২০০৭ সাল। ভারত ক্রিকেটে মজে। এরই মধ্যে ফুটবলে একটি কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললো ভারত। বব হাউটনের কোচিংয়ে প্রথমবারের জন্য ভারত জিতে নিলো নেহরু কাপ, তাও ফাইনালে সিরিয়ার মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে হারিয়ে। কোনো ভারতীয়ই হয়তো ভাবতে পারেনি ভারত নেহেরুকাপ চ্যাম্পিয়ন হবে। এই অসাধ্যসাধনের পিছনে বাইচুং, সুনীল, এন.পি.প্রদীপদের যেমন অবদান ছিলো, ঠিক তেমনই অবদান ছিলো ভারতের ‘স্পাইডারম্যান’ গোলকিপারের। সেমিফাইনাল আর ফাইনাল মিলিয়ে গোলপোস্টের সামনে অনতিক্রম্য দুর্গের আকার ধারণ করেছিলেন তিনি। তিনি না থাকলে নেহেরু কাপবিজয় সম্ভব হতোনা। তিনি আর কেউ নন, আমাদের পশ্চিমবাংলা তথা ভারতের গর্ব সুব্রত পাল।
সুব্রত পাল জন্মগ্রহণ করেন ২৪ শে ডিসেম্বর, ১৯৮৬ সালে, সোদপুরে। সোদপুরের এক টালির ছাউনির বাড়ি থেকে ভারতের জাতীয় দলের জার্সি, সেখান থেকে বিদেশের দলে সুযোগ পাওয়া—নাহ্, যাত্রাটা মোটেও সহজ ছিলোনা। এই যাত্রার সূচনা হয়েছিল টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমীতে। কথিত আছে বাড়ি থেকে পালিয়ে টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমীতে গিয়েছিলেন তিনি। অ্যাকাডেমীর মেন গেটের সামনে টানা দুইরাত্রি পড়ে ছিলেন। সকালবেলায় তৎকালীন টি.এফ.এ.-এর কোচ রঞ্জন চৌধুরী দেখেন গেটের সামনে পড়ে থাকা এক তরুণকে। ততক্ষণে ট্রায়াল শেষ। কিন্তু অনেক অনুনয় বিনয়ের পর তরুণ সুব্রত সুযোগ পান নিজের প্রতিভা প্রদর্শনের। রাতভর দৌড়ঝাঁপের ক্লান্তি দূরে সরিয়ে তিনি অবশেষে সক্ষম হয়েছিলেন কোচেদের মনোরঞ্জনের। এভাবেই শুরু হয়েছিল লড়াইটা। বাড়ি থেকে পালিয়ে সোদপুরের এক টালির ছাউনি থেকে সোজা টাটা ফুটবল একাদেমী।
তাঁর আউটিং আর ডাইভিংটা ছোটো থেকেই ছিলো দুর্দান্ত। তার উপর ছায়া হিসেবে পেয়ে গিয়েছিলেন ভারতবিখ্যাত ইউথদলের কোচ রঞ্জন চৌধুরীকে। শুরু হলো তরুণ সুব্রত পালের গ্রুমিং। ২০০৪ এর বাংলা সন্তোষ ট্রফি দলে নিজের জাত চেনালেন তিনি। সেই সময় বাংলা দলের সাথে যুক্ত ছিলেন প্রাক্তন গোলকিপার দেবাশীষ মুখার্জী। কোচ হিসাবে দেবাশীষ মুখার্জীকে পেয়ে তাঁর গ্রুমিং আরও সম্পূর্ণ হতে থাকলো। ২০০৪ সালেই মোহনবাগান দলে সুযোগ পেয়ে গেলেন তিনি। কিন্তু এই ২০০৪ সালেই সুব্রত পালের জীবনে নেমে এলো এক কলঙ্কের অধ্যায়।
২০০৪ এর ৫ ডিসেম্বর। ফেড কাপ ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিলো মোহনবাগান-ডেম্পো। ম্যাচের একটি সময় একটি বল ধরতে গিয়ে সুব্রত পালের দ্বারা ভয়ংকরভাবে আহত হন ডেম্পোর খেলোয়াড় ক্রিশ্চিয়ানো জুনিয়র। এই আঘাতে মৃত্যু ঘটে জুনিয়রের।সুব্রত পালের কেরিয়ারে নেমে আসে কালিমা।দুমাসের জন্য সাসপেন্ড হন তিনি।
