শনিবার | ২২শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৮ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১২:২৪
Logo
এই মুহূর্তে ::
নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘অমৃতসরী জায়কা’ মহিলা সংশোধনাগারগুলিতে অন্তঃসত্ত্বা একের পর এক কয়েদি, এক বছরে ১৯৬ শিশুর জন্ম : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় ‘শোলে’র পঞ্চাশ বছর : সন্দীপন বিশ্বাস বিভাজনের রাজনীতি চালিয়ে হিন্দুত্ববাদীরা ইতিহাস পালটাতে চায় : তপন মল্লিক চৌধুরী অশোক সম্পর্কে দু-চারটে কথা যা আমি জানি : অসিত দাস চৈত্রের শুরুতেই শৈবতীর্থ তারকেশ্বরে শুরু হলো সন্ন্যাস মেলা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় প্রথম বাঙালি পরিচালকের প্রথম নির্বাক লাভ স্টোরি : রিঙ্কি সামন্ত গোপিনী সমভিব্যাহারে রাধাকৃষ্ণের হোলি ও ধ্যানী অশোকবৃক্ষ : অসিত দাস শেখাওয়াটির হোলী-হাভেলী : নন্দিনী অধিকারী সংস্কৃত সাহিত্যে অশোকবৃক্ষ যখন দোহলী : অসিত দাস প্রাণগৌরাঙ্গের প্রিয় পঞ্চব্যঞ্জন : রিঙ্কি সামন্ত ‘দ্য স্টোরিটেলার’ — শিল্প এবং বাজারের মধ্যে দ্বন্দ্ব : কল্পনা পান্ডে অপুষ্টি আর দারিদ্রতা ঢাকতে সরকার আর্থিক উন্নয়নের পরিসংখ্যান আওড়ায় : তপন মল্লিক চৌধুরী দোহলী মানে অশোকবৃক্ষ, তা থেকেই দোল ও হোলি : অসিত দাস সিনেমা প্রেমীদের হোলির গান : রিঙ্কি সামন্ত দোলের আগের দিনের চাঁচর নিয়ে চাঁচাছোলা কথা : অসিত দাস খোল দ্বার খোল, লাগল যে দোল — দোলা লাগল কি : দিলীপ মজুমদার শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বৃন্দাবন যাত্রা (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত সিঙেরকোণ-এর রাধাকান্ত এখনও এখানে ব্যাচেলর : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বৃন্দাবন যাত্রা (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত বাজারে ভেজাল ওষুধের রমরমা দায় কার : তপন মল্লিক চৌধুরী বাঙালি বিজ্ঞানীর গবেষণায় চাঞ্চল্যকর তথ্য ‘কুড়কুড়ে ছাতুতে’ ক্যানসার নিকেশ : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় বোলপুর কি সত্যিই বলিপুর : অসিত দাস রাখাইন পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশের উপর প্রভাব : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন অসুখী রাজকন্যাদের লড়াইয়ের গল্প : রিঙ্কি সামন্ত বিশ্ব থেকে ক্যানসারকে নির্মূল করতে গবেষণায় একের পর এক সাফল্য রূপায়ণের : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় কল্পনার ডানায় বাস্তবের রূপকথা : পুরুষোত্তম সিংহ হাইকোর্টের রায়ে ভাবাদিঘীতে তিন মাসের মধ্যে কাজ শুরুর নির্দেশ : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী কমছে, সঙ্কটে সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুল : তপন মল্লিক চৌধুরী ফল্গু নদীর তীরে একটি ছোট শহর এই বুদ্ধগয়া : বিজয় চৌধুরী
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ দোলপূর্ণিমা ও হোলি ও বসন্ত উৎসবের  আন্তরিক শুভেচ্ছা শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

দিব্যেন্দু পালিত-এর ছোটগল্প ‘ঝালমুড়ি’

