বাংলা নববর্ষ ১৪৩১ বিশেষ সংখ্যার লেখা।
মৃত পশুর চামড়া কাটার প্রয়োজনে, হাড় ভেঙে ভিতরের মজ্জা বের করে খাওয়ার তাগিদে একদিন প্রস্তরায়ুধ তৈরি করেছিল মানুষ। আনুমানিক কুড়ি লক্ষ বছর আগে মানুষ (Homo habilis) পাথরের অস্ত্র তৈরি করে খাদ্য সংগ্রহ করতে শিখেছিল। আর সে (Homo erectus) আগুনে মাংস পুড়িয়ে খেতে শিখেছে মাত্র চার লক্ষ বছর আগে। আগুনে ঝলসে মাংস খেতে শিখতে পারাটা ছিল মানব সভ্যতার জন্যে একটা বড় লাফ। নৃতাত্ত্বিক রিচার্ড রংহ্যাম মনে করেন তখন থেকেই মানুষের প্রকৃত বৌদ্ধিক বিকাশের সূত্রপাত। এতদিন মানব শরীরের যে শক্তি ব্যায় হত পাচনক্রিয়ায়, রান্না করা খাবার খেতে শুরু করার ফলে সেই শক্তির অনেকটা সঞ্চিত হতে শুরু করল। ব্রেন ডেভেলপমেন্টে মন দিল শরীর। মানব মস্তিষ্কের বিকাশের কারণেই ক্রমে ক্রমে তারা (Homo Sapience) তৈরি করল আরও সূক্ষ্ম পাথরের অস্ত্র, বঁড়শি, তীর, সূচ ইত্যাদি। ক্রমে ক্রমে শিকার করা পশুকে নিয়ে নাচতে নাচতে গুহায় ফেরা, যাদু বিশ্বাসকে রূপ দেওয়া, শিকার করার অভিজ্ঞতা বিনিময় থেকে শুরু করে রান্না করা, খাবার ভাগ করে খাওয়ার সময় গল্পগুজব করতে করতেই জীবন যাপনের যাবতীয় জটিল উপাদানগুলির মিথস্ক্রিয়ায় জন্ম হচ্ছিল সংস্কৃতির। তারপর শুরু হল অভিপ্রয়াণ। আনুমানিক পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে পায়ে হেঁটে অস্ট্রেলিয়া পৌঁছে গেল মানুষ। মানব সভ্যতার জন্য আরও চমক তখনও অপেক্ষা করে ছিল। প্রকৃতি উপাসনা, দৈবে বিশ্বাস, মূর্তি পূজা, টোটেম-ট্যাবু, ভেষজ চিকিৎসা, গোষ্ঠীর আইন কানুন, জন্ম-বিবাহ-মৃত্যু সংক্রান্ত আচার অনুষ্ঠান, খাদ্য সংরক্ষণ, বাসস্থান নির্মাণ, জল বহন করে নিয়ে যাওয়া, আবহাওয়ার উপযোগী পোশাক তৈরি ইত্যাদি সামাজিক ব্যবস্থা স্পষ্ট রূপ নিতে শুরু করল। শেষ হিমযুগ কাটিয়ে উঠে সে খেয়াল করল প্রকৃতির বুকে আশ্চর্য এক পরিবর্তন শুরু হয়েছে। আনুমানিক দশ হাজার বছর আগে কৃষিকাজের পত্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যাযাবর জীবনে ইতি টেনে স্থায়ী বসতি স্থাপন করতে শুরু করল কৃষিক্ষেত্রকে ঘিরে। বস্তুগত সংস্কৃতি পরিপূর্ণ বিকাশ লাভ করল এই সময়। বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে ‘ক্লাইমেট রিফিউজি’ কথাটা আজ আর অচেনা নয়। কিন্তু আমরা মনে রাখব এর আগেও প্রাকৃতিক কারণে শত শত গোষ্ঠী এক দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যেতে বাধ্য হয়েছে, এক দেশের মানুষ অন্য দেশ দখল করে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে সেই দেশের নিজস্ব সংস্কৃতিকে। এর বিপরীত দিকটাও স্মরণীয়— দেশ বদলের