এখানেই হয়তো তাঁর কেরিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু বিধাতা অন্য কিছু লিখেছিলেন সুব্রত পালের ললাটে।
২০০৭ সালটা সুব্রত পালের কেরিয়ারে এক ব্রেকআউট বছর হয়ে দাঁড়ায়। তখন তিনি ইস্টবেঙ্গলে। এরই মধ্যে নেহেরু কাপে জাতীয় দলের হয়ে সুযোগ পান তিনি; আরেক বাঙালী গোলরক্ষক সন্দীপ নন্দীর পরিবর্তে। এই সুযোগটাকে লুফে নেন সুব্রত।সেমিফাইনালে কিরজিগিস্তানের বিপক্ষে অসাধারণ নৈপুণ্য দেখান তিনি। আর ফাইনালকে স্মরণীয় করে রাখেন শক্তিশালী সিরিয়ার বিপক্ষে একের পর এক আক্রমণের তরঙ্গকে রুখে দিয়ে। ভারত চ্যাম্পিয়ন নেহেরুকাপে; প্রথমবারের জন্য। আর চ্যাম্পিয়ন দলের গোলরক্ষক হিসাবে নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখেন সুব্রত পাল।
এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এফ সি চ্যালেঞ্জ কাপ ২০০৮-এর ফাইনালেও অসাধারণ কিছু সেভ করে দেশকে চ্যাম্পিয়ন হতে সাহায্য করেন তিনি। এই টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হবার ফলে ভারত ২০১১ সালের এশিয়া কাপে ২৪ বছর পর খেলার সুযোগ পায়।
২০০৯ সালের নেহেরু কাপ ছিলো সুব্রত পালের কেরিয়ারে অন্যতম উল্লেখযোগ্য এক টুর্নামেন্ট। সেবারেও ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিলো ভারত-সিরিয়া। নির্ধারিত সময় অতিক্রম হবার পর খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানে তিনটি শট সেভ করে আবারও দেশকে নেহেরুকাপ চ্যাম্পিয়ন করেন সুব্রত পাল। ২০০৯ সালে নেহেরুকাপ চ্যাম্পিয়ন হবার পরে সুব্রত পাল ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে চলে আসেন পুনে এফসিতে। এটা সুব্রত পালের কেরিয়ারের জন্য যথেষ্ট আশীর্বাদজনক হয়েছিলো। কলকাতা থেকে দূরে থাকায় কলকাতা ময়দানের তুমুল চাপ থেকে তিনি নিজেকে মুক্ত রাখতে পেরেছিলেন। পুনে এফসিতে তিনি নিজের খেলার উপর আরও মনোযোগ আরোপ করার সুযোগ পান।
সুব্রত পালের প্রথম থেকেই ইচ্ছা ছিলো বিদেশের ক্লাবে খেলার। ২০১০ তে কানাডার ক্লাব ভ্যাঙ্কুভার হোয়াইটক্যাপসে ট্রায়াল দেন তিনি। ২০১২ সালে জার্মান ক্লাব আর.বি.লেপজিগে ট্রায়াল এবং ট্রেনিংয়ের সুযোগ পান তিনি। আর বি লেপজিগের তৎকালীন গোলরক্ষক কোচের সুব্রত পাল সম্পর্কে একটি বক্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছিলেন যে সুব্রত পালের অন্যতম ক্ষমতা হলো তাঁর রিঅ্যাকশন, তিনি গ্রাউন্ডের বলে যথেষ্ট ভালো, হাইটের কিছুটা ঘাটতি থাকলেও তাঁর দুরন্ত জাম্পিং এবিলিটির জন্যে সেই ঘাটতিও তিনি পূরণ করেছেন; এছাড়াও সুব্রত পাল এমন একজন বলপ্লেয়িং গোলরক্ষক যাঁকে নির্ভয়ে বল পাস করা যেতে পারে।