দিব্যেন্দু পালিত / ২২১ জন পড়েছেন
আপডেট শুক্রবার, ৩ জানুয়ারি, ২০২৫

সকাল থেকেই স্ত্রীকে তাড়া দিতে শুরু করেছিল রথীন। দেবীর সময় চলে সংসার মেনে ঠিকঠাক চলার উপায় থাকলে এগোয়, না হলে যখন-তখন স্লো হয়ে পড়ে। সেই জন্যেই ভাবনা। তবে, আজকের দিনটা আলাদা। কত বছর পরে যে দেবীও মনে করতে পারে না, বাড়ি ও বাড়ির আশপাশের কলকাতা থেকে ঝাড়া হাত-পায়ে বেরুবার একটা উপলক্ষ পেল। মনে মনে একটা হিসেব ছকে ফেলেছিল রথীন। বেলা নটা নাগাদ ট্রেনে উঠতে পারলে বারোটার আগেই পৌঁছে যেতে পারবে বর্ধমানে। স্টেশন থেকে দীপনারায়ণের বাড়ি হাঁটা পথে মিনিট কুড়ি, রিক্সায় সাত-আট মিনিট। গরম পড়তে শুরু করেছে, ওই সময় রোদও কড়া হবে। দেবীকে নিশ্চয়ই সে হাঁটিয়ে নিয়ে যাবে না। তা হলেও ট্রেনফেনের যা গণ্ডগোল; হিসেব করে বেরুলেও যে পৌঁছুতে পারবে সময়মত, তার নিশ্চয়তা কোথায়।

নিজে আগে তৈরি হয়ে নিয়েছিল। সকালের কাগজটা উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে বলল, ‘একটা দিন সব কাজ না করলে কী ক্ষতি হবে!’

‘একেই অভ্যাস নেই, তার ওপর তাড়া দিলে আরও নার্ভাস হয়ে পড়ব।’ দেবী বলল, ‘পা দুটোয় এরই মধ্যে কেমন ঝিঁঝিঁ ধরে গেছে—’

সুশান্ত বলল, ‘এখান থেকে বর্ধমান আর কত দূর! ছোটপিসির বিয়েতে যে গাড়িটা ভাড়া নিয়েছিলে সেটাই আর একদিন ভাড়া নিলে পারতে!’ খবরের কাগজের আড়াল থেকে মুখ সরিয়ে ছেলেকে দেখল রথীন। ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেল দেবীকে! তারপর কিছু বা উদাসীন ভাব দেখিয়ে বলল, ‘তোর মা গাড়ি চড়ার ভাগ্য করে আসেনি।’

‘ওটা তোমার অজুহাত।’ হঠাৎই সিরিয়াস হয়ে উঠল সুশান্ত, ‘বোনের বিয়েতে হাজার হাজার টাকা খরচ করে বউকে একদিন গাড়ি চড়াতে পারবে না, এটা কোনও কথা নয়।’ এইমাত্র শ্বশুরকে জলখাবার দিয়ে বেরিয়ে এল দেবী। ছেলের কথা শুনে ভুরু কুঁচকে বলল, ‘তুই থামবি! অতই যদি মাকে গাড়ি চড়াবার শখ, তাড়াতাড়ি পাশ করে রোজগার শুরু কর। তোর টাকায় আমি আর তোর বাবা দুজনেই গাড়ি চড়ব।’

স্কুল ফাইনাল দেবার পর একলাফে অনেকটা বড় হয়ে গেছে সুশান্ত— এখন অনেক কথাতেই মতামত দেয়। দেবীর কথায় বুঝতে পারল কথাগুলো এভাবে বলা ঠিক হয়নি। মার ভয় দাদু-ঠাকুমার কানে কথা যাবে। সে জন্যে নয়। বাবার দিকে তাকিয়েই সে চুপ করে গেল। ‘ওকে বলছ কেন!’ রথীনের গলায় সস্নেহ বিষাদ, সুশান্তর কথাগুলো গায়ে না-মাখার ধরনে বলল, ‘ও তো ঠিকই বলেছে—’

