সময়টা জুন, ২০০৭; খাতড়া শহর সংলগ্ন এলাকায় একশ দিনের কাজে পুকুর খননে উঠে এল তিনটি পাথরের মূর্তি, দু’টি মৃৎপাত্র এবং একটি প্রত্নশিকড়ের মুখোশ। আমি তখন খাতড়ার মহকুমা শাসক। খবর পেয়ে খননস্থলে গিয়ে আমি অপার বিস্মিত, একটি প্রায় পাঁচ ফুট অন্যটি তার চেয়ে সামান্য ছোট দু’টি বেলে পাথরের জৈন তীর্থঙ্করের মূর্তি যেন স্মিত হেসে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মূর্তিদ্বয়ের পায়ের কাছে রাখা আছে দুই ফুট উচ্চতার আর একটি মূর্তিফলক। ফলন্ত অম্রবৃক্ষের তলায় উপনিবিষ্ট নারী-পুরুষ। কোলে শিশুমূর্তি। নিচে পাঁচজন তীর্থঙ্করের মূর্তি। গ্রামবাসী বলল, বড় মূর্তি দু’টি শিবমূর্তি। তারা গ্রামে পূজা করতে চায়। তৃতীয় মূর্তিফলক কাদের তা অনুমান করা আমার বিদ্যায় কুলোল না। আমি গ্রামবাসীদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে প্রত্নসামগ্রী নিয়ে এলাম অফিসে। ঠাঁই মিলল খাতড়া মহকুমার প্রশাসনিক ভবনের ট্রেজারি স্ট্রং রুমে। সারারাত উত্তেজনায় ঘুম হলো না, এত মূর্তি কোথা থেকে এল? শিশু কোলে উপনিবিষ্ট নর-নারী কারা? শুরু হলো পড়াশুনা, অন্বেষণ। যত পড়াশুনা করছি, খুলে যেতে শুরু করল এক অজানা ভুবন। বিষ্ণুপুর প্রত্নতত্ত্ব মিউজিয়ামে এমন একটি মূর্তির দর্শন মিলল। ঐতিহাসিকদের মতে অম্রতলে শিশু কোলে উপনিবিষ্ট নর-নারী স্বয়ং তীর্থঙ্করের পিতা মাতা।
জৈন আচারাঙ্গ সূত্রের (খৃঃ পূঃ ৩০০) রাঢ় বিষয়ক পরিচিত কাহিনিতে বলা আছে যে তীর্থঙ্কর মহাবীর বঙ্গদেশ পরিভ্রমণ করেছিলেন। গঙ্গার দক্ষিণ ও পশ্চিমভাগে সীমাবদ্ধ রাঢ়দেশ ছিল পথঘাটহীন জঙ্গলাকীর্ণ অনুন্নত দুর্গম এলাকা। জৈন সন্ন্যাসীরা অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে ক্লেশকর পরিভ্রমণ করেছিলেন বলে কথিত। সম্ভবত অনুন্নত আদিবাসীদের আমিষ বহুল খাদ্যকেই উত্তর ভারতের সন্ন্যাসীদের অখাদ্য কুখাদ্য মনে হয়েছিল। ঐতরেয় আরণ্যকে (আনুমানিক খৃঃ পূঃ ৭০০) ‘বঙ্গ’ এবং ‘বগধ’র আদিবাসীদের ‘অসুর’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই অঞ্চলের অপর নাম ছিল সুহ্ম। জৈনগ্রন্থ মতে বজ্ঝভূমি। নদী কেন্দ্রিক বানিজ্য ও পরিবহনের সুযোগ নিয়েই রাঢ়ভূমিতে প্রবাহিত প্রধান নদী দ্বারকেশ্বর, দামোদর, কুমারী, কংসাবতীর তীরবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ধারবাহিকভাবে জৈন ধর্মের প্রসার ঘটেছিল। খ্রিস্টপূর্ব সময় থেকেই আর্যদের বঙ্গে বানিজ্যিক আগমণ শুরু হয়েছিল। আর খ্রিস্টাব্দ পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকের বহু আগের থেকেই ধীর গতিতে রাঢ় অঞ্চলে জৈন সভ্যতা বিস্তার লাভ করতে শুরু করে, যা সপ্তম-অস্টম শতকের পরেও চালু ছিল। এখন গোটা জঙ্গলমহল জুড়েই প্রাচীন জৈন ধর্মের এক লুপ্তভূমি।
আমার স্বল্পদিনের খাতড়া অধ্যায়ে উপলব্ধি হয়েছে, আমি এক ‘ট্রেজার আইল্যান্ডে’ এসেছি। দুই নদী কুমারী-কংসাবতী’র সঙ্গমস্থল মুকুটমণিপুরই শুধু নয় পুরুলিয়া থেকে গোটা কংসাবতীর অববাহিকা জুড়ে অবহেলিত ও অযত্নে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বহু জৈন পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন। কত যে লুট হয়েছে বা কত ধ্বংস হয়ে গেছে অথবা ধ্বংসের মুখোমুখি তার ইয়াত্তা নেই। ছোট্ট টিলার উপর বাংলোর লনে বসে জ্যোৎস্নায় তাকিয়ে থাকতাম দুই নদী কুমারী আর কংসাবতী’র সঙ্গম উচ্ছ্বাস জলে আর ভাবতাম, কিছু করতে পারি না এই সব অমূল্য সম্পদ রক্ষায়? শনি-রবিবার বা ছুটির দিনে বেরতাম মূর্তি উদ্ধারে। কেউ কেউ আমার উদ্দেশ্য নিয়ে হাসত। তাতে আমার জেদ বেড়ে যেত। বেরিয়ে তাজ্জব বনে যেতাম, কোথায় নেই মূর্তি? মাঠে ঘাটে, পুকুর পাড়ে, বাড়িতে পূজার আসনে, স্থানীয় মন্দিরে, বট-পাকুরের পাদদেশে, গৃহস্থবাড়ির দাওয়ায় বা বাউলের আখড়ায় জৈন মূর্তি বা মূর্তির ধ্বংসাবশেষ পড়ে রয়েছে। মূর্তি তালাশের ফল হল অভাবনীয়, তিন মাসের মধ্যে কুড়িটি বিভিন্ন ধরনের মূর্তি উদ্ধার করে ফেললাম। অফিসের লোকজনের প্রাথমিক অনীহা দেখালেও তারা ছুটির দিনে স্বেচ্ছায় মূর্তি উদ্ধার অভিযানে সামিল হল। কোথায়ও গ্রামবাসীর সামান্য প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছে কিন্তু উদ্দেশ্য মহৎ বুঝে তারাই সহযগিতার হাত বাড়িয়ে দিত। এমনকি বহুলোক আমাকে চিঠিতে, ফোনে মূর্তির হদিশ দিত। তাদের আস্থা ভজন হতে পেরে বেশ আনন্দ লাগত। মুখিয়ে থাকতাম নতুন নতুন মূর্তি উদ্ধারের আশায়। অধিকাংশ মূর্তি ছিল তীর্থঙ্করদের। তারা হলেন আদিনাথ, শান্তিনাথ, পার্শ্বনাথ ও মহাবীরের মুর্তি, জৈন শাসন যক্ষিণীর মূর্তি, একটি কৃষ্ণ মূর্তি, অশ্বারোহী মাতৃযোদ্ধার মূর্তিও উদ্ধার হোয়েছিল। তীর্থঙ্করদের আড়াই ফুট দীর্ঘ এবং প্রায় দুই ফুট চওড়া বিরল একটি মূর্তিফলক উদ্ধার করেছিলাম। সেখানে চব্বিশজন তীর্থঙ্কর দন্ডায়মান এবং একজন ধ্যানরত উপনিবিষ্ট তীর্থঙ্কর। পাথর খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে সূক্ষ্ম কারুকাজযুক্ত ফলকটি।
মুকুটমণিপুর বাঁধে পার্শ্বনাথ পাহাড়ের উপর পূজিত হচ্ছে একটি অশ্বারোহী মাতৃযোদ্ধা মূর্তি। পাদদেশে শায়িত বহু খণ্ডে খণ্ডিত ছয় ফুট দীর্ঘ একটি পার্শ্বনাথের মূর্তি তিলে তিলে ক্ষয়ে যাচ্ছে। তার ঠিক বিপরীতে কুমারী নদীর দক্ষিণ পাড়ে রয়েছে তিনটি জৈন মূর্তি। হিন্দু মতে পূজা পচ্ছে এমন অসংখ্য জৈন মূর্তি প্রায় প্রতিটি গ্রামে। আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার সমাধিতে এখনও দেখা মেলে প্রাচীন অশ্বারোহী প্রেতশীলা বা মতানৈক্যে অশ্বারোহী জিমূতবাহনের মূর্তি। রাইপুর ব্লকের সাতপাটো-মন্ডলকুড়ি গ্রামে অনেকগুলি জৈন উদ্ধার হয়েছে স্থানীয় ঝিল, পুকুর থেকে। গ্রামবাসী সেগুলি রক্ষার্থে মন্দিরগাত্রে গেথে কালো রঙ করে রেখেছে। পুরুলিয়া জেলার পাকবিড়ার জৈনমূর্তি, মন্দির স্থাপত্য শুধু জৈন ধর্মের কথাই বলে না, চমৎকার তাদের শিল্পশৈলীও বটে। সেখানে রয়েছে টেরাকোটার একাধিক প্রাচীন দুর্লভ মূর্তি। ময়ূর বাহনে উপনিবিষ্ট জৈন অষ্টভুজা যক্ষিণী মূর্তিটি শিল্পকলার একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন। মূর্তি ভাস্কর্যে লেগেছে ব্রাহ্মণ্য প্রভাব।
খোঁজা একটু গভীর হতেই উন্মোচিত হল অনেকগুলি বিষয়। প্রাচীনকাল থেকে প্রবাহমান জৈন ধর্মালম্বি মানুষজন আর এই অঞ্চলে নেই। কিন্তু এখনও জৈন আচার বিচার বিভিন্ন স্থানে জনজীবনে ক্ষয়িষ্ণু হলেও আছে। সোনামুখি থানার নায়েববাঁধ গ্রামে সাড়ে পাঁচ ফুট একটি তীর্থঙ্করের মূর্তি স্থানীয় ভাবে ‘বুদ্ধ’ নামে পরচিত। স্থানীয় অধিবাসীরা শ্রাবণ মাসের প্রথম শনিবার এঁকে অন্নভোগ দিয়ে পূজা করে সুবৃষ্টি ও ভাল ফসলের আশায়। এমন বহু জায়গায় তীর্থঙ্করগণ গ্রাম-দেবতায় পরিণত হয়েছে। ধীরে ধীরে জৈন ধর্মের আচার বিচার স্থানীয় অধিবাসীদের ধর্ম বিশ্বাসে মিশে গেছে। পুরুলিয়ার আদ্রা স্টেশনের কাছে বাস করেন ‘শরাক’ নামে একটি উপজাতি। মনে করা হয়, জৈন ‘শ্রাবক’ শব্দটির অপভ্রংশ হল ‘শরাক’। নিরামিষ আহার গ্রহণ, অহিংস জীবন যাপন, রাত্রিকালে উপবাস প্রভৃতি জৈন ধর্মাচার তাঁরা পালন করেন। জঙ্গলমহলে বৌদ্ধ প্রভাবও সুস্পষ্ট। এখানে তা আলোচনা করা হল না। জৈন ধর্মাচার পালিত হলেও পুরুলিয়া থেকে বাঁকুড়া জেলায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে তীর্থঙ্কর সহ দেবদেবী হিন্দু ধর্ম আত্মীকরণ বা হিন্দুয়ায়ণ করে ফেলেছে। এ হল সংস্কৃত্যায়ণ। যেমন হয়ে আদিবাসী দস্যু রত্নাকর বনে যান ঋষি বাল্মীকি। আদিবাসীদের দেবদেবী কালি, শিবলিঙ্গ আর্যায়ণ হয়েছে। প্রাক-মুসলিম যুগের অম্বিকানগরের পাথরে দেউল সুদ্ধ জৈন শাসন যক্ষিণী অম্বিকা দেবীকে হিন্দুরা দুর্গা জ্ঞানে পূজা করে। আসলে অম্বিকা হলেন তীর্থঙ্কর নেমিনাথের শাসন যক্ষিণী। তেমনি রাইপুর থানার রাইপুর গ্রামে মহামায়া, সাতপুটো-মন্ডলকুলীর অম্বিকা, সিমলাপাল থানার জোড়সা ও গোড়তা গ্রামের অম্বিকা, বাঁকুড়ার দামোদর ও দ্বারকেশ্বর নদের মধ্যবর্তী গ্রামগুলিতে ‘আসিনী’ পাঁচলা গ্রামে ‘পরশাসিনী’ গ্রাম-দেবী হিসেবে পূজিত হলেও এঁরা কেউ কেউ জৈন শাসন যক্ষিনী। এই গ্রামগুলিতে আলাদাভাবে দুর্গাপূজা নিষিদ্ধ। ফলে বাংলায় যখন দুর্গাৎসব হয় তখন এখানে দুর্গা পূজার প্রচলন নেই। অধিকাংশ অম্বিকা মূর্তির রূপ হল, ফলন্ত আম গাছের তলায় শিশু সঙ্গে নারী মূর্তি, পায়ের কাছে বাহন সিংহ। আবার বিহারিলাল পাহাড়ে উত্তর পাদদেশে একটি হিন্দু মন্দিরের পাশে বহু প্রাচীন ক্ষয়িষ্ণু তীর্থঙ্করের মূর্তি আছে, যার মাথায় নাগছত্র। কোথায়ও বা তীর্থঙ্করের দশভুজা মূর্তিতে ব্রাহ্মণ্য বিষ্ণুমূর্তির সংমিশ্রণ দেখা যায়। শিলাবতীর তীরের হাড়মাসড়া নামক এক প্রচীন গ্রাম থেকে নাগছত্রধারী প্রায় পাঁচফুটের একটি পার্শ্বনাথের মূর্তি উদ্ধার করেছেন কে এন দীক্ষিত। তালডাংরা থানার দেউলভিড়া গ্রামে যোগাসনে উপনিবিষ্ট নাগছত্রধারী পার্শ্বনাথের মূর্তি বিষ্ণু হিসেবে পূজিত হন। কোথায়ও বা জৈনমূর্তি গ্রামদেবতা হিসেবে পূজা পায়।
প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে জৈনধর্ম ধানবাদ-বরাকর এলাকার পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমে রেওয়া এবং ওড়িশার অরণ্যময় অঞ্চল পর্যন্ত সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। ১৮৭২-৭৩ সালে আর্কোলজিকাল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়ার মিঃ বেগলার রাঢ়ভূমি সন্নিহিত পশ্চিমাংশে রানি-গদার-এ কয়েকটি গুহারও সন্ধান পেয়েছিলেন, যেগুলির অবস্থান ও আকৃতি থেকে অনুমান করা হয় গুহাগুলি ছিল সরাইখানা। তিনি গভীর অরণ্যে বেশ কিছু জৈন পুরাকৃর্তি আবিস্কার করেন এবং প্রাচীন পথেরও সন্ধান পান। যে পথ তাম্রলিপ্ত থেকে রাঢ়ভূমির বুকচিরে চলে গেছে পাটনা-বোধগয়ায়। এই পথ ধরে জৈন সন্ন্যাসী ও বনিকরা যাতায়াত করতেন। পথিমধ্যে তারা সরাইখানা ব্যবহার করতেন। তাম্রলিপ্ত ছিল জৈনধর্মের একটি ক্ষমতাশালী কেন্দ্র। জৈন আচার্য ভদ্রবাহুর শিষ্য হলেন গোদাস। তিনি গোদাস-গণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে গোদাস-গণ চারটি শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। গণ-গুলি অন্যতম হল ‘তম্রলিপ্তিকা’। শিলালিপি ও তাম্রশাসন থেকে অনুমান করা যায় খ্রিঃ পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকের আগে থেকেই জৈন ধর্মের প্রসার ঘটতে থাকে রাঢ় অঞ্চলে যার প্রভাব খ্রিঃ অস্টম-নবম শতক পর্যন্ত অক্ষুন্ন ছিল।
প্রশ্ন হচ্ছে পাঁচ শতাধিক বছর ধরে জঙ্গলমহলের বা রাঢ় অঞ্চলে সুপ্রতিষ্ঠিত জৈনধর্ম কি করে বিলুপ্ত হয়ে গেল? পাল ও সেন-যুগে ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থানের ফলে বাংলায় বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে জৈনধর্মের ক্ষতি ত্বারান্বিত হয়। পাল রাজারা বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তাদের পৃষ্ঠপোষকতাও করতেন। কিন্তু জৈন ধর্মের তেমন কোনো রাজন্য পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি। অবশ্য রাঢ়দেশ কখনই সম্পূর্ণরূপে পাল রাজাদের অধীনস্ত হয়নি। সেখানকার দেশজ রাজাদের অধীনে জৈন ধর্মের প্রভাব অস্টম-নবম শতাব্দি পর্যন্ত সুদৃঢ় ছিল। মূলত হিন্দু ধর্মের উত্থানই জৈন ধর্মের অবলুপ্তির প্রধান কারণ। হিন্দু ধর্ম যে ক্রমান্বয়ে জৈন ধর্মকে আত্মীকরণ করে নিচ্ছিল তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। ধীরে ধীরে হিন্দু ধর্মের তান্ত্রিকতাও জৈন ধর্মকে প্রভাবিত করে ফেলেছিল, ফলে হিন্দু ধর্মে ক্রম বিবর্তন ঘটে যায় জৈন ধর্ম। তবে হিন্দু বা পরবর্তীকালে মুসলিম ধর্মের অগ্রাসী মনোভাবকে অস্বীকার করা যায় না। যার জন্য জৈনরা খাল, বিল, পুকুর, নদী-নালা, পাহাড়ের মাথায় জৈন মূর্তি লুকিয়ে ফেলে নিজেদের হিন্দুত্ব প্রমাণের চেষ্ঠা করেছে। ভয়ানক ধ্বংসলীলাও সংগঠিত হতে পারে। হয়ত তাই যত্রতত্র অসংখ্য জৈন মূর্তির ভগ্নাবশেষ দেখা মেলে। বিভিন্ন স্থানে আমালক, খুরা, মণ্ডপ, খপুরি ইত্যাদির ভগ্নাবশেষ দেখে অনুমান করা হয় এগুলো পার্শ্বনাথের মূর্তি বা মন্দিরের ভগ্নাবশেষ। বহু জৈন মন্দিরগুলিও অবস্থান বদলে হিন্দু মন্দিরে রূপান্তরিত হয়েছে।
উঠে পড়ে লেগেছিলাম জাদুঘর নির্মাণ প্রচেষ্টায়। জেলা প্রশাসনকে একটি প্রকল্প জমা দিয়েছিলাম, মুকুটমণিপুরের কাছে বারোঘুটু পাহাড়ের পাদদেশে একটি আদিবাসী লোকশিল্প কেন্দ্র করতে চাই। যা হবে আদিবাসীদের লোকসংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র, মুক্ত মঞ্চ, পাঁচমুড়ার মৃৎশিল্পের কর্মশালা, হস্তশিল্পের বিক্রয়কেন্দ্র এবং অবশ্যই থাকবে একটি জাদুঘর। যেখানে ঠাঁই পাবে উদ্ধার করা মূর্তি। মূর্তি উদ্ধার যেমন আমার ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছিল তেমনি একটি স্বপ্নেরও জন্ম দিয়েছিল। স্বপ্নটি হল ওই অঞ্চলে অবহেলিত অবস্থায় পড়ে থাকা বিশাল জৈন, বৌদ্ধ, হিন্দু এবং আদিবাসী প্রত্নসম্পদের একটি জাদুঘর নির্মাণ করে ধর্ম ও লোকসংস্কৃতির ইতিহাস সংরক্ষণ করা। ভবিষ্যতে যেটি হতে পারত মুকুটমণিপুর পর্যটনের প্রাণকেন্দ্র, সান্ধ্য-দুপুরের মিলনকেন্দ্র। প্রতি সন্ধ্যায় বসত আদিবাসী সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কমপ্লেক্স জমে উঠত মাদলের ডুং ডুং ডুরা শব্দে। জেলা প্রশাসন যাবতীয় আর্থিক সহযগিতার আশ্বাস দিয়েছিল। ঠিক সেই সময়েই পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের থেকে একটি চিঠি এসে হাজির, সব মূর্তি দিয়ে দিতে হবে পশ্চিমবঙ্গ প্রত্ন সংগ্রহশালায়। মন ভারাক্রান্ত হয়েছিল। চিঠির সঙ্গে যুক্ত ছিল প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু’র অনুমোদিত একটি নোট সীটের প্রতিলিপি, বক্তব্যও মোটামুটি এক। দুই পাতার নোটটি পড়তে পড়তে এক জায়গায় এসে থমকে গেলাম, লেখা আছে আঞ্চলিক ইতিহাস, শিল্পী সংস্কৃতি প্রসারের প্রয়োজনে স্থানীয়ভাবেও প্রত্নসামগ্রী সংরক্ষণ করা যাবে। উত্তরে হেরিটেজ কমিশনকে লিখেছিলাম, রাঢ় অঞ্চলের স্থাপত্য, ভাস্কর্য, ইতিহাসের সংরক্ষণ স্থানীয় ভাবেই করতে চাই। কমিশন বরঞ্চ প্রত্নবিদ পাঠিয়ে কার্বন ডেটিং করে মূর্তি সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য দিয়ে জাদুঘর নির্মাণে সহায়তা করুক। কমিশন আর উচ্চবাচ্য করেনি। মূর্তিগুলি এখনও বন্দি হয়ে আছে খাতড়া ট্রেজারি স্ট্রং রুমে। আমার অকাল বদলিতে ভাটা পড়ে গেল জৈন ধর্ম, ভাস্কর্য, আদিবাসী লোকসংস্কৃতি রক্ষার এক সম্ভাবনাময় প্রকল্প রূপায়ণে। এখনও সময় আছে, ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এই বিশাল প্রত্নসম্পদের সংরক্ষণে নজর দিলে পশ্চিমবঙ্গে হারিয়ে যাওয়া জৈনধর্ম, সাহিত্য স্থাপত্য-ভাস্কর্যের ইতিহাসের বিষ্ময়কর দরজা খুলে যাবে।
পড়ে খুব ভালো লাগলো। এরকম আরো প্রবন্ধ পড়তে চাই
মূল্যবান আলোচনা ও প্রস্তাব।