রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষ (ঠাকুর্দার ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা) পঞ্চানন কুশারী ও-বঙ্গের খুলনার রূপসা অঞ্চলের পিঠাভোগ গ্রাম থেকে কাকা শুকদেব কুশারীর সঙ্গে নদীপথে এ-বঙ্গের কলকাতা সংলগ্ন গোবিন্দপুর গ্রামে এসে বাসা বাঁধেন সতেরো শতকের শেষদিকে। বাবা মহেশ্বর কুশারীর সঙ্গে কলহবিবাদ করে তিনি বাড়ি ছেড়েছিলেন। গোবিন্দপুরে তখন জেলে-মালো-কৈবর্তদের বাস। তারা নাকি গৌরবর্ণ ব্রাহ্মণ দেখেই ভক্তিতে গদগদ হয়ে তাঁদের ‘ঠাকুরমশাই’ সম্বোধন করে। তাই কুশারী পদবি লোপ পেয়ে তাঁদের পদবি হল ঠাকুর। এই মুচমুচে কাহিনীটি অম্লানবদনে সকলেই বিশ্বাস করে নিয়েছেন। কোনও দ্বিতীয় ভাবনার কথা কোথাও লেখা নেই। কিন্তু চিরকাল পুরুত-বামুনকে যজমানরা ‘ঠাকুরমশাই’ বলেই ডাকে। তাতে তাঁদের পদবি বদলে যাওয়ার কথা শোনা যায় না। চক্রবর্তী পদবিধারী চক্রবর্তীই থাকেন, ভট্টাচার্য পদবিধারী বামুনেরা পদবি ভট্টাচার্যই লেখেন, কেউ ঠাকুর লেখেন না। মাঝের মিসিং লিঙ্কটা কেউ ধরতে পারেননি।
কবিগান সম্বন্ধে বিরাট গবেষণাগ্রন্থ লিখেছেন ড. সুশীলকুমার দে ও সজনীকান্ত দাস। দুজনেই লিখেছেন, সপ্তদশ শতকের শেষে কবিগানের উদ্ভব হয়েছিল। সমাজের অন্ত্যজ মানুষদের মধ্যে এর প্রচলন হয় প্রথমে। জেলে-মালো, মুচি, রুইদাসদের মধ্যে কবিগানের প্রচলন ছিল প্রথম যুগে। কেষ্টা মুচি, নিতাই বৈরাগী, ভবানী বেনে নামকরা কবিয়াল ছিলেন।
কবি ঈশ্বর গুপ্ত ১৮৫৪ সালে সংবাদ প্রভাকর কাগজে কবিয়ালদের নামধাম ও তাদের গাওয়া গানের কথা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তাঁর মতে গোঁজলা গুঁই ছিলেন তাঁর খুঁজে পাওয়া প্রথম কবিয়াল। তাঁর জন্ম ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু ঈশ্বর গুপ্ত গোঁজলা গুঁইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বীদের নাম খুঁজে পাননি। হরু ঠাকুর ছিলেন সে যুগের আর এক নামী কবিয়াল। তাঁর জন্ম ১৭৩৮-এ। তিনি রাজা নবকৃষ্ণ দেবের সভাকবি ছিলেন। অরুণ নাগ সম্পাদিত ‘সটীক হুতোম প্যাঁচার নকশা’ বইয়ে কবিয়াল হরু ঠাকুর ও নীলু ঠাকুর নিয়ে সম্পাদনা বিভাগে অনেক তথ্য আছে। হরু ঠাকুরের আসল পদবি ‘দীর্ঘাঙ্গী’। ব্রাহ্মণ কবিয়াল হওয়ায় তাঁর পদবি পাল্টে ‘ঠাকুর’ হয়ে যায়। নীলু ঠাকুরের আসল নাম নীলমণি চক্রবর্তী। ব্রাহ্মণ হওয়ায় তাঁরও পদবি পাল্টে গিয়ে নীল ঠাকুর হয়ে যায়। এরকমভাবে কবিয়াল রামপ্রসাদ ঠাকুর, সৃষ্টিধর ঠাকুর (ছিরু ঠাকুর), রমাপতি ঠাকুর, নবাই ঠাকুর, রামকানাই ঠাকুর, মনোরঞ্জন ঠাকুর, নিমচাঁদ ঠাকুরের নাম আমরা পাই। এঁদের মধ্যে ছিরু ঠাকুর শুধু বদ্যিবামুন ছিলেন (পূর্বপদবি জানা নেই), বাকি সকলে নিখাদ ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ কবিয়ালদের পদবি পাকাপাকিভাবে ঠাকুর হয়ে যেত। উপরোক্ত সকল ঠাকুর পদবিধারী ব্রাহ্মণ কবিয়াল ছিলেন চক্রবর্তী পূর্বপদবির অধিকারী। কেবলমাত্র রমাপতি ঠাকুরের পূর্বাশ্রমের পদবি ছিল বন্দ্যোপাধ্যায়।
তাই মনে হয় সপ্তদশ শতকের শেষে পঞ্চানন কুশারী ও শুকদেব কুশারী যখন গোবিন্দপুরে বাসা বাঁধেন, তাঁরা জেলে-মালো-কৈবর্ত-তাঁতিদের মুখে কবিগান শুনতেন। কবির লড়াই দেখতেন। পরে তাঁরা দুজনেই সক্রিয়ভাবে তাতে অংশ নেন ও আস্তে আস্তে নামকরা কবিয়াল হিসেবে স্বীকৃতি পান। তখন তাঁদের পদবি পাকাপাকিভাবে ঠাকুর হয়ে যায়।
সাহিত্যিক অদ্বৈত মল্লবর্মণের লেখা ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ একটি কালজয়ী উপন্যাস। এই উপন্যাসে জেলে-মালোদের জীবনের আখ্যান বিবৃত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, মালো-সংস্কৃতিতে গীত একটি বিশেষ স্থান অধিকার করেছে। একটু উদ্ধৃতি দিলেই বোঝা যাবে, –
‘তিতাস নদীর তীরে মালোদের বাস। ঘাটে-বাঁধা নৌকা, মাটিতে ছড়ানো জাল, উঠানের কোণে গাবের মট্কি, ঘরে ঘরে চরকি, টেকো, তক্লি—সুতা কাটার, জাল বোনার সরঞ্জাম। এই সব নিয়াই মালোদের সংসার।
…
মাঘ মাসের শেষ তারিখে সেই মালোপাড়াতে একটা উংসবের ধূম পড়িল। এটা কেবল কুমারীদের উৎসব। নাম মাঘমণ্ডলের ব্রত।
এ-পাড়ার কুমারীরা কোনোকালে অরক্ষণীয়া হয় না। তাদের বুকের উপর ঢেউ জাগিবার আগে, মন যখন থাকে খেলার খেয়ালে রঙিন, তখনই একদিন ঢোল সানাই বাজাইয়া তাদের বিবাহ হইয়া যায়। তবু এই বিবাহের জন্যে তারা দলে দলে মাঘমণ্ডলের পূজা করে।
মাঘ মাসের ত্রিশদিন তিতাসের ঘাটে প্রাতঃস্নান করিয়াছে; প্রতিদিন স্নানের শেষে বাড়িতে আসিয়া ভাঁটফুল আর দূর্বাদলে বাঁধা ঝুটার জল দিয়া সিঁড়ি পূজিয়াছে, মন্ত্রপাঠ করিয়াছে: ‘লও লও সুরুজ ঠাকুর লও ঝুটার জল, মাপিয়া জুখিয়া দিব সপ্ত আঁজল।’ আজ তাদের শেষ ব্রত।
তরুণ কলাগাছের এক হাত পরিমাণ লম্বা করিয়া কাটা ফালি, বাঁশের সরু শলাতে বিঁধিয়া ভিত করা হয়। সেই ভিতের উপর গড়িয়া তোলা হয় রঙিন কাগজের চৌয়ারি-ঘর। আজিকার ব্রত শেষে ব্রতিনীরা সেই চৌয়ারি মাথায় করিয়া তিতাসের জলে ভাসাইবে, সঙ্গে সঙ্গে ঢোল-কাঁসি বাজিবে, নারীরা গীত গাহিবে।
দীননাথ মালোর মেয়ে বাসন্তী পড়িল বিষম চিন্তায়। সব বালিকারই কারো দাদা, কারো বাপ চৌয়ারি বানাইতেছে,—ফুলকাটা, ঝালরওয়ালা, নিশান-উড়ানো কত সুন্দর সুন্দর চৌয়ারি। সংসারে তার একটি ভাইও নাই যে কোনরকমে একটা চৌয়ারি খাড়া করিয়া তার মাঘব্রতের শেষ-দিনের অনুষ্ঠানটুকু সফল করিয়া তুলিবে। বাপের কাছে বলিতে গিয়াছিল, কিন্তু বাপ গম্ভীর মুখে আগুন-ভরা মালসা, টিকা-তামাক-ভরা বাঁশের চোঙা, আর দড়িবাঁধা-কল্কে-ওয়ালা হুকা লইয়া নৌকায় চলিয়া গিয়াছে। ‘কাঠায়’ লাগিয়া কাল তার জাল ছিঁড়িয়াছে, আজ সারা দুপুর বসিয়া বসিয়া গড়িতে হইবে।
মেয়ের এই মর্মবেদনায় মার মন দয়ার্দ্র হইল। তার মনে পড়িয়া গেল কিশোর আর সুবলের কথা। দুইটি ছেলেতে গলায় গলায় ভাব। এইটুকু বয়সেই ডানপিটে বলিয়া পাড়াতে নামও করিয়াছে। বাসন্তীর মার ভালই লাগে এই ডানপিটে ছেলেদের। ভয় ডর নাই, কোনো কাজের জন্য ডাকিলে উড়িয়া আসে, মা বাপ মানা করিলেও শোনে না। বিশেষতঃ কিশোর ছেলেটি অত্যন্ত ভাল, যেমন ডানপিটে তেমনি বিবেচক।
বাসন্তীর মার আহ্বানে কিশোর আর সুবল বাসন্তীদের দাওয়ায় বসিয়া এমন সুন্দর চৌয়ারি বানাইয়া দিল যে, যারা দেখিল তারাই মুগ্ধ হইয়া বলিল,—বাসন্তীর চৌয়ারি যেন রূপে ঝলমল করিতেছে। নিশানে ঝালরে ফুলে উজ্জ্বল চৌয়ারিখানার দিকে গর্বভরে চাহিতে চাহিতে বাসন্তী উঠান-নিকানো শেষ করিলে, তার মা বলিল, ‘উঠান-জোড়া আলিপনা আকমু; অ বাবা কিশোর, বাবা সুবল, তোমরা একটা হাতী, একটা ঘোড়া, আর কয়টা পক্ষী আইক্যা দেও।’
বাল্যশিক্ষা বই খুলিয়া তাহারা যখন উঠানের মাটিতে হাতী ঘোড়া আঁকিতে বসিল, বাসন্তীর তখন আনন্দ ধরে না। সারা মালোপাড়ার কারো উঠানে হাতীঘোড়া নাই; কেবল তারই উঠানে থাকিবে। শিল্পীদের অপটু হস্তচালনার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চাহিয়া বাসন্তী এক সময় খুশিতে হাসিয়া উঠিল।
আলিপনার মাঝখানে বাসন্তী ছাতা মাথায় দিয়া একখানি চৌকিতে বসিল। ছাতাখানা সে আস্তে আস্তে ঘুরাইতে লাগিল এবং তার মা ছাতার উপর খই আর নাড়ু ঢালিয়া দিতে লাগিল; হরির লুটের মত ছেলেরা কাড়াকাড়ি করিয়া সে-নাড়ু ধরিতে লাগিল। সবচেয়ে বেশি ধরিল কিশোর আর সুবল।
নারীরা গীত গাহিতেছেঃ ‘সখি ঐ ত ফুলের পালঙ রইলো, কই কালাচাঁদ আইলো।’ বহুদিনের পুরানো গীত। সাত বছর আগে বাসন্তী যখন পেটে আসে, তখনও তারা এই গানই গাহিত উৎসবের এই দিনটিতে। আজও উহাই গাহিতেছে; সঙ্গে সঙ্গে দুখাই বাদ্যকর ঢোল ও তার ছেলে কাঁসি বাজাইতেছে। প্রতি বছর একই রকম তালে তারা ঢোল আর কাঁসি বাজায়। আজও সেই রকমই বাজাইতেছে। সবই একই রকম আছে, পরিবর্তনের মাঝে কেবল দুখাইর ঢোলটা আরো পুরানো হইয়াছে, তার ছেলেটা আরো বড় হইয়াছে।’
জেলেপাড়ার সঙ প্রসঙ্গের অবতারণা করতেই হয় এ প্রসঙ্গে। কলকাতার জেলেপাড়া থেকে ফি-বছর বেরোয় সঙযাত্রা। তারা চৈত্রসংক্রান্তিতে যে মিছিল করে, তার প্রধান উপকরণই হল একধরনের গান।
যে কয়েকটি সঙ-সঙ্গীতের দেখা মেলে, তার মধ্যে কিন্তু সঙ-এর নদী ও সাগরযাত্রার চিহ্ন পরতে পরতে।
১.
সাগরপারের নাগর-ধরা
স্বেচ্ছাচারিণী
তারাই হল ভারতনারীর
কেচ্ছাকারিণী৷
২.
আগুনের জ্বালা ধরে অঙ্গে
দেখে দেখে পূণ্যভূমি সাধের বঙ্গে
রঙ্গিনী ভঙ্গিনী সঙ্গিনী সঙ্গে
ভদ্দর মদ্দরা যান সাগরসঙ্গম স্থানে।
৩.
জয়ী হতে প্রবেশ পরীক্ষায়
পড়ুয়াবেশে এসেছিল হায়
গুণসিন্ধুসুত নব যুব রায় এই শহরে
মশান ভাসে নয়ন ঝোরে৷
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে জেলেপাড়ার সঙের ছড়ায় ও গানে ঘুরে-ফিরে আসছে নদী ও সমুদ্রের জলকল্লোল৷ কোনও নৌযাত্রার আখ্যান যেন এগুলি।
সারিগান ও জারিগানেও আমরা পাই জেলে-মাঝিদের জীবনযাপনের চিহ্ন। এছাড়া ভাটিয়ালি ও ভাওয়াইয়া সুরে বিধৃত আছ তাদের জীবন আলেখ্য।
জারিগানের গায়কদের বলা হয় বয়াতী। জারিগানের শিল্পী তোরাব আলি বয়াতীর নাম আমরা জানি।
তাহলে শেষমেশ এটাই দাঁড়াচ্ছে যে, গোবিন্দপুরে আসার পর, সেখানে জেলেমালোদের মধ্যে প্রচলিত কবিগান, কবির লড়াইয়ে অংশ নিতেন পঞ্চানন কুশারী ও তাঁর কাকা শুকদেব কুশারী। ব্রাহ্মণ কবিয়াল হওয়ায় তাঁদের ‘ঠাকুর’ বিশেষণে ভূষিত করত জেলে-মালো-কৈবর্তরা। তা থেকেই তাঁদের পদবি পাকাপাকিভাবে ঠাকুর হয়ে গেল।
গোঁজলা গুঁইয়ের সময়কাল অনুযায়ী পঞ্চানন কুশারী হতে পারেন তাঁর প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বী। এঁর খোঁজ কবি ঈশ্বর গুপ্ত পেলেন না কেন, সেটাই পরম আশ্চর্যের বিষয়। পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরদের অন্নে প্রতিপালিত ঈশ্বর গুপ্ত কি ইচ্ছা করেই তাঁর নাম উল্লেখ করেননি? যেহেতু খেউড় অংশের জন্যে কবিগান শেষ পর্যন্ত সম্ভ্রান্ত মহলে নিন্দিত ও ধিকৃত হচ্ছিল? ঠিক জানি না। এ বিষয়ে বিস্তৃত গবেষণার দরকার। বনগাঁর কবিগান আকাদেমি এ বিষয়ে খোঁজ নিক।