় লুটিয়ে দিয়েছি।
কাঁদতে কাঁদতে কাকাকে মনে মনে খুব গালাগাল দিলাম।
আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম, মা আমাকে তোমার কাছে নিয়ে চলো না। আর ভালো লাগে না। কেউ আমাকে ভালবাসে না। সবাই আমাকে মারে, বকে।
জানি না সেদিন মা আমার কথা শুনেছিলেন কিনা।
কাকীমা ভুলিয়ে ভালিয়ে ধরে এনে তেল মাখিয়ে স্নান করাল। দেরেমুশে কাকাকে গাল দিল।
আদরকরে ভাত মেখে খাইয়ে দিল।
খাওয়াতে খাওয়াতেই কাকীমা জিজ্ঞাসা করলো।
আজ স্কুলে কি দুষ্টুমি করেছিলি।
আজ দুষ্টুমি করি নি। তুমি বারণ করেছিলে।
আনাদিমাস্টার বলে গেল যে কোন মেয়ের প্যান্ট ধরে টেনেছিলি।
না-তো। আমি তো বটতলায় গিয়ে নামতা পরছিলাম। ভল লাগল না। বকুল গাছের তলায় চলে গেলাম। আজ নামতা পরি নি।
কাকীমা গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল কিছুটা কাঁদল।
রাতে বারান্দায় শুয়েছি। গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন বারান্দার বাঁশ বেয়ে চালে উঠে আকাশ দেখেছি, চাঁদ উঠেছে কিনা। অনেকক্ষণ বসে থেকে যখন চাঁদ উঠলো না। এসে শুয়ে পরলাম।
আয়েষা আর তারপর থেক স্কুলে আসে নি। কেন আসে নি, আমি আজও জানি না।
কয়েক দিন পর খেতে খেতে কাকাকে বলতে শুনেছি, জানো মেয়েটার বিয়ে হল।
কাকীমা উত্তরে বলেছে অনি স্বীকার করেছে, সে অন্যায় করে নি। তুমি মিছিমিছি ওর গায়ে হাত দিয়েছ।
আমার সামনে আর কথাটা বিশেষ এগোয় নি।
তখন বুঝি নি। কাঁচা বয়স।
কাকার মুখ থেকে পীরবাবার কথা শুনেছিলাম। আমাকে হাতে ধরে নিয়েও এসেছিলেন। প্রণাম করেছি। সকলে বলতেন পীরবাবা খুব জাগ্রত। মন দিয়ে পীরবাবাকে ডাকলে যা চাওয়া যায় তাই পাওয়া যায়।
তখন গ্রীষ্মকাল সকালে স্কুল হতো। একদিন স্কুল থেকে ফিরে সোজা এখানে চলে এলাম।
ভরা দুপুর। চারদিক শুনসান। খাঁ খাঁ করছে মাঠ ঘাট।
গাছের তলায় এসে প্রণাম করলাম। মনে মনে বললাম।
পীরবাবা তুমি তো জাগ্রত। বাবা তোমায় দেখেছেন। আগে বলো কেন তুমি আয়েষার বিয়ে দিলে। আমি এখন কার সঙ্গে খেলব। কে আমাকে পাটালি খাওয়াবে।
তখন ছোট ছিলাম এর বেশি চাহিদা আমার ছিল না।
চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে ফেললাম, কেউ কোন কথা বললো না।
ভীষণ রাগ হল গাছটার ওপর। দু-চারটে মাটির ঢেলা তুলে গাছের গুঁড়িতে ছুঁড়ে মারলাম।
হঠাৎ কে যেন বলে উঠলো।
ওরে পাগল ওর বিয়ে হয় নি।
চারিদিকে তাকাই কাউকে দেখতে পাই না।
কে কথা বলে? চেঁচিয়ে উঠলাম।
তুমি কে? আমার সামনে এসো।
আমার গলা এই ফাঁকা মাঠে রিনিঝিনি হয়ে আমার সামনেই ফিরে এলো।
কেউ এলো না। আর কথাও বললো না।
অনেকক্ষণ এদিক ওদিক খুঁজলাম, কাউকে পেলাম না।
বিকেলে বাড়ি ফিরে গেলাম।
স্কুলে গিয়ে বকুল গাছটার তলায় দাঁড়ালেই আয়েষার কথা মনে পরে যেত।
নিজে নিজেই কেঁদে ফেলতাম।
