রাজা শুয়েছিল রাজার মতো। কিন্তু ভঙ্গিটা ঠিক রাজার মতো ছিল না, বরং বড্ড ভিখারি ভিখারি! না, অর্জুন এমন ছিল না। তবু—
কোয়েল ঘরের মধ্যে ঘুরছে ফিরছে। এটা ওটা কাজ করছে। এই সময় তার খুব শুতে ইচ্ছে করছিল। বিছানা-বালিশ যেন তাকে ডাকছে। শরীরটা ক্লান্তিতে ভেঙে না এলেও একটু আরাম চায়। কিন্তু সে খাটের কাছে যাচ্ছিল না। কোয়েল রাজার হাতের কাছে যাবে না বলেই শুচ্ছিল না। বিউটি পার্লার থেকে ফিরেছে একটার সময়। ঘরদোরের কাজ, রান্না, স্নান সেরে পার্লারে গিয়েছিল। ফিরে এসে খাবে, খেয়ে শোবে। খাওয়া হয়ে গেছে, কিন্তু শুতে যাওয়ার সময়ই রাজা এল। রাজা বড় ভাশুরের ছেলে। এ বছর সেপ্টেম্বরে একুশ পূর্ণ করেছে। কলেজে পড়ছে। তবে ওর পড়াশোনা হবে না। অর্ধেক দিন কলেজ যায় না। ইদানীং নেশাও করছে খুব। মারপিট গোলমালে জড়াচ্ছে। ওর বাপ এসে সেদিন খুব দুঃখের কথা বলল। প্রায়দিনই রাতে মদ খেয়ে বাড়ি ঢুকছে। কোয়েল বড় ভাশুরের দিকে তাকাল না। বড় ভাশুর মদ খাওয়া নেশা করার প্রসঙ্গে অর্জুনের কথা বলল। বেশ হতাশ গলায় বলল, ‘পুরো কাকার ধাত পেয়েছে।’ কোয়েল ভাশুরের কথা শুনছিল কিন্তু তাকাচ্ছিল না। সেও একদিন ওর সঙ্গে বসে বিয়ার খেয়েছে। সেদিনই ফার্স্ট অ্যান্ড লাস্ট। আসলে রাজা সেদিন দুটো বিয়ার খেয়ে তার উরুর ওপর হাত রেখেছিল। ঘষছিল। খুব আস্তে আস্তে। কোয়েলের কোলটা বেশ বড়। আর দুই উরু খাম্বার মতো। দু’দুটো বিয়ার খেয়ে রাজাকে বেশ পুরুষ পুরুষ মনে হচ্ছিল। মুখ লাল, চোখে ঘোর। একুশ বছর বয়েস। চব্বিশে অর্জুন বিয়ে করেছিল। সাতাশে মরেছে।
কোয়েলও দুটো বিয়ার খেয়েছে। দুটো বিয়ারে ওর কিছু হয় না। আগে অর্জুন এক ক্রেট বিয়ার নিয়ে এসে ঘরের ফ্রিজে ঠান্ডা করত। কে ক’টা খেত গুনতি করত না। খাওয়া তখন থামত যখন কোয়েল ঝাঁপিয়ে পড়ত অর্জুনের ওপর। সেসব দিনে দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত ওরা বিছানায় পড়ে থাকত।
“উরুর ওপর হাত রেখেছিল রাজা।
কোয়েলের খুব শক্ত শরীর।”
অনেকদিন পরে দুপুরবেলা এমন চিল্ড বিয়ার খেল কোয়েল। ও রাজার গায়ে অর্জুনের গন্ধ পাচ্ছিল। যতই হোক একই বংশের পুরুষ। বেশ জোয়ান হয়েছে। জামার বোতাম খোলা। বুকের ভেতর রোমগুলো ঝিলিক মারছে। গলায় ভাঁজে ঘাম জমে। জোয়ান পুরুষের ঘামের গন্ধে কোয়েলের নেশা হয়। বিয়ারের থেকে বেশি নেশা।
