১৮৭৮ সালে কলকাতার চন্দ্রকিশোর সেন আয়ুর্বেদিক ‘জবাকুসুম কেশতৈল’ তৈরি করেন আর সেই তেলের বিজ্ঞাপণের জন্য ডাক পড়লো এক বাঙালি যুবকের। কোম্পানির ইচ্ছা ছিলো ছাপানো পোস্টারে বিজ্ঞাপন না করে নতুন কিছু করার। ছেলেটি ফটোগ্রাফার তো ছিলেনই প্রথম সিনেম্যাটোগ্রাফি যন্ত্রের মালিকও তিনি। কাজ শুরু হলো। চন্দ্রকিশোরের আগরপাড়ার বাগানবাড়িতে অভিনেত্রী কুসুমকুমারী দেবীকে নিয়ে, সিনেমার ফ্লিম ব্যবহার করে ছেলেটি বানিয়ে ফেললো এশিয়ার প্রথম ফ্লিম অ্যাডভার্টাইজমেন্ট। এই ছেলেটি কে ছিলো জানেন? ইনি হলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ হীরালাল সেন। আজও এই তেল বহু মানুষের স্মৃতিতে অথচ এই বঙ্গসন্তান হীরালাল অখ্যাত হয়ে হারিয়ে গেলেন বিস্তৃতির অন্তরালে। কিন্তু কেন এমন হলো?
হীরালালের জন্ম আনুমানিক ১৮৬৭ সালে বাংলাদেশের মানিকগঞ্জের বগজুড়ি গ্রামের এক বিত্তশালী পরিবারে। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াশোনার সময় অধ্যাপক ফাদার লাফোঁ একটি প্রজেক্টর মেশিনে এনে ছাত্রদের বিজ্ঞান ক্লাসে শিক্ষা দিতেন। চলমান চিত্র দেখে হীরালাল উৎসাহী হয়ে পড়েন। প্রফেসরের কাছ থেকে শিখলেন অনেক কিছু।
১৮৯৭ সালে কলকাতায় স্টিফেন্স নামের এক ইংরেজ, ব্যবসায়িক ভিত্তিতে প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনী বা বায়োস্কোপ নিয়মিত দেখানো শুরু করেন কলকাতার স্টার থিয়েটারে। সেই প্রদর্শনী দেখে আইন ব্যবসায়ী চন্দ্রমোহন সেনের দুই পুত্র হীরালাল সেন এবং মতিলাল সেনের তাক লেগে গেলো। উৎসাহিত হীরালাল সাহেবের কাছ থেকে বায়োস্কোপ তৈরি করা শিখতে চায় কিন্তু তেমন পাত্তা করে উঠতে পারলো না। অবশেষে একবগ্গা হীরালাল নিজের চেষ্টাতেই যেমন স্টিল ফটোগ্রাফি শিখেছিলেন তেমনই শিখে নিলেন সিনেম্যাটোগ্রাফি।
মা বিধুমুখী দেবীর কাছে আবদার করে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে সিনেম্যাটোগ্রাফ মেশিনের অর্ডার দিয়ে দিলেন। এরপর নানারকম জোগাড়যন্ত্র করে নেমে পড়লেন ময়দানে। ১৮৯৮ সালের মাঝামাঝি সেন ব্রাদার্স হীরালাল সেন ও তার ভাই মতিলাল সেন ও দেবকীলাল আর ভাগ্নে কুমারশঙ্কর গুপ্তকে সঙ্গে নিয়ে খুললেন “রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি”। এই কোম্পানি কলকাতা তথা ভারতের প্রথম ব্যবসায়িক ভিত্তিতে নিয়মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শনী শুরু করেন।
শুরু হয় নির্বাক চলমান ছায়াছবির যুগ। যদিও কোন নির্দিষ্ট ঘটনা বা গল্পকে কেন্দ্র করে পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র তখন প্রদর্শিত হতো না। মূলত খন্ড চিত্র হিসেবে বিখ্যাত নাটকগুলির মঞ্চসফল কিছু অভিনয় দৃশ্যাবলি বায়স্কোপে প্রদর্শিত হতো। সেই সময়ে স্টার থিয়েটারের নাট্য প্রযোজক নাট্যকার অভিনেতা অমর দত্ত তার নিজস্ব ‘ক্লাসিক থিয়েটার’ এ নাট্যাভিনয়ের আগে নিয়মিত “রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি” কে দিয়ে বায়োস্কোপ দেখানোর ব্যবস্থা করেন। দর্শকদের মনে অতিরিক্ত মনোরঞ্জনের সুযোগ তৈরি করতে এবং পাশাপাশি প্রচার আকর্ষণ বাড়াতে এই সিদ্ধান্ত।
