পুতুলপট্টি মোড়, ঘূর্ণী — সেখান থেকেই সূত্রপাত। কবি হেমচন্দ্র বাগচীর সিমেন্টের তৈরি একটি সুন্দর আবক্ষ মূর্তি দৃষ্টিগোচর হল। হঠাৎ করে হল — সে কথা বলব না। কারণ কৃষ্ণনগর আমার নিজের শহর। এর আগেও হয়তো অনেকবার দেখেছি। কিন্তু মস্তিষ্ক সাড়া দিয়েছে সেই মুহূর্ত সম্ভবত বছর পনেরো পার করেছে। পরবর্তীতে সেই পথেই কর্মক্ষেত্র চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়ে যাতায়াত শুরু হওয়ায়, সপ্তাহে প্রায় পাঁচদিনই তাঁর দেখা পাই। প্রায় পাঁচ ফুট লম্বা বেদীর উপর তিনি বিরাজ করছেন। কবির আসল চেহারার সাথে মূর্তির চেহারার মিল খোঁজার চেষ্টা করি। বারংবার পর্যবেক্ষণ করতে করতে মূর্তিটির কিছু বিশেষত্ব খুঁজে পাই, প্রথমত — দূর থেকে কবির মূর্তিটি বেশি আকর্ষণীয় লাগে। আর কবির মুখমন্ডলে একই সাথে সরলতা এবং গাম্ভীর্য দুটিই দেখতে পাই। তবে বছরের অধিকাংশ সময়েই কবির মূর্তিটি ধুলাবৃত অবস্থায় দেখি। কৃষ্ণনগর-করিমপুর রাজ্য সড়ক — নদিয়া জেলার অন্যতম ব্যস্ত রাস্তা, তার পাশেই কবির মূর্তি। অবস্থানগত গুরুত্ব থাকার পাশাপাশি এ ধরনের কিছু নেতিবাচক দিক থাকাটাও খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু পাশেই আরেকজন মনীষীর ঝাঁ-চকচকে ‘ওয়েল মেইনটেইন্ড’ মূর্তি দেখে প্রকৃতি-পরিবেশ-ভূগোল নয়, নিজেদেরই খামতি আছে বলে মনে করি।
ক্রমান্বয়ে কবি হেমচন্দ্র বাগচীর সাথে আমার সম্পর্ক গাঢ় হয়। ইতিপূর্বে তাঁর কবিতা পড়ার সুযোগ হয়েছিল। বাবা গ্রন্থাগারিক হওয়ায়, কবিপৌত্র ‘হেমচন্দ্র বাগচীর কাব্যসংগ্রহ (প্রথম খণ্ড)’ প্রকাশের পরপরই আমাদের বাড়িতে দিয়ে গিয়েছিলেন। সেটা আমার জীবনের দ্বিতীয় দশক ছিল। স্বীকার করতেই হয়, ঘূর্ণী পুতুলপট্টি মোড়ে কবির আবক্ষ মূর্তি এবং তাঁর কাব্যসংগ্রহ—এই দুটির সমন্বয়ে ধীরে ধীরে কবি হেমচন্দ্র বাগচী সম্পর্কে আমার জানার আগ্রহ বাড়তে থাকে। মনে আছে কর্মজীবনে প্রবেশের পর এ বিষয়ে কিছুটা অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিলেন আমার কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ ড. কৃষ্ণগোপাল রায়। তিনিও সেই সময়ে তাঁর সাহিত্য-অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে নদিয়ার ভূমিপুত্র যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, হেমচন্দ্র বাগচী প্রমুখের কাব্যগ্রন্থগুলির খোঁজ করছিলেন। সেই সময় তাঁর সাথে অনেক ভাবের আদান-প্রদান ঘটেছিল। মনে আছে—হেমচন্দ্র বাগচীর কাব্যসংগ্রহ (প্রথম খণ্ড) সম্পর্কে তাঁকে জানাতে পেরে আমার বেশ ভালো লেগেছিল।