কারণে তাদের নিজস্ব খাদ্যসংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন ঘটাতে বাধ্য হয়েছে গোষ্ঠীগুলি। স্থান ভেদে নতুন প্রাকৃতিক পরিবেশকে মেনে নিয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থান পরিবর্তনে মাটির প্রকৃতি, আবহাওয়া, জলবায়ু ইত্যাদি প্রাকৃতিক পরিবেশ বদলে যায়। কিন্তু কৃষিকাজের প্রাথমিক কৌশলগুলির পরিবর্তন হয় না। মানুষ যেখানে যায় গোষ্ঠীস্মৃতিকে যেমন বহন করে নিয়ে যায় তেমনি নিয়ে বস্তুগত সংস্কৃতিকে। দেশ কাল ভেদে জমি তৈরি, বীজ বোনা, ফসলের পরিচর্যা, ফসল কাটা, ঝাড়া, বাছাই, পেষাই থেকে সংরক্ষণ পর্যন্ত পর্যায়গুলি কার্যত যেমন এক, তেমনি প্রতিদিন ক্ষুধার মুখে চব্য চোষ্য লেহ্য পেয় যোগান দেওয়ার ক্রম পর্যায়গুলিও এক। সন্দেহ নেই দুটোই বড় কাজ এবং সময় সাপেক্ষ কাজ।
রান্নাঘরকে একটা দেশের সাংস্কৃতিক জাদুঘর বলা চলে। সেই জাদুঘর থেকে প্রস্তুত করা খাবারের যোগান দেখেই দেশের আবহাওয়া, প্রধান ফসল, অর্থনৈতিক অবস্থা, ধর্ম আচার বিচার, পুষ্টি সংক্রান্ত ধারণা ইত্যাদির খসড়া আঁকা সম্ভব। নানা রকম রান্নাকে ঘিরে যেমন বিধি নিষেধ আছে তেমনি আছে অরন্ধন বা মহোৎসবের মত কর্মকাণ্ড। পূজ্য প্রণম্য শক্তি, দেবতা, ঈশ্বর এবং অবতারের প্রিয় খাদ্যর ইতিহাস, পানাহার দিয়ে দেবতা বা ঋষিকে তৃপ্ত করা ইত্যাদি পৌরাণিক আখ্যান চর্চা করলেও আদিম সমাজ বা পরবর্তী সমাজের খাদ্যাভ্যাস ও রান্নাঘর বিষয়ে একটা ধারণা তৈরি করা সম্ভব। বছরে একদিন একসাথে খাওয়া বা একটি নির্দিষ্ট তিথিতে উপবাস ও পারণ প্রথাই তো এখনও সমাজকে বেঁধে রেখেছে। সামাজিক উৎসবে, আনন্দে ও শোকে মানুষ মিলিত হলেই রান্নার তোড়জোড় শুরু হয়। সংস্কৃতি ভেদে তার হয়তো নানা রূপ কিন্তু দেশের সাংস্কৃতিক বিবর্তনের প্রায় সবকটি ধাপ এক জায়গায় দেখতে পাওয়া যায় এই পাকশালায় বা হেঁশেলে। পোড়া মাটির হাঁড়ির ভাঙা টুকরো আর মজুদ শস্যর অবশিষ্ট অংশ দেখেই তো ভারত ইতিহাসের একটা অংশের পুনর্নির্মাণ করেছেন নৃতাত্ত্বিকরা! হরপ্পা মহেঞ্জদারো থেকে মধ্যপ্রদেশের মির্জাপুর, অন্ধপ্রদেশের কারনুল বা বাংলার বর্ধমানের পান্ডুরাজার ঢিবি— সে যুগের মানুষ নেই, রয়ে গেছে তার রান্নাঘরে ব্যবহৃত চিত্রিত বাসনপত্র, শবাধারে দেওয়া খাবারে সাজানো হাঁড়ি। আগুনের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, জ্বালানী, রান্না করার পাত্রের আকার, খাওয়ার পাত্র, এলাকার প্রধান খাদ্য শস্য, সব্জি মাংস মশলা কাটা বা বাটার যন্ত্র, ধাপে ধাপে প্রস্তুতিকরণ, দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণ এবং সবকিছুর উপরে থাকে রান্না করা খাবারের স্বাদ— নৃতাত্ত্বিকরা এই নিয়েই ইতিহাস উদ্ধারে মগ্ন।
