শিশির মঞ্চে সোজা ঢুকে গেলাম, গেটের কাছে যিনি ছিলেন তিনি শুধু বললেন ‘প্রতুলদা?’ আমি সামান্য থমকে গেলেও বুঝতে না দিয়ে ঘাড় নেড়ে জানালাম — হ্যাঁ, আমি প্রতুলদাকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি। এই গান বা আবৃত্তি জগতে কয়েক বছরের ঘোরাফেরা করে প্রথমেই যেটি শিখতে হয় সেটি হল সকলকে দাদা এবং দিদি বলে সম্বোধন করতে শেখা। প্রতুলদার বয়স এখন যা, আমার মা বর্তমান থাকলে সেই বয়সে এসে পৌঁছতেন। তবে আমার মা অনেক আগেই দূর থেকে বহুদূরে চলে গেছেন। যে ধাক্কা সামলাতে আজও আমাকে সবসময় নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করতে হয়।
একটা করে মৃত্যু, আপনজনের মৃত্যু মানে আপনার পাশ থেকে, আপনার মাথার উপর হাত রাখার হাতটা সরে গেল। যিনি নরম মনের মানুষ হন, তাকে এগুলো ভুলতে অনেক কিছুর আশ্রয় নিতে হয়। সবথেকে বড় আশ্রয় সেক্ষেত্রে বই আর গান। আমি একটু আধটু লেখার ফাঁকে, গান, আবৃত্তি এগুলো নিয়ে ভান করি যে আমি ভালো আছি। যাদের হাত সরে গেছে তাদের আমি মনেই করি না। দিব্যি আনন্দে আছি। সবটাই আসলে নিজেকে নিজে ফাঁকি দিতে থাকি।
তখন বেশ বয়স কম। প্রথম প্রথা ভাঙা একটি গান শুনলাম। টিভি রেডিও সর্বত্র। ‘আমি বাংলায় গান গাই।’ আশ্চর্য এটাই, যে এই গায়কের সঙ্গে আমার পরিচয় (অবশ্যই টেলিভিশনের পর্দায়) ঘটালেন আমার জননী। উনি দেখছিলেন টিভি, চেঁচিয়ে ডাকলেন আমাকে, “শিগ্গির আয়, দেখ, কি অপূর্ব গান করেন ভদ্রলোক।” আমি শুনলাম, মুগ্ধ হলাম, এবং গানটি একবার শুনেই মাথায় গেঁথে গেল। ভুলতে পারলাম না। চলতে ফিরতে গানটি গাইতে লাগলাম। কখনো গুনগুন করে, কখনো গলা ছেড়ে। ‘আমি বাংলায় গান গাই। আমি বাংলার গান গাই।’
কিছু মানুষ থাকেন যাঁদের দেখলেই মনে হয় খুব কাছের একজন মানুষ। আমি যদি এনার কাছে গিয়ে দাঁড়াই, ইনি ঠিক আমার মাথায় হাত রাখবেন। প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে দেখে আমার ঠিক এই অনুভূতি হত। কেন? বলতে পারব না। আরও একজনকে দেখে হয়। তিনি শ্রী সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় মহাশয়। তো, এইরকম যাঁকে দেখলে মনের মধ্যে ‘আপন’ এই ভাবটি ফুটে ওঠে, তাঁকে সামনাসামনি দেখার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ আমি তো মনে মনে তাঁকে নিজের একজন আপন মানুষ বলে ভেবে নিয়েছি। তিনি আমায় চেনেন কি চেনেন না, সেটা বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক।
ছিলেন তিনি অন্তরে। কিন্তু ইদানিং একটু আধটু লিখতে শিখে চেনাজানাও বেড়েছে। জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় (দা) এর ডাকে বছর দুই আগে একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে একদম সামনে থেকে আমার অতি প্রিয় গায়ককে দেখলাম। দেখলাম বলব না, শুনলাম। ওনার খালি গলায় হাতে তালি দিয়ে গান। ওনার প্রতিটি কথা শুনলাম। ভাষা নিয়ে ওনার হতাশা, তাও শুনলাম। মর্মে মর্মে কথাগুলি উপলব্ধি করলাম। আর দেখলাম, এই অতি সাধারণ মানুষটিকে অনায়াসে ভালোবাসা যায়। আমি যে এতদিন ধরে এনাকে আপনজন ভেবে এসেছি, সেটা এক্কেবারে ভুল করিনি। ইনি সত্যিই মানুষের আপনজন।
১৯৪২ এর ২৫ শে জুন জন্ম। অদ্ভুত এক নতুন ধারা নিয়ে এলেন গানে। কোনও আড়ম্বর নেই, বাজনার দরকার পড়ে না, শুধু গলা আর হাতে তালি এই সম্বল করে আপামর বাঙালির মনে ঢুকে পড়া খুব সহজ ব্যাপার নয়। অবিভক্ত বাংলাদেশের বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা প্রভাতচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন শিক্ষক। দেশবিভাগের পর তাঁর শৈশব কেটেছে চুঁচুড়ায়। মাত্র বারো বছর বয়সে তিনি কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমি ধান কাটার গান গাই’ কবিতায় প্রথম সুর দেন। তাঁর অসংখ্য গান, আ্যলবামের নাম লিখতে আমি আজ বসিনি। অসামান্য এক গুণী মানুষের সৃষ্টি অসামান্যই হয়। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই।
এত গুণী একজন মানুষ কত আটপৌরে হতে পারেন এটা তাঁকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না। আজ শিশির মঞ্চে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে বহু নামী দামী মানুষ এসেছিলেন। তাঁদের প্রত্যেকের বক্তব্য থেকে শুধু একটি কথাই উঠে আসছিল বারবার, যে অনেক গুণের সঙ্গে যেটি প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের ছিল, সেটি হলো সরল থাকার, সাধারণ মানুষ হয়ে থাকার, সকলের সঙ্গে মেশার ক্ষমতা। তাঁর অসাধারণ রসবোধের টুকরো টুকরো কথার কোলাজ গোটা প্রেক্ষাগৃহে যখন ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন সকলের মুখে হাসির সঙ্গে চোখের কোণ ভিজে যাচ্ছিল। যেমন যায় খুব আপনজন চলে গেলে, দূরে বহুদূরে। ‘সব মরণ নয় সমান’ জানি, কারণ প্রিয় আপনজনের মৃত্যু কোনও কিছুর সঙ্গে তুলনায় আসতেই পারে না।
Excellent writing. It touched my heart.
ধন্যবাদ জানাই
Some genuine words said about a very genuine person.