[“তুই তোর শরীরের যত্ন রাখ, তুই তো জানিসনে বেঁচে থাকার জন্য তোর শরীরটার প্রয়োজন হবে।” আফ্রিকার উগান্ডার তরুণ প্রজন্মের লেখিকা জোয়ানিতা ম্যালে তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন এ গল্পের মুখ্য চরিত্র গণিকা মেয়েটির প্রতি তার গর্ভধারিনী মায়ের এই উক্তিকে সাহসিকতার সঙ্গে তুলে ধরে।]
আপনি অবশ্যই বুঝতে পারবেন, আমি এই জীবনকে পছন্দ করি না। কিন্তু খদ্দেররা আমাকে পছন্দ করে। যেভাবেই হোক শৈশবেই আমাকে নাইট জবের জন্য তৈরি করে তোলা হয়। আপনি কি একে জব বলেন? আমার মাও এই জব করতো, তার মাও! আমি এ কাজ থেকে মুক্তি পাওয়ার কথাই ভাবতেই পারি না।
শীতের এক সন্ধ্যা, ৭টার কাছাকাছি। আমি নিশ্চিত আজ বৃষ্টি হবে না। বৃষ্টি হলে আমাদের ব্যবসা প্রায়ক্ষেত্রেই শূন্যের কোটায় পৌঁছে। আপনি জানেন প্রবল বৃষ্টির সময় রাস্তায় লোকজন থাকে না। মেঘ কেটে যাওয়ার পর নীল আকাশে তারা দেখা গেলে বৃষ্টি হবে না বলে আমি জানি। তখন আমাকে বলা হয়, তারাগুলো থেকেই বোঝা যাচ্ছে আকাশ আগের অবস্থায় ফিরে আসবে।
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! আমি সাদা পোশাক পরে আছি, সাদা পোশাকে আমার শরীরের আনাচে কানাচে স্পষ্ট দেখা যায়। আপনি অন্য মেয়েদেরকে লক্ষ করার চেষ্টা করলে দেখতে পাবেন সাদা রঙটা সত্যিই ভাল। আমার গায়ের রঙ কালো বলে আমি মেক আপ করে থাকি। আমার মা আমাকে শিখিয়েছেন কিভাবে মেক আপ করতে হয়। মেরুন লিপস্টিক আর একটু আই স্যাডো। আমার পায়ে ছয় ইঞ্চি উঁচু হিলের জুতো। ফ্যাসানের জন্য আমি ওটা পরিনি, ওটা পরেছি যাতে আমাকে ৫ ফুট ১ ইঞ্চি লম্বা দেখতে লাগে। আমিই ওখানকার একমাত্র ছোটখাট মেয়ে। আমি কোন অন্তর্বাস পরি না। আমি জানি, এতে কাস্টমারা বুঝতে পারে আমি কি কাজে ওখানে এসেছি।
আমি বার্টোন স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে আছি, রাস্তাটা একটু একেবেঁকে ইউসুফ লুলে রোডের দিকে চলে গেছে। অধিকাংশ মেয়েরাই ইতিমধ্যেই সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তাটাতে মোটেই আলো নেই। আমি আঁধারকে পছন্দ করি, আলোর কোন চিহ্ন থাকার অর্থ আমাদের কারো না কারোর একজন গুরুত্বপূর্ণ মক্কেল আছে। রাস্তার পাশের বিল্ডিংগুলো অফিসের দিকে চলে গেছে।অফিসগুলোর প্রবেশ পথের গেটে পরিচিতিমূলক বড়সড় সাইনবোর্ড সাঁটা। এ সময়ে অফিসগুলোতে কোন শব্দ থাকে না। হঠাৎ আলো এসে পড়লে আমি তাড়াতাড়ি শরীরটাকে বাঁকিয়ে ড্রাইভারের নজর কাড়তে পছন্দ করি, যাতে আমাকে সহজেই পছন্দ করতে পারে। আমার মুখটা তারা যাতে দেখতে পারে তার জন্য আমার শরীরটাকে সামনে এগিয়ে নেই। আমি মুচকি মুচকি হাসি। ওই সময়টাতে আমি সুন্দর করে হাসতে পারি। সুন্দর হাসি দেওয়া আমাকে রপ্ত করতে হয়েছে। মিষ্টি হাসি দিয়ে আমি কিন্তু সুখ পাই না। আপনার সামান্যতম অনুরোধেই আমি হাসির জাদু দেখাতে পারি। এ চাকুরীর যোগ্যতাগুলোর মধ্যে এটা অন্যতম।