ম্যানেজমেন্ট গুরুরা অনেক আলোচনাতেই মাস্টার সেফদের উদাহরণ দিয়ে থাকেন। যিনি রান্না করেন তাকে প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিতে হয় কী রান্না করবেন। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেলেই তিনি জোগাড় করেন সেই নির্দিষ্ট রান্নার প্রাথমিক উপাদানগুলি। তারপর প্রয়োজন মত সেগুলো কেটে ধুয়ে নিয়ে মশলাপাতি সাজিয়ে উনুনের কাছে যান বাসন পত্র নিয়ে। পাকা রাঁধুনি হলে যেমন তিনি চাটুতে ডাল রান্নার বা ভাতের হাঁড়িতে মাছ ভাজার পরিকল্পনা করবেন না, তেমনি উনুনে আগুন ধরিয়ে তিনি পরিকল্পনা করবেন না আজ কী রান্না হবে। প্রথাগত ভাবে ম্যানেজমেন্ট না পড়েও এক একজন রাঁধুনি তাই দক্ষ ম্যানেজারদের মতই ক্রমান্বয়ে কাজ করে চলেন। রান্না বিষয়টা যেহেতু নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট অনুপান সঠিক মাত্রায় ব্যবহার করার কৌশলের উপর দাঁড়িয়ে আছে অতএব একটুও অমনোযোগী হওয়ার উপায় নেই রাঁধুনির। অমনোযোগী হলেই রান্নার দফারফা। বেছে নেওয়া তরিতরকারির শেষ স্বাদ বিষয়ে তাঁর স্পষ্ট ধারণা আছে বলেই কাজটি তিনি যথাযথ ভাবে শেষ করতে পারেন।
একটা বড় সময় রান্নাঘর দখল করে রেখেছিল কাঠ, পাথর ও মাটির তৈরি বাসনপত্র। ক্রমে ক্রমে তামা, কাঁসা, পিতল, ব্রোঞ্জ, লোহা এমনকি সোনা ও রূপার তৈরি বাসনপত্রেরও ব্যবহার শুরু হয়। কৃষির উন্নতির সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বদলেছে সেই সব বাসনপত্রের আকার আয়তন। কৃষক, কামার, কুমোর ও রাঁধুনির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কেই রান্নাঘর সচল থাকে। কৃষিক্ষেত্র থেকে পৌষ্টিকতন্ত্রে পৌঁছতে ফসলকে যে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয় তার প্রতিটি ধাপে আছে বস্তগত সংস্কৃতির প্রযুক্তিগত কৌশলের অবদান। রাজবাড়ির প্রধান পাচক, ধনবান গৃহস্তর রাঁধুনি বা মধ্যবিত্ত-দরিদ্র গৃহবধূ— যেই হন না কেন এই প্রযুক্তির ব্যবহার তাকে করতেই হয়। আমরা সংক্ষেপে বাংলার রান্নাঘরের প্রযুক্তিগত কৌশলের দিকটি আলোচনা করব। কৃষিকাজ ও ফসল ফলানোর আলোচনা অন্যত্র করা যাবে।
পলিমাটি সঞ্চিত নদীমাতৃক বাংলার প্রধান খাদ্য মাছ ভাত। মাছে ভাতে আছে বলেই গ্রামগুলি এখনও টিকে আছে। গঙ্গা, হুগলী, অজয়, দামোদর, ময়ূরাক্ষী, তিস্তা, তোর্সা, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা কত না নদ নদী এখানে। সঙ্গে আছে বিল, ঝিল, পুকুর, খাল। আউস আমন বোরো চাষের কথা ধরলে প্রায় সারা বছর বাংলায় ধান চাষ হয়। অতএব সে দেশে গাওয়া ঘি, ভাজা মাছ ও শাক সহযোগে গরম ভাত পরিবেশন করলে গৃহস্থ বা অতিথি প্রসন্ন হবেন সন্দেহ নেই। তখন আমরা মনে রাখি না এই পদগুলি কাটা, ঝাড়া, বাছা, পেষাই, সংরক্ষণ ও রান্নার মত ধাপগুলি অতিক্রম করেই পাতে পরিবেশন করা হয়েছে। প্রধান খাদ্য শস্য ধানের কথাই বলা যাক।