উরুর ওপর হাত রেখেছিল রাজা। কোয়েলের খুব শক্ত শরীর। নরমসরম নয়। তেমন তেমন পুরুষমানুষের অনেক আদর পেলে এ শরীর ঢিলে হয়। রাজার দিকে তাকিয়ে কোয়েলের মনে হয়েছিল, রাজার তেমন কামড় নেই। যা আছে, তা এই বয়েসের ছটফটানি। কোয়েল খপ করে রাজার চুলের মুঠি ধরল। রাজা ভাবেনি কাকি তাকে এমন করে ধরতে পারে। তার নেশা চড়াং করে বেড়ে গেল। কিন্তু কোয়েল তাকে টেনে এনেও বুকে ঠাঁই দিল না। তার মুখ ঠেসে ধরল কোলে, বলল, ‘খুব নেশা চড়েছে তোর, ঘুমা আমার কোলে।’
রাজা হাঁসফাঁস করল, শরীর মুচড়ে ঝটকা দিল। হাতদুটোকে যদি ফ্রি করত পারত তবে কাকির কোমর জড়িয়ে ধরত। চিত করে ফেলত। তারপর উঠত কাকির ওপরে। যদি একবার মুখ তুলতে পারত তবে কাকির বুকে মুখ গুঁজে দিত। কাকির ভারী বুক এখনও মাথায় ঠেকছে। কিন্তু সে মুখ ডোবাতে চায়। পারছে না। একবার, একবার, সে গোঁ গোঁ করছিল।
কিন্তু সে পারল না। আর সেদিনই সে বেশ টের পেল, তার থেকে তার কাকির গায়ের জোর বেশি। জোরাজোরি করে কিছু হবে না। সে যতবার নড়তে চড়তে গেল, ততবারই সে পারল না। সে বুঝতে পারল, তাকে বাবুসোনার মতো কোলে শুয়েই দুপুর কাটাতে হবে। যতক্ষণ না কাকি আরও কাছে ডাকে ততক্ষণ সে কাছে যেতে পারবে না। তাকে আরও অপেক্ষা করতে হবে। কোলে শুয়ে শুয়ে সে দেওয়ালে কাকার ছবির দিকে তাকাল। কাকার চোখদুটো জ্বলছে! উরে শালা! সে আরও গুটিয়ে গেল। নড়াচড়ার ক্ষমতা থাকল না। পরে মনে হয়েছিল, বহুত নেশা হলে এমন হয়। একে ধুমকি বলে!
তবু এর আগে সে কোনওদিন কোয়েলের এত কাছাকাছি হয়নি। বিকেলবেলা বাড়ি চলে গেলে সারা সন্ধে, সারা রাত্রি সে গা থেকে কোয়েলের গন্ধ পাচ্ছিল।
প্রিয়াঙ্কা স্কুল থেকে ফিরে দেখল ঘরের মেঝেতে চারটে বিয়ারের বোতল, দুটো গ্লাস, গ্যাসে কড়ায় মাছভাজা। আর কোয়েল অবেলায় চান করে, ভালো করে গায়ের জল না মুছে, চুলে জল নিয়ে বিছানায় এলোমেলো পড়ে।
এমন পড়ে থাকা দেখলেই যে কোনও মেয়েই ভাবতে চেষ্টা করে এর আগে আগে কী কী হয়েছে। সেক্ষেত্রে কে এসেছিল তা জানার জন্য, তার নামটার জন্য বুকের ভেতর হাঁসফাঁস করে। প্রিয়াঙ্কা হাঁড়ি থেকে ভাত বেড়ে খেল না। সে বিয়ারের বোতলগুলো তুলে বাইরে বের করে দিল। মাছের কাঁটা রাখা তেল তেলে প্লেট নিয়ে সিঙ্কে দিয়ে দিল। গ্লাসদুটো মেজে রান্নাঘরের র্যাকে তুলে রাখল। ঘরের মেঝে মুছতে মুছতে কী যেন আতিপাতি খুঁজল। কী খুঁজল? কোনও গোপন জিনিস খোঁজার মতো। কনডোমের প্যাকেট বা তার কোনও চিহ্ন। যদি সেটা পেত, ওর খারাপও লাগত, সরাসরি প্রমাণ। তবে ভালোও লাগত। সাবধানতা নেওয়া উচিত। দিনকাল ভালো নয়, আবার যদি বেবি-টেবি পেটে এসে যায়। খুব খারাপ ব্যাপার।
