অবশ্য অনেক গবেষক আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারের উপর ইসলামের আগ্রাসনকে কেবল ‘মিথ’ বলেই মনে করেন ১৭।
হাইপেশিয়াকে হত্যার পর তাকে যেন আক্ষরিক অর্থে ভুলেই গিয়েছিলো মর্তের বিস্মৃতিপরায়ন মানবজাতি। স্মৃতির পরতে পরতে পড়েছিলো ধুলোর পুরু স্তর। ৪১৫ খ্রীষ্টাব্দে তাকে হত্যার পর প্রায় তের’শ বছর ধরে সত্যিকার অর্থেই যেন নিশ্চুপ হয়ে পড়ে রয়েছিলো সবাই। অনেক অনেক বছর পরে — সেই ১৭২০ সালে জন টোলান্ড (John Toland) Hypatia or the History of a most beautiful, most virtuous, most learned and in every way accomplished lady; who was torn to pieces by the clergy of Alexandria to gratify the pride, emulation and cruelty of the archbishop commonly but undeservedly titled St Cyril’ নামের দীর্ঘ শিরোনাম বিশিষ্ট প্রবন্ধে হাইপেশিয়াকে স্মৃতির ছাইভস্ম হাত্রে আমাদের সামনে তুলে আনেন। তিনিই বিশ্ববিবেক কে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলেন এই বলে যে হাইপেশিয়ার মত অনিন্দ্যসুন্দর, বিজ্ঞ এবং নিষ্পাপ দার্শনিকের রক্তে হাত রঞ্জিত করার দায়ে সমস্ত পুরুষতন্ত্রের লজ্জিত হওয়া উচিৎ ১২। হাইপেশিয়ার হত্যাকারী হিসেবে খ্রীষ্টিয় চার্চ আর তার তৎকালীন পুরোধা সিরিলকে অভিযুক্ত করে টোলান্ড ওই প্রবন্ধে স্পষ্ট করেই বলেন —
‘সেইন্ট বা সন্ত নামধারী পুরুষতন্ত্রে দীক্ষিত এক বিশপ ছিলেন এই জঘন্য হত্যাকান্ডের মূল হোতা, আর তার শিষ্যরা ছিলেন তাদের গুরুর জিঘাংসা চরিতার্থ করার নিয়ামক’।
টোলেন্ডের হাত ধরে পৃথিবী যেন কুম্ভকর্ণের ঘুম থেকে জেগে উঠলো। যে ভলটেয়ার তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ইতিহাসে এর আগে কোন ‘নারী উদ্ভাবক’ পাননি, তিনিই হলেন এবার হাইপেশিয়া বন্দনায় উচ্ছসিত। তিনি Examen Important De Milord Bolingbroke Ou Le Tombeau Du Fanatisme (১৭৩৬), বইয়ে বলেন — এই পাশবিক হত্যাকান্ড পরিচালিত হয় সিরিলের মাথা-মুড়োনো ভিক্ষু হিসেবে খ্যাত কতকগুলো ‘ডালকুত্তা’র সহচর্যে, আর উগ্র, গোঁড়া ধর্মবাদীদের আস্ফালনে’।
ভলটেয়ার হাইপেশিয়ার অবদান উল্লেখ করেছিলেন তাঁর Dictionnaire Philosophique বইয়েও। তিনি সেখানে হাইপেশিয়াকে একজন সম্মানিত শিক্ষক এবং বিজ্ঞানী হিসেবে উল্লেখ করেন আর সিরিলকে হত্যার আভিযোগে সরাসরি অভিযুক্ত করে বলেন, ‘সিরিল তাঁর খ্রীষ্টিয় আক্রোশ হাইপেশিয়ার উপর ঝেরে দিলেন।’ পরবর্তীতে হাইপেশিয়াকে নিয়ে এন্তার লিখেছেন এডওয়ার্ড গিবন (দ্য ডিক্লায়েন এন্ড ফল অব রোমান এম্পায়ার), দামাস্কিউয়াস (সুদা), হেনরি ফিল্ডিং (আ জার্নি ফ্রম দিস ওয়ার্ল্ড টু দ্য নেক্সট), চার্লস লিকন্ট দ্য লিসল (Hypatie; Hypatie et Cyrille), মরিস বারস্ (Sous l’oeil des barbares), চার্লস কিংসলে (হাইপেশিয়া অর দ্য নিউ ফো’স উইথ এন ওল্ড ফেস), জে ডবলিউ ড্রাপার (হিস্ট্রি অব ইন্টেলেকচুয়াল ডেভেলপমেন্ট ইন ইউরোপ), বার্ট্রান্ড রাসেল (হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলোসফি) সহ অনেকেই। ইতালিতে আঠারো শতকে হাইপেশিয়া ‘আধুনিক সাহিত্য’-এর এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে উঠে আসে। দ্য স্যালুজো, কার্লো প্যাস্কাল, মারিও লুজি হাইপেশিয়াকে নিয়ে কবিতা, প্রবন্ধ আর নাটক রচনা করেন। জার্মান ভাষায় আর্নুলফ জিটল্ম্যানের ইতিহাস ভিত্তিক উপন্যাস ‘হাইপেশিয়া’ (১৯৮৯) দারুন জনপ্রিয়তা পায়। ক্যানাডাতেও প্রায় একই সময়ে আঁদ্রে ফেরেত্তি আর জ্য মার্সেল হাইপেশিয়াকে নিয়ে দু দুটি দীর্ঘ উপন্যাস রচনা করেন। নারীবাদীরা হাইপেশিয়াকে ঘিরে রচনা করতে শুরু করেন নারীবাদী সাহিত্য। নারীবাদী কবি এবং ঔপন্যাসিক উর্সুলা মোলিনারো হাইপেশিয়াকে নিয়ে আশির দশকের শেষভাগে রচনা করেন একটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ। আজ দু’ দুটি বিখ্যাত গবেষনা-সাময়ীকীর (জার্নাল) নাম হাইপেশিয়ার নামানুসারে রাখা হয়েছে। একটি হল এথেন্স থেকে প্রকাশিত ‘হাইপেশিয়া: ফেমিনিসট স্টাডিস’; এবং অপরটি ‘হাইপেশিয়া : এ জার্নাল অব ফেমিনিস্ট ফিলোসফি’ । হাইপেশিয়া উঠে এসেছে আজকের দিনের নারীবাদী চিত্রকর্ম এবং শিল্পকলাতেও — অত্যন্ত প্রবলভাবেই। ১৯৭৯ সালে হাইপেশিয়াকে নিয়ে নারীবাদী চিত্রকর জুডি শিকাগোর একটি স্থাপত্যকর্ম স্যান ফ্রান্সিস্কো মিউজিয়ামের ‘আধুনিক চিত্রকলা’ প্রদর্শিত হয় ১২। ২০০৯ সালে হাইপেশিয়ার মর্মান্তিক কাহিনী উপজীব্য করে ‘এগোরা’ নামে একটি স্প্যানিশ চলচিত্র নির্মিত হয় আলেহান্দ্রো আমেনাবারের পরিচালনায়, সেটি সে বছর ১৩টি গয়া পুরস্কারের (স্পেনের প্রধান চলচিত্র পুরস্কার) জন্য মনোনীত হয়, এবং শেষপর্যন্ত এর মধ্যে ৭টি জিতে নেয়। সে তুলনায় বরং বাংলা সাহিত্য, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, চলচিত্র এবং শিল্পকলায় হাইপেশিয়ার উল্লেখ নিতান্তই অপ্রতুল।
সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই জ্ঞান-বিজ্ঞানে নারীরা অবদান রেখেছে বিপুল ভাবে। বিশ্বকবি রবিঠাকুর সভ্যতার বিনির্মাণে নারীর কোন অবদান খুঁজে না পেলেও আধুনিক সমাজবিজ্ঞানী, প্রত্নতাত্ত্বিক, এবং নৃতত্ত্ববিদদের মতে মানব সভ্যতার শুরুর প্রথমদিকে নারী-পুরুষের অবদান ছিলো প্রায় সমান সমান। অনুমান করা হয় আগুনের আবিস্কারক ছিলো নারী ৪। যদি তা নাও হয়, এটি নিঃসন্দেহ যে নারীরাই প্রথম আগুন ও তাপ দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে খাদ্য-সংরক্ষণ করতে শিখেছে। নৃতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব এমনকি প্রাচীনকালের পুরাণতত্ত্বগুলোও সাক্ষ্য দেয় যে, নারীরা প্রথম থেকেই খাদ্যসংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং সংরক্ষণের ভূমিকায় নিয়োযিত ছিলো ১৮। কাজেই যৌক্তিকভাবেই এটি ধরে নেয়া হয় যে নারীরাই সেই ব্যবস্থাগুলোর উন্নতি সাধন করেছে। গবেষকরা এও স্বীকার করেন যে নারীরাই তৈরী করেছে হোর্টিকালচার বা উদ্যানবৃত্তির ১৯। মানব সভ্যতার উষালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত লক্ষাধিক বছর পার হয়ে গেছে, অথচ পুরো সময়কালের শতকরা নিরানব্বই ভাগ সময়ই মানুষ কাটিয়েছে সেই প্রাক-উদ্যানবৃত্তির সময়টিতে যখন পুরুষেরা শিকার এবং মৎসাহরণের সাথে যুক্ত ছিলো, আর মেয়েরা যুক্ত ছিলো গৃহস্থালীর নানা রকমের কাজ আর ফলমূল ও অন্যান্য খাবার-দাবার সংগ্রহ আর সংরক্ষণে। গবেষকরা বলছেন যে, সে সময় শিকারের মাধ্যমে পুরুষেরা যে পরিমাণ খাদ্য সংগ্রহ করতো, তাতে মাত্র ২০ থেকে ৪০ ভাগ প্রয়োজন মিটতো, বাকী ৬০ থেকে ৮০ ভাগ প্রয়োজনই মেটাতো আসলে নারীরা ১৮। অর্থাৎ নারীরাই ছিল মুলতঃ খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থার উদ্ভাবক এবং নিয়ন্ত্রক। প্রাচীন পুরাণ এবং মিথ্গুলোও এই মতকে সমর্থন করে। দেখা যায়, রুটি-রুজির সংস্থানকারী হিসেবে যাদের উপাস্য হিসেবে ভাবা হত তারা সবাই ছিলেন দেবী- অর্থাৎ নারী – আইসিস, সাইবেল, অ্যাগদিস্তিস, দিনদিমিন, ইশতার, আসতারতে, রিঅ্যা কিংবা লক্ষ্মী। প্রায় সব জাতির মধ্যেই যে আদিম রূপকথা প্রচলিত আছে তাতে দেখা যায় স্বর্গের কোন দেবী তার আদ্যাশক্তি বিতরণ করেছিলো এই মর্তের মানুষের মাঝে যার ফলে মানুষ শিখেছিল বীজ বুনতে, উদ্যান তৈরীতে আর কৃষিকাজের জন্য উপকরণ বানাতে। প্রকৃতিজগতেও ‘বৈজ্ঞানিক নারীবাদের’ সমর্থন রয়েছে। যে শিম্পাঞ্জিকুলের সাথে আমরা -গর্বিত মানুষরা- শতকরা প্রায় ৯৯ ভাগ সদৃশ জিন বিনিময় করি, তাদের সাথে তুলনা করেও দেখেছি যে, পুরুষ শিম্পাঞ্জীদের তুলনায় স্ত্রী-শিম্পাঞ্জীরা অনেক বেশী সময় ব্যয় করে ছোট ছোট হাতিয়ার আর যন্ত্রপাতি তৈরীর কাজে। সেগুলো তারা ব্যবহার করে মাটি খোঁড়া আর খাবার সংগ্রহে ৭।
সম্ভবতঃ মেসোপটেমিয়ার মুরিবেতের মেয়েরাই সর্বপ্রথম ভূমি-কর্ষণ করে বীজ বুনতে শিখেছিলো খ্রীষ্টের জন্মের ৮,০০০ বছর আগে ১৮। সে সময় প্যালেস্টাইনে মেয়েরা শিখেছিলো শস্যক্ষেত্র আর সবজি বাগানের পরিচর্যা করতে, আর তুরস্কে গম থেকে রুটি বানাতে। পরবর্তীকালে মৃৎপাত্র তৈরীর রাসায়নিক প্রক্রিয়া, সুতা কাটার বিদ্যা, তাঁতের প্রযুক্তি আর শণ ও তুলার রকমারি উদ্ভিদবিদ্যা শেখানোর কৃতিত্ব শুধুমাত্র নারীদের। নারীরাই প্রথম চিকিৎসক, শিল্পী আর প্রকৌশলী ৪। কাজেই এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে নারীদের কর্মস্থল শুধু রন্ধনশালা আর শয়নকক্ষেই সীমাবদ্ধ ছিলো না, নারীরা পুরুষদের সাথে পাল্লা দিয়ে উন্নয়ন ঘটিয়েছিলো সে সময়ের জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির। (ক্রমশ)