পাকা ধান কাটার জন্য কাস্তে, হেঁসো, কাঁচি ব্যবহার করা হয়। তিনটি অস্ত্রই লোহার তৈরি। গ্রাম বাংলার কামারশালায় চাষের মরশুম শুরু হলেই কাস্তে, হেঁসো, কাঁচি পাজাতে বা ধার দিতে ভিড় বেঁধে যায়— কার ধার পড়েছে কার বাঁট ভেঙেছে। তখন নেহাইয়ের উপর ঠকা ঠাই ঠাই ঘা পড়ে হাপর টানা চলে দিন রাত। চার পাঁচ গুচ্ছ কাটা ধান এক জায়গায় করে তৈরি হয় একটা ধানের আঁটি। খড়ের আঁটি গণনার জন্য পণ ও কাহন শব্দ দুটি এখনও শ্রমিকরা ব্যবহার করে থাকেন। মূলত কে কতটা কাজ করছে আর ক্ষেতে কত ফসল ফলেছে বুঝতে এই প্রাচীন গণনা পদ্ধতি ব্যবহৃত হয় আজও। ৪ আঁটি খড়ে ১ গণ্ডা। ২০ গণ্ডা খড়ে হয় ১ পণ। ১৬ পণ খড়ে ১ হয় কাহন। ধান সহ খড়ের আঁটি বোঝা করে মাঠ থেকে খামারে আনা হয় মাথায় চাপিয়ে, বাঁকে চাপিয়ে বা গরুর গাড়ি, ট্রাক্টর বোঝাই করে। কেউ গাদা দিয়ে রাখে কেউবা দিন কয়েকের মধ্যেই ঝাড়ান মাড়ান সেরে নেয়। খড় থেকে ধানকে আলাদা করতে এক একটা আটিকে মাটিতে, তক্তায় বা শক্ত ঝুড়ির উপর আছাড় মারা হয়। তাতেই ধান ঝরে পড়ে। কুলোর হাওয়া দিয়ে ধান থেকে খড় কুটো আলাদা করে তবে বস্তাবন্দি হয় ধান। এখন কম্বাইন হারভেস্টর মেশিন এসে যাওয়ার কারণে মাঠেই ধান কাটা ঝাড়ার পর চলে যাচ্ছে রাইস মিলে। খড়ের দফারফা করে দিচ্ছে মেশিন। এই খড় মূলত গবাদি পশুর খাদ্য। আবার ঘর ছাইতে, মরাই তৈরি করতে, জ্বালানী হিসেবে, দড়ি তৈরি করতেও ব্যবহৃত হয়। আজও গ্রাম বাংলার রান্নাঘরে খড়ের তৈরি বিঁড়ে ব্যবহার হয় মেঝেয় হাঁড়ি বসাতে।
রোদে শুকনো করা ধান জালা, হাঁড়ি, মটকি, মরাই, গোলা বা বস্তায় ভরে সংরক্ষণ করা হত। জালা, হাঁড়ি, মটকির ব্যবহার এখনও প্রচলিত— মাটির তৈরি এই ছোট বড় পাত্রগুলির বিভিন্ন নামকরণ হয়েছে আকার আকৃতি ও স্থানভেদের কারণে। তবে অনেক ধান সংরক্ষণ করতে আজও মরাই ও গোলার বিকল্প নেই। গোলা তৈরি হয় বাঁশের বেতা দিয়ে। বাঁশের বেতা বা চ্যাঁচাড়ী বুনে গোলাকৃতি বড় ফানেলের মত গোলা তৈরির পর সেটা একটা বেদি বা ভীটের উপর স্থাপন করা হয়। মাথায় দেওয়া হয় খড় বা টিনের ছাউনি। একটা ছোট প্রবেশ পথ থাকে। যেখান দিয়ে ভিতরে ঢুকে ভিতরের দিকে পুরু মাটির প্রলেপ দিয়ে চার পাশের ফাঁক বন্ধ করা হয়। এবার বাইরে থেকে ভিতরে ঢেলে দেওয়া হয় মন মন ধান। গোলার আকৃতি অনুযায়ী একশো থেকে দুশো মন পর্যন্ত ধান সংরক্ষণ করা সম্ভব। মরাই তৈরি