প্রিয়াঙ্কা টুয়েলভে পড়ে। এ বছর হায়ার সেকেন্ডারি দেবে। ক’দিন আগে ওর কোচিং ক্লাসের একটা ছেলে এসেছিল বাড়িতে। কোয়েল তখন পার্লারে ছিল। এসে জানল একটা ছেলে এসেছিল। কোয়েল রাতে হঠাৎ প্রিয়াঙ্কাকে ডেকে বলল, ‘ওই ছেলের সঙ্গে কী কী করেছিস বল?’ প্রিয়াঙ্কা আকাশ থেকে পড়ল— ‘ও আমার কোচিংয়ের বন্ধু, আমি কী করব ওর সঙ্গে?’ কোয়েল বলল, ‘ও কী করেছে বল?’ প্রিয়াঙ্কা বলল, ‘ও গল্প করে চলে গেল।’ কোয়েল বলল, ‘একা ঘরে গল্প করলি?’ সেদিন স্পষ্ট করে সে মেয়েকে বলে দিল, ‘শোনো মেয়ে, মেয়েদের শরীর বড় শত্রু। ছেলেরা ফুর্তি করে চলে যাবে, দগ্ধাতে হবে তোমায়, কিছু করলে নিজে বুঝে নিয়ে করবে, আগে সাবধান হবে। বড় হয়েছিস, আমি ইচ্ছে করলেই তোকে আটকাতে পারব না। তাই আগে সেফটি। কনডোম আছে কিনা দেখে নিয়ে তারপর যা করার করবে। পেট বাঁধালে আমি রক্ষা করতে পারব না।’ মায়ের কথা শুনে প্রিয়াঙ্কা আঁতকে উঠেছিল।
প্রিয়াঙ্কা সেদিন মায়ের কথার মাঝে লজ্জা পায়নি। থরথর করে কেঁপেছিল। সে জানে তার মাকে দু-দু’বার হাসপাতালে যেতে হয়েছিল, অ্যাবরশন করাতে। আর অ্যাবরশনগুলো দু’বারই তার মা করিয়েছে বিধবা হওয়ার পর। বাবা মারা যাওয়ার পর এখানে একবার আর মামার বাড়িতে একবার।
সেদিন প্রিয়াঙ্কা দেখতে চেয়েছিল, মা কি সাবধানতা নিয়েছিল? কে এসেছিল? মাকে জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি। তবে সে পরপর তিনটি নাম সাজিয়েছিল। হ্যাঁ তিনজন।
“রাজা ফুঃ করে মুখ দিয়ে আওয়াজ করল।”
আজ রাজাকে শুয়ে থাকতে দেখে একটা সময় কোয়েল খুব বিরক্ত হল, বলল, ‘রাজা এবার বাড়ি যা, তোর মা খুঁজবে।’ রাজা ফুঃ করে মুখ দিয়ে আওয়াজ করল।
কোয়েল বলল, ‘এখন তোর মা যদি জানতে পারে, ঠিক কোনও না কোনও বাহানা করে আসবে। তখন ভালো ছেলের মতো লেজ খাড়া করে পালাবি। যা, আগেভাগেই চলে যা।’ রাজা বলল, ‘মায়ের কথা তুলছ কেন? তুমি তো কাউকে ভয় পাও না।’
‘পাই না তো। তাই জন্যে বললাম। আমি ফালতু অশান্তি চাই না। আমি এখন শোব।’
রাজা হাসে, ‘এই তো এত জায়গা আছে। তুমি আমার পাশে শুয়ে পড়ো।’ রাজার শুয়ে থাকা দেখে কোয়েলের যেমন বিরক্ত লাগছিল, তেমন হাসিও পাচ্ছিল। ক’দিন আগে এসে ওর বড়জা কান্নাকাটি করে গেছে। ‘আমার ছেলেটাকে খাস না। ও তোর ছেলের মতো।’ কোয়েল দেখছিল, টাটকা পূর্ণ যুবক রাজা! তাকে ডাকছে।
“ভালোবাসিস? আমি বিধবা আর তোর বিয়ে হয়নি।
রাজা, বিয়ে করবি আমাকে?”
