তার বিচক্ষণতা আর বিচার বুদ্ধি সমাজে এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিলো যে নগরপাল অরিস্টিস (Orestes) হাইপেশিয়ার মতামত না নিয়ে কোন কাজ করতেন না ৮। এই সমৃদ্ধি আর স্বীকৃতিই বোধ হয় হাইপেশিয়ার কাল হল! ‘তুচ্ছ নারী’র মেধা, মনন আর জ্ঞান অনেক সময়ই পরাক্রমশালী পুরুষতন্ত্রের কাছে নিতান্ত অসহনীয়। তার মধ্যে আবার সে নারী যদি হয় বিজ্ঞানমনস্ক মুক্ত-বুদ্ধির চর্চাকারী, রাজনীতি সচেতন এক স্বাধীনচেতা রমণী! আমেরিকান বিজ্ঞানী জন উইলিয়াম ড্রাপার ( J.W.Draper) স্পষ্ট করেই বলেন, ‘হাইপেশিয়া ছিলেন ধর্মের বিপরীতে বিজ্ঞানের নিবিড় সমর্থক।’ হাইপেশিয়াকে ড্রাপার দেখেছেন সেসময়কার ইউরোপীয় সভ্যতার বিদ্যমান দুটি ধারার সংঘর্ষে এক বিরোচিত নিয়ামক চরিত্র হিসেবে ১২। দুটি ধারার একটি হচ্ছে মুক্ত বুদ্ধির চর্চা সমৃদ্ধ ‘লিবারেল’ ধারা আর একটি হল কট্টর-পন্থী ধর্মান্ধ ‘পুরিতানিক’ ধারা। হাইপেশিয়ার অনেক বক্তব্যই ছিলো গোঁড়ামী বিরোধী আর মুক্তবুদ্ধির প্রতি সমর্থনসূচক, যা নিঃসন্দেহে কট্টরপন্থিদের উষ্মার কারণ ঘটিয়েছিলো। হাইপেশিয়া তাঁর এক শিষ্যকে বাইবেল সম্পর্কে বলেছিলেন ৪ —
‘আমি খ্রীষ্টান নই। কিন্তু বাইবেলের প্রাচীন ও নবীন দুটো খন্ডই আমি পড়েছি। আব্রাহাম ইয়াকুব ইউসুফ ধর্মই বল, আর যীশু খ্রীষ্টের ধর্মই বল, অহঙ্কার না করেও আমি বলতে পারি, ও দুটি মর্মই আমি উপলব্ধি করেছি। বিশ্বাসের কথা, ঈশ্বরের প্রেমের বাণী ও-দূটিতে আছে ঢের কিন্তু দার্শনিকের দৃষ্টিতে ওসব বালকসুলভ উচ্ছ্বাস ছাড়া আর কিছু নয়। পরিণত বুদ্ধির জাতির জন্য থাকা উচিৎ যুক্তি-নির্ভর জ্ঞানভিত্তিক ধর্ম একটা, যা ছিলো গ্রীকদের, যার পুনঃপ্রতিষ্ঠার সঙ্কল্প নিয়ে আমি যথাসাধ্য কাজ করে যাচ্ছি আলেকজান্দ্রিয়ায় বসে।’
এ ধরনের স্বচ্ছ কথাবার্তা যে যুগে যুগে মৌলবাদীদের ক্ষিপ্ত করেছে তা বলাই বাহুল্য। এমনি একজন মৌলবাদী খ্রীষ্টান ছিলেন সিরিল (Cyril) যিনি ৪১২ খ্রীষ্টাব্দে আলেকজান্দ্রিয়ার আর্চ বিশপ বা পেট্রিয়ার্ক হয়েছিলেন। এই ‘পেট্রিয়ার্ক’ ব্যাপারটা হয়ত অনেকের কাছেই অপরিচিত। ছোটট একটু বয়ান করা যাক এ নিয়ে। পোপের পদ সৃষ্টির পূর্বে খ্রীষ্টানদের ধর্মগুরু ছিলেন তিনজন। তাদের একজন থাকতেন রোমে, একজন বাইজেন্টিয়ামে আর আরেকজন থাকতেন আলেকজান্দ্রিয়ায়। তাদেরকে বলা হত পেট্রিয়াক। আলেকজান্দ্রিয়ার এই পেট্রিয়ার্ক সিরিল হাইপেশিয়ার রাজনৈতিক দর্শনের জন্য, তার মুক্তবুদ্ধির চর্চার জন্য এবং সর্বোপরি নগরপাল অরিস্টিসের সাথে হাইপেশিয়ার সুসম্পর্কের কারণে তাঁকে ঘৃণার চোখে দেখতেন। মুলতঃ এই আর্চ বিশপ সিরিল খ্রীষ্ট ধর্মের পথ প্রশস্ত করার জন্যই হাইপেশিয়াকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় ৪। এর পেছনে আরো একটি রাজনৈতিক দিকও ছিলো। সিরিলের সাথে অরিস্টিসের ছিলো ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। অরিস্টিসের প্রতি হাইপেশিয়ার প্রচ্ছন্ন সমর্থন সিরিলকে প্রতিহিংসাপরায়ণ করে তুলে। খ্রীষ্টিয় অনুরাগীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে, আর্চ বিশপের সাথে অরিস্টিসের পুনর্মিলনে হাইপেশিয়াই হচ্ছেন প্রধান অন্তরায় ১৩।
চার্লস কিংসলের উপন্যাস Hypatia and or the New Foes with an Old face (১৮৫৩) থেকে জানা যায়, বিশপ সিরিল খ্রীষ্টান ধর্মানুরাগী তরুণদের হাইপেশিয়ার বক্তৃতা শুনতে যেতে নিরুৎসাহিত করতেন। তার ভয় হত যে, হাইপেশিয়ার প্রবল ব্যক্তিত্ব আর তীক্ষ্ন যুক্তির কাছে খ্রীষ্ট ধর্মের দার্শনিক ভিত্তির দুর্বলতাটুকু প্রকাশিত হয়ে পড়বে। উপন্যাসে দেখা যায়, সিরিলের প্রিয় এক তরুণ খ্রীষ্টান সন্ন্যাসী ফিলামন (Philammon) হাইপেশিয়ার সভায় যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলে সিরিল হাইপশিয়াকে তাঁর সামনে তুলে ধরেন এভাবে —
‘হাইপেশিয়া হচ্ছেন সাপের চেয়েও ধূর্ত আর সব ধরনের চালাকিতে ওস্তাদ আর যুক্তিতে পটু।’ আর সিরিল ফিলামনকে এই বলে সাবধান করেন যে, ‘তুমি যদি ওখানে যাও তবে নিজেকে ঠাট্টার পাত্র বলে মনে হবে, আর লজ্জায় তুমি পালিয়ে আসবে’ ১৪।
ফিলামনের মত সন্ন্যাসীদের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিলো হাইপেশিয়ার বক্তৃতামঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে হাইপেশিয়ার সমস্ত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে মিথ্যা প্রমাণিত করা। তারা ভাবতেন তুচ্ছ নারী কী জানবে দর্শনের, বিজ্ঞানের? অথচ তাঁর অনুগামীদের কাছে হাইপেশিয়া ছিলেন মিনার্ভার মত জ্ঞানময়ী, জুনোর মত মর্যাদাময়ী আর আফ্রোদিতির মত সুন্দর। কিংসলের উপন্যাসে দেখা যায়, ফিলামন কিছুটা কৌতুহল আর আর অবজ্ঞা নিয়েই প্রথমে হাইপেশিয়ার বক্তৃতা শুনতে গিয়েছিলেন, মূল উদ্দেশ্যটি ছিল হাইপেশিয়াকে ভুল প্রমাণ করে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত করা। কিন্তু হাইপেশিয়ার ব্যক্তিত্ব, বাগ্মীতা আর জ্ঞানের আলোক-স্পর্শে ফিলামন আক্ষরিক অর্থেই সম্মোহিত হয়ে পড়েন এবং শেষ পর্যন্ত হাইপেশিয়ার একজন একান্ত অনুরাগীতে পরিণত হন। তাদের বন্ধুত্ব আর কিছুটা নৈসর্গিক প্রেমের মূর্চ্ছনা হাইপেশিয়ার মৃত্যুর শেষ দিনটি পর্যন্ত অক্ষুন্ন ছিল ১২।
তার প্রিয় খ্রীষ্টান সন্ন্যাসীদের হাইপেশিয়া-মোহ সিরিলকে ক্রুদ্ধ নেকড়ের মতই উন্মত্ত করে তোলে। সিরিল হাইপেশিয়াকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিলেন। ৭১-এ বাঙালী বুদ্ধিজীবী হত্যার মতই সিরিল যেমনিভবে বেছে বেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নব্যতান্ত্রিক’ নিও-প্লেটোনিস্টদের ধরে ধরে হত্যার মহোৎসবে মত্ত ছিলেন, এমনি এক দিন কর্মস্থলে যাওয়ার পথে হাইপেশিয়া মৌলবাদী আক্রোশের শিকার হলেন, অনেকটা আজকের দিনের হুমায়ুন আজাদের মতোই। তবে হাইপেশিয়ার ক্ষেত্রে বীভৎসতা ছিলো আরও ব্যাপক। হাইপেশিয়া-হত্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পাওয়া যায় পনের শতকে সক্রেটিস স্কলাসটিকাসের রচনা হতে ১৫ —
‘পিটার নামের এক আক্রোশী ব্যক্তি অনেকদিন ধরেই তক্কে তক্কে ছিলো, শেষমেষ সে হাইপেশিয়াকে কোন এক জায়গা হতে ফিরবার পথে কব্জা করে ফেলে। সে তার দলবল নিয়ে হাইপেশিয়াকে তার ঘোড়ার গাড়ী থেকে টেনে হিঁচড়ে কেসারিয়াম (Caesarium) নামের একটি চার্চে নিয়ে যায়। সেখানে তারা হাইপেশিয়ার কাপড়-চোপড় খুলে একেবারে নগ্ন করে ফেলে, তারপর ধারালো অস্ত্রের সাহায্যে তাঁর চামড়া চেঁছে ফেলে, তার শরীরের মাংস চিরে ফেলে, আর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত হাইপেশিয়ার উপর তাদের অকথ্য অত্যাচার চলতে থাকে। এখানেই শেষ নয়; মারা যাবার পর হাইপেশিয়ার মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে সিনারন (Cinaron) নামের একটি জায়গায় জড় করা হয় আর তারপর পুড়িয়ে তা ছাই করে দেয়া হয়’।