একটা কোরোনা কার ধীরে ধীরে আমার কাছে এসে থামল। কার দেখেই আমি বলতে পারি যে মক্কেলটা আমার পছন্দ মতো মুক্তহস্তে দাম দেবে। আমি কিন্তু অনেক আগে থেকেই এটা জানতাম। একটা কালো মুখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আমার চোখদুটো বিষ্ফারিত করে মুক্ত ঝরা দাঁত বিকশিত করে তাকে দেখলাম।
“ভেতরে এসো।” অধৈর্য হয়ে লোকটি চিৎকার করে উঠল। কেউ তাকে দেখতে না পারে তাই সে গাড়িতে স্টার্ট দিল। আমি হাসতে হাসতে লাফ দিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। আমি জানি না আমরা কোথায় যাচিছ। আমাকে কত দাম দেবে সে সম্পর্কে পরিষ্কার হতে হবে। “দূরে, না কাছে?” আমি ভ্রুকুটি করে উচ্চকন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম। আমি এটা সব সময়ই জেনে নেই। লোকটি চিৎকার করে বলল, “দূরে, কত দিতে হবে?” দূরে যাওয়া কষ্টকর ব্যাপার, তাই আমি ভেবে বললাম। “পঞ্চাশ হাজার শিলিং।” “ওকে,” সঙ্গে সঙ্গে লোকটা বলে ফেলে। আমি অনুমান করলাম কার নতিন্দাতে যাচ্ছে। ওখান থেকে ফিরে আসতে বেশি খরচ হবে না, আমি মনে মনে ভাবলাম। আমি নালিয়াতে থাকি। আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখান থেকে নতিন্দা কাছেই।
আমরা ম্যাক্স মোটেলে পৌঁছালাম। প্রত্যেকেই নতিন্দার স্পটাকে পছন্দ করে।আমরা কার থেকে বাইরে এলাম। লোকটা দ্রুতগতিতে আমার আগে আগে চলতে লাগল। আমি অবাঞ্ছিত কুকুর ছানার মতো তাকে অনুসরণ করছি। তারা প্রথমে সব সময়ই এমন ব্যবহার করে যেন তারা তোমাকে অনুকূল্য দান করছে। এমন আচরণকে আমি ঘৃণা করি।আমরা রুমের মধ্যে প্রবেশ করার পর লোকটি একটুও সময় নষ্ট না করে তার পোশাক খুলে ফেলে ধুসর রঙের পুরু কম্বল পাতা ডবল বেডে শুয়ে পড়ল। এই মোটেলের সব কিছুই আলোআঁধারীতে ঘেরা। ধুসর রঙের পর্দাগুলো কম্বলের সাথে ম্যাচ করা। ক্রিম কালারের ওয়াল আর সাধারণ আসবাবপত্র দেখে মনে হচ্ছে আসপাশের প্রাইমারী স্কুল থেকে যেন এগুলো নিয়ে আসা হয়েছে। আলোআঁধারীতে ঘেরা এই মোটেলের সব কিছুই লোকচক্ষুর অন্তরালে চলছে।
বিভিন্ন ধরনের মক্কেল এখানে আসে, তারা বোডাবোডা নামের ক্যারিয়ার বাইকেও এখানে আসে। নগরীতে দিনের বলা আয়-উপার্জন ভাল হলে বোডাবোডা বাইকের চালকরা নিজেরাও এখানে আনন্দ স্ফুর্তি করতে আসে।