হয় সম্পূর্ণ আলাদা পদ্ধতিতে। পুরু ও লম্বা খড়ের দড়ি তৈরি করে বেদির উপর বৃত্তাকারে পাক দিয়ে গোলাকৃতির মরাই তৈরি ও ধান ঢালা এক সাথে চলতে থাকে। নিচে ও চারধারে খড়ের আঁটি সাজিয়ে সেটাকে ঘিরে বেড়া দেওয়া হয়। নিচের থেকে তৈরি হয়ে শেষ হয় ছাউনি দিয়ে, খোলার সময় উপর থেকে খুলতে খুলতে নামা হয়। মরাইয়ে ঢোকা বের হওয়ার কোন রাস্তা থাকে না। ছাউনি সরিয়ে খড়ের বেড়ি খুলে ধান বের করে আবার ছাউনি দেওয়া হয়।
‘কত ধানে কত চাল’ প্রবাদটি বহুল প্রচলিত। ধানের গায়ে খোসা আছে। খোসা খুলে ফেলে না দিলে চাল বের হয় না। পক্রিয়াটি শ্রমসাধ্য। এবং পদ্ধতির হের ফের হলে চালের পরিমাণ কম বেশি হয়। এই সব কারণেই প্রবাদটির উৎপত্তি। দানা শস্যের খোসা ছাড়াতে ও শস্য গুড়ো করতে শিল নোড়া, উদুখল, হামান দিস্তা, ঢেঁকি ইত্যাদির ব্যবহার হয়ে আসছে প্রাচীন কাল থেকেই। শিলে দানা শস্যকে নোড়ার সাহায্যে চাপ দিয়ে বা ঠুকে ঠুকে পিসে ফেলে খোসা ও দানা আলাদা করা হয়। এতে সময় লাগে। ঢেঁকি সেই কাজটাই দ্রুত করে। ধান ভাঙার জন্য গ্রামে গ্রামে বর্ধিষ্ণু বাড়িতে আগে ঢেঁকিশাল। ঢেঁকিশাল মুখরিত থাকত উৎসবে পার্বণে। ধর্ম কর্ম আচার অনুষ্ঠানে ঢেঁকিতে কোটা গুঁড়ি আজও লাগে বলে এখনও অনেক সমাজে ঢেঁকি টিকে আছে। অন্তত দুজন ছাড়া ঢেঁকি চালু রাখা যায় না। একজন ঢেঁকিতে পাড় দেয়, অন্যজন ঢেঁকির গড়ে দেয় ধান। ভিজে চাল থেকে গুঁড়ি তৈরির কাজেও ঢেঁকি ব্যবহৃত হয়; শীতকালে পিঠে তৈরি করতে যে গুঁড়ির বিকল্প নেই। যাঁতার কৌশলকে কাজে লাগিয়েই বর্তমানে মেশিনের সাহায্যে খোসা ও চাল আলাদা করা হয়। দ্রুত কাজ হয়, সামান্য অর্থ লাগে বলেই মানুষ হাস্কিং মিলের ধারে লাইন দেয়। রোদে শুকনো ধান থেকে সরাসরি চাল তৈরি হলে হয় আলো চাল বা আতপ চাল। রোদে কতটা শুকনো করা হয়েছে তার উপর নির্ভর করে চালের পরিমাণ। খোসা আলাদা করার সময় আতপ চাল সহজেই ভেঙে যায়। আর ধান জলে ভিজিয়ে বা একবার সিদ্ধ করে রোদে শুকিয়ে খোসা ছাড়ান হলে হয় সিদ্ধ চাল। এই পদ্ধতিতে চাল কম ভাঙে। চিড়ে, খই, মুড়ি তৈরি করার পদ্ধতি সম্পূর্ণ আলাদা। বাছাই করা শুকনো ধান একদিন জলে ভিজিয়ে রেখে জল ঝরিয়ে ঢেঁকিতে পিসে চিঁড়ে তৈরি হয়। কুলোর সাহায্যে চিঁড়ে আর তুষ আলাদা করা হয়। গরম খোলায় বালিতে ফেলে শুকনো ধান ভাজলে হয় খই। খইয়ের গায়ে ধানের খোসা লেগে থাকে বলে চালুনিতে ফেলে খই নাড়া হয়। তাতে ধানের খোসা নিচে পড়ে যায়। মুড়ি তৈরির পক্রিয়া একটু জটিল। সিদ্ধ চালকে জলে ভিজিয়ে প্রথমে নুন মাখিয়ে শুকনো করা হয়। কয়েকদিন পর প্রথমে শুকনো খোলায় আগুনের তাপে চালকে হালকা ভাজা হয়, পরে ছোট খোলায় গরম বালির উপর সেই চালকে অল্প অল্প দিয়ে নাড়লেই চাল ফুলে ফেঁপে মুড়ি হয়ে যায়। চিঁড়ে ও মুড়িতে গুড় মাখিয়ে মোয়া তৈরি করা হয়। মোয়া দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়। চিঁড়ে মুড়ি ভাতের বিকল্প খাবার হিসেবে জনপ্রিয়। ভাত তৈরির জন্য চাল ধুয়ে হালকা গরম জলে হাঁড়িতে দিয়ে দীর্ঘক্ষণ ফোটানো হয়। যতক্ষণ না চাল সিদ্ধ হয় ততক্ষণ হাঁড়িতে জলের পরিমাণ ঠিক আছে কিনা নজর রাখতে হয়। পরে ফ্যান ফেলে দিয়ে শুকনো ঝরঝরে ভাত খাওয়ার জন্য রাখা হয়। তবে ফ্যান না ঝরিয়ে ভাত খাওয়াও প্রচলিত আছে। পরিমাণ মত ঘি বা দুধ, সব্জি, ডাল, মাছ বা মাংস দিয়ে ভাত খেতে পেলে বাঙালী আর কিছুই চায় না। যদিও এই সামান্য আয়োজনটুকুই সবার পক্ষে করে ওঠা সম্ভব হয় না। খরা বন্যায় প্রকৃতি বিরূপ হয়। অর্থনৈতিক অবস্থার পালা বদল হয়। কৃত্রিম অভাব তৈরি করা বাজারে। খাদ্য সংরক্ষণ ও বীজ সংরক্ষণের ভাবনা এই কারণেই তৈরি হয়। শাক পাতা খেয়ে বেঁচে থেকেছে মানুষ। কিন্তু সংরক্ষিত বীজ রান্না করে খেয়ে নেয়নি। অপেক্ষা করেছে অনুকূল প্রকৃতির, ভালো সময়ের। দেখা গেছে চিড়ে, খই, মুড়ি, চালভাজা দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা গেলেও ভাত এক দুদিনের বেশি রেখে খাওয়া অস্বাস্থ্যকর। আবার জলে ভেজানো একদিনের দুদিনের বাসী পান্তা ভাত বাংলার সব শ্রেণীর মানুষের কাছেই জনপ্রিয় একটি খাবার। অর্ধেক সিদ্ধ ভাত পচিয়ে হাঁড়িয়া বা দেশী মদ তৈরিও একটা প্রাচীন পদ্ধতি। এই হাঁড়িয়ায় গুণেই হাজার হাজার বছর জলে কাদায় কাজ করে দিব্বি আছে সমাজের একটা বড় অংশ।
আমরা ধান নিয়েই যতটুকু আলোচনা করেছি তাতেই কাটা, ঝাড়া, বাছাই, সংরক্ষণ, পরিমাপ, রান্না, পরিবেশন সব ক্রমান্বয়ে চলে আসছে। অর্থাৎ এই কয়েকটি ধাপ অতিক্রম না করে কৃষিক্ষেত্র থেকে পৌষ্টিকতন্ত্রে পৌঁছায় না খাদ্য। সে খাদ্য ধান গম ডাল সরষে শাক মাছ দুধ ভাত যাই হোক না কেন। পাকা ফসল, সব্জি বা মাছ মাংস প্রথমেই কাটতে হয়। কাস্তে হেঁসো এক ফলা বিশিষ্ট অস্ত্র। দুটোই ছোট বড় আকৃতির হয়, হালকা এই অস্ত্রের একদিকে ধরার বাঁট থাকে। কাঁচি দুই ফলা বিশিষ্ট অস্ত্র। মূলত ফসল কাটতেই এই অস্ত্রগুলি ব্যবহার হয়। হাতল যুক্ত কুড়ুল প্রায় লক্ষ বছর ব্যবহার করছে মানুষ। মানুষের আত্মরক্ষার ও শিকারের কাজে কুড়ুলের ব্যবহার জনপ্রিয় ছিল। তবে সেসব হাতল যুক্ত কুঠারের মাথায় ঘষা পাথর বাঁধা থাকত। গাছ পালা কেটে সাফ করতে, রান্নার জ্বলানি সংগ্রহের কাজে কুড়ুল আজও জনপ্রিয়। উল্লেখিত প্রত্যেকটি অস্ত্র লোহার তৈরি। কাস্তে বা হেঁসোর মত কুড়ুল ধারালো নয়। ধারে না কাটলেও শক্ত কিছুকে ভারে কাটতে এর বিকল্প নেই। বাংলার রান্নাঘরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হল বটি। সব্জি কাটার জন্য সরু পাতের হালকা ওজনের বটি ব্যবহৃত হয়। ভারি মোটা পাতের ধারাল আঁশ বটি ব্যবহার করা হয় মাছ কাটতে।