‘না রে বাবু, তুই যা। আমি একাই ঘুমাব। একটু পরে প্রিয়াঙ্কা এসে পড়বে।’
রাজা উঠল না, নড়ল না। বরং গাঢ় গলায় বলল, ‘তোমাকে আমার চাই।’
কোয়েল দু’চোখ বন্ধ করল, ‘কী চাস, আমার সঙ্গে শুবি, তাই তো?’
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
‘ভালোবাসিস? আমি বিধবা আর তোর বিয়ে হয়নি। রাজা, বিয়ে করবি আমাকে?’
‘বিয়ে!’
‘হ্যাঁ তোর কোনও ভয় নেই। প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে আমি কথা বলে নেব। আর তোর মা-বাপের ক্ষমতা নেই এখানে এসে তোকে টেনে নিয়ে যাবে। আমি তোকে খাওয়াব।’
রাজা বিড়বিড় করল, কী বলল ঠিক শোনা গেল না। কোয়েল বলল, ‘তুই কী বললি ঠিক শুনতে পেলাম না।’
রাজা বলল, ‘আমি তোমার কথা সব জানি—।’
‘কী জানিস? আমি অনেক লোকের সঙ্গে শুয়েছি, তাই তো জানিস। শোন, তোর কাকা খুন হয়ে যাওয়ার পরে আমি খুব বিপদে পড়ে গিয়েছিলাম। তখন দু-চারজন আমার সঙ্গে জোর করে শুয়ে গেছে। আর এখন আমার যাকে ভালো লাগে তার সঙ্গে শুই। তোকে আমার খারাপ লাগে না কিন্তু তোর সঙ্গে আমি শুতে পারব না। আর তুইও জোর করে আমার সঙ্গে শুতে পারবি না। বরং অন্য মেয়ে জোগাড় কর, আমি তো দোকানে থাকি, তোকে বাড়ির চাবি দিয়ে দেব।’
‘কেন, আমার মাগি নিয়ে যাওয়ার ঘরের অভাব?’
রাজা বিছানা থেকে উঠল। ম্যানিব্যাগ পকেটে ঢোকাল, মোবাইল, হেডফোন তুলল। আয়নায় মুখ দেখল, চুল ঠিক করল। তারপর আবারও বলল, ‘তোমাকে আমার চাই।’
‘কেন, তোর বংশের হক আছে? আমি তোদের ঘরের মাল!’
