প্রবাদ আছে দেবী দুর্গা মর্ত্যে আসার পর গহনা পরতে আসেন জোড়াসাঁকোর শিবকৃষ্ণ দাঁ-র বাড়িতে, আহার সারেন কুমোরটুলির অভয়চরণ মিত্রের বাড়িতে আর গান শোনেন শোভাবাজার রাজবাড়িতে। এখানে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির উল্লেখ থাকলেও সেটা বাহুল্য হত না।
একসময দুর্গাপূজার জাঁকজমকে জোড়াসাঁকোর দাঁ বাড়ির সঙ্গে সমানতালে পাল্লা দিত জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িও। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজা ছিল আড়ম্বর ও আভিজাত্যের শেষ কথা। যদিও কালের প্রবাহে তা হারিয়ে গেছে বহু আগেই, তবু দখল করে আছে রঙিন এক ইতিহাস।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নীলমণি ঠাকুর। তাঁর বাবা জয়রাম ঠাকুরের হাত ধরেই ঠাকুর পরিবারের যাত্রা শুরু। যদিও তাঁর ঠাকুরদা পঞ্চানন কুশারী তথা পঞ্চানন ঠাকুর এই বংশের প্রথম উল্লেখযোগ্য মানুষ। তিনি ছিলেন একাধারে জাহাজের পণ্যসরবরাহকারী বা Stevedore এবং কবিয়াল। কলকাতার গোবিন্দপুরে ছিল তাঁর বাস। জয়রাম ঠাকুর প্রথমদিকে ছিলেন চন্দননগরে ফরাসিদের বানিয়া এবং পরবর্তীকালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বানিয়া ও আমিন। ফলে প্রচুর টাকা উপার্জন করেছিলেন। নীলমণি ঠাকুর নিজেও ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান এবং পরবর্তীকালে উড়িষ্যার কালেকটরের সেরেস্তাদার। যার ফলে তাঁর হাতেও প্রচুর অর্থ ও ধনসম্পদ এসেছিল। পরে ভাইয়ের সঙ্গে নানা বিষয়ে মতভেদ ও বিবাদের জেরে নীলমণি ঠাকুর শালগ্রামশিলা নিয়ে একবস্ত্রে পাথুরিয়াঘাটার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। কলকাতার মেছুয়াবাজারের জোড়াসাঁকোতে বৈষ্ণবচরণ শেঠের বাড়িতে কবির লড়াইয়ে অংশ নিয়ে বৈষ্ণবচরণের নেকনজরে পড়েন তিনি। তাঁর থেকে পাওয়া জমিতে নীলমণি ঠাকুর তৈরি করেন একটি আটচালা, যা কালক্রমে পরিচিত হয়ে উঠলো জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি নামে।
যেহেতু জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির প্রতিষ্ঠা নীলমণি ঠাকুরের হাতে, তাই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে দুর্গাপূজার সূচনাও হয়েছিল নীলমণি ঠাকুরের হাত ধরেই। সালটা ছিল ১৭৮৪। সেবার নীলমণি ঠাকুর দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির খোলার ছাউনির চালাঘরে।
জোড়াসাঁকোয় নীলমণি ঠাকুর দুর্গাপূজার সূচনা করলেও তা সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে উঠেছিল নীলমণি ঠাকুরের পৌত্র প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সময়কালে।
যেহেতু ঠাকুর পরিবারের আরেকটি ধারা পাথুরিয়াঘাটায় ছিল, তাদের টেক্কা দেওয়ার একটি সুপ্ত ইচ্ছা নিহিত ছিল বিশাল জাঁকজমকপূর্ণ দুর্গাপূজার আয়োজনের মধ্যে।
নীলমণি ঠাকুরের সময়কার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজার বিস্তৃত বিবরণ না পাওয়া গেলেও অনুমান করে নিতে অসুবিধা হয় না। একচালার দুর্গাপূজা হত তখন। কারণ সে সময় আলাদা করে দেবী ও তার পুত্রকন্যাদের স্থাপনের রেওয়াজ হয়নি। তাঁরা নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব হওয়ায় নবমীতে পশুবলি হত না। তবে বিসর্জনের পর বিজয়া উপলক্ষে যাত্রাপালা ও কবিগানের আয়োজন করা হত। নীলমণি নিজেও কবিগান জানায় জমজমাট হত কবিগানের আসর।