আমি লোকটার দিকে তাকালাম, লোকটা সুঠাম দেহী। সাধারণ মক্কেলদের চাইতে অন্য রকম, এক কথায় ভালই দেখতে। সে কাঙ্খিত চোখে আমার দিকে তাকাল। আমি এমন ভাবে তাকানোকে ঘৃণা করি। শুরুতেই আমি আমার পোশাক খুলে ফেললাম। যদিও সে আমাকে ভাল দাম দেবে, তবুও আমি তাকে অল্প সময় দিতে সংকল্প করলাম। আজ আমার বেশি সময় দেওয়ার মতো মনের অবস্থা নেই। তবুও আমি তাকে আনন্দ দেব যাতে সে বলতে না পারে মজা পাইনি। তাকে বেশি মাত্রায় খুশি করাকে আমি ঘৃণা করতে পারি না। আমি মোটেলের অন্য বেড থেকে ক্যাচ ক্যাচ শব্দ শুনতে পাচ্ছি পাশের রুমগুলো থেকে একই ধরনের শব্দও অল্পস্বল্প শুনতে পাচ্ছি। শব্দ যেন সঙ্গীতের ছন্দের মতো ভেসে আসছে। লোকটাকে দেখে আমার মনে হল, তার মুখটা যেন ব্যথায় ভরে উঠেছে। আমি এ থেকে বুঝতে পারলাম আমি আমার কাজ ভাল ভাবেই করতে পেরেছি। তার মানে, তার মুখ চুমু দেওয়ার সাথে সাথে আমি দু-একটা কামড়ও দিয়েছি।
আমি নিশ্চিত, লোকটার এখানে এবারই প্রথম আসা। সে আমাকে আমার দামের কথা জানতে চাইল। কাজটা হয়ে যাওয়ার পর কেউই এটা জিজ্ঞেস করে না। এ সম্বন্ধে ভেবে আমি ভাল ভাবে নিশ্চিত হলাম আমার ধারণাই ঠিক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমি এটাকে ঘৃণার চোখে দেখি। এটা একটা ঘৃণ্য কাজ।
ঘৃণ্য কাজে বাধ্য করায় আমি আমার মাকে নিন্দা করতে শুরু করার মুহূর্তে প্রত্যেক রাতে তারা আমার মাকে ছেড়ে সময় আমার মায়ের কান্নার স্মৃতি মনের কোণে ভেসে উঠত। বিভিন্ন ধরনের লোকদের মা বাড়িতে নিয়ে আসতো। সে সময় আমি বিস্মিত হতাম এই ভেবে কী কারণে মা এতটা অসুখী। আমাদের মানুষ করার জন্য আমার মায়ের প্রচুর অর্থকড়ি ছিল। সে একজন ভাল মা। আমি বড় হয়ে সব কিছু বুঝতে পারলাম।
“দাম মিটিয়ে দিন।” আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম। সে সময় আমি হাসতে আর পারছিলাম না। দাম বুঝে নেওয়ার সময় আমার আর হাসার প্রয়োজন নেই। “তোমার দাম খুবই বেশি।” লোকটা আমাকে ভোগ করার পর আমাকে বলল। “কাজের পরে আমি কোন যুক্তি শুনতে রাজি নই” আমি তার দিকে শুধুমাত্র তাকিয়ে থাকতে দেখে সে পঞ্চাশ হাজার শিলিং-এর নোট বের করল। আমি ওইগুলো তার হাত থেকে আঁকড়ে ধরে আমার ব্রার মাঝে ঢুকিয়ে দেওয়ার সময় লোকটা দিগম্বর অবস্থায় পাশের বাথরুমে যেয়ে তার শরীরটা ধোয়মোছা করতে গেল। লোকটা আসলেই এ কাজে প্রথম।
আমি আর সময় নষ্ট করতে চাই না, তার টাউজারটাতে খুঁজে পেতে কিছুই পেলাম না। আমি তার শার্ট চেক করে কয়েকটা পকেটে ভাঁজ করা দশ হাজার শিলিং পেয়ে ওইগুলো মুঠো করে ম্যাক্স থেকে বের করে মেইন রোডে এসে পৌঁছেছি। আমাকে এখন একটা বোডাবোডা ক্যরিয়ারকে ডাকতে হবে। ভালয় ভালয় আমি এখন বাড়িতে পৌঁছে গেছি। আমার দিকে মুচকি হেসে মা দরজা খুলে দিয়ে সে জানতে চাইল যে আমি তার জন্য কিছু অর্থ নিয়ে এসেছি কিনা।