ইত্যবসরে ২০১২ সালের শেষের দিকে ‘কবি হেমচন্দ্র বাগচী: দূরের নক্ষত্র’ নামে একটি গ্রন্থ হাতে পেলাম। খুব ভালো লাগলো, কবি সম্পর্কে আরো কিছু জানতে পারলাম। গ্রন্থটি পড়ে কবি হেমচন্দ্র বাগচী সম্পর্কে জানার আগ্রহ আরও প্রগাঢ় হল। বইটির প্রধান গুরুত্ব হল এই যে, সেটি পড়ে আমার মনে অনেক প্রশ্ন জেগেছিল। কয়েকটি অসঙ্গতি চোখে পড়েছিল, যেগুলি মেলাতে পারছিলাম না। কবির পরিবারের সাথে দেখা করা, কথা বলার অপেক্ষায় ছিলাম। আগেই বলেছি ইতিপূর্বে কবিপৌত্রর সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। কিন্তু সেসময় হেমচন্দ্র বাগচী সম্পর্কে খুব বেশি জানতামও না, আর তাই বিশেষ আগ্রহও জন্মায়নি। তারপর জলঙ্গী দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। একাডেমিক গবেষণার কাজ নিয়ে ব্যস্ততা অনেকটাই বেড়ে যায়, ক্ষেত্রসমীক্ষার জন্য নদিয়া জেলার বাইরে অনেকটা সময় কাটাতে হয়। সেই পর্বে নদিয়ার আঞ্চলিক সাহিত্য, আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চায় সময় কিছুটা কম দিতে পারি। এমতাবস্থায় কাকতালীয়ভাবে কবি হেমচন্দ্র বাগচীর প্রপৌত্ৰীকে আমি ছাত্রী হিসেবে পাই। আবার একটি যোগসূত্রতা গড়ে ওঠে। ক্রমান্বয়ে কবির পরিবারের অনেকের সাথেই যোগাযোগ করতে পারি। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সানন্দে সহযোগিতা করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
২০১৯ সাল থেকে আমরা জোটবদ্ধ হয়ে নতুন করে পরিকল্পনা গ্রহণ শুরু করি। কৃষ্ণনগরে একদল হেমচন্দ্র অনুরাগীকে পাওয়া যায়। আমাদের দৃঢ়চেতা মন স্থির করে নেয় যে, একদা বাংলার স্বনামধন্য কবি হেমচন্দ্র বাগচীকে ইতিহাসের কালগহ্বরে বিস্মৃত হতে দেওয়া যাবে না। যে সকল অনুরাগীবৃন্দ সে সময়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছিলেন, তারা হলেন—
দীপঙ্কর দাস, রতনকুমার নাথ, অপূর্ব দাশ,মীনা সাহা, সতীনাথ ভট্টাচার্য, শর্মিষ্ঠা আচার্য্য, বিজিতকুমার সাহা, কৌশিক চ্যাটার্জী, সর্বাণী দত্ত, অরিন্দম দেব, অমৃতাভ দে, মলয়কুমার বিশ্বাস, অংশুমান দে প্রমুখ। এছাড়াও বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু শুভার্থীকে আমরা পাশে পেয়েছিলাম। অতঃপর হেমচন্দ্র বাগচীকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের কথা ভাবা হয়। কবির জন্ম জয়ন্তী ও প্রয়াণ দিবস ভালোভাবে উদযাপন, স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ, মূর্তি সংস্কার প্রভৃতি বহুবিধ কর্মসূচির পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কবি হেমচন্দ্র বাগচী স্মৃতি রক্ষা সমিতি পরিচালনার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। কবির জন্মস্থান গোকুলনগর গ্রামেও যাওয়ার সুযোগ হয়। কবির পরিবারের লোকজনকেও কমবেশি পাশে পাওয়া যায়।কবিপৌত্রকে আহ্বায়ক রেখে কাজের সূত্রপাত হয়। কবি হেমচন্দ্র বাগচীর অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি নিয়েও কাজ শুরু হয় (যেটি শীঘ্রই প্রকাশ পাবে)।