ফসল ও খাদ্য দ্রব্য পচনশীল। দ্রুত পচনশীল ও আংশিক পচনশীল খাদ্য দ্রব্য সংরক্ষণ না করলে নষ্ট হয়ে যায়। সব্জি যতক্ষণ গাছে লেগে আছে বা বেঁচে আছে ততক্ষণ অসুবিধা নেই। ফসল পাকলে এবং গাছ থেকে কেটে নিলে ব্যকটেরিয়া বা ছত্রাকের আক্রমণে তাতে পচন ধরবেই। এই নিয়মের কোন ব্যতিক্রম নেই সারা পৃথিবীতে। বাংলায় নির্দিষ্ট কয়েকটি পদ্ধতিতে খাদ্য সংরক্ষণ হয়ে থাকে- সরাসরি রোদে শুকিয়ে বা আগুনে শুকিয়ে, নুন বা মশলা মাখিয়ে, চিনি বা গুড়ের গাঢ় দ্রবণে ডুবিয়ে, তেলে ডুবিয়ে, তেঁতুল লেবুর রসে জারিয়ে, গাঁজিয়ে এবং বায়ু নিরোধক হাঁড়ি-মটকির মধ্যে রেখে। অনেক মাছ ধরা পড়লে আজও নুন মাখিয়ে রোদে শুকিয়ে যেমন সারাবছরের জন্য সংরক্ষণ করা হয়, তেমনি তেঁতুলের কাত্থ দিয়ে আগুনে ফুটিয়ে ঘন করে মাছের টক বানিয়ে প্রায় একমাস ধরে খাওয়াও প্রচলিত আছে। এই সব কিছু রাখতে কিন্তু তামা পিতলের বাসন ব্যবহৃত হয় না আজও। কারণ টকের সংস্পর্শে এলেই ধাতুগুলি বিক্রিয়া শুরু করে। পোড়া মাটির, কাচের বা চীনে মাটির বয়াম এই সব কাজের জন্ত আদর্শ পাত্র। আখের রস ফুটিয়ে গুড় বা চিনি তৈরি করে সারাবছর রাখা যায়। আমের আচার বা আমসত্ত্বও তাই। পাস্তুরিকরণ পক্রিয়ায় দুধ থেকে যে দই, ছানা, পনীর, মিষ্টি তৈরি হয় তা বেশ কিছুদিন পর্যন্ত সুন্দর থাকে। হাঁড়ির বা কৌটোর মুখ বার বার খোলা বন্ধ হলে খাবার দ্রুত নষ্ট হয়। বাঙালী তাই গুরুত্বপূর্ণ সংরক্ষিত খাবার বা বীজ শিকেয় তুলে রাখাই পছন্দ করত। বরফের প্রাচুর্য ছিল না বাংলায়। ইদানিং ফ্রিজ এসে সেই সমস্যা মিটিয়েছে বটে তবে খাদ্যগুণ নষ্ট করতে যন্ত্রটির জুড়ি মেলা ভার।
উনুনের কথা না বললে আলোচনা অসমাপ্ত থাকবে। নিয়ন্ত্রিত আগুনের ব্যবহার সভ্যতার অগ্রগতিতে একটা বড় ভূমিকা নিয়েছে। বাংলার রান্নাঘরের মাটির তৈরি উনুন এর ব্যতিক্রম নয়। সামান্য গর্ত খুড়ে কাদা মাটির সাহায্যে গর্তের চারপাশে জ্বালানী প্রবেশের মুখ রেখে তিন কোণা যুক্ত উঁচু বেদি তৈরি করা হয়। এবার এর ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী আকার ও প্রকৃতি ছোট বড় হয়। ধান সিদ্ধর উনুন বা আখের রসে জ্বাল দেওয়ার উনুন অনেক বড় হয়। সাধারণ সব্জি রান্নার উনুন ও ভাত রান্নার উনুনে পার্থক্য থাকে। দুধ জ্বাল দিতে ছোট উনুন ব্যবহার করা হয়। হাস্কিং মেশিনের বহুল প্রচলন যেমন হয়েছে তেমনি বেড়েছে গ্যাসের উনুন। মাঝখানে কয়লা ও কেরোসিনের স্টোভ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। যে উনুন ভাঙলে সহজেই মাটি মেখে তৈরি করে নেওয়া যেত, জ্বালানী পাওয়া যেত ক্ষেতের ফসল থেকে বা হাতের নাগালে সেই উনুনের দখল নিয়েছে আজ বহুজাতিক। সময়ে গ্যাস বুক না করলে যেমন উনুন জ্বলবে না তেমনি যন্ত্র বিগড়ে গেলে ছুটতে হবে শহরের দোকানে।
আলোচনার শেষে ফসল পক্রিয়াকরণের কাজে বাংলায় ব্যবহৃত বস্তুগত সংস্কৃতির এই ঐতিহ্যবাহী জিনিসগুলির একটা তালিকা করা যেতে পারে।
কাটা- কাস্তে, কাঁচি, ছেদনী, হেঁসো, বটি, কাটারি, কুড়ুল, কুরনি, জাঁতি
ঝাড়া- কুলো, চ্যাঙারী, পেতে, ঝুড়ি
বাছাই- চুবড়ি, চালুনি, ধুচুনি, ছাঁকনি, কুলো, ঝাঁঝরি
পেষাই- শিল নোড়া, উদুখল, হামান দিস্তা, ঢেঁকি, জাঁতা, চাকি
সংরক্ষণ- জালা, নাদ, হাঁড়ি, মটকি, মরাই, গোলা, বস্তা, ধর্মগোলা
জলের পাত্র- ঘড়া, কলসি, ঘটি, বোকনা, জালা, বদনা, ঘট, বালতি, গাড়ু
পরিমাপ- তোলা, ছটাক, পোয়া, সের, মন, পলা
আগুন- উনুন, চুলা
রান্না – হাড়ি, কড়াই, খোলা, হাতা, খুন্তি, চামচ, গামলা, ডেচকি, ডাবু
পরিবেশন- থালা, বাটি, গ্লাস
পর্যাপ্ত নিদ্রার অভাব ঘটলেও আহার এবং মৈথুন এখনও মানুষের কৌতূহলকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে। ইন্টারনেটে হরেক রকমের বিনোদনের উপাদান থাকলেও ইউটিউবে রান্নার চ্যানেলের ভিউয়ার্স সংখ্যা দেখলেই বোঝা যায় সাংস্কৃতিক বিনিময় থেমে নেই। স্বাদ বদলাতে ও রান্নায় নতুন মাত্রা যোগ করতে এই ভিডিওগুলি বিচিত্র ভূমিকা পালন করছে। হয়তো সেই কারণেই বাংলার বিচিত্র রান্না ও রান্নাঘরের জিনিসপত্রের বাজার কিছুটা চলে গেছে বহুজাতিকের হাতে। রেডিমেড কিচেন কেবিনেট, রেডিমেড মশলা, গ্যাসের উনুন, মাইক্রোওভেন অনেকটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে গত দুই দশকে। নতুন জনপ্রিয় শব্দ এসেছে ‘কিচেন ডেকর’। তবে স্টিল বা এলুমিনিয়াম— যে হাঁড়িতেই রান্না হোক— সময় কম বেশি একই লাগে, কোন ধাপ এড়িয়ে রান্না করা প্রায় অসম্ভব, আর ফুটতে থাকা ভাত বা মাংসের গন্ধ মানুষের মনকে উতলা করে আজও। ঘ্রাণ পেলে, খাবার দেখলে লালা নিঃসরণ হবেই। “মন বলে তায় ‘খাব খাব’, মুখ চলে তায় খেতে”… যুদ্ধে জিতে ফিরে আসতে হয় সেই দেশী ডিসে—হরেকরকম ভর্তা, বেগুন পোড়া, আলুভাতে, কাঁচা লঙ্কা, পেঁয়াজ, পান্তাভাত, আমানি, টক, শাক- এখনও পর্যন্ত কেউ যে ডিসের বিকল্প আমদানি করতে পারেনি বাংলায়।
কৃষি কাজ ও রান্না সাথে অনেক কিছু জানতে পারা গেল।খুবই সাবলীল লেখা তথ্য ভিতরে সম্পূর্ণ আলাদা করা আছে।রান্না র সরনজাম ও উপকরনের বরননা আছে।
মনোগ্রাহী এবং তথ্য সমৃদ্ধ লেখা।