হাইপেশিয়াকে হত্যা করা হয় ৪১৫ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে। হাইপেশিয়ার হত্যাকারীদের তালিকায় ছিলো মূলতঃ সিরিলের জেরুজালেমের চার্চের প্যারাবোলানস, মৌলবাদী সন্ন্যাসী, নিটৃয়ান খ্রীষ্টীয় ধর্মবাদীরা ৫। তবে সিরিল নিজ মুখে তার সাংগপাংগদের হাইপাশিয়াকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন কিনা তা অবশ্য বিতর্কের উর্ধ্বে নয়। কিন্তু এটি অন্ততঃ নিঃসন্দেহ যে, সিরিল এমন এক ধরনের রাজনৈতিক বাতাবরণ তৈরী করতে সমর্থ হয়েছিলেন যা হাইপেশিয়া-হত্যায় ইন্ধন যুগিয়েছিলো। সিরিলকে পরবর্তীতে ধর্মীয় অধিকার বলে সেইন্ট বা সন্ত হিসেবে অভিসিক্ত করা হয়। ইতিহাসের জঘন্যতম অপরাধের উপযুক্ত ধর্মীয় ‘শাস্তি’ই বটে!
যা হোক, অরিস্টিস এই নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড সম্বন্ধে রিপোর্ট করেন এবং রোমকে এর তদন্ত পরিচালনা করতে অনুরোধ করেন। তারপর তিনি তার কর্মস্থল থেকে অব্যহতি নিয়ে আলেকজান্দ্রিয়া থেকে চিরতরে বিদায় নেন। আর ওদিকে তদন্তকাজ পদে পদে ‘পর্যাপ্ত সাক্ষীর অভাবে’ বাধাপ্রাপ্ত হয়, আর শেষপর্যন্ত সিরিল জল ঘোলা করতে এও জনসমক্ষে প্রচার করতে শুরু করেন যে, হাইপেশিয়া নাকি জীবিত আছেন এবং এথেন্সে বহাল তবিয়তে বাস করছেন ১৬।
হাইপেশিয়ার হত্যাকান্ড আলেকজান্দ্রিয়া এবং পুরো রোমান সাম্রাজ্যে বৈজ্ঞানিক আর যুক্তিবাদী শিক্ষার বিদায় ঘন্টা বাজিয়ে দেয়। ইউরোপ পুরোপুরি প্রবেশ করে ‘অন্ধকার যুগে’। এমনকি মৃত্যুর পরও হাইপেশিয়াকে রেহাই দেয়নি ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা। ৫৮১ খ্রীষ্টাব্দে চার্চের পক্ষ থেকে হাইপেসিয়াকে উদ্দেশ্য করে ঘোষণা করা হয় ‘That woman had neither souls nor reasons’ ৫। গোঁড়া খ্রীষ্টধর্মের প্রসারের সাথে সাথে আলেকজান্দ্রিয়া নানা ধরনের ধর্মীয় সংস্থার (cult) ক্রীড়নকে পরিণত হয়ে যায়, মুক্তবুদ্ধির চর্চা ব্যহত হয়; নানা ধরণের ধর্মীয় তুক-তাক, জ্যোতিষশাস্ত্রের চর্চা, কুসংস্কার, অতীন্দ্রিয়তা আর আধ্যাত্মিকতা ধীরে ধীরে বৈজ্ঞানিক গবেষণার স্থান দখল করে নেয়। ৬৪০ খ্রীষ্টাব্দে আলেকজান্দ্রিয়া আরবদের অধীনস্ত হয় আর সমস্ত গ্রন্থাগারটি পুনর্বার (জুলিয়াস সিজারের আগ্রাসনের পর) ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় — এবারে অবশ্য বর্বর খ্রীষ্টিয় মৌলবাদীদের আরেক সহোদর ইসলামী মৌলবাদীদের হাতে ৫। কথিত আছে আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারের বই-পত্তর ধ্বংস করতে গিয়ে খলিফা ওমর নাকি বলেছিলেন —
বইপত্রগুলো যদি কোরানের শিক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না হয় তবে সেগুলো আমাদের দৃষ্টিতে নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়। কাজেই ওগুলোর ধ্বংস অনিবার্য; আর বই-পত্তরগুলোতে যদি কোরানের শিক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কোন কথাবার্তা আদৌ থেকেও থাকে তবে সেগুলো হবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত। কাজেই সে দিক দিয়েও ওগুলো ধ্বংস করা জায়েজ’। (ক্রমশ)