‘আমি কিন্তু তোমার টোটাল কথা জানি।’
‘কী জানিস? যা এলাকা থেকে শুনেছিস তাই জানিস তো? আর তোর মা যা বলেছে, তাই জানিস। শোন, আমার কাছ থেকে আরও শুনে যা। মিলিয়ে নে, সব কিছু ঠিক ঠিক শুনেছিস কিনা। তোর কাকা খুন হয়ে যাওয়ার পরে আর এক মস্তান আমার উপকার করতে এসে আমাকে খুব লুটেছে। তারপর তোর বাপ আমাকে কোর্টে নিয়ে যেত, আসত। নির্ঘাত তোর মা তোকে বলেছে, আমি তোর বাপকে পাকড়েছিলাম। ভুল কথা, তোর বাপ সুযোগ বুঝে আমাকে দিনের পর দিন ভোগ করেছিল। যাকে বলে রেপ। তোর বাপের জন্য আমাকে হাসপাতালেও ঘুরে আসতে হয়েছে। আর শুনবি? এলাকার লোক যা বলে সব সত্যি, আমার পছন্দ হলে তাকে ঘাড় ধরে নিয়ে এসে শোয়াই। তোকেও পছন্দ, খুব পছন্দ। তুই অন্য কেউ হলে তোকে বিয়ে করে রেখে দিতাম। তোর কাকার মতো জব্দ করে রাখতাম। কিন্তু না, তোকে ছেড়ে দিলাম।’
দুই
কোয়েল ছেড়ে দিয়েছে রাজাকে কিন্তু রাজা মন থেকে কাকিকে হঠাতে পারছে না। লাস্ট তিন মাসে তার যতবার নাইটফল্স হয়েছে, প্রতিবারে সে কাকিকে স্বপ্নে পেয়েছে। ভেতরে ভেতরে সে পাগল হয়ে আছে। সে জেনে গেছে কোয়েলের তাকে পছন্দ। কিন্তু সে বয়েসে ছোট, তাই তাকে টানছে না। সে ভাশুরের ছেলে, তাই তাকে নিচ্ছে না। এই দুটো না হলে কাকিকে সে পেত। কোয়েলের দোকানের কাজ করত চম্পা, বাইরে অনেক কথা বলেছে। আর পাঁচজনের মতো সেসব কথা রাজাও শুনেছে। কোয়েল তার বিউটি পার্লারের কোনও মেয়েকে বাড়িতে অ্যালাউ করে না। কোয়েলের বিউটি পার্লার শুধু লেডিস। এ এলাকার অনেক মেয়ে-বউ তার কাছে যায়। তারা কোয়েলের ফিগার দেখে হিংসে করে, স্কিন দেখে চোখ টাটায়। কোয়েল নিজেকে খুব সাজিয়ে রাখে। তবে সে সোনার দোকান নয়, আবার ইমিটেশন জিনিসেও ঝকমক করে না। তার যা সম্পদ তা শরীর। তার এই শরীরের জন্য এলাকা পাগল।
“কোয়েল ছিল চাক্ষুষ সাক্ষী।
তাকে সরিয়ে দিতে পারলে কেস মিটে যাবে।”
আগে তাকে সবাই অর্জুনের নামে চিনত। অর্জুন মস্তান। পনেরো বছর আগে এই দোকানে কোয়েলের সামনেই অর্জুন গুলি খেয়ে মরেছিল। তারপর অনেক ঝামেলা। পুলিশ, কোর্ট। অর্জুনকে যারা মেরেছিল তাদের দেখেছিল কোয়েল। তাদের নামও বলেছিল। তারা সবাই অ্যারেস্ট হয়। এই সময়টাই কোয়েলের জীবনের সব থেকে বড় সংকট আসে। এ-পার্টি ও-পার্টি, মস্তান, পুলিশ, পরিবার।