দেবী যে অনেকটা কাজই এর মধ্যে শেষ করে ফেলেছে ওর চলনবলন দেখে তা বুঝতে অসুবিধে হয় না কোনও। স্নানটা আগেই সেরেছিল। শ্বশুর-শাশুড়ির জলখাবারের ব্যবস্থা করে ব্যস্তভাবে এগুলো হেঁসেলের দিকে। তাদের নেমন্তন্ন থাকলেও বাড়িতে আরও চারটে মুখ খাবে। রথীনের সামনে চায়ের কাপটা নামিয়ে দিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘কুড়ি বছরে কোথাও না গিয়ে গিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেটাই গেছে মরে। আজও না গেলে কী হত।’ এ কথার অনেক রকম অর্থ হয়। চায়ে চুমুক দিতে গিয়েও থেমে গিয়ে অসহায় ভাবে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল রথীন।

‘যাবে না!’

‘যাব না কেন! দেবী বলল, ‘কথা দিয়ে না গেলে দাদাই বা কী ভাববে!’

ভাবনা গভীর হয়ে আছে, ডুবতে চাইলেই ডুবে যেতে হয়। অসময়ে কাঁটা বেঁধে শরীরে। ফেলে আসা রাস্তা ও যাবার রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুরকম হয়ে গেল রথীন। ছোট বোন শীলার বিয়ে গেছে দিন বারো হল। সম্বন্ধ হয় আর ভেঙে যায়— খরচের ভয়েই বিয়েটা হচ্ছিল না এত দিন। তার আগের তিনটিকে পার করতেই অ্যাজমার টানে কথা বেরুত না বাবার। এবারের সম্বন্ধটা ভেঙে যাবার মুখে ছিলা ছিঁড়ে গেল। ‘যে-ছেলে বিশ-বাইশ বছর চাকরি করছে তার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা যায় কোথায়!’ গলায় রাজ্যের জ্বালা ফুটিয়ে বাবা বলল, ‘বেইমান! সব বেইমান! এই বলে দিচ্ছি, শীলার এই বিয়ে ভেঙে গেলে আমি আত্মহত্যা করব।’

হঠাৎ আক্রমণে ধাঁধা লাগে। এঁটো হাতেই উঠে গিয়ে বিছানায় কুঁজো হয়ে বসেছিল রথীন। বাবা নয়, দেখেছিল, কখনও বিষ খেয়ে, কখনও গায়ে কেরোসিন ঢেলে, কখনও বা কড়িকাঠে ঝুলে আত্মহত্যা করছে শীলা।

‘বাপ ছেলেকে আত্মহত্যা করবে বলে শাসাচ্ছে এমন শুনেছ কখনও।’

রথীনের কথাটা শুনে নিঃশব্দে খোলা দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল দেবী। পরের দিন গয়নার দোকানে গিয়ে বারো হাজার টাকার হিসেব পেয়েছিল রথীন— বাকিটা তুলেছিল প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে।

দেবীর বাপের বাড়ি বলতে এখন শুধু দীপনারায়ণ। যোগাযোগহীন সম্পর্ক থেকে ওকে দাদা বলে চেনা যায় না। শীলার বিয়ের দিন দেবীকে ন্যাড়া দেখে বলেছিল, ‘শ্বশুরের সংসার টানতে হবে জানলে বাবা এখানে তোর বিয়ে দিত না।’ রাত্রে রথীনের বুকে আচমকা ব্যথা হয়। দেবী তখন হাত বুলোচ্ছে বুকে। রথীন বলেছিল, ‘ছেলেটা না থাকলে আমিই আত্মহত্যা করতাম।’