নীলমণি ঠাকুরের পুত্র রামলোচন ও রামমণির আমলে দুর্গাপূজার জাঁকজমক ও আড়ম্বর অনেক বাড়ে। রামলোচন তখন কলকাতার অন্যতম রহিস আদমি। তিনি তাঁর বাড়ির পূজায় হাফআখড়াই, কীর্তন, কেলোয়াতি ও কবিগানের আয়োজন করতেন। নিঃসন্তান রামলোচন তাঁর ভাই রামমণির দ্বিতীয়পুত্র দ্বারকানাথকে দত্তক নিয়েছিলেন।
প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সময়ে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির পূজা ছিল কলকাতার মধ্যে অন্যতম সেরা পূজা। দ্বারকানাথ ঠাকুর জীবনযাপন করতেন রাজসিকভাবে। তাঁর জীবনযাত্রাও ছিল প্রিন্সের মতো। তিনি নিজে প্রতিদিন নিষ্ঠাসহকারে গৃহদেবতা লক্ষ্মীজনার্দনের পূজা করতেন, তবে অন্যান্য দেবদেবীর পূজাও করতেন। প্রথমদিকে দ্বারকানাথ ঠাকুর ছোঁয়াছুঁয়ির বিষয়েও বেশ কট্টর ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ইংরেজদের সঙ্গে দ্বারকানাথ ঠাকুরের দহরমমহরম বেড়ে যাওয়ায় তাঁর ভক্তির আতিশয্য কমে এসেছিল। তবে দুর্গাপূজার বেলায় তিনি ছিলেন উদারহস্ত।
জোড়াসাঁকোর দুর্গাপূজার প্রতিমা তৈরি হতো গঙ্গার তীরের মাটি দিয়ে। ভাসানের দিন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর মুক্ত আকাশে ছেড়ে দিতেন শঙ্খচিল। বিশ্বাস ছিল, এই শঙ্খ চিলই দুর্গাকে পরের বছর পথ দেখিয়ে আনবে।
দুর্গাপূজা উপলক্ষে জোড়াসাঁকোর সব কর্মচারীকে নতুন পোশাক কেনার জন্য উপহারস্বরূপ নগদ অর্থ দিতেন দ্বারকানাথ। পূজার প্রতিদিনের জন্যই বাড়ির মেয়েদের জন্য বরাদ্দ ছিল আলাদা আলাদা শাড়ি, ছেলেদের জন্য পাঞ্জাবি, আচকান ও জরির টুপি। কেবলমাত্র জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজায় দেবীকে দুবেলা আলাদা বেনারসি শাড়ি পরানো হতো। মাথায় ছিল সোনার মুকুট। দেবীকে পরানো হতো নানা ধরনের স্বর্ণালঙ্কার। একই সঙ্গে পায়ে পরানো হতো সোনার নূপুর।
দ্বারকানাথ ঠাকুরের সময়ে দুর্গাপূজার দেবীর ভোগ দেওয়া হতো রাজসিক কায়দায়। মোট ৫১ রকমের ভোগ তৈরি হতো। সোনার থালা ও বাটিতে দেওয়া হতো ভোগ। একই সঙ্গে থাকতো অসংখ্য ফল এবং ক্ষীরের মিষ্টান্ন। যা পূজার শেষে আগত ভক্তদের মধ্যে বিতরণ করা হতো। ঠাকুর পরিবার বৈষ্ণব হওয়ায় পশুবলির জায়গায় বলি হতো কুমড়ো।
দুর্গাপূজায় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ঠাকুর দেখতে কলকাতার নানান অঞ্চল থেকে দলে দলে দর্শনার্থী আসতেন।
পূজার সময়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দ্বার ছিল উম্মুক্ত। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির পূজায় আমন্ত্রণ পেতেন কলকাতার বিশিষ্টজনেরা। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর নিজের হাতে লেখা পত্রে অভিজাত ইংরেজ এবং স্বদেশী ব্যবসায়ীদের তাঁর বাড়িতে দুর্গাপূজায় আমন্ত্রণ জানাতেন। যদিও আমন্ত্রণপত্রে দ্বারকানাথ ঠাকুর নিজের নাম লিখতেন না আমন্ত্রণকর্তা হিসেবে লেখা হতো পিতা রামমণি ঠাকুরের নাম।
পূজা শেষ হতো নবমীর রাতে। দশমীর দিন ছিল বিসর্জনের। এদিন জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি থেকে আকাশে উড়িয়ে দেওয়া হতো নীলকণ্ঠ পাখি। বিশ্বাস নীলকণ্ঠ পাখি কৈলাসে গিয়ে মহাদেবকে পার্বতীর আগমন বার্তা জানিয়ে দিবে।
এদিন সন্ধ্যায় বিসর্জনের শোভাযাত্রা যোগে দেবীকে নিয়ে গঙ্গার উদ্দেশে বের হতেন ঠাকুর বাড়ির সদস্যরা। ঠাকুরবাড়ির নারীরা বাড়ির তেতলার ছাদ থেকে দেখতেন। রবীন্দ্রনাথের বোন সৌদামিনী দেবী লিখেছিলেন, ‘বিজয়ার দিন ছাদে ওঠা ছিল একটুকরো মুক্তি।’