তবে ২০২০ সালের মার্চ থেকে করোনা অতিমারীর জেরে শুরু হওয়া লকডাউন পরিস্থিতি আমাদের গতিকে কিছুটা কমিয়ে দেয়। পরিবেশ পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে পুনরায় উদ্যোগ নেওয়া হয়। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই চলে আসে কবি হেমচন্দ্র বাগচীর পঁয়ত্রিশতম প্রয়াণ দিবস। ২০২১ সালের ৪ঠা এপ্রিল দিনটি ভালোভাবে উদযাপনের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়। ঠিক হয় কবির পঁয়ত্রিশতম প্রয়াণ দিবসের শ্রদ্ধা-স্মরণ অনুষ্ঠানটি ঘূর্ণী পুতুল পট্টি মোড়ে কবির আবক্ষ মূর্তির সম্মুখে করা হবে। ৪ঠা এপ্রিলের আগে মূর্তিটি সংস্কারের প্রয়োজন অনুভূত হয়। সমসাময়িক অন্যান্য কবি-সাহিত্যিকদের চাইতে হেমচন্দ্র বাগচী অনেকটাই অনালোচিত। কারা দায়িত্ব নিয়ে কবির মূর্তি সংস্কার করবেন? এদিকে সময়ও বেশি নেই। একথা ভাবতে ভাবতে ‘কৃষ্ণনগর ঐকতান’ সংস্থার কথা মাথায় আসে। বিলম্ব না করে শীঘ্রই বন্ধুবর সুজয় ঘোষকে বিষয়টি জানাই। বলা মাত্রই তিনি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন এবং সংস্থার কাছে এই প্রস্তাবটি পেশ করতে বলেন। কিন্তু হাতে বেশি সময় নেই যে! অগত্যা, তারই পরামর্শে তড়িঘড়ি সামাজিক গণমাধ্যমকে কাজে লাগাই এবং কবি হেমচন্দ্র বাগচী স্মৃতি রক্ষা সমিতির পক্ষ থেকে কৃষ্ণনগর ঐকতান সংস্থার সভাপতিকে মূর্তি সংস্কারের বিষয়টি প্রস্তাবাকারে পাঠিয়ে দিই। সেই লিখিত প্রস্তাবটি নিম্নে দেওয়া হল:—
প্রতি,
সভাপতি,
কৃষ্ণনগর ঐকতান,
কৃষ্ণনগর, নদিয়া
নদিয়া জেলার স্বনামধন্য কবি হেমচন্দ্র বাগচীর প্রয়াণ দিবস আসন্ন। আগামী ৪ঠা এপ্রিল, ২০২১ ঘূর্ণী পুতুলপট্টি মোড়ে কবির আবক্ষ মূর্তির সম্মুখে সে উপলক্ষে একটি শ্রদ্ধা-স্মরণ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তার আগে কবির আবক্ষ মূর্তিটির সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে। ‘কৃষ্ণনগর ঐকতান’ কবির মূর্তিটি সংস্কারে এগিয়ে এলে আমরা সেটাকে প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখব।
তারিখ: ২৩ মার্চ ২০২১
কবি হেমচন্দ্র বাগচী স্মৃতি রক্ষা সমিতি, ঘূর্ণী, কৃষ্ণনগর
আজ এই স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে সেদিনের রোমাঞ্চ পুনরায় অনুভব করছি। আশানুরূপ ভাবেই কৃষ্ণনগর ঐকতানের সদস্যরা কবি হেমচন্দ্র বাগচীর মূর্তি সংস্কারে এগিয়ে এসেছিলেন। শুধু সেটুকুই নয়, অনুষ্ঠানের আগে তারা মূর্তিটিকে ভালোভাবে সংস্কার করার জন্য দুইদিন সময় দিয়েছিলেন। ২৫ মার্চ ২০২১ সকালে তারা প্রথম হেমচন্দ্র বাগচীর মূর্তি সংস্কারে হাত লাগিয়ে ছিলেন। আর মনে আছে, মূর্তি সংস্কারের দ্বিতীয় দিন ২৮ মার্চ ২০২১ ছিল শুভ দোল পূর্ণিমা। দোল পূর্ণিমার দিন সকালে কবি হেমচন্দ্র বাগচীর মূর্তি সংস্কারের কাজ শেষ হয়েছিল। প্রসঙ্গত, ধন্যবাদ জানাই ‘হেমচন্দ্র বাগচী জন্মশতবর্ষ উদযাপন সমিতি’র সদস্যদের, যাদের উদ্যোগে কবি হেমচন্দ্র বাগচীর জন্ম শতবর্ষের সময় ঘূর্ণীর পুতুল পট্টি মোড়ে এই আবক্ষ মূর্তিটি স্থাপিত হয়েছিল। পাশাপাশি ধন্যবাদ জানাতে হয় কৃষ্ণনগর পৌরসভার তৎকালীন প্রশাসক মণ্ডলীকে, যাদের পৃষ্ঠপোষকতায় মূর্তিটি এত সুন্দর একটি জায়গায় স্থাপন করা সম্ভব হয়েছিল। মূর্তিটি তৈরি করেছিলেন শিল্পী দীপঙ্কর ধর। এত সুন্দর একটি ভাস্কর্য তৈরির জন্য তাকেও ধন্যবাদ জানাতে হয়।