কোয়েল ছিল চাক্ষুষ সাক্ষী। তাকে সরিয়ে দিতে পারলে কেস মিটে যাবে। সেই সময় কোয়েলের যাতে কেউ ক্ষতি না করতে পারে তার জন্য অর্জুনের এক বন্ধু জর্নাদন সব সময় তাদের বাড়িতে আসত। আর এ সুযোগ সে কাজেও লাগায়। কোর্টে নিয়ে যেত বড় ভাশুর। সেও ছাড়ে না। সেও কোয়েলকে দিনের পর দিন ভোগ করে। কোয়েল তখন অসহায়। তার আছে বলতে শরীর। এমনকী কেসের আই ও তার কাছে এক দুপুরে এসে বলেছিল, ‘ওদের আমি ফাঁসিতে চড়াব। কিন্তু একদিন তুমি আমার সঙ্গে দীঘা চলো।’ কোয়েল দীঘা যায়নি। ডায়মন্ডহারবার গিয়েছিল। ফুল ডে। ইচ্ছে হয়েছিল, গিয়েছিল। ভালো লাগেনি। গিয়েছিল, তার কারণ আছে। এই আই ও-কে দিয়ে সে জেলে খবর দিয়েছিল। সে সাক্ষী দেবে না। কেস থেকে সরে যাবে। তাকে পঁচিশ লক্ষ টাকা দিতে হবে। সেটা পনেরো লক্ষতে ঠিক হয়। আগে টাকা ব্যাঙ্কে পড়বে, তারপর থেকে কোয়েল আর কোর্টে হাজিরা দেবে না। সাক্ষী বিরূপ হবে। আই ও কথা রেখেছিল। পনেরো লক্ষ টাকা নিজের দায়িত্বে ব্যাঙ্কে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। এক টাকাও কমিশন খায়নি। ঝামেলা মিটলে তার সঙ্গে কোয়েল তারাপীঠ গিয়েছিল। সেকেন্ড টাইম। ফেরার সময় অফিসারকে স্পষ্ট বলে দিয়েছিল, ‘আর কোনওদিন ডাকবে না। ডাকলে আমি আসব না।’
ওরা জেল থেকে বেরিয়ে এসে রটিয়ে দিয়েছিল, অর্জুনের বউ পনেরো লক্ষ টাকা নিয়েছে।
জনার্দন আগেই জানতে পেরেছিল, বলেছিল, ‘তুমি কেস তুলে নেবে। তোমার কোনও ভয় নেই। ওরা আর কোনওদিন জেল থেকে বেরোতে পারবে না। ওদের ফাঁসি কি লাইফার হয়ে যাবে। আমি আছি, তোমার ভয় কিসের?’
কোয়েল স্পষ্ট বলেছিল, ‘তোমার এ বাড়িতে আর আসার দরকার নেই।’
বড় ভাশুর তখন ছক সাজিয়ে ফেলেছে। অর্জুনের দোকানটা তাদের পরিবারের। ওই দোকান তার চাই। কোয়েল এক রাতে দোকান আর বাড়িতে তালা মেরে বাপের বাড়ি চলে গেল। তবে যাওয়ার আগে শাসিয়ে গেল, ‘বিধবা হওয়ার সাত মাস পর তুমি আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে খালাস করিয়ে এনেছ। কাগজপত্র সব আমার কাছে আছে। যদি দোকান বা বাড়ির দিকে হাত বাড়াও, আমি ওই কাগজ থানায় জমা দিয়ে তোমায় জেল খাটাব। আর থানা-পুলিশকে কী করে ম্যানেজ করতে হয় সব আমি জেনে গেছি। দরকারে ওদের গলা জড়িয়ে শোব আর তোমায় একটা একটা করে কেস দেব।’
“এই মেয়ে বেঁচে থাকার অস্ত্র পেয়ে গেছে।”
কোয়েলের বড় ভাশুর সেই থেকে ঠান্ডা মেরে গিয়েছিল। বুঝেছিল, এই মেয়ে বেঁচে থাকার অস্ত্র পেয়ে গেছে।