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বোন বিনয়িনী দেবী লিখেছিলেন, ‘রুপোর প্রদীপদানিতে এক হাজার একটি ঘিয়ের প্রদীপ দিয়ে, রুপোর ঘণ্টা বাজিয়ে আরতি শুরু হতো। প্রতিমার দুপাশে আলো হয়ে জ্বলতো ঘিয়ের প্রদীপ। তিনদিন তিনরাত্রির ধরে প্রদীপ জ্বলবে।’
মহিলারা বিসর্জন দেখতে গঙ্গার পাড় অব্দি যেতেন পালকিতে করে, বাকিরা যেতেন পায়ে হেঁটে। সেই শোভাযাত্রায় ছিল যন্ত্রী, বাজনদার এবং ঢাকিরা। বিসর্জনের পর তারা বাড়ি ফিরে এলে শুরু হতো বিসর্জনের দিনের পরবর্তী উৎসব।
রাতে ঠাকুরবাড়িতে চলতো গানের জলসা। কলকাতার বিখ্যাত ওস্তাদদের সুরের ঝংকারে মেতে উঠতো গোটা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি। একই সঙ্গে দুর্গাপূজার সময়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে আয়োজন করা হতো যাত্রা আর কবিগানের অনুষ্ঠানের। পালকপিতা রামলোচন ঠাকুরের আমলের হাফআখড়াই, কীর্তন, কেলোয়াতি, কবিগানের চল দ্বারকানাথ বজায় রেখেছিলেন পুরোমাত্রায়।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজার বৈভব নিয়ে রয়েছে একাধিক কাহিনী। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পার্শ্ববর্তী বাড়ি ছিল জোড়াসাঁকোর শিবকৃষ্ণ দাঁ-র বাড়ি। এই বাড়িতে প্রতিমার গায়ে পরানো হতো প্রচুর দামি স্বর্ণালঙ্কার ও গয়না। পূজার শেষে দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জনের সময় অবশ্য সেই স্বর্ণালঙ্কার খুলে নেওয়া হতো।
বিষয়টি বাড়ির মেয়েদের মাধ্যমেই শুনেছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। তাই তিনি ঠিক করলেন শিবকৃষ্ণকে টেক্কা দেওয়ার। ফরাসি দেশ থেকে একবছর দুর্গাপূজার আগে বানিয়ে আনলেন বহু দামী গয়না। এরপর সেই গয়না পরানো হলো প্রতিমার গায়ে। দ্বারকানাথ ঠাকুরের কড়া আদেশ ছিল বিসর্জনের সময়েও তা কেউ খুলতে পারবে না। গয়না পরনেই বিসর্জন হবে দেবীর। নির্দেশ অনুসারে গয়নাসহযোগেই বিসর্জন হয়েছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির প্রতিমার। এরপর থেকে ফি বছর চালু হয়ে গিয়েছিল এই রীতির। বিসর্জনের পর জোড়াসাঁকোর ঠাকুরদের সেই প্রতিমার সোনাদানা ও বহুমূল্যবান গয়নাগাটি নেওয়ার জন্য বহুলোকের ভিড় জমে যেত গঙ্গার ধারে।
যদিও কালের প্রবাহে রাজা রামমোহন রায়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করায় ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজা। ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজা বন্ধ হয়েছিল মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে। কারণ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন নিরাকার ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী। ১৮৬১ সালে, তাঁর বয়স যখন চুয়াল্লিশ বছর, তখন থেকেই পাকাপাকিভাবে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজা বন্ধ হয়ে গেল। সেটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের বছরও।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দিয়েই একবার রাজা রামমোহন রায়ের কাছে দুর্গোৎসবের আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। রাজা রামমোহন রায় ছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের ঘনিষ্ট বন্ধু।
সালটা ছিল ১৮২৯। সেই বছরের দুর্গাপূজায় বাবার দেওয়া পত্র নিয়ে রাজা রামমোহন রায়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। বললেন, ‘কদিন পরে পূজা আমাদের বাড়িতে। পূজোর শেষ তিনদিন প্রতিমা দর্শনে আপনার নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন বাবা। তাই এই পত্রখানা পাঠিয়েছেন।’