২০১১ সালের এশিয়ান কাপের উল্লেখ ছাড়া সুব্রত পালের কেরিয়ার অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। সেবার ২৪ বছর পর এশিয়ান কাপে সুযোগ পায় ভারত। ভারতের গ্রুপে ছিলো অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, বাহরিন। গ্রুপ লিগে ভারত একটিও ম্যাচ জিততে পারেনি। কিন্তু ভারতীয় দলের মুখ হিসাবে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন সুব্রত পাল। তিনটি ম্যাচ মিলিয়ে তিনি প্রায় ৩৫ টিরও অধিক শট সেভ করেন যার মধ্যে শুধু দক্ষিণ কোরিয়া ম্যাচেই তিনি করেছিলেন প্রায় ষোলোটির মতো সুপারসেভ। মূলত এই ম্যাচটির পরেই বা বলা বাহুল্য এই টুর্নামেন্টের পরেই তিনি ‘স্পাইডারম্যান’ নামটি অর্জন করেন। ২০১২ সালের নেহেরু কাপও ভারত জয়লাভ করে। কোভারম্যান্সের কোচিংয়ে ভারত সেবার ফাইনালে হারায় অসীম শক্তিশালী ক্যামেরুনকে। সেবারও ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। ভারত জেতে আবারও। ভারতের গোলকিপার কে ছিলেন? —সুব্রত পাল। ২০১৫ সালে ভারতের হয়ে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন তিনি। এছাড়া ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ওয়ার্ল্ডকাপ কোয়ালিফায়ারেও দেশের সদস্য ছিলেন তিনি। ২০১৬ সালে অর্জুন পুরস্কার লাভ করেন সুব্রত পাল। ব্যক্তিগতজীবনে সুব্রত পাল বিবাহ করেন তাঁর অন্যতম গাইড ও কোচ দেবাশীষ মুখার্জীর কন্যা দেবস্মিতা মুখার্জীপাল-কে।
ক্লাব কেরিয়ারেও সুব্রত পাল খেলেছেন বহুক্লাবে। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, পুনে এফসি, ডি এস কে শিবাজিয়ান্স, প্রয়াগ ইউনাইটেড-সহ বিভিন্ন ক্লাবে। আইএসএলেও তিনি খেলেছেন মুম্বাই সিটি, নর্থইস্ট ইউনাইটে, জামশেদপুর এফসি-সহ বিভিন্ন ক্লাবে। বিশেষত নর্থইস্ট ইউনাইটেড ও জামশেদপুর এফসির হয়ে যথেষ্ট সফলতার সাথে গোলকিপিং করেন সুব্রত পাল। গত ৮ ডিসেম্বর, ২০২৩-এ বর্ণময় কেরিয়ারকে বিদায় জানিয়ে ফুটবল থেকে অবসর গ্রহণ করেন সোদপুরের মিষ্টু, ভারতের ‘স্পাইডারম্যান’।
একসময় বাংলাকে বলা হতো ‘গোলকিপারদের রাজ্য’। হীরালাল মুখার্জি থেকে সনৎ শেঠ হয়ে তরুণ বসু, ভাস্কর গাঙ্গুলী কিংবা আজকের সুব্রত পাল—তালিকাটা অনেক বড়ো। সোদপুরের মিষ্টু, পশ্চিমবাংলার মিষ্টু কখন যে ‘ভারতের স্পাইডারম্যান’ হয়ে জাল বিছিয়েছেন ভারতীয়দের মনের গহীনে তা টেরই পাওয়া যায়নি। সুব্রত পাল অবসর নিয়েছেন। আর হয়তো গ্লাভস হাতে দেখা যাবেনা তাঁকে। কিন্তু গোলকিপিংয়ের যে মাইলফলক ভারতজুড়ে তিনি স্থাপন করেছেন তা অনেক তরুণদের ‘সুব্রত পাল’ হয়ে ওঠার প্রেরণা দেবে। ফুটবল কেরিয়ারে শেষ বাঁশি বাজার আগে কখনও হারেননি সুব্রত পাল। কিন্তু নিঃশব্দে কখন যে নিজের ফুটবল কেরিয়ারের শেষ বাঁশি বাজিয়ে দিলেন তা খেয়ালই করা গেলোনা। কোনো ফেয়ারওয়েল ম্যাচ তিনি পেলেন না বা তিনি খেললেননা এই যা!