কেসের দেড় বছর পর সে পনেরো লক্ষ টাকা নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিল। তারও তিন বছর পর কোয়েলের দাদার শালা বলল ওকে বিয়ে করবে। মেয়েকে নিয়ে কোনও অসুবিধে নেই। এই সময়টা কোয়েলের খুশির সময়। দাদার শালা দেবুর সঙ্গে ঘুরছে-ফিরছে। নতুন করে সাজছে। এবং সেসময়ই যথারীতি কোয়েল আবার গর্ভবতী হয়ে পড়ল। দেবু বলল, ‘চিন্তা নেই, বিয়েটা লাগিয়ে দেব। তুমি ওই টাকাটা দাও। বারুইপুরে দোকান নেব।’ কোয়েল জানিয়ে দিল, ‘ওই টাকা আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ। ও টাকায় আমি হাত দিতে পারব না।’ দেবু বেঁকে বসল। কোয়েল বালিগঞ্জের নার্সিংহোমে গিয়ে সাফসুতরো হয়ে এল। তারপর ফিরে এল স্বামীর বাড়িতে। ততদিনে সে একটা বিউটিশিয়ান কোর্স করেছিল। অর্জুনের ইমারতি দোকান এখন প্রিয়াঙ্কা বিউটি পার্লার। সকাল দশটা থেকে একটা-দেড়টা টানা কাস্টমার। আবার বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে ন’টা।
তার নামে অনেক কথা ওড়ে, অনেক গল্প বাতাসে ভাসে। কখনও প্রোমোটার, কখনও এক চোট পাওয়া ফার্স্ট ডিভিশনের ফুটবলার, কখনও এক কবি। প্রিয়াঙ্কা তার মায়ের এই তিনজনকে নামে চেনে।
কোয়েল হাসে, আরও আছে। যাকে যাকে ভালো লাগে—। খুব ভালো লাগে।
এ ভালোলাগা এখন তো রাজাকেও লাগছে তার। পুরো যেন অর্জুন! সেই মুখ। চওড়া কবজি, হাতের পেশি, চৌকো চোয়াল। শুধু একটা খিঁচ, ওই নির্বিষ ঢোঁড়া সাপ ভাশুর অনেকদিন আগে কামড়টা দিয়ে গেছে। তখন দিনের পর দিন দুপুরবেলা ভাশুর আসত। প্রিয়াঙ্কার খোঁজ নিতে। আসলে মেয়ে নয়, লক্ষ্য ছিল সে। তাকে টেনে নিয়ে যেত, পাশের ঘরে। প্রথম দু-এক দিন সে আটকানোর চেষ্টা করেছিল। পারেনি। তখন মানুষটা নানা কথা বলত। কোয়েলে তখন মনে হত, লোকটা তাকে পাওয়ার জন্য বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলছে। আবার কখনও মনে হত, বিয়ের দিন এক দিদিশাশুড়ি হাসতে হাসতে অর্জুনকে বলেছিল, ‘নে এবার নিজের বউ পেয়েছিস, ভালো করে ধামসা। অন্যের মেয়ে-বউ নিয়ে আর টানাটানি করিস নে।’
সে সব দিনে ভাশুর মানুষটা প্রতিদিন সঙ্গম করার পর কাঁদত, ‘আমার ছেলেটা আমার নয়। অর্জুনের। আমার বিয়ের পর অর্জুন দিনের পর দিন ওর বউদির সঙ্গে শুয়ে গেছে। রোজ দুপুরে। রোজ। সবাই জানে। আমি প্রতিবাদ করেছিলাম বলে আমাকে হুমকি দিয়েছিল, খুন করে দেব। দ্যাখ, এখন তুই-ই খুন হয়ে গেলি।’
উলঙ্গ কোয়েল ভাশুরের পাশে শুয়ে শুয়ে দেখত, শোক আর বদলা কেমন মিলেমিশে যায়।
না, সে রাজাকে ডাকবে না। এ বাড়িতে আর ঢুকতে দেবে না। রাজাকে তার যতই ভালো লাগুক, তার শরীর যতই আনচান করুক। কোয়েল কলঘরে গেল। আবার হুড়মুড় করে চান করল। শরীর কি শান্ত হল?
সে মোবাইল ফোনটা নিয়ে তার এক বেকার প্রেমিক কবিকে ফোন করল, ‘এই ভরদুপুরবেলা কী করছ বাড়িতে? এসো, আমি কবিতা শুনব!’