১৯০১ সালে হীরালাল সেনের কোম্পানি নিজেই কলকাতার ডালহৌসি ইনস্টিটিউট ভাড়া নিয়ে স্বাধীনভাবে বায়স্কোপ প্রদর্শনী শুরু করেন। বিশেষত বঙ্কিমচন্দ্রের ‘সীতারাম’, তারকনাথ গাঙ্গুলীর ‘সরলা’, অমর দত্ত অভিনীত ‘ক্ষীরোদপ্রাসাদ’, বিদ্যাবিনোদের ‘আলিবাবা’, প্রভৃতি নাটকের মঞ্চসফল নির্বাচিত অভিনয় দৃশ্যের চলমান ছবি (moving scenes) তুলে নিয়মিত প্রদর্শন শুরু করেন।
চলচ্চিত্র শিল্পকে আরো বিকশিত এবং উন্নীত করার জন্য হীরালাল বিদেশ থেকে নিজের অর্থ ব্যয় করে উইলিয়ামসন এবং প্রিফেক্ট মুভি ক্যামেরা এবং প্রজেক্টর মেশিনের সাহায্যে চলমান দৃশ্যের হুবহু ছবি তুলে বিশেষত ১৯০১ থেকে ১৯০৩ সালের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে দিলেন এবং আভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ১৯০৩ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত হীরালাল সেনের চলচ্চিত্র কেরিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রসঙ্গে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শোভাযাত্রা এবং তার বক্তৃতা সহ নানান ঘটনা ক্যামেরাবন্দী করেন হীরালাল। যদিও রাজনৈতিক তথ্যচিত্র দেখানোর জন্য তাকে নানান ঝামেলার মধ্যে পড়তে হয়।
হীরালালের “রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি” সে সময় অন্যান্য বায়োস্কোপ কোম্পানি যেমন — কুমার গুপ্ত প্রতিষ্ঠিত নারায়ণ বসাকের ‘লন্ডন বায়োস্কোপ’, হরেনবাবু এবং হেমন্ত কুমার দেবের ‘ওয়েলিংটন বায়োস্কোপ’, অনাদিনাথ বসুর ‘অরোরা বায়োস্কোপ’ প্রভৃতির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বেশ এগিয়েছিলো।
তবে মুম্বাইয়ের পার্সি চলচ্চিত্র ব্যবসায়ী জামশেদজি ফ্রামজী ম্যাডান কোম্পানির কাছে বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারেননি রয়্যাল বায়োস্কোপ। ম্যাডান প্রথমে তাঁবু খাটিয়ে বায়োস্কোপ ব্যবসা শুরু করলেও পরে সাফল্যের সঙ্গে তিনটি প্রেক্ষাগৃহ কর্নওয়ালীশ (আজকের শ্রী), ক্রাউন (আজকের উত্তরা) এবং পিকচার প্যালেস (যা বর্তমানে অপেরা নামে পরিচিত) নির্মাণ করে নিয়মিত বায়োস্কোপ দেখিয়ে চলচ্চিত্র শিল্পের ইতিহাসে হয়ে ওঠেন এক অপ্রতিদ্বন্ধী প্রবাদপুরুষ।
এদিকে প্রতিভাবান হীরালাল যত বিখ্যাত হতে লাগলো সঙ্গে সঙ্গে তার চরিত্রও নানারকম দোষও প্রকট হতে লাগলো। হীরালালের স্ত্রী ছিলেন হেমাঙ্গিনী দেবী। হীরালালের তিন ছেলে এক মেয়ে। হীরালালের কন্যা প্রতিভা দেবীর সঙ্গে প্রখ্যাত অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের শ্বশুরমশাই আদিনাথ সেনের ছোট ভাইয়ের বিবাহ হয়।
সোনার চামচ নিয়ে জন্মালেও হীরালাল না ছিলেন সংসারী না ছিলেন বিষয়ী। তার উপর অভিনেত্রী কুসুমকুমারীর সঙ্গে তাঁর একটি অবৈধ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আলিবাবার মর্জিনা ছিলেন কুসুমকুমারী ও ক্লাসিকের মূল নায়িকা। থিয়েটারের দৃশ্য ক্যাপচার করতে গিয়ে হীরালাল দিনরাত পড়ে থাকতেন ক্ল্যাসিকে।