প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর জানতেন রাজা রামমোহন রায় নিরাকার ঈশ্বরে বিশ্বাসী এবং তিনি দেবদেবী পূজা করেন না। তাই রাজা রামমোহন রায় বেশ অবাকও হয়েছিলেন। তাই আমন্ত্রণপত্রটি সরাসরি গ্রহণ না করে তিনি সেটি তাঁর পুত্র রাধাপ্রসাদ রায়ের মাধ্যমে গ্রহণ করেছিলেন।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনীতে পাওয়া যায় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজার বর্ণনা। তিনি লিখেছেন, ‘প্রতি বৎসরে যখন দুর্গাপূজার উৎসবে উৎসাহিত হইতাম, প্রতিদিন যখন বিদ্যালয়ে যাইবার পথে ঠনঠনিয়ার সিদ্ধেশ্বরীকে প্রণাম করিয়া পাঠের পরীক্ষা হইতে উত্তীর্ণ হইবার জন্য বর প্রার্থনা করিতাম, তখন মনে এই বিশ্বাস ছিল যে, ঈশ্বরই শালগ্রামশিলা, ঈশ্বরই দশভুজা দুর্গা, ঈশ্বরই চতুর্ভুজা সিদ্ধেশ্বরী।’
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজা বন্ধ হয়েছিলো ধীরে ধীরে। প্রথমে পরিবারের অনেকেই দীর্ঘদিনের এই প্রথা বন্ধ হবে, এটি মেনে নিতে চাননি। যদিও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কোনবারই দুর্গাপূজায় অংশ নিতেন না। দুর্গাপূজার সময়টাতে তিনি হিমালয়ে চলে যেতেন। একপর্যায়ে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করলে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি পরিচিত হয়ে উঠল ব্রাহ্মদের বাড়ি হিসেবে। যার ফলে ধীরে ধীরে ঠাকুরবাড়িতে একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে দুর্গাপূজার আয়োজন পুরোপুরি বন্ধ হলেও দুর্গাপূজার রেশ কিন্তু রয়ে যায়। যার প্রমাণ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি দুর্গাপূজার ষষ্ঠীর দিন থেকে আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের বাড়িতে নিমন্ত্রণে যেতেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাড়িতে দুর্গাপূজার কথা বাড়ির গুরুজনদের কাছে শুনতেন। তিনি দুর্গোৎসব উপলক্ষে বিসর্জনের পরের দিন বাড়িতে যাত্রাপালা ও কবির লড়াইয়ের কথাও জেনেছিলেন। কবির লড়াই তাঁর মননে বিরাট প্রভাব ফেলেছিল। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ধনীর গৃহে না জন্মে যদি দরিদ্রের কুটীরে তিনি জন্মাতেন, তাহলে হয়ত তাঁকে কবিগানের দলে নাম লেখাতে হত। গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতে হত। তাঁর অনেক লেখাতেই কবিয়াল হরু ঠাকুর ও রাম বসুর উল্লেখ আছে। তিনি শান্তিনিকেতনে কবিয়াল গুমানি দেওয়ানকে ডেকে তাঁর কাছে কবিগান শুনতেন। কলকাতার বিদ্বজ্জনসমাজ আয়োজিত গুমানি দেওয়ান ও রমেশ শীলের কবির লড়াই অমীমাংসিত থাকলেও, রমেশ শীল বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত হন। সেই পুরস্কার কবিগুরুই নাকি রমেশ শীলের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
কবি-সংগীত শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “তথাপি এই নষ্টপরমায়ু কবির-দলের গান আমাদের সাহিত্য এবং সমাজের ইতিহাসের একটি অঙ্গ,— এবং ইংরেজ-রাজ্যের অভ্যুদয়ে যে আধুনিক সাহিত্য রাজসভা ত্যাগ করিয়া পৌরজনসভায় আতিথ্য গ্রহণ করিয়াছে এই গানগুলি তাহারই প্রথম পথপ্রদর্শক।”
তথ্যসূত্র : ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজা, চিত্রা দেব; ঠাকুরবাড়ির বাহিরমহল, চিত্রাদেব; আত্মজীবনী, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর