“আমরা দুটি ভাই,
শিবের গাজন গাই
ঠাকুমা গেছেন গয়া কাশী,
ডুগডুগি বাজাই”।
[প্রচলিত শিশু ছড়া]
শৈশবে পড়া ছড়া থেকে মনে হতে পারে গাজন শুধু শিব ঠাকুরেরই হয়, তা কিন্তু নয়। শিব ছাড়াও অন্যান্য দেবতারও গাজন হয়; যেমন ধর্মরাজের গাজন, চণ্ডী গাজন, ভগবতীর গাজন, মনসা গাজন, ভৈরব গাজন, বসন্তকুমারী মায়ের গাজন, শীতলা গাজন, বলরামের গাজন, পঞ্চানন্দের গাজন, রতনমালার গাজন ইত্যাদি।
এ কথা ঠিক যে শিবগাজনের সংখ্যা সর্বাধিক। পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত জেলায় শিবগাজন অনুষ্ঠিত হয়। তারপর ধর্মরাজের গাজন। ধর্মগাজন দক্ষিণবঙ্গের প্রায় সমস্ত জেলাতে হতে দেখা যায়। অন্যান্য দেবতার গাজন গুলি প্রায় আঞ্চলিক। যেমন বাঁকুড়া জেলাতে দেখা যায় চণ্ডী গাজন, ভগবতীর গাজন, ভৈরব গাজন, বসন্তকুমারী মায়ের গাজন, মনসা গাজন। বর্ধমান জেলার কুরকুবা গ্রামে শ্রাবণ সংক্রান্তিতে হয় কমলাদেবীর গাজন, যা আসলে মনসা গাজন। চৈত্র সংক্রান্তিতে শীতলা গাজন দেখা যায় হুগলি জেলার খানাকুল থানার পিলখান গ্রামে। চৈত্র মাসে ব্যান্ডেলের কাছে বালিকাটা গ্রামে দক্ষিণ ভারতীয় তামিলদের ‘ভেল ভেল’ উৎসব হয়; তা আসলে শীতলা গাজন। চৈত্র সংক্রান্তিতে পঞ্চানন্দের গাজন হয় তিনটে জায়গায়। হুগলির উত্তরপাড়া থানার রঘুনাথপুর গ্রামে, হাওড়া জেলার ডোমজুড়ের নার্না এবং পাঁচলার বেলডুবি গ্রামে। বর্ধমানের রায়না থানার বোড়ো গ্রামের বলরামের গাজন হয় বুদ্ধ পূর্ণিমার সময়। চৈত্র সংক্রান্তিতে হাওড়া জেলার শ্যামপুর থানার রতনপুর গ্রামে হয় রতনমালার গাজন।
গাজন হল বিভিন্ন দেবদেবীদের বাৎসরিক লৌকিক উৎসব। এই লোকিক উৎসবে ভক্তরা সমবেতভাবে গর্জন করে। ব্যুৎপত্তিগত ভাবে গাজন শব্দটি এসেছে এই গর্জন শব্দ থেকে। গর্জন > গজ্জন > গাজন। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষে আছে, “ধর্মের উৎসবে ভক্তগণ ‘জয় জয় নিরঞ্জন, ‘ধর্ম জয়’, ‘জয় জয় ধর্ম’ ইত্যাদি বলিয়া উচ্চস্বরে গর্জন করে বা ডাকে; এইজন্য ধর্মের ‘উৎসব’, ‘ভক্তগণ’, ‘ধর্মমন্দির’ সবই ‘গাজন’ শব্দে অবিহিত হয়। চড়ক পার্বণেও শিবের উৎসবে ‘গাজন’ শব্দ ঐ সকল অর্থেই ব্যবহৃত হয়। শিবের গাজন, ধর্মের গাজনেরই পরিণাম”।
যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি তার ‘পূজাপার্বণ’ গ্রন্থে বলেছেন, “শিবের গাজনের প্রকৃত ব্যাপার হরকালীর বিবাহ, সন্ন্যাসীরা বরযাত্রী। তাহাদের গর্জন হেতু ‘গাজন’ শব্দটি আসিয়াছে। ধর্মের গাজনে মুক্তির সহিত ধর্মের বিবাহ হয়। দুই বিবাহই প্রচ্ছন্ন। এজন্য চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন নীলপূজার রাতে শিবের সঙ্গে নীলাবতী দেবীর বিয়ে হতে দেখা যায় অনেক জায়গায়।
গাজন শব্দের উৎপত্তির আরেকটি ভিন্নমত আছে, তা হল, “গাঁ-জন অর্থাৎ গ্রাম জনের উৎসব”। ১৮২৯ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির এক অনুষ্ঠানে শ্রীযুক্ত রামকমল সেন চড়কের গাজন সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ পাঠের সময় এই কথা বলেছিলেন। গ্রামবাংলায় লোকজন জড়ো হয়ে উৎসবে মাতলেও গাজন বলে থাকে। এই সব কারণে অন্যান্য দেবতাদেরও গাজন হতে দেখা যায়। এর মধ্যে বলরামের গাজন ও রতনমালার গাজন শুধু মাত্র একটি করে গ্রামে হয়, অন্য জায়গায় কোথাও হতে দেখা যায় না। হাওড়া জেলার বাগনান থানার যোত বীরেশ্বর গ্রামে একটি রতনমালা মন্দির আছে। সেখানে বার্ষিক পূজা হয় চৈত্র সংক্রান্তিতে; কিন্তু কোন গাজন হয় না।
রতন মালা লৌকিক দেবী, রতনমালা দেবীর কোন লিখিত ইতিহাস নেই। যা আছে সব জনশ্রুতি। অতীতে যখনই অঞ্চল ছিল জঙ্গলে আকীর্ণ দামোদরের চর। দামোদর এখন দূরে সরে গেছে। তখন স্থানীয় আদিবাসীরা এই দেবীর পূজা করত পাথরের নুড়িতে। তখন মা উগ্রচণ্ডা ছিলেন। তারপর হয় নিম কাঠের মূর্তি। এই নিম কাঠের মূর্তি তৈরি হওয়ার সঙ্গে জড়িয়ে আছে শ্রীমন্ত সদাগরের নাম। শ্রীমন্ত সদাগর নাম আমরা সকলেই জানি। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের উজানি নগরের বণিক ধনপতি সদাগরের পুত্র। শ্রীমন্ত সদাগরের মায়ের নাম ছিল খুল্লনা। এই খুল্লনা ছিলেন সাপভ্রষ্টর স্বর্গের নর্তকী রত্নমালা। তাই এজন্য রতনমালা দেবীর সঙ্গে শ্রীমন্ত সদাগরের নাম জড়িয়ে থাকা অস্বাভাবিক নয়।
দেবরাজ ইন্দ্রের সভার নর্তকী পরম রূপসী রত্নমালা। একদিন নৃত্য করার সময় তাল ভঙ্গ হয়ে যায়। এই অপরাধে দেবতাদের অভিশাপে মর্ত্যে মানব হয়ে জন্মাতে হয়। ইছানি নগরে লক্ষপতি ও রম্ভাবতীর কন্যা হয়ে জন্মালেন রত্নমালা। নাম হল খুল্লনা। তাঁর রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে উজানি নগরের ধনপতি সদাগর তাকে বিবাহ করলেন। যদিও ধনপতি পূর্বেই বিবাহিত ছিলেন। তার প্রথমা স্ত্রীর নাম ছিল লহনা। ধনপতি সিংহল (বর্তমান শ্রীলঙ্কা) -এ বাণিজ্য করতে গিয়ে বন্দী হন। ধনপতিল পুত্র শ্রীমন্ত সাবালক হলে সপ্তডিঙ্গা সাজিয়ে সিংহল রওনা দিলেন পিতাকে উদ্ধার করতে। পিতাকে উদ্ধার করে, সিংহলের রাজকন্যাকে বিবাহ করে শ্রীমন্ত দেশে ফিরলেন।
এই যাতায়াতের পথে হয়তো পড়েছিল রতনপুর গ্রাম দামোদরের চরে এক বট গাছে শ্রীমন্ত নোঙ্গর করেছিলেন। সেই বটগাছ এখনো আছে। বট গাছের পাশে একটি তালপাতায় ছাওয়া মন্দিরে পূজা করত স্থানীয় বাসিন্দারা। তাই দেখে তিনিও পূজা দেন। অভিযান সফল হওয়ার কারণে ফেরার সময় হয়ত তিনি আবার মায়ের কাছে আসেন। মায়ের মন্দির বানিয়ে দেন। নিজের মায়ের পূর্ব জন্মের নাম অনুসারে নাম রাখেন রত্নমালা। যা গ্রাম্য ভাষায় হয়ে দাঁড়ায় রতনমালা। নিম কাঠের বিগ্রহ বিনষ্ট হয়ে গেলে পরে মাটির বিগ্রহ নির্মিত হয়। রতনমালা দেবীর নাম অনুসারে গ্রামের নাম হয় রতনপুর। রতন মালা দেবীর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে বর্ধমানরাজ বিজয় চন্দ্র মহাতাবের কানে যায়। তিনি মন্দিরের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। জমি জায়গা দিয়ে পূজার বন্দোবস্ত করে দেন।
এই সব জনশ্রুতি থেকে একটা ধারণা করা যেতে পারে রতনমালা দেবী চণ্ডীর রূপভেদ। দেবী ছিলেন উগ্রচণ্ডা। শ্রীমন্ত সদাগর ছিলেন দেবী চণ্ডীর বরপুত্র। শ্রীমন্ত সদাগরের মা খুল্লনা ছিলেন দেবী চণ্ডীর পরম ভক্ত। চণ্ডী প্রথম লৌকিক দেবী ছিলেন, পরে পুরাণে স্থান পায়। তাই এখানে আদিবাসীদের পূজিত কৌলিক দেবতা শ্রীমন্ত সদাগরের জনশ্রুতিকে অবলম্বন করে আর্যায়িত হয়েছেন।
বর্তমান রতন মালা দেবীর বিগ্রহ সিমেন্টের। দেবী দ্বিভূজা মহাকালের উপর দণ্ডায়মান। এক হাতে খড়্গ, অপর হাতে সুধা ভাণ্ড। গলায় নর মুণ্ডমালা। মায়ের ডান দিকে বৃষারূঢ় মহাদেব। এখানে বলে বিষধর। সমুদ্র মন্থনের বিষ ধারণ করার কথা স্মরণ রেখে বা বৃষের ওপর আসেন বলে কথ্য ভাষায় বিষধর হয়ে গেছেন। বিষধরের পাশে মায়ের দাসী ডাকিনী। মায়ের বাম পাশে মায়ের ছেলে ভৈরব ও মায়ের আরেক দাসী যোগিনী। দুপাশে দুটি দুটি বাঘ; রয়েল বেঙ্গল টাইগার। মায়ের পাশে একটু উঁচুতে দুই পরী। মা দুর্গা রূপে পূজিতা হন; ধ্যান-মন্ত্র মহাকালীর। মায়ের নিত্য পূজা হয়। মাকে দেওয়া হয় শুকনো ভোগ অর্থাৎ রান্না করা খাবার দেয়া হয় না। চাল ধুয়ে দেয়া হয়। এ ছাড়া চিনি, ঘি, কিসমিস ও ডাল। মায়ের মন্দিরে দুর্গাপূজা, কালীপূজা, লক্ষ্মীপূজা, সরস্বতীপূজা করা হয়। এজন্য গ্রামে আলাদা করে এইসব দেবীর অর্থাৎ কোন শক্তি পূজা হয় না। দেবীর বার্ষিক পূজা চৈত্র সংক্রান্তিতে। এ সময় ছয় দিন ধরে চলে গাজন। গাজন শুরু হবার আগের দিন অর্থাৎ ২৪শে চৈত্র (যদি তিরিশে মাস হয়) মূল সন্ন্যাসী সন্ন্যাস গ্রহণ করে। তারপর দিন বাকি সন্ন্যাসী বার কামান করে, উত্তরীয় গ্রহণ করে, নতুন ধুতি ও গামছা পরে সন্ন্যাসী হয়ে যায়।
এখানে রতন মালা দেবীর সঙ্গে শিবের গাজনও হয়। রতনালা মন্দিরের পাশে শিব মন্দির। দুই গাজনের জন্য দুটি বাঁশ তোলা হয়। বাঁশের মাথায় পাখির পালক লাগানো থাকে। এই বাঁশ নিয়ে সন্ন্যাসীরা পাঁচ দিন (২৫ থেকে ২৯ চৈত্র) সন্ধ্যা বেলা ডাবের জল খেয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামে মাঙ্গন করতে যায়। সাতটা মারো অর্থাৎ সাতটা গ্রামে যায়। ৭ টা মারো হলো ঘনশ্যামপুর, অমরদহ, পিপুরল্যান, দুর্গাপুর নস্করপুর, রাজীবপুর, পাইকবার। আগে গ্রামের মোড়ল বাড়ি যাওয়া হতো। মারোতে ভোগ আনতে যাওয়া হয় বলে একে বলে মারোভাটা। গভীর রাতে সন্ন্যাসীরা ফিরে তারপর ভোগ রান্না করে, ভোর তিনটের সময় খায়। তারপর সারাদিন কিছু খায় না। সন্ধ্যা বেলা ডাবের জল খেয়ে উপবাস ভাঙ্গে।
নীল পূজার দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন নীলরাত্রিতে রাত দেড়টার সময় রতনমালা সঙ্গে শিবের বিবাহ হয়। দু-তিনজন ব্রাহ্মণ থেকে, মাথায় মুকুট ও টোপর পরিয়ে বিবাহ হয়। তারপর দেওয়া হয় মায়ের শুকনো ভোগ। তারপর হয় বিখ্যাত কালিকাপাতাড়ি নাচ।
কালিকাপাতাড়ি নাচ হল শিব, কালী সেজে মহিষাসুর বধ নৃত্য। যদিও কালীর সাথে মহিষাসুর বধের কোন সম্পর্ক নেই। তবে লোক উৎসবের আঙিনায় সবই সুন্দর। আগে কালিকাপাতাড়ি নৃত্যে শিব, কালী সেজে নাচতো। সঙ্গে থাকত ঢোল আর কাঁসি। শিব সাজতো ছাইমেখে, মাথায় একটা জটা নিয়ে। আর কালী সাজতো মুখে, গায়ে ভূষো কালি মেখে এবং মুখে তালপাতা দিয়ে তৈরি জিভ এটে। তালপাতা দিয়ে তৈরি জিহ্বায় সিদুঁর মাখিয়ে লোলজিহ্বা করে নিত। এখনও কালী সাজাটা একই রকম আছে। তবে মেক-আপের প্রবেশ ঘটেছে। এসেছে সৌখীন বাজনা। প্রথমে এতে কোনও কাহিনী বা পালা ছিল না, শুধু অঙ্গভঙ্গি ছিল। পরবর্তীকালে শুম্ভ-নিশুম্ভ, মহিষাসুর চরিত্র নিয়ে আসে মনোরঞ্জনের জন্য। কিন্তু অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষ গাজনে অংশ নেওয়ার জন্য এইভাবে সেজে রাত জাগানিয়া ভক্তদের আমোদ দিত। শুধু তাই নয় গাজনের সন্ন্যাসীরাও কালিকাপাতাড়ি নাচত এখনো কালিকাপাতারি নৃত্য দলের কয়েকজন গাজনের সন্ন্যাসী হয়।
একবার কালিকা পাত্রীর আজ বিষয়ে বিশদে জানতে রতনপুর গ্রামে গিয়েছিলাম। তখন মন্দিরের পুরোহিত ঘনশ্যামপুর নিবাসী প্রভাত চক্রবর্তী রতন বালা মাকে নিয়ে একটি সুন্দর গান শুনিয়েছিলেন। গানটি হল —
মা, মাগো আমার;
রত্নমালা মাগো, একি তোমার লীলার বাহার।
মা মুণ্ডমালা গলে পরে, খড়্গ হাতে কী লো ধার।
শুনেছি মা পূর্ব কালে, তুমি নাকি রাক্ষসী ছিলে।
ওমা কন্যা সন্তান নিয়েছো গিলে,
চোখেতে নেই জল, দেখি শুধু হাসির বাহার।
লোকে তোমায় কালী বলে,
জিভ দেখি নি কোনও কালে,
ওমা ডাইনে নিয়ে বৃষধ্বজকে,
বামে পুত্তুর ভৈরব বলে।
বাঘ বাহন আছে তোমার,
জয়া বিজয়ার দেখি বাহার।
রত্নমালা মাগো, একি তোমার লীলার বাহার।
সংক্রান্তির দিন সকালে হয় ‘হাকন্দ’। কাঁদি সমেত কলা গাছ মাটিতে পোঁতা হয়। দুর্গাপুর গ্রামের ভবেশ মন্ডল বলে এক সন্ন্যাসীকে বান মারা হয়। এটা বান ফোঁড়ার বান নয় তন্ত্র-মন্ত্রের বান। ভদ্রলোক কাঁপতে কাঁপতে অজ্ঞান হয়ে যায়। আগে গর্ত করে মাটিতে পোতা হত। কানের সামনে জোরে ঢাক বাজানো হত। যে সোজা মাথা থাকে সেই সোজা মাটি খুঁড়ে নিঃশ্বাস বের হলে তাকে মাটি থেকে তোলা হত।
বিকেলে হয় কাঁটা গড়গড়ানি। সন্ন্যাসীরা কুল কাঁটা, শেওড়া কাঁটার ওপর গড়িয়ে মন্দিরে চারিদিকে প্রদক্ষিণ করে। তারপর হয় ঝাঁপ। এই ঝাঁপ দেখার জন্য এক বছর সংক্রান্তির দিন হাজির হয়েছিলাম রতনপুর গ্রামে। আমাদের ভাগ্যে কাঁটা গড়গড়ানিও জুটে ছিল। প্রথমে একটি শিব ঠাকুরের ঝাঁপ হয় সেটা মন্দিরের কাছে, সামান্য উচ্চতা থেকে। তারপর পাঁচটি ঝাঁপ হয় মায়ের নামে। আগে অনেক লোক ঝাঁপ দিত, অনেক উঁচু থেকে। প্রায় ৭০-৮০ ফুট উঁচু থেকে। ২০১৪ সালে এই ঝাঁপের সময় এক ব্যক্তি মারা যান। তারপর থেকে ঝাঁপের ব্যাপারে প্রশাসনের বিধি-নিষেধ এসেছে, উচ্চতা কমেছে। স্থানীয়রা বলেন যিনি মারা গিয়েছিলেন তিনি গাজনের নিয়ম কানুন মানেনি। তিনি মদ্যপান করেছিলেন, বাড়িতে অশৌচ ছিল (বাড়িতে কারোর পক্স হয়েছিল)। বাড়ির লোকেরা এ বিষয়ে থানাতে কোন অভিযোগ করেননি। ফলে পরবর্তীকালে ঝাঁপ দেয়ার ক্ষেত্রে আইনগত কোন বাধা হয়নি।
এখন ৩০/৪০ ফুট উঁচু থেকে ঝাঁপ হয়। ঝাঁপ দেওয়ার ব্যক্তির সংখ্যাও কমেছে। নিচে একটা খড় ভরা বস্তা ধরে রাখা হয়। তার ওপর থাকে একটি ছোট বঁটি। বঁটিটি অবশ্য এখন ভোঁতা হয়ে গেছে। মায়ের মন্দির থেকে সন্ন্যাসীকে ধরে ধরে ঝাঁপের কাছে আনা হয়। সন্ন্যাসী মায়ের মন্দিরের দিকে মুখ করে থাকেন। অর্থাৎ সন্ন্যাসী পিছনে হেঁটে ঝাঁপের কাছে আসে। এই ঝাঁপ দেখতে দূর দূরান্ত থেকে লোক আসে। রতনমালার ঝাঁপ হাওড়া জেলায় অত্যন্ত বিখ্যাত। ঝাঁপের সময় লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়।
পয়লা বৈশাখ হয় ভোগ বিতরণ। মায়ের ভোগের উপকরণগুলি দিয়ে ভোগ রান্না হয়। প্রায় চার-পাঁচ হাজার লোককে দেওয়া হয়। বসিয়ে খাওয়ানো হয় না। মায়ের সামনে বলি হয় সাতটি। কালী পূজার সময় দুটি। দুর্গাপূজায় তিনটি। চৈত্র সংক্রান্তিতে একটি, পয়লা বৈশাখ একটি। এছাড়া ভক্তরা মানসিক করলে শনি মঙ্গলবার বলি দিতে আসে। এখানে মৃগী রোগের ওষুধ দেওয়া হয়। ওষুধ দেন ব্রাহ্মণ অশোক রায়। মন্দিরের সামনে রতন মালা পুকুরে স্নান করে কলার মধ্যে খাওয়ানো হয়। ওষুধ খাওয়ার পর অনেক বিধি নিষেধ আছে। কলাপাতায় খাওয়া চলবে না, কলা খাওয়া যাবে না, কলা ছোঁয়াও চলবে না। পার্শ্ববর্তী গ্রামে প্রণবেশ কয়াল নামে এক ব্যক্তি এক কোটি টাকা খরচ করে নতুন মন্দির করে দিয়েছেন। মন্দিরের গায়ে লেখা হয়েছে ‘রত্নমালা’। আমার মনে হয় রতনমালা নাম থাকলেই ভালো হতো, তাহলে মন্দির ও গাজনের ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হত।
তথ্য ঋণ: —
১) কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল — সম্পাদনা সুকুমার সেন (সাহিত্য একাডেমী)
২) হাওড়া জেলার লৌকিক দেবদেবী — ড. মোহনলাল মণ্ডল। লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
৩) গাজন — মনোজিৎ আধিকারী (দে’জ পাবলিশিং)
৪) ক্ষেত্র সমীক্ষা