কতদিন বেনীর মোড়ে দাঁড়িয়ে একা একা কেঁদেছি।
মনে মন বলতাম পীরবাবা বলেছে আয়েষার বিয়ে হয় নি।
বড় হলাম। প্রাথমিক স্কুল থেকে হাইস্কুল। মাধ্যমিক পরীক্ষা দিলাম। ভাল রেজাল্ট হলো।
মিললো কলকাতা যাওয়ার ছাড়পত্র।
কলকাতায় যেদিন আসবো, তার আগের দিন আমার গ্রামের ভাল লাগা জায়গাগুলো একবার করে দেখতে গেলাম। পীরসাহেবের থানেও এসেছিলাম। শেষে সেই বকুল গাছের তলায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। তারপর বেণীর মোড়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম। মনে হলো আয়েষা যেন আমার নাম ধরে ছুটতে ছুটতে আসছে। ওর সেই হাসি আমার চোখে ভেসে উঠলো।
আবার বুকের ভেতরটা কেমন চিন চিন করে উঠলো। শেষে পালেদের বাঁশ ঝাড়। যে জায়গায় বসে আয়েষা আমাকে কাজুবাদাম, কিসমিস, খেঁজুর খাইয়েছিল সেই জায়গায় বসলাম। অনেক খুঁজেও সেই শুকনো শালপাতা খুঁজে পেলাম না।
হঠাৎ আবিষ্কার করলাম গাছটাই কাটা হয়ে গেছে।
তখন অনেক কিছু বুঝতে শিখেছি। মনে পরে গেল সেদিন আয়েষার কপালে কুমকুমের টিপ, দীঘল চোখে গভীর হাসি।
বার বার কানের কাছে রিনিঝিনি করছে, আমাকে দেখতে ভাল লাগছে অনি।
বুকের ভেতরটা যন্ত্রণা করে উঠলো। আর দাঁড়ালাম না।
পায়ে পায়ে অনাদি মাস্টারের বাড়ি গেলাম। তখন অনাদি মাস্টার রিটায়ার করেছে।
প্রণাম করে বলেছি, স্যার আমি কাল কলকাতা চলে যাচ্ছি।
স্যার আমার মাথায় হাত রেখে আর্শীবাদ করলেন।
আরও বড় হও। গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করো।
একবার ইচ্ছে হল স্যারকে আয়েষার কথা জিজ্ঞাসা করি, পারলাম না।
বাড়ি ফিরেছি।
ভেবেছিলাম কাকাকে জিজ্ঞাসা করি, তাও পারি নি।
কলকাতায় এসেছি।
ঈদ বছর বছর ঘুরে এসেছে। যেখানে যে আবস্থাতে থেকেছি গভীর রাতে ঈদের চাঁদকে দেখতে চেয়েছি, আমার এই পোড়া চোখে ঈদের চাঁদ ধরা পরেনি।
আফতাবভাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। চোখ ছল ছল করছে।
সবার মুখের দিকে চোখ পরে গেল। ওদের চোখেমুখের ভাষা ঠিক ধরতে পারছি না।
চারিদিক নিস্তব্ধ। ঝিঁ ঝিঁ পোকার তারস্বর শব্দ। কয়েকটা জোনাকী ইতি উতি উড়ে বেরাচ্ছে। গাছের তলায় সার দিয়ে মোমবাতি জলছে। কোনওটা অর্ধেক কোনওটা একবারে নিভে গেছে। ধূপের ধোঁয়া তখনো কুন্ডলী পাকিয়ে গাছের মাথার ঝাঁকরা চুলে গিয়ে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে।
বম্বের জিন্নাতবাইকে তোমার মনে পরে।
আফতাবভাই আমাকে জাপ্টে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো।
আমারও চোখ ছল ছল করছে।
আয়েষা অর্জুনকে আমার হাতে তুলে দিয়েছিল। আমি যে ওর শৈশবের খেলার সাথী।
দিদি এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখলো।
তোমার জন্য আমার শৈশবকে খুঁজে পেয়েছিলাম।
(আবার আগামীকাল)
আপনাদের আপডেট এর তারিখটা ঠিক করুন