রবিবারে বাসে ভিড় কম। দেবীকে পাশে বসিয়ে রথীন দেখল রোদের মধ্যে জায়গা বদল করছে রোদ, বৃষ্টি না-হওয়া আকাশে ছেঁড়াখোঁড়া মেঘ সিনেমা হাউসের দেয়ালে রঙিন পোস্টারের ছয়লাপ। বন্ধ হয়ে-যাওয়া টিকিটঘরের সামনে জটলা করছে কিছু খেই হারানো মানুষ। নিজেকে অনুভব করতে গিয়ে ভোঁতা লাগল— ঠিকানা আছে, কেন যাচ্ছে বুঝতে পারছে না কিছু। সকালে দেবী বলেছিল, যাওয়ার ইচ্ছেটাই মরে গেছে।

দেবীকে বলল, ‘নটার মধ্যে বেরুব ভেবেছিলাম। এরই মধ্যে দশটা বেজে গেল!’ ‘কী আর হবে।’ রোগা মুখে হাসি ফোটাল দেবী। রথীনের সংসার কুড়ি বছরে অনেক কাড়াকাড়ি করেছে ওর কাছে— শরীর, স্বাস্থ্য, সময়, সোনাদানা, হয়তো বা মনও। হাসিটায় এখনও নজর পড়েনি কারও। রথীনের মুখের ওপর থেকে ধাবমান রাস্তায় চোখ নিয়ে গিয়ে বলল, ‘রাজকাজে যাচ্ছি না, পরীক্ষাও দিতে হবে না। তোমার এত তাড়া কীসের—’

‘তাহলেও—’ রথীন চুপ করে গেল। দেবী জানালার দিকে বলেই নিজের তাকানোটা যথেচ্ছ করা যায়। এখনই দেখল, ব্লাউজের রেখার ওপরে ওর ঘাড়ের সাদা রোমগুলো চিকচিক করছে রোদ লেগে। সোনা থাকলেও করত; হয়তো আরও বেশি। হিসেব করতে গিয়ে গুলিয়ে গেল হিসেব। কিছু না বুঝেই তখন দেবীকে স্ত্রী হিসেবে চেনার চেষ্টায় আরও একটু গা-ঘেঁষা হল রথীন, তার কোলের ওপর ছড়ানো হাতে হাত রাখল।

‘কী দেখছ!’

‘কী আর! হঠাৎ মনে হল কুড়ি বছর পরে এই প্রথম বেরুচ্ছি তোমাকে নিয়ে।’

‘যাঃ! আরও কত বার বেরিয়েছি—’

‘কাজে।’ রথীন থামল এবং আবার বলল, ‘এতগুলো বছর কী করে কেটে গেল।’ রথীনের গলার ধরা ভাবটা কান এড়াল না দেবীর। আগে হত, হঠাৎ-ইচ্ছায় এখন আর কোনও শারীরিক প্রতিক্রিয়া হয় না। ইচ্ছাটা, চেনার মুখেই বাস থামল। জনা তিনেক নতুন যাত্রী ওঠার পর আবার ছেড়ে দিল। রথীনের মাথা থেকে হাতটা সরিয়ে নিল দেবী। ‘এখন আর তোমার কোনও দায় থাকল না। নিশ্চয়ই হালকা লাগছে, তাই এসব ভাবছ।’ দেবী কি নিজের কথাই বলল! ডুবতে চাইলেই ডুবে যেতে হয়। দায়-দায়িত্বের ভারটা মাপা হয় শরীর, সময়, সোনাদানা দিয়ে। পাথরের ভার ক্ষইলেই কমে। রথীনের সামনে আবার ডোবার সুযোগ এল। আত্মরক্ষার চেষ্টায় বলল, সুশান্ত ভুল বলেনি কিছু। এই পথটা তোমাকে ট্যাক্সিতে আনতে পারতাম। তুমি বললেই পারতে—

‘আমি কোনও দিন কিছু বলি—’ বলতে বলতেই থেমে গেল দেবী! একবার রথীনকে দেখে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ গো, কলকাতা কি এমনিই ছিল’

‘কেন!’

‘কিছুই যেন চিনতে পারছি না। চারিদিকে খোঁড়াখুঁড়ি— কাগজে ছবি দেখে এতটা বুঝিনি!’

‘হ্যাঁ।’ রথীন আর কিছু বলল না। দীপনারায়ণ বলেছিল, ‘চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না এইভাবে সর্বস্বান্ত হয়েছিস!’ শুধুই দেবীকে নয়, তাকে শোনাবার জন্যেও বলা। তারপর বলল, ‘ব্রাবোর্ন রোড পেরিয়ে এলাম। সামনে লক্ষ্য রাখো, ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে সোজা ব্রিজে পৌঁছুব।’

‘উড়ালপুল!’ নড়েচড়ে বসল দেবী, ‘সুশান্ত বলছিল, শিয়ালদার ওপর যেটা হয়েছে— নাকি ভারী সুন্দর! সেবার বড় ননদাইকে সি-অফ করতে যাবার সময় আমারও যাবার কথা হয়েছিল—’

‘জানি। বাবার হাঁফানি বাড়ায় তোমার যাওয়া আটকে গেল।’

দেবী শুনল কি শুনল না; গঙ্গা দেখতে পেয়ে জোড়া হাত দুটো এমনভাবে কপালে ঠেকাল যেন এইমাত্র বিপদসীমা পেরিয়ে এসেছে। এই মুহূর্তে ওর মুখে যে-ছায়া সেটা রোদেরই তারতম্যে কি না বোঝা যায় না। আরও একটু এগিয়ে বলল, ‘হঠাৎ বর্ধমানে বা যাচ্ছি কেন!’ রথীন জানে না এ-প্রশ্নে উত্তর কী হতে পারে। নিজেকে যে-সব প্রশ্ন করে আজ সকাল থেকেই সে বিব্রত হয়েছে এটি তার একটি। ইচ্ছা মরে গেলে দিকও যায় হারিয়ে, নির্দিষ্ট দিকে হাত ধরে না টানলে এগোনো যায় না আর। এমন কিছু হতে পারে। শুধু দেবীর জন্যেই দীপনারায়ণের উপলক্ষটা আঁকড়ে ধরেছিল সে। দেবীকে এসব বলা যাবে না।

‘দাদার কাছে যাচ্ছ, ভাল লাগছে না।’

দেবী তেমনিই অন্যমনস্ক। বলল, ‘বুঝি না।’

স্টেশনে ঢুকে আরও একবার দিশেহারা হল। দশটা পঞ্চাশের লোকালটা যে পাবে না তা ধরেই নিয়েছিল। পরের ট্রেনটা বাতিল হয়ে গেছে। সাড়ে বারোটার আগে সরাসরি আর কোনও ট্রেন নেই। গেটে দাঁড়ানো টিকিট-চেকার বলল, ‘দানাপুর ছাড়ছে পাঁচ নম্বর থেকে। তাড়াতাড়ি গেলে ধরতে পারবেন—’

রথীন ছুটতে শুরু করেছিল। দেবী বলল, ‘তুমিও কি ফেলে যাবে আমাকে?’ ‘হাঁটতে পারছ না!’ রথীনের বিব্রত মুখের দিকে তাকিয়ে একটুক্ষণ কী ভাবল দেবী। তারপর বলল, ‘চলো’। ট্রেনটা ধরতে পারলেও ছুটোছুটির উত্তেজনায় মুখে রঙ ধরেছে দেবীর। একটুখানি জায়গা পেয়ে জানলার দিকে মুখ করে বসে হাঁফাতে লাগল। কামরার দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে রথীন দেখতে পেল ওর মুখের ওপর কতকগুলো রেখা জায়গা বদল করছে দ্রুত। উত্তেজনায়, নাকি অভিমানে, বুঝতে পারল না ঠিক। নিজের মধ্যে ক্রমশ সঙ্কুচিত হতে লাগল সে। এর পরেও হয়তো আর একটা প্রশ্ন থাকবে। প্রশ্নটা না জেনেই উত্তরের সন্ধানে এখন নিজেকে খোঁড়া যায়।

শেওড়াফুলি স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াতে ইশারায় রথীনকে কাছে ডাকল দেবী। দূর প্ল্যাটফর্মের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ‘ঝালমুড়ি না? ডাকো না গো লোকটাকে?’

‘এত দূরে কি আসবে!’ চিন্তিত মুখে রথীন বলল, ‘হঠাৎ ঝালমুড়ি খাবার শখ হল কেন?’

‘এই শেওড়াফুলি স্টেশনেই খেয়েছিলাম একবার বাবার সঙ্গে আসতে আসতে। কত বছর আগে!’

সময়ের একটা হিসেব করল রথীন। দূরত্ব বেশি নয়। তাড়াহুড়ো করে গেলে হয়তো ট্রেন ছাড়ার আগেই ফিরে আসতে পারবে। দেবীর শখের চেয়ে নিজের মরিয়া ভাবটাকেই এই মুহূর্তে চিনতে পারল সে! তারপর বলল, ‘তুমি বোসো, আমি নিয়ে আসছি—’

‘ট্রেন ছেড়ে দেবে না তো!’

‘ছাড়লে খালি হাতেই ফিরব।’

রথীন নেমে গেল। ঝালমুড়ির ফেরিওলার কাছে পৌঁছে ফরমাশ করতে করতে পিছনে তাকিয়ে হঠাৎ দেখল, দেবীও নেমে পড়েছে। ব্যস্তভাবে এগিয়ে আসছে তার দিকে। ‘কী হলো! ভয় পেলে নাকি?’

‘না গো।’ রেখাগুলো মিলিয়ে গেছে। নিজের মতো করেই হাসল দেবী। বলল, ‘ভাজা ছোলা দিচ্ছে কি না দেখতে এলাম।’

‘আছে, মা।’ টিনের কৌটোয় চামচ নাড়তে নাড়তে ফেরিওলা বলল, ‘ভাজা ছোলা আছে, শশার কুচি— যত ইচ্ছে খান।’

কুড়ি বছরে ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া চোখে এই দেবীকে নতুন লাগছে রথীনের। কথা ফুটল না মুখে। শুধু ট্রেনটা ছেড়ে যেতে দেখে ও বলল, ‘ছেড়ে গেল যে!’

‘যাক।’প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে ক্রমশ বেরিয়ে-যাওয়া ট্রেনের দিকে একবারও না তাকিয়ে দেবী বলল, ‘তুমিও খাও না গো!’

দেবীর হাতে কাগজের ঠোঙা-ভরতি ঝালমুড়ি। একগাল মুখে দিয়ে চোয়াল নাড়ছে আস্তে। কপালে ঘামের আভাস। লাল হয়ে উঠেছে নাকের পাটা। আর, প্রায় স্তম্ভিত হয়ে লক্ষ করল রথীন, ওর চকচকে চোখ দুটো আস্তে আস্তে ভরে উঠছে জলে। ব্যাপারটা বুঝবার জন্যে আরও দু-এক মুহূর্ত সময় নিল রথীন। তারপর অসহায় গলায় বলল, ‘তুমি কাঁদছ কেন, দেবী!’

‘আ-হা, কাঁদব কেন!’ রথীনের মুখের দিকে তাকিয়ে হাতের উল্টো পিঠে নাক পর্যন্ত নেমে আসা জলের রেখা মুছে দেবী বলল, ‘ঝালমুড়িতে ঝাল থাকবে না!’


আপনার মতামত লিখুন :

One response to “দিব্যেন্দু পালিত-এর ছোটগল্প ‘ঝালমুড়ি’”

  1. Pijush Kanti Das says:

    অসাধারণ এক ছোটো গল্প।

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন