বর্ধমানের কালনায় এক কবিরাজ পরিবারে তাঁর জন্ম হয়েছিল। পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসারে আয়ুর্বেদচর্চায় শিক্ষা লাভ করেছিলেন। কিন্তু কেবল আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছিলেন না। চলে এসেছিলেন কলকাতায়। কলকাতা তখন বৃটিশ ভারতের রাজধানী – শিক্ষা, ব্যবসা, বাণিজ্য ,বিভিন্ন কর্মে প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর।
তরুণটি তাঁর আয়ুর্বেদ শিক্ষাকে মূলধন করে নতুন কিছু করতে চাইছিলেন, নতুন এক আয়ুর্বেদিক শিল্পোদ্যোগ। গতানুগতিক জড়িবুটির নিদান নয়, তিনি মনোনিবেশ করলেন ভেষজ প্রসাধন তৈরীতে। প্রাচীনকাল থেকেই আয়ুর্বেদে জবা ফুলের ভেষজ গুণ স্বীকৃতি পেয়েছে, বিশেষ করে কেশচর্চায়। আর ভারতীয় নারীদের সৌন্দর্যচর্চায় কেশচর্চার এক বিশেষ স্থান প্রাচীনকাল থেকেই আছে। সেই জবা ফুলের নির্যাসের সঙ্গে আরো কিছু ভেষজ উপাদান মিলিয়ে তৈরি করলেন এক নতুন ভেষজ কেশ তেল। নাম দিলেন জবাকুসুম কেশ তৈল। নবীন শিল্পোদ্যোগীর নাম চন্দ্রকিশোর সেন, যিনি পরবর্তীকালে প্রসিদ্ধ হয়েছিলেন সি কে সেন নামে।
১৮৭৮ সালে যাত্রা শুরু করেছিল সি কে সেন এন্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড। জবাকুসুম কেশ তৈল বাজারে আসার কিছুকালের মধ্যেই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এবং কালক্রমে ঘরে ঘরে কেশবিলাসীনী মহিলাদের কাছে প্রসাধনের এক আদরণীয় অপরিহার্য সামগ্রী হয়ে উঠেছিল।
তখন আরো কয়েকটি কেশ তেল বাজারে ছিল। যেমন, কবিরাজ নগেন্দ্রনাথ সেনের কেশরঞ্জন তেল। চন্দ্রকিশোর বুঝেছিলেন যে কেবল গুণমান নয়, ক্রেতাদের মনে দাগ কাটতে হলে বিপণন ও বিজ্ঞাপনের দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। ১৯০৩ সালে জবাকুসুম কেশ তৈল নিয়ে এক বিজ্ঞাপনী ফিল্ম তৈরী করিয়েছিলেন হীরালাল সেনকে দিয়ে, যাঁকে ভারতের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে গণ্য করা হয়। সি কে সেনের আগরপাড়ার বাগানবাড়িতে নির্মিত এই ফিল্ম ভারতের প্রথম বিজ্ঞাপনী ফিল্ম। যে সময়ে সাধারণভাবে ব্যবসায়ীরা পণ্যের বিজ্ঞাপনকে অত গুরুত্ব দিতেন না, সেই সময়ে সি কে সেন বুঝেছিলেন পণ্যের বিক্রয় বাড়াতে বিজ্ঞাপন কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
সৃষ্টিশীল বিজ্ঞাপনকে বরাবরই গুরুত্ব দিয়ে এসেছিলেন জবাকুসুম নির্মাতারা। সত্যজিত রায় এঁকেছিলেন জবাকুসুম এর বিজ্ঞাপন চিত্র। ১৯৮১ সালে মুনমুন সেনকে দেখা গিয়েছিল বিজ্ঞাপনী ছবিতে। তারও অনেক আগে জীবৎকালেই কিংবদন্তী দাদাঠাকুরের জঙ্গিপুর সংবাদ এ জবাকুসুম কেশ তৈলের বিজ্ঞাপন দেখা যেত। সেই সময়ের অধিকাংশ সাময়িক পত্রিকাতেই বেরোত জবাকুসুম এর বিজ্ঞাপন।
পত্রিকা চালানোর জন্য বিজ্ঞাপন জোগাড়ের তাগিদে কলকাতায় এসে দাদাঠাকুরের যোগাযোগ হয়েছিল জবাকুসুম এর কর্তাব্যাক্তিদের সঙ্গে। তাঁর রসবোধ আর বাগ্মীতায় তাঁরা মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং তাঁকে বিজ্ঞাপন দিতে রাজী হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, জবাকুসুম এর কয়েকটি চমকপ্রদ বিজ্ঞাপনও লিখে দিয়েছিলেন দাদাঠাকুর।
একবার দাদাঠাকুরের চৌত্রিশটি টাকার বিশেষ প্রয়োজন হলো। তিনি সি কে সেন কোম্পানীর তদানীন্তন পরিচালক বলাইচন্দ্র সেনের কাছে টাকাটা অগ্রিম চাইলেন। বলাইবাবু বললেন, ‘অগ্রিম কেন ? একটা বিজ্ঞাপন লিখে দিয়ে টাকাটা নিয়ে যান।’ দাদাঠাকুর কবিতার ছন্দে লিখে দিলেন পাঁচটি স্তবক।
‘আয়ুর্বেদ জলধিরে করিয়া মন্থন,
সুক্ষণে তুলিল এই মহামূল্য ধন।
বৈদ্যকুল ধুরন্ধর স্বীয় প্রতিভায়,
এর সমতূল্য তেল কি আছে ধরায়?’
#
এই তৈলে হয় সর্ব শিরোরোগ নাশ,
অতুল্য ইহার গুণ হয়েছে প্রকাশ,
দীনের কুটির আর ধনীর আবাসে,
ব্যবহৃত হয় নিত্য রোগে ও বিলাসে
#
চুল উঠা টাক পড়া মাথা ঘোরা রোগে,
নিত্য নিত্য কেন লোক এই দেশে ভোগে।
সুগন্ধে ও গুণে বিমোহিত হয় প্রাণ,
সোহাগিনী প্রসাধনে এই তেল চান।
#
কমনীয় কেশগুচ্ছ এই তেল দিয়া,
কৃষ্ণবর্ণ হয় কত দেখ বিনাইয়া,
তৃষিতে প্রেয়সী চিত্ত যদি ইচ্ছা চিতে,
অনুরোধ করি মোরা এই তৈল দিতে।
#
চিত্তরঞ্জন এভিনিউ চৌত্রিশ নম্বর,
বিখ্যাত ঔষধালয় লোকহিতকর,
অবনীর সব রোগ হরণ কারণ,
ঔষধের ফলে তুষ্ট হয় রোগীগণ।’
এই বিজ্ঞাপনী কবিতাটি লিখে দাদাঠাকুর চৌত্রিশ টাকা দক্ষিণা পেয়েছিলেন।
একবার সত্যব্রত সেনের বাড়িতে দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে অনেক গুণী ব্যক্তির সমাবেশ হয়েছে। এঁদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন দাদাঠাকুরও। সবাই আলাপ আলোচনা কথাবার্তা বলছেন। এমন সময়ে সি কে সেন কোম্পানির তখনকার ম্যানেজিং ডিরেক্টর বলাইচন্দ্র সেন এসে হাজির হলেন। তাঁর হাতে দুখানি ছবি। একখানা ছবিতে দশভুজা প্রতিমার সামনে এক মহিলা কতকগুলি জবাফুল দিয়ে অঞ্জলি দিচ্ছেন, অপর ছবিতে এক সুন্দরী তরুণী আয়না, চিরুনি আর জবাকুসুম তেলের শিশি নিয়ে কেশচর্চায় মগ্ন। জানা গেল জবাকুসুম তেলের বিজ্ঞাপনের জন্য ছবিদুখানি কোনো শিল্পীকে দিয়ে আঁকানো হয়েছে। বলাই বাবু ছবি দুখানি হিতবাদী পত্রিকার সম্পাদক চন্দ্রোদয় বিদ্যাবিনোদের হাতে দিয়ে অনুরোধ করলেন বিজ্ঞাপনের জন্য ক্যাপশন লিখে দিতে। বিদ্যাবিনোদ কিছুক্ষণ ভেবে ছবি দুটি দাদাঠাকুরের হাতে দিয়ে বললেন , ‘শরৎ, এ তোমার কাজ।’ দাদাঠাকুর ছবিদুখানি নিয়ে একবার চোখ বুলিয়েই বললেন – এটি ‘সাধনে জবাকুসুম ‘ আর ঐটি হল ‘প্রসাধনে জবাকুসুম’।
সি কে সেনের জবাকুসুম তেলের এক অনুরাগী ক্রেতামণ্ডলী তৈরী হয়ে গিয়েছিল। যাঁরা এই তেল ব্যবহার করতেন, বিশেষ করে মেয়েরা, তাঁরা কয়েক প্রজন্ম ধরে এই তেলই ব্যবহার করতেন। কিন্তু কালক্রমে রুচিপছন্দ পাল্টাতে শুরু করল। সৌন্দর্যচর্চায়, বিশেষ করে কেশচর্চায় ‘কুঁচবরণ কন্যা, তার মেঘবরণ কেশ’ -এই ধারণা পাল্টে যেতে লাগল। জবাকুসুম তেল রয়ে গেল একই রকম।
এক বাঙালী শিল্পোদ্যোগীর সৃষ্টিশীল উদ্যোগ ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায় হয়ে রইল।
তথ্যঋণ : দ্য টেলিগ্রাফ, দাদাঠাকুর : নলিনীকান্ত সরকার, জবাকুসুম ওয়েবসাইট, বাংলা চলচ্চিত্রের প্রাণপুরুষ হীরালাল সেন : আলেকজান্ডার বন্দ্যোপাধ্যায় (বঙ্গদর্শন)