অনেক দিন আগের থেকেই মা পুরুষদেরকে বাড়িতে আনা বন্ধ করেছ। বয়স পঞ্চাশ বেশি হলে বড়শিতে গেঁথে তোলার মতো কোন পুরুষ পাওয়া যায় না। আমি নিজে ওই বয়সে কবে পৌঁছাব? আমি নিজেও বুঝতে পারি না। আমি লক্ষ করি আমার মা প্রত্যেকদিন মেক আপ করে আর আমাকে বলে “তুই তোর শরীরের প্রতি যত্ন রাখ, তুই এখনো জানিসনে বেঁচে থাকার জন্য তোর শরীরটার প্রয়োজন হবে।”
এটা করলে হয়তো আমি রিসিপসনিস্টের চাকুরী পেতে পারি, আর সেখান থেকে আমার আয় উপার্জন হবে। আমি সেটাই মাকে বললাম। সে আমার কথা বিশ্বাস করার ভান করল। আমি জানি না সে এটা আসলেই বিশ্বাস করেছে কিনা। মা তার ছোট্ট হাত বাড়িয়ে অপেক্ষায় আছে। এমনকি পঞ্চশ বছর বয়সেও তার চেহারায় সুঠাম, যদিও সে আর নিজেকে পুরুষের কাছে সঁপে দেওয়ার জন্য এখন আর তেমন সুন্দরী নয়। তাই তার রাতের চাকরী আমার ওপর বর্তেছে। প্রত্যেক হাসির পেছনে কালছায়া পড়ে। সে রাতের চাকুরী। ওই কারণে আমি সিরিয়াসলি নাইট জবে যবনিকা টানতে যাচ্ছি। কয়েকদিন পরে, আমি মায়ের হাতে পঞ্চশ হাজারে বেশি নোট পৌঁছে দিলাম। সে এত অর্থ পেয়ে মুচকি হেসে গর্ব অনুভব করে বলল, “ওকে।” আমি আসলেই মায়ের বাসনাকে ঘৃণা করি। আমি রুমের দিকে হাঁটা দিলাম। আগামীতে আমার জীবনে দীর্ঘ সময় পড়ে আছে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাকে অবশই বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসে সোশিয়লোজি পরীক্ষায় বসতে হবে।
লেখক পরিচিতি : জোয়ানিতা ম্যালে (Joanita Male) তরুণ আফ্রিকান লেখিকা। জন্ম ও বেড়ে উঠা উগান্ডার কাম্পালায়। তিনি আফ্রিকান সাহিত্যে তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি। তিনি তাঁর বাবা মায়ের সঙ্গে থাকেন। তারাই তাঁকে লেখালেখিতে অনুপ্রাণিত করেন। জোয়ানিতা ইংলিশ লেখিকা এনিড ব্লিটন( Enid Blyton) এর লেখা বই পড়ে বেড়ে উঠেন। তারপর তিনি চিমামান্দা নগোজি এদিচিই (Chimamanda Ngozi Adichie) এবং বিলি কাহোরা (Billy Kahora.) মতো আফ্রিকান লেখক লেখিকাদের লেখায় অনুপ্রাণিত হন। জোয়ানিতা ম্যালে এর মাঝেই বেশ কিছু গল্প লিখেছেন, যা পাঠক মহলের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছে।
জোয়ানিতা ম্যালে (Joanita Male) লেখা গল্প “Its a Night Job” কে “নাইট জব” নামে বঙ্গানুবাদ করা হল। মায়ের কথায় গণিকার কাজে বাধ্য হওয়া এক বালিকার কাহিনী লেখিকা বিশেষ অনুষঙ্গে উপস্থাপন করেছেন।
ইংরেজি গল্পের লিঙ্ক : https://modomodo-african-short-stories.netlify.app/nightjob
মনোজিৎকুমার দাস, কথাসাহিত্যিক, লাঙ্গলবাঁধ, মাগুরা।