উল্লেখ্য, আমাদের বিস্মরণ জগতের নিভৃতচারী কবি হেমচন্দ্র বাগচীর ১১৭তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে কবি হেমচন্দ্র বাগচী স্মৃতি রক্ষা সমিতির পক্ষ থেকে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের (১৭-১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১) আয়োজন করা হয়েছিল। কবির ১১৭তম জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠানের প্রথম দিন অর্থাৎ ১৭ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ (শুক্রবার) বৈকাল ৫ ঘটিকায় কৃষ্ণনগরে কাজী নজরুলের স্মৃতিধন্য গ্রেস কটেজে ‘কবি হেমচন্দ্র বাগচী স্মারক গ্রন্থ’ প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটি প্রকাশের তিনমাসের মধ্যেই নিঃশেষিত হয়। আমাদের কাছে এই স্মারক গ্রন্থটি কবি সম্পর্কিত একটি নির্ভরযোগ্য দলিল হিসেবে রয়ে গেছে। ২০২২ সালেও কবি হেমচন্দ্র বাগচী স্মৃতি রক্ষা সমিতির পক্ষ থেকে কবিকে শ্রদ্ধা-স্মরণ করার যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হয়। আগামী দিনগুলিতেও সকলকে একসাথে নিয়ে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সাধক কবি হেমচন্দ্র বাগচীকে আমরা স্মরণ করতে পারব— এই আশা রাখি।
লেখক: সম্পাদক, কবি হেমচন্দ্র বাগচী স্মৃতি রক্ষা সমিতি।
সুলিখিত সুন্দর একটি প্রতিবেদন। কল্লোল -ক্লান্ত কৃষ্ণনাগরিক কবি হেমচন্দ্র বাগচী র কাব্য প্রতিভা ও অপ্রকাশিত কীর্তি আঁধার থেকে আলোয় আনার জন্য দীপাঞ্জন এর প্রচেষ্টা -নিষ্ঠা — প্রয়াস কে প্রশংসা ও সাধুবাদ জানাই।জয় হোক।
অনেক ধন্যবাদ
ভালো কাজ। প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
ধন্যবাদ স্যর
স্মারক গ্রন্থটি পড়ে জানাবেন স্যর
খুবই ভালো লাগলো এরকম কিছু অজানা তথ্য কাব্য ইতিহাস জানতে পারলাম। কবি হেমচন্দ্র বাগচী জীবনী টি পড়ে বেশ ভালো লাগলো। অনেক তথ্য পাওয়া গেলো ।
তোমার আগ্রহ দেখে ভালো লাগলো। কবির বিস্তারিত জীবনী পাঠাবো তোমায়।
খুব ভালো লাগল লেখাটি। প্রচেষ্টা সফল হোক।
পাশে থাকতে অনুরোধ করবো ম্যাডাম। আপনার মতো গুণীর ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম।
দীপাঞ্জন দে মহাশয় নদীয়া জেলার কবি ও সাহিত্যিক কি জানাবেন। আমি শংকর হালদার শৈলবালা। দত্তপুলিয়া, নদীয়া।
নদীয়া জেলার কবি ও সাহিত্যিকদের পরিচয়-১ নামক গ্রন্থের পান্ডুলিপি তৈরির কাজ করছি। নদীয়া জেলার কবি ও সাহিত্যিক গণ তাদের নাম নথিভুক্ত করার জন্য আপনার নাম ঠিকানা ও মোবাইল নাম্বার 8926200021 পাঠানোর জন্য অনুরোধ করছি।