কাজ, কুসুমকুমারী, মদ্যপান এইসবে যতই ডুব দিতে থাকলেন, সংসারের সঙ্গে দূরত্ব ততই বাড়তে লাগলো। সঙ্গে ছিল তাঁর বেহিসেবি খরচা। ম্যাডান ও পাথে ফ্রেরেজ এই যৌথভাবে গঠিত বায়স্কোপ কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে না উঠে, একের পর এক ভুল করতে শুরু করেন তিনি। শুরু থেকেই ঠিক ছিল ক্যামেরা যন্ত্রপাতি মালিকানা হীরালালের আর সিনেমা স্টক মতিলালের। দাদার ভুলভাল খরচা কিছুতেই সামলে উঠতে পারছিলো না মতিলাল, উপরন্তু কুসুমকুমারীর সঙ্গে মতিলালের মনোমালিন্য, সম্পর্কে তিক্ততা আসতে শুরু করে দুই ভাইয়ের মধ্যে।
এরপর আনুমানিক ১৯১৩ সালে নিজের হাতে গড়া “রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি” দু টুকরো হয়ে ভেঙে যায়। হীরালাল এবং মতিলাল পৃথকভাবে ব্যবসা শুরু করলেও সাফল্য আসে না। হীরালাল ক্রমশ সর্বস্বান্ত হয়ে যান। অবশেষে ১৯১৭ সালে নিঃস্ব হয়ে দুরারোগ্য ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হন। দারিদ্র আর্থিক অনটন এই সময় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। তিনি তার সাধের ক্যামেরা এবং যন্ত্রপাতি জনৈক আংটি মল্লিকের (যার দুই হাতের প্রতিটি আঙুলে হীরের আংটি ছিল) কাছে বন্ধক দিতে বাধ্য হন।
হীরালাল যখন মৃত্যু শয্যায় ঠিক সে সময় তার ভাই মতিলালের বাগানে বাড়িতে এক বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডে “রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি”-র প্রায় যাবতীয় দুষ্প্রাপ্য ছবি প্রিন্ট মূল্যবান নথিপত্র পুরনো দলিল দস্তাবেজ ইত্যাদি পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যায়। কপর্দক শূন্য অবস্থায় দুরারোগ্য ক্যান্সার রোগে ২৬ অক্টোবর ১৯১৭ সালে ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পের পথিকৃৎ হীরালাল সেনের মৃত্যু হয়। শেষ হয় চলচ্চিত্র শিল্পের গর্ব করার মতো স্বর্ণযুগের।।
বাঙালির সেন্টিমেন্টে এর চেয়ে বড় আঘাত আর কিছু হতে পারে না। তবু ১৯৬০ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার একবার এব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন এবং তার প্রচার মন্ত্রী জগন্নাথ কোলে রাজ্য পরিষদে বাংলার দাবিকে মর্যাদা দিতে সেই সময় কিছু ঐতিহাসিক তথ্য পেশ করেন। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। মারাঠাবাসী তথা সমস্ত ভারতবাসীর কাছে দাদাসাহেব ফালকেই স্বীকৃতি পেলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রে প্রথম পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রকার নির্মাতা ও জনক হিসেবে। পক্ষান্তরে হীরালাল সেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের একজন পথিকৃৎ হিসেবে বেঁচে রইলেন আপামর বাঙালি হৃদয়ে।
Bhalo thakun
ভারতীয় চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি 🙏
অপূর্ব সুন্দর প্রতিবেদনটি , অনেক অজানা তথ্য সুন্দর পোস্টের মাধ্যমে জানা যায়।💝
থ্যাঙ্ক ইউ ❤️
অনবদ্য প্রতিবেদন, হারিয়ে যাওয়া হীরা কে ফিরিয়ে আনার সফল প্রয়াস সার্থক। আন্তরিক অভিনন্দন।
আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই 🌹
খুব সুন্দর তথ্য ভিত্তিক লেখনী,,, ধন্যবাদ
থ্